বিটি বেগুনে বিষ ব্যবহার

আব্দুল জব্বার || Saturday 15 April 2017

সরোজমিন প্রতিবেদন

আনিসুর রহমান শেখ নামের একজন কৃষক বিটি বেগুন চাষ করে সফল হয়েছেন, বলে দাবি করেছেন বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারী)। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট এর দাবিকৃত বিটি বেগুন চাষে সফল কৃষকের সেই সফলতা স্বচক্ষে দেখা এবং সফলতার হেকমত সম্পর্কে জানার জন্য বিটি বেগুন চাষী আনিসুর রহমান শেখের খোঁজে প্রথমে বগুড়া জেলা সদরে যাই। বগুড়া যাবার প্রধান কারণ হচ্ছে, বিটি বেগুন চাষী আনিসুর রহমান শেখের বাড়ির ঠিকানা একটি বিদেশি পত্রিকায় দেয়া হয়েছে বগুড়া জেলার সাদুল্লাপুর গ্রামে।

সেই তথ্য অনুসারে চাষী আনিসুর রহমান শেখের বিটি বেগুন চাষের খবর নিতে বগুড়া জেলা সদরে আসি। সেখান থেকে গাবতলী উপজেলা, গাবতলী উপজেলা থেকে মহিষাবান বাজারে। এখানে এসে ঠিকানা অনুসারে সাদুল্লাপুর গ্রাম খুঁজে হয়রান হয়ে গেলাম কিন্তু সাদুল্লাপুর গ্রাম পেলাম না।

ঠিকানা জানার জন্য মহিষাবান ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ে এসে সাদ্দুলাপুর গ্রামের ঠিকানা জিজ্ঞাসা করলে ওই গ্রামের খোঁজ দিতে পারেন নাই। আবার ফিরে আসলাম মহিষাবান বাজারে। সেখানে একটি কীটনাশকের দোকান আছে সে দোকানীর নিকট সাদুল্লাপুর গ্রামের ঠিকানা জানার চেষ্টায় কীটনাশক বিক্রেতাকে জিজ্ঞাসা করলাম এ এলাকায় কোন কৃষক বিটি বেগুন চাষ করেছেন কি না? কীটনাশক বিক্রেতা বললেন, “এখানে একজন কৃষক এই ধরণের একটা বেগুনের চাষ করেছে। সেই কৃষক আমার নিকট থেকে বিষ নিয়ে যায় ”।

আমি সে কৃষকের নাম জানতে চাইলাম। কীটনাশক বিক্রেতা বলেন সে কৃষকের নাম মন্টু। এবার গেলাম মন্টু মিয়াকে খুঁজতে। মহিষাবান গ্রামের লোকজনকে জিজ্ঞাসা করার পরে মন্টু মিয়ার বাড়ি খুঁজে পাওয়া গেল। সে সময় মন্টু মিয়া তার বাড়িতে ছিলেন না। তার ছেলে জানালো, তার বাবা বিটি বেগুনের কাজে মাঠে আছে। তৎক্ষণাৎ মন্টু মিয়ার ছেলেকে নিয়ে মন্টু মিয়ার বেগুনের মাঠে যাই। সেখানে গিয়ে দেখি মন্টু মিয়া বিটি বেগুনের ক্ষেতে কাজ করছে। তখন তার সাথে কথা হয়।

মন্টু মিয়ার প্রকৃত নাম, মজিবুর রহমান (মন্টু)। বয়স প্রায় ৫৫ বছর। দেশীয় জাতের বেগুন চাষের অভিজ্ঞ কৃষক। নভেম্বর ২০১৬ এর দিকে কৃষি কর্মকতা এনামুল হক তাকে ৫ গ্রাম বিটি বেগুনের বীজ দিয়েছিল। কৃষি কর্মকর্তা বিটি বেগুনের বীজ দেয়ার সময় বলেছিলেন, বিটি বেগুন গাছে কোন বিষ দিতে হবে না। তার কথা মত মজিবুর রহমান মন্টু মিয়া আলাদা একটা জমিতে বিটি বেগুনের বীজ চারা দেয়। কিছু দিন পরে বিটি বেগুনের চারা ১০ শতক জমিতে লাগান এবং দেশী বেগুনের মত বিটি বেগুনের পরিচর্যা করেন। কিন্তু যখন বিটি বেগুনের ফুল আসার কথা তখন আর বিটি বেগুনের গাছে ফুল আসছে না। ইতোমধ্যে বিটি বেগুন গাছের পাতা কোচকানো অবস্থা দেখা দিয়েছে। তখন মজিবুর রহমান মন্টু কৃষি কর্মকতার সাথে যোগাযোগ করেন।

কৃষি কর্মকর্তা মন্টু মিয়াকে বিটি বেগুনের পাতা কোচকানো রোগের জন্য বিষ দিতে বলেন। কৃষি কর্মকর্তার পরামর্শ মত কীটনাশকের দোকান থেকে পাতা কোচকানো রোগের জন্য বিষ এনে বিটি বেগুনের গাছে দেন। বিটি বেগুনের গাছে বিষ দেয়ার কিছু দিন পরে সেই গাছে দু একটা করে ফুল দেখা যায়। কিন্তু এবার অন্য ধরনের রোগ দেখা দিল। সেটা হচ্ছে বিটি বেগুন গাছের কান্ড পচা রোগ।

মন্টু মিয়া আবার কৃষি কর্মকতার নিকটে যায় পরামর্শের জন্য। এবারে কৃষি কর্মকর্তা কান্ড পচা রোগের জন্য একটা বিষের নাম লিখে দিলেন। বিটি বেগুন গাছে এই দু ধরনের বিষ ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু বিটি বেগুনের যে রকম ফলনের কথা বলা হয়েছে, সে ধরনের ফলন হয় নাই। মন্টু মিয়া দুঃখ করে বলেন, ১০ শতক জমিতে যদি স্থানীয় জাতের বেগুন চাষ করা হতো তাহলে ৮,০০০ থেকে ১০,০০০ টাকার বেগুন বিক্রি করতে পারতাম। কিন্তু বিটি বেগুন আবাদ করে বিটি বেগুন চাষের জন্য যে খরচ হয়েছে সেই টাকা বিক্রি করে তুলতে পারি নাই। এই পর্যন্ত ৭ থেকে ৮ শত টাকার মত বেগুন বিক্রি করেছি। আর আশায় আছি সামনে রোজার মাস যদি একটু লাভ হয়। নতুন করে বিটি বেগুন গাছের পরিচর্যা করতেছি। সার, বিষ দিচ্ছি। এছাড়া কৃষি কর্মকর্তাও নতুন কিছু বিষের নাম দিয়েছে। সেগুলো দেয়ার ইচ্ছা আছে।

বিটি বেগুন চাষীকে জিজ্ঞাসা করলাম, আপনি কি এই বিটি বেগুন নিজ বাড়িতে খেয়েছেন? তিনি বললেন, “আমাদের খাওয়া হয় নাই।” মন্টু মিয়ার উৎপাদিত বিটি বেগুন বিক্রি করেছে মহিষাবান বাজারে। কিন্তু যারা এই বিটি বেগুন কিনেছেন তারা বিটি বেগুনের নাম জানেনা। কারণ মন্টু মিয়া উৎপাদিত বিটি বেগুন বাজারে বিক্রি করার সময় কোনো নাম বা লেবেল ব্যবহার করেন নাই। ফলে বাজারের লোকজন বিটি বেগুনের নাম শুনে নাই। যার কারণে এলাকার লোক অন্য বেগুনের মতই বিটি বেগুনও কিনছেন। মন্টু মিয়ার কথা অনুসারে।

এসেছিলাম সাদুল্লাপুর গ্রামের বিটি বেগুন চাষী আনিসুর রহমান এর খোঁজে কিন্তু মহিষাবান গ্রামে এসে পেলাম বিটি বেগুন চাষী মন্টু মিয়াকে। বগুড়ার সাদুল্লাপুর গ্রাম এখন পর্যন্ত খুঁজে পাই নাই। একজন স্থানীয় লোক বললেন, সাদ্দুলাপুর গ্রাম শাহাজানপুর উপজেলায়। সেখানে সাজাপুর নামে একটা গ্রাম আছে। সেখান থেকে শাহাজাহানপুর উপজেলায় সাজাপুর গ্রামে এসে খোঁজ নিয়ে জানলাম, সেখানেও আনিসুর রহমান শেখকে কেউ চেনে না। কোন উপায় না পেয়ে চলে গেলাম বগুড়া পল্লী উন্নয়ন একাডেমী কার্যালয়ে। সেখানেও কৃষি বিজ্ঞানি মো. তারভির হাসান এর খোঁজ পেলাম না। সেখানে জানলাম সেইজগাড়ী বগুড়া সদরে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনিস্টিটিউটের অফিস রয়েছে বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা তানভির হাসান সেখানে থাকতে পারেন। এই আশায় বগুড়া শহরে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) অফিসে যখন এসে পৌঁছালাম তখন অফিস সময় শেষ হয়ে গেছে।

বগুড়া বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) অফিসে এসে বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে নিশ্চিত হলাম যে, বিটি বেগুন চাষী আনিসুর রহমান শেখ এর বাড়ি সাদুল্লাপুর গ্রাম বগুড়ায় নয়। গাইবান্ধা জেলায়। তখন প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেছে। আর গাইবান্ধা যাওয়া হলো না। বারী’র বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তার নিকট থেকে বিটি বেগুন চাষী আনিসুর রহমান শেখ এর বাড়ি সাদুল্লাপুর গ্রামে জানতে পারলাম। কিন্তু ঠিকানা জানতে চাইলে তিনি এড়িয়ে গিয়ে বললেন, গাইবান্ধা জেলার সাদুল্লাপুর উপজেলার কৃষি সম্প্রসারণ অফিসে যোগাযোগ করলে বিটি বেগুন চাষী আনিসুর রহমান শেখ এর সব খবর পাবেন।

সবশেষে আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, বর্তমানে বিটি বেগুনের অবস্থা কেমন? উত্তরে তিনি বললেন, বিটি বেগুনের অবস্থা অনেক ভাল, অনেক কৃষক চাষ করছে। এখানে আমার প্রশ্ন এই একই কথা বিটি বেগুন চাষীরা বলেন না। যেমন মন্টু মিয়া। তার ক্ষতি হয়েছে এবং তাকে বেগুন গাছে বিষও ব্যবহার করতে হয়েছে। বিটি বেগুন যখন এতো সফল হচ্ছে তাহলে বিটি বেগুন চাষীদের সম্পর্কে এতো গোপনীয়তা কেন? যেকোনো সফলতা তো তার ব্যাপক প্রচার প্রচারণা করে, বিটি বেগুনের বেলায় এতো রাখ-ঢাক কেন?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *