তামাক চাষ নিয়ন্ত্রণ অত্যন্ত জরুরি

ফরিদা আখতার || Saturday 22 June 2019

সিগারেট, বিড়ি, জর্দা, গুল, সাদাপাতার মতো ধোঁয়াযুক্ত এবং ধোঁয়াবিহীন তামাক দ্রব্যের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের জন্যে দেশে আইন আছে এবং সেই আইন বাস্তবায়নের জন্যে বিধিমালাসহ নানা ধরণের ব্যবস্থা রয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশান অন টোবাকো কন্ট্রোল (এফসিটিসি) এখন সংশ্লিষ্ট সকল কর্মকর্তাদের কাছে পরিচিত। তামাক স্বাস্থ্যের জন্যে ক্ষতিকর, তামাকের কারণে প্রতিরোধযোগ্য রোগে লক্ষাধিক মানুষ মারা যাচ্ছে প্রতি বছর, এই ব্যপারে সচেতনতাও সৃষ্টি হচ্ছে। কিন্তু তামাক নিয়ন্ত্রণ কেবল ব্যবহার বা চাহিদা নিয়ন্ত্রণের বিষয় নয়। এর যোগানের দিক, যেমন তামাক পাতার চাষ, বিড়ি/সিগারেট/জর্দা উৎপাদন নিয়ন্ত্রণ করা না হলে ২০৪০ সালের মধ্যে দেশকে তামাকমুক্ত করার মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা কার্যকর করা যাবে না। তামাকদ্রব্যের আগ্রাসন একদিকে যেমন ব্যবহার বৃদ্ধির মধ্যে ঘটছে তেমনি এর যোগানও চলছে তামাক দ্রব্যের কাঁচামাল হিশাবে তামাক পাতা চাষের মাধ্যমে।

কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের তথ্য অনুযায়ি সারা দেশের বিভিন্ন জেলায় ৪৬,৪৭২ হেক্টর জমিতে ৮৭৬২৮ টন তামাক উৎপাদন করা হচ্ছে। এই তামাক পাতা শুধু বাংলাদেশেই ব্যবহারের হচ্ছে না, কয়েকটি বহুজাতিক তামাক কোম্পানির (বৃটিশ আমেরিকান টোবাকো কোম্পানি, ঢাকা টোবাকো বা ফিলিপ মরিস) উদ্যোগে দামী ব্রান্ডের সিগারেট উৎপাদনের জন্যে বিদেশে রপ্তানী করা হচ্ছে। বিশ্বে তামাক চাষের জন্যে জমির ব্যবহার হিশেবে বাংলাদেশ ১৪তম দেশ, আর উৎপাদনের পরিমান হিশাবে ১২তম অবস্থানে। বিশ্বের মোট তামাক উৎপাদনের ১.৩% বাংলাদেশে উৎপাদন করা হয়। চীন, ইন্দোনেশিয়া, ব্রাজিল, ভারতসহ এশিয়া, ল্যাটিন আমেরিকা এবং আফ্রিকার ২০টি দেশে তামাক চাষ হচ্ছে; অন্যদিকে ইওরোপে তামাক চাষ সংকুচিত হয়ে আসছে, যুক্তরাষ্ট্রে মাত্র ৪% এবং ইওরোপে ৪% উৎপাদন করা হয়।

তামাকের দুটি প্রজাতি Nicotiana Tabacum (বিশেষ করে ভার্জিনিয়া, বার্লি জাত) এবং স্বল্প প্রচলিত Nicotiana Rustica (যেমন মতিহারি জাত) বিভিন্ন জেলায় বিভিন্ন কোম্পানি কৃষকের মাধ্যমে উৎপাদন করে। ব্রান্ড সিগারেট ফ্লু কিউর্ড ভার্জিনিয়া পাতা দিয়ে তৈরি হয়, আর মতিহারি পাতা ব্যবহার হয় জর্দা এবং অন্যান্য ধোঁয়াবিহীন তামাকদ্রব্য উৎপাদনে। ভার্জিনিয়া প্রধানত ব্রিটিশ আমেরিকান টোবাকো কোম্পানি এবং ফিলিপ মরিস কোম্পানির উদ্যোগে কৃষকদের চুক্তিবদ্ধ করে তাদেরই দেয়া তামাক বীজ, সার-কীটনাশক এবং পাতা কেনার নিশ্চয়তা দিয়ে উৎপাদন করে। আপাত দৃষ্টিতে এটা কৃষকের জন্যে সুবিধা মনে হলেও দীর্ঘ মেয়াদে কৃষক ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ে এবং তামাক চাষ থেকে সহজে বের হতে পারে না। তামাক কোম্পানি কৃষকের সাথে কোম্পানি কার্ডের মাধ্যমে দাদন-জাতীয় সম্পর্ক গড়ে তোলে। কোম্পানি কর্তৃক প্রদত্ত কোম্পানি কার্ড কোম্পানির সাথে চুক্তিবদ্ধ তামাক চাষীদের পরিচয় পত্র হিশেবে ব্যবহার হয়।

যেহেতু খাদ্য ফসলের জমিতেই তামাক চাষ করা হয়, এবং খাদ্য ফসল চাষিরাই এর সাথে যুক্ত হয়ে পড়েন, ফলে তামাক চাষের কারণে খাদ্য ফসল চাষ ব্যাহত হয়। বিশেষ করে বোরো মৌসুমের ফসল যেমন সব্জি, ডাল, সরিষা, বোরো ধান ইত্যাদি গুরুত্বপুর্ণ খাদ্য ফসল চাষ করা যায় না। বোরো মৌসুমের আগে ও পরের ফসলের চাষও বাধাগ্রস্থ হয় কারণ তামাক বীজ লাগানো এবং পাতার তোলার সময় অনেক ফসলের সাথে সাংঘর্ষিক হয়ে ওঠে। কৃষক তামাককেই প্রধান ফসল বিবেচনা করে অন্য ফসলের পরিকল্পনা করতে পারে না। শুধু তাই নয়, তামাক চাষের কারণে ফসল অন্যান্য কৃষি কার্যক্রমও প্রায় বন্ধ হয়ে যায়, যেমন গবাদি পশু ও হাঁস-মুরগী পালন করা যায় না। তামাকের জমিতে অতিরিক্ত সার ও কীটনাশকের ব্যবহার করার কারণে তামাকের জমি থেকে নদী ও অন্যান্য জলাশয়ের মাছ ও অন্যান্য জলজ প্রাণীর ক্ষতি হয়। এসবই মানুষের খাদ্যের উৎস। গরিব মানুষের খাদ্যের যোগান প্রায় নিঃশ্বেষ হয়ে যায়। আগে যেসব কৃষক নিজের জমি থেকে সারা বছরের খাদ্য ফসল পেতো তাদের বাজারের ওপর নির্ভরশীল হতে হয়। কৃষকের বাড়ীতে ফলফলাদী গাছ যা ছিল তাও তামাক পাতা পোড়াতে খড়ি হিশেবে ব্যবহার হয়ে যায়। তামাক পাতার নিকোটিন সংক্রমণের কারণে তামাক চাষী বা শ্রমিকের গ্রীণ টোবাকো সিকনেস (Green Tobacco Sickness) রোগ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাছাড়া কোন ধরণের সুরক্ষা ব্যবস্থা ছাড়া কীটনাশক ও রাসায়নিক সারের প্রয়োগের সময় কৃষক নিজে এবং শ্রমিক, যার মধ্যে নারী ও শিশু শ্রমিকও আছে, নানা স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে পড়ে।


তামাক চাষের ক্ষতি পারিবারিক ও সামাজিক পর্যায়েও দেখা যায়। তামাক পাতা তোলার সময়, ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে তামাক চাষীর বাড়ীতে পরিবারের সকল সদস্যকেই যুক্ত হতে হয়। এই সময় মাঠ থেকে পাতা ঘরে আনা হয়, সেই পাতা স্টিক করে চুল্লিতে দিতে হয়। ছোট শিশু থেকে শুরু করে পরিবারের সব বয়সের সদস্যদের ব্যস্ত থাকতে হয়। ব্যস্ততার কারণে বাচ্চারা স্কুলে যেতে পারে না, কেউ মারা গেলে কোন আনুষ্ঠানিকতা করা হয় না। বিয়ে-শাদী তো চিন্তাও করা যায় না। তাদের একটি মাত্র চিন্তা কোম্পানির কাছে প্রতিশ্রুতি অনুযায়ি ভাল গ্রেডের পাতা দিয়ে পাতার ভাল দাম পাওয়া। যে নগদ টাকা পাওয়ার আশায় তারা তামাক চাষ করে, সেটা পেতে হলে পাতার মান ভাল হতে হবে। এবং পাতার মান ভাল হতে হলে তন্দুরে সঠিক তাপে পাতা পোড়াতে হবে। এই কঠিন কাজটি করেন কৃষকের স্ত্রী বা পরিবারের নারী সদস্য। তাঁর কাজ একনাগারে চুল্লীতে খড়ি যোগানো যেন তাপে কোন তারতম্য না হয়। খড়ি যোগান দেয়ার এই কাজে এক একটি লোড পাতা পোড়াতে গিয়ে প্রায় ৬০ থেকে ৭২ ঘন্টা একটানা আগুন জ্বালাতে হয়। এই সময় খাওয়া-দাওয়া, ঘুমানো, নামাজ পড়া কিছুই সময়মতো করা যায় না। শরীর খারাপ লাগলে বিশ্রাম নেয়ার উপায় নেই।

আটটি গ্রেডের মাধ্যমে তামাক কোম্পানির একক সিদ্ধান্তে পাতার গ্রেড করা হয়। সে অনুযায়ি কৃষককে পাতার দাম দেয়া হয় এবং আগাম দেয়া সার-কীটনাশক, বীজ ইত্যাদীর দাম সমন্বয় করে নগদ অর্থ দেয়া হয়। এতে কৃষকের কোন মতামত দেয়ার অধিকার থাকে না। ফলে কোম্পানি যা সিদ্ধান্ত নেবে তাই কৃষককে মেনে নিতে হয়। গ্রেডের মারপ্যাঁচে কোম্পানির দেয়া প্রতিশ্রুত দামের চেয়ে কৃষক কম দাম পায়। এভাবে কৃষক কোম্পানি দ্বারা শোষিত হয় যা প্রতি বছর কৃষকের দুদর্শার কারণ ঘটায়। কৃষক এই শৃংখল থেকে বেরিয়ে আসতে চায়।

তামাক চাষের নানা ধরণের ক্ষতি বিভিন্ন গবেষণায় নথিভুক্ত হয়েছে। শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বের অনেক দেশেই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এফসিটিসি মূলত চাহিদা নিয়ন্ত্রণমুলক হলেও আর্টিকেল ১৭ তে বিকল্প জীবিকার জন্যে কৃষককে সহায়তা প্রদানের আহবান জানানো হয়েছে। অন্যদিকে, আর্টিকেল ১৮ তামাক চাষের কারণে পরিবেশ ও স্বাস্থ্য ক্ষতির বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলা হয়েছে। বাংলাদেশের ২০১৩ সালের সংশোধিত তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন অনুযায়ি তামাক উৎপাদন নিরুৎসাহিত করার জন্যে এবং বিকল্প ফসলের সহায়তা প্রদানের জন্যে নীতিমালা করার কথা। সে অনুযায়ি স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় একটি খসড়া তামাক নিয়ন্ত্রণ নীতি করেছে যা অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে। তামাক চাষ নিয়ন্ত্রণ একটি বহুমাত্রিক বিষয় যা এককভাবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বা কৃষি মন্ত্রণালয় করতে পারবে না। তামাক চাষ নিয়ন্ত্রণ নীতিতে এইসব বহুমাত্রিক দিকগুলো তুলে ধরা হয়েছে। তবে

এফসিটিসির স্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবে এখনও তামাক চাষ নিরুৎসাহিত করে বিকল্প ফসলের চাষে সরকার, বিশেষ করে কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ, সুযোগ-সুবিধা দিতে পারে এবং খাদ্য ফসল বাজারজাত করণে সহায়তা করতে পারে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড তামাকপাতা রফতানির ওপর ২৫ শতাংশ রফতানি শুল্ক অব্যাহত রাখলে তামাক পাতা রপ্তানি কমে আসবে। ফলে তামাক উৎপাদন কমে যাবে।

তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে হলে তামাক চাষ বন্ধ করা ছাড়া আর কোন বিকল্প নাই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *