দেশী বেগুন চাইলে বিটি বেগুন না

উবিনীগ || Friday 19 July 2013

স্বাস্থ্য, পরিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্যের ঝুঁকি নিয়ে বিটি বেগুনের অনুমোদন দেয়া যাবে না এবং স্থানীয় জাতের বেগুন রক্ষা করতে হবে বিষয়ে ১৮ জুলাই, ২০১৩ বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনষ্টিটিউট (বারি) এবং গাজীপুর জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সামনে মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়।বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনষ্টিটিউটের প্রধান কার্যালয় ঢাকা শহর থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে গাজীপুর জেলায় অবস্থিত।তাই এই মানবব বন্ধনের আয়োজন সেখানেই করা হয়।উবিনীগ, নয়াকৃষি আন্দোলন ও স্বাস্থ্য আন্দোলনের সদস্যরা এই মানববন্ধনের আয়োজন করা হয়। মানবন্ধনে অংশ নেয়ার জন্য পাবনার ঈশ্বরদী থেকে নয়াকৃষির কৃষক নিহার বানু, হাফিজুর রহমান, মরিয়ম বেগম ও এলাহি বক্স, এবং টাংগাইল থেকে আক্কাছ আলী, শাহানাজ বেগম, সোহাগী বেগম, জিন্নত আলী, আনোয়ারা বেগম, চায়না বেগম, জয়নাল মিয়া ও আব্দুল মান্নান গাজীপুরে আসেন। এছাড়া উবিনীগের পক্ষ থেকে ছিলেন ফরিদা আখতার, ড. এম এ সোবহান, সীমা দাস সীমু, পলাশ বড়াল, জাহাঙ্গীর আলম জনি, গোলাম রাব্বী বাদল, রোকেয়া বেগম, রবিউল ইসলাম চুন্নু, জয়নাল আবেদীন খান, ফাহিমা খাতুন লিজা, রজব আলী, শামিউল ইসলাম, নুরুল ইসলাম ও মোহাম্মদ রুবেল।

প্রথমে সকাল ১০টায় বারই প্রধান ফটকের সামনে কৃষকরা ব্যানার নিয়ে দাড়িয়ে যান। তাদের হাতে ধরা ছিল একটি বড় বিটি বেগুন আকৃতি বানিয়ে সেখানে তাঁদের মুল দাবী লিখে রাখা হয়েছিল “কৃষকের দেশী জাতের বেগুন রক্ষা করতে হলে কোম্পানির বিটি বেগুনের অনুমোদন দেয়া যাবে না”। স্থানীয় উৎসুক জনগণ এই দাবীটি পড়ে সম্মতি জানান।কিন্তু একটু পরেই পুলিশ এসে এখানে কোন মানববন্ধন করা যাবে না, এমন কি বেগুনের জাত রক্ষার মতো একটি জনগুরুত্বপুর্ণ ইস্যুতেও কর্মসুচি পালনের ক্ষেত্রে বাধা দেয়া হবে। তাঁরা অবশ্য সেদিনের হরতালের কারণে এই বাঁধা দিচ্ছে বলে জানান। এরপর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে এই মানববন্ধন করা হয়।সেখানে কোন বাধা দেয়া হয়নি। ফলে বোঝা যায় বারি-এর কর্তৃপক্ষের আপত্তির কারণেই করতে দেয়া হয় নি।


জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে মানববন্ধনে বক্তব্য রাখেন উবিনীগের নির্বাহী পরিচালক, ফরিদা আখতার,কৃষি বিজ্ঞানী ড. এম এ সোবহান, উবিনীগের সীমা দাস সীমু, পলাশ বড়াল, জাহাঙ্গীর আলম জনি, জয়নাল আবেদীন খান, নয়াকৃষি আন্দোলনের কৃষক প্রতিনিধি শাহানাজ বেগম ও হাফিজুর রহমান।


মানববন্ধন অনুষ্ঠানের শুরুতে নয়াকৃষি আন্দোলনের কৃষক প্রতিনিধি আক্কাছ আলী তার স্ব-রচিত স্থানীয় জাতের বেগুনের উপর একটি গান পরিবেশন করেন।তাঁর গানে বলা হচ্ছিল,

বাংলাদেশের ভাই বোনেরা শোনেন মন দিয়া

দেশী জাতের বেগুনের স্বাদ, না যাইও ভুলিয়া রে

       আমার সোনার ভাই বোন রে।।

কামরাঙ্গা, ভোলানাথ, আর কাঞ্চন বারমাসে

       ও ভাই বোন কাঞ্চন বারমাসে

কাটা চিকন ডিম বেগুনি তরকারী ইলিশ মাছেরে।।

     শুটকী মাছে লম্বা বেগুন, শৈল বোয়াল রুপিয়াজী

ও ভাই বোন শৈল বোয়াল রুপিয়াজী

আমার দেশী জাতের বেগুনে নাই

       কোন টেকনোলজি।।

দেশী বেগুন মোদের সম্পদ বাড়ায় মোদের মান

      ও ভাই বোন বাড়ায় মোদের মান

কোম্পানিকে দিয়া দিলে যাবে মোদের প্রাণ রে।।

বিটি বেগুন চাই না মোরা, দেশী বেগুন চাই

    দেশী বেগুন রক্ষার দাবী সরকারকে জানাই ও রে ।।


ফরিদা আখতার বলেন, বিটি বেগুন এর বীজ কৃষক পর্যায়ে চাষ করার জন্য কৃষি মন্ত্রণালয়ে অনুমোদন চেয়ে আবেদন করেছে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বারি)।বেগুনের মতো অতি পরিচিত এবং প্রচুর ব্যবহৃত একটি সব্জির জৈবিক গঠন -বিশেষত প্রাণ সংকেত কেন জেনেটিক মডিফিকেশনের মাধ্যমে বিকৃতি ঘটানো বাংলাদেশের কৃষি গবেষণার জন্য জরুরী হয়ে পড়ল সেটা স্পষ্ট নয়।বেগুনের বিভিন্ন জাত আমাদের কৃষক – বিশেষত কৃষক নারীর হাজার বছরের আবিষ্কার। বাংলাদেশের জনগণের বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তি। বিকৃত বেগুন প্রবর্তনের ফলে অন্য সমস্ত জাত ভয়াবহ জৈবিক দূষণের (Biological pollution) কবলে পড়বে। দেখা যাচ্ছে এই ধরণের বিকৃত জাতের বেগুন কৃষক পর্যায়ে গোপনে অনুমোদন চাওয়া শুধু বিতর্কিত বিষয়ই নয়, রীতিমতো একটি বিপজ্জনক প্রস্তাব। বাংলাদেশেও বিটি বেগুনের গবেষণা শুরু থেকে প্রতিবাদ করা হচ্ছে। উবিনীগ ও নয়াকৃষি আন্দোলন এ নিয়ে কৃষকদের সাথে মতবিনিময় করেছে এবং আমাদের স্থানীয় জাতের বেগুন সংগ্রহ ও চাষ করে প্রমাণ করেছে বিকৃত বেগুনের আমাদের কোন প্রয়োজন নেই। আমরা মনে করি বিটি বেগুন নিয়ে সব রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও ছাড় করার অপচেষ্টা অনতিবিলম্বে বন্ধ করতে হবে এবং স্থানীয় জাতের বেগুন রক্ষা করতে হবে।

ড. এম এ সোবহান বলেন, দাবী করা হয়েছে বিটি বেগুনে কোন পোকা লাগবেনা। এ কথা মোটেও সত্য নয়। কোম্পানীর প্রচার থেকেই বোঝা যায় যে বিটি বেগুন কেবল মাত্র কান্ড ও ফল ছিদ্রকারী পোকা প্রতিরোধ করতে পারে। কিন্তু ঢালাওভাবে বলা হয় যে বিটি বেগুন চাষ করলে কোন বালাইনাশক ব্যবহার করতে হবে না। এ কথা বলে কৃষককে প্রত্যারনার ফাদে ফেলার চেষ্টা হচ্ছে। হাইব্রীড বেগুনে যে সমস্ত রোগবালাই ও পোকা আক্রমন হয় বিটি বেগুনেও তা হবে। বরং বিটি বেগুন যেহেতু ব্যাকটেরিয়ার জিন সংযোজনে গঠিত তাই এই বেগুন খেলে মানবদেহে ক্ষতির আশংকা রয়েছে। পক্খান্তরে স্থানীয় জাতের বেগুন বেশীর ভাগ রোগবালাই ও পোকা প্রতিরোধ করতে পারে। স্থানীয় জাতের বেগুন রক্ষার স্বার্থে বিটি বেগুন ছাড় করনের অপচেষ্টা বন্ধ করতে হবে।

টাংগাইলের কৃষক প্রতিনিধি শাহনাজ বেগম বলেন, আমাদের দেশীয় বেগুনের কয়েক জাত আছে, যেমন লম্বা বেগুন, ঝুঁমকা বেগুন, চেপা বেগুন, তিত বেগুন। এসব বেগুনে খুব ভিটামিন এবং খুব সুস্বাদ। এসব বেগুন দিয়ে সব ধরণের তরকারী, মাছ রান্না করা যায়। মাছ দিয়ে চরচরি করেও খেলে অনেক মজা লাগে। আমন ধানের ভাতে বেগুন পোড়া ভর্তা অনেক মজা। দেশীয় বেগুনের সার লাগে না। জৈব সার দিয়ে চাষ করি। দেশীয় বেগুন বীজ রক্ষা করে। বিটি বেগুন চাই না। আমাদের দেশীয় বেগুন আমরা হারাতে চাই না।

পাবনার কৃষক প্রতিনিধি মো: হাফিজুর রহমান বলেন, স্থানীয় বেগুনে রোগ বালাই কম। স্বাস্থ্যতে কোন ক্ষতি নাই। তারপর কেন আমরা বিটি বেগুন চাষ করবো? এই বেগুন চাষ করলে আমাদের ক্ষতি, দেশের ক্ষতি। আমরা কৃষকরা স্থানিয় জাতের তুলা চাষ করতাম এতে খরচ কম হত রোগ বালাই পোকা মাকর কম হত। কিন্তু এক কোম্পানি এসে বলে আমাদের কাছে ভাল জাতের তুলা অর্থাৎ রূপালি ১ সুপরিনসিট নামের হাইব্রীড তুলা চাষ করলে ফল ছিদ্রকারী ও ডগা ছিদ্রকারী পোকা লাগবে না। কিন্তু দেখা গেল ঐ পোকা নাই। অন্যান্য পোকা ও রোগে আক্রান্ত হয়েছে অনেক বেশী। তাই এই বিটি বেগুনে ফল ছিদ্রকারী ও ডগা ছিদ্রকারী পোকা অন্যান্য পোকা যে তুলার মত শেষ করে দিবেনা তার কোন গ্যারান্টি নাই। তাই আমরা বিটি বেগুন লাগাতে চাইনা।

স্বাস্থ্য আন্দোলনের পক্ষ থেকে পলাশ বড়াল বলেন, বেগুন একটি আদর্শ সবজি। স্থানীয় জাতের বেগুনের মধ্যে রয়েছে প্রোটিন, খনিজ লবণ, শর্করা ও ভিটামিনসহ অনেক পুষ্টিগুণ। আমাদের সুস্থ্য থাকার স্বাথে স্থানীয় জাতের বেগুন রক্ষা করতে হবে।

জয়নাল আবেদীন খান বলেন, ঈশ্বরদীতে বিটি বেগুনের বারির গবেষণা মাঠ খামারে দেখা গেছে যে, খোলা মাঠে বিটি বেগুণের চাষ করা হচ্ছে। এই ভাবে বিটি বেগুনের চাষের ফলে স্থানীয় জাতের বেগুনের কৌলিক দূষণ ঘটতে পারে।


 গাজীপুর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে অনুষ্ঠিত মানববন্ধনে গাজীপুর-২ আসনের মাননীয় সংসদ সদস্য মো: জাহিদ আহসান রাসেল স্বাস্থ্য, পরিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্যেও ঝুঁকি নিয়ে বিটি বেগুনের অনুমোদন দেয়া যাবে না এই দাবির সাথে সংহতি প্রকাশ করে বক্তব্য রাখেন। তিনি বলেন, কৃষকের স্বার্থ তথা জাতীয় স্বার্থে স্থানীয় জাতের বেগুন রক্ষা করা এবং বিটি বেগুন ছাড় করানোর তৎপরতার বন্ধ করা উচিত বলে আমি মনে করি।


পরিশেষে ফরিদা আখতার মাননীয় সংসদ সদস্যকে বিটি বেগুন ছাড়ের অনুমোদন যেন না হয় বিষয়টি জাতীয় সংসদে উত্থাপনের অনুরোধ জানালে তিনি তা জাতীয় সংসদে উত্থাপনের আশ্বাস দেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *