নয়াকৃষির দশ নীতি

নয়াকৃষি আন্দোলন || Tuesday 01 December 2015

কিভাবে ‘দশনীতি’ ঠিক হোল

কোন প্রকার বিষ, কীটনাশক, রাসায়নিক সার ছাড়া কিভাবে একর প্রতি নিরাপদ, সুস্বাদু, পুষ্টিকর ও স্বাস্থ্যকর ফসলের ফলন বাড়ানো যায় তার পরীক্ষা নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে নয়াকৃষি আন্দোলন গড়ে ওঠে।

নয়াকৃষির দশনীতি হচ্ছে পরিবেশসম্মত উন্নত জৈবকৃষি চর্চার দশটি নিয়ম যা নয়াকৃষির বিধান অনুযায়ী চর্চা করলে আমরা আমাদের খাদ্য ও পরিবেশকে বিষ ও ক্ষতিকর পদার্থ থেকে মুক্ত রাখতে পারি। নয়াকৃষি সাধারণ ভাবে ‘অর্গানিক’ বা জৈব কৃষি হলেও এই পদ্ধতি আরও উন্নত। বিভিন্ন ফসল এবং প্রাণ ও প্রকৃতির বৈচিত্র রক্ষা এবং তার বিকাশ সাধন নয়াকৃষি চর্চার একটি প্রধান লক্ষ্য। এর ফলে মৌসুম, ফসলের জাত ও স্থানীয় পরিবেশ ভেদে ফসল উৎপাদন করা হয় বলে নয়াকৃষির উৎপাদন সুস্বাদু, পুষ্টিকর ও স্বাস্থ্যকর।

কৃষিতে কীটনাশক, ছত্রাক নাশক, আগাছা নাশকসহ নানান কিসিমের বিষ ও বিষাক্ত রাসায়নিক দ্রব্যের ব্যবহার মানুষসহ সকল প্রাণ ও প্রাণীর জীবন ও স্বাস্থ্যের  জন্য মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি করেছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নানান রাসায়নিক সার। আধুনিক কৃষি যখন হাজার বছরের অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ কৃষকের বীজের পরিবর্তে বৈজ্ঞানিক গবেষণাগার থেকে ‘উচ্চ ফলনশীল’ বীজ প্রবর্তন করে তখন ফলন বেশী পাবার শর্ত হিসাবে বিষ, রাসায়নিক সার ও মাটির তলা থেকে পানি ব্যবহারের প্রয়োজনও বেড়ে যায়। সকল প্রাণ ও প্রাণীর জীবনের ঝুঁকি সহ পরিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্যের জন্য তার ফল হয় মারাত্মক।

পরিবেশ, প্রাণ ও প্রাণবৈচিত্রের অপরিসীম ক্ষতি পরিহার করার পথ হিসাবে নয়াকৃষি কৃষকের বীজ ব্যবহার ও ব্যবস্থাপনার বিজ্ঞান আরও ঘনিষ্ঠ ভাবে পর্যবেক্ষণ ও কৃষকদের নিয়ে গবেষণা শুরু করে। এতে দেখা মাটির উন্নত ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা গেলে দেশীয় বীজ থেকে উন্নত ফলন পাওয়া সম্ভব। মাটি ব্যবস্থাপনার দুটোদিক গুরুত্বপূর্ণ। কৃষকের ঘরের আশপাশ থেকেই প্রাকৃতিক সার তৈয়ার করা এবং নিয়মিত মিশ্র ফসল না ফসল আবর্তনের নিয়ম মেনে চলা। এর মধ্য দিয়ে স্থানীয় জাতের বীজ সংরক্ষণ ও তাদের মধ্য থেকে পরিবেশ ও প্রকৃতি অনুযায়ী বীজ নির্বাচন নয়াকৃষির গুরুত্বপূর্ণ নীতি হয়ে উঠেছে।

মাটির তলা থেকে পানি তোলার ফলে পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং মাটিতে আর্সেনিক দূষণ ঘটে। এ কারনে নয়াকৃষির কৃষক মাটির ওপরের পানি সাশ্রয়ের দিকে মনোযোগী হয়ে ওঠে এবং ডিপ টিউব ওয়েল ব্যবহারে নিরুৎসাহিত হয়ে পড়ে। নদি, বিল, হাওর রক্ষা ও বৃষ্টির পানির সদ্ব্যবহারের প্রতি নয়াকৃষির মনোযোগ বাড়ে।

এভাবে বিভিন্ন ভাবে ও বিভিন্ন পর্যায়ে অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ হয়ে নয়াকৃষির কৃষকরা ১৯৯৭ সালে সুনির্দিষ্ট দশটি নীতি, বিধান বা নিয়ম নির্ধারণ করেন। এটাই নয়াকৃষির দশনীতি নামে বিখ্যাত।

দশনীতি কৃষকদের অভিজ্ঞতারই সারমর্ম। দুই হাতের দশ আঙ্গুলের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে এই অভিজ্ঞতা দশটি অনুসরণীয় বিধান হিসাবে সারসংক্ষেপ করা হয়েছে। দশনীতি কৃষকদের পক্ষে মনে রাখা সহজ। প্রতিবছরই নয়াকৃষির কৃষকেরা নিজেদের চর্চা ও নতুন অভিজ্ঞতার আলোকে নীতি বা নিয়মগুলো নিয়ে ব্যাপক আলাপ আলোচনা পর্যালোচনা করেন।

সর্বশেষ পর্যালোচনা হয় ২০১৪ সালে। এই পর্যায়ে নীতিগুলোকে দুটো পর্যায় বা ভাগে ভাগ করা হয়। অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায় কৃষক সরল কৃষিব্যবস্থা থেকে আস্তে আস্তে আরও উন্নত বা তুলনামূলক ভাবে আরও আকর্ষণীয় প্রাণবৈচিত্রভিত্তিক কৃষিব্যবস্থা গড়ে তুলছেন। প্রথম পাঁচটি নীতি এই দিক থেকে প্রাথমিক পর্যায়ে সরল নিয়মে নয়াকৃষি চর্চা নিশ্চিত করে। এরপর কৃষক তার অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা অনুযায়ী বাকি আরও পাঁচটির চর্চা বাড়িয়ে তুলনামূলক ভাবে উন্নত কৃষিব্যবস্থা গড়ে তুলতে সক্ষম হন।

বলাবাহুল্য প্রতিটি নীতিরই দুটো দিক রয়েছে। বাহ্যিক ভাবে সেটা সুনির্দিষ্ট বিজ্ঞান ও কৃৎকৌশলগত দিক। অর্থাৎ অভিজ্ঞতা ও গবেষণাজাত জ্ঞানের সারকথা এবং কী ধরণের চাষপদ্ধতি ও কৃৎকৌশল উন্নত কৃষিব্যবস্থার উপযোগী সেই সত্য তারা ধারণ করে। এই দিক থেকে নয়াকৃষি সুনির্দিষ্ট বিজ্ঞান চর্চা। কিন্তু স্রেফ অভিজ্ঞতা ও গবেষণার ফল কৃষিতে প্রয়োগ করা হবে কি হবে না সেটা নীতি ও আদর্শের প্রশ্ন। পদার্থ বিজ্ঞান পারমাণবিক বিজ্ঞান ও পারমাণবিক বোমা আবিষ্কার করেছে বলে তা প্রয়োগ করতে হবে তার কোন যুক্তি নাই। সেটা তখন আর শুধু বিজ্ঞান বা কৃৎকৌশলের বিষয় থাকে না, সেটা নীতি, ভাব বা দর্শনের বিষয় হয়ে ওঠে। এ কারনে জীবন ও জগতের প্রতি আমাদের সুনির্দিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গী গড়ে তোলা ও তার চর্চাকে নয়াকৃষিতে জরুরী। এই চর্চাকে নয়াকৃষি বিজ্ঞান ও কৃৎকৌশলের বিচার থেকে আলাদা করে না।

নয়াকৃষি আন্দোলনের ভাবগত বা দার্শনিক দিক সে কারণে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নয়াকৃষি কৃষকরাও তার প্রতি বিশেষ ভাবে মনোযোগী। বিজ্ঞান ও কৃৎকৌশলের বৈজ্ঞানিক পর্যালোচনা যেমন নয়াকৃষিতে জরুরী, তেমনি নয়াকৃষির সামগ্রিক ভাবগত বা দার্শনিক ভিত্তির ক্ষেত্র থেকে গ্রহণ বর্জন নয়াকৃষির রীতিনীতির অন্তর্গত। দুটো দিক নিয়েই নয়াকৃষির বিভিন্ন সভায় ব্যাপক পর্যালোচনা হয় যা নয়াকৃষিকে নানান ভাবে সমৃদ্ধ করে।

নয়াকৃষির নীতি একটাইঃ আনন্দ

নয়াকৃষির নীতি আসলে একটাই: আনন্দ। আনন্দই নয়াকৃষির নিরিখ। নিরিখ-বা আমাদের সকল ইন্দ্রিয় চিন্তা প্রজ্ঞা কিম্বা অন্য কথায় আমাদের সকল বৃত্তিকে যে ভরকেন্দ্রে স্থাপন করে নয়াকৃষি জীবনযাপন ও প্রাণের চর্চা করে তার নাম: আনন্দ। কৃষিকাজে আনন্দময় সম্পর্ক চর্চার জন্য নয়াকৃষির বিখ্যাত দশটি বিধান বা নীতি এখানে বিশদ বর্ণনা করা হয়েছে।

নয়াকৃষি মনে করে এই বিশ্বজগত বা প্রকৃতি আনন্দময়। ভাবে, সংকল্পে ও কাজে এই আনন্দকে নিরিখে রেখে সৃষ্টি, সৃষ্টির শর্ত ও সৃষ্টি-প্রক্রিয়ার সুরক্ষা ও বিকাশই ধর্ম। আনন্দ আনন্দই-নিরানন্দ বা অসুখী অবস্থার বিপরীত কোন ধারণা নয়। তবে মানুষের সঙ্গে মানুষের এবং মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির সকল প্রকার হানাদারি সম্পর্কের বিনাশ বা বিলয় ছাড়া আনন্দের আবির্ভাব অসম্ভব। অতএব ব্যবহারিক ক্ষেত্রে কাজেকর্মে আচারব্যবহারে বিশ্বাসে সংস্কৃতিতে সকল প্রকার হানাদারির বিরুদ্ধে ব্যক্তি পর্যায়ে, পরিবারে, সমাজে ও সর্বত্র লড়াই সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে। আনন্দের শর্ত তৈরীর জন্যই সকল প্রকার হানাদারি সম্পর্কের অবসান চায় নয়াকৃষি।

আনন্দের নিরিখে কৃষিকাজে সমৃদ্ধি ও উন্নতির জন্য দশটি কৃষিনীতির ব্যবহারিক প্রয়োগ করে নয়াকৃষি। সেই প্রয়োগ থেকে অভিজ্ঞতা অর্জন, নতুন শিক্ষালাভ, গবেষণা, পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং আবিষ্কারের দৈনন্দিন চর্চায় নয়াকৃষি বিকশিত হয়ে চলেছে।

নয়াকৃষি আনন্দকে আনন্দ হিশাবেই কল্পনা করতে চায়, জানতে চায় এবং মানুষের সংকল্পে, জীবনযাপনের চর্চায় তার সম্ভাব্য রূপ প্রদর্শন করতে চায়। আনন্দের বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে আনন্দময় সমাজ গড়তে চায়।

কাজের সুবিধার জন্য পাঁচ ধরণের কর্মযোগের মধ্য দিয়ে নয়াকৃষি বিশ্বমানব হওয়ার চর্চা করে। এই কর্মযোগগুলো হচ্ছে – (১) সংরক্ষণ বা রক্ষা (২) সৃজন বা সৃষ্টি (৩) পালন ও প্রতিপালন (৪) বিকাশ ও (৫) উন্নতি। সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে এই পাঁচ কর্মযোগের প্রকাশ ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। এই আদর্শে যাঁরা মানুষের সঙ্গে মানুষের বিভেদ, শোষণ ও নির্যাতনের সম্পর্ক উচ্ছেদের জন্য সংগ্রাম করে নয়াকৃষি তাঁদের সঙ্গে মৈত্রীর বন্ধন দৃঢ় করে। নয়াকৃষি মনে করে এই মৈত্রীর চর্চাই নতুন ধরণের শ্রেণী চেতনা কিম্বা গোষ্ঠ ভাবের উদয় ঘটাবে, অনুৎপাদক ও পরজীবী শ্রেণীর বিরুদ্ধে সংগ্রাম তীব্র করবে, সকল প্রকার মহাজনগিরি, সুদখোরি, শোষণ ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে সামাজিক ও রাজনৈতিক ঐক্য প্রতিষ্ঠা করবে এবং দুনিয়াব্যাপী সাম্রাজ্যবাদ অর্থাৎ পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থার বিরুদ্ধে দেশে দেশে মানুষের লড়াই-সংগ্রামকে এক সূত্রে গাঁথবার শর্ত তৈরি করবে। এর ফলে জাতপাত, শ্রেণীভেদ ও নারীপুরুষের সম্পর্কের মধ্যে পুরুষতান্ত্রিক শোষণেরও অবসান ঘটবে।

কর্মযোগের এই মানুষ ও প্রকৃতির অভিন্ন বিকাশ নিশ্চিত করবার শর্ত। মানুষের সত্যিকারের ইতিহাস শুরু করার এই প্রতিজ্ঞা ও কর্মযোগের নিরিখই নয়াকৃষির কেন্দ্রীয় চালিকা শক্তি।

নয়াকৃষি বিজ্ঞান চর্চা করে, কিন্তু বিজ্ঞানের পূজা করে না

সূক্ষ্ম জ্ঞান যার ঐক্য মুখ্য
   সাধকেরই উপলক্ষ্য
   অপরূপ তারই বৃক্ষ
দেখলে জীবের জ্ঞান থাকে না ॥
                 (ফকির লালন শাহ)

নয়াকৃষি নিছক কোন কারিগরী বিদ্যা বা কৃৎকৌশল প্রবর্তনের নামে ভুয়া ও মিথ্যা জাদুকরির প্রতিশ্রুতি নয়। অথচ নয়াকৃষি অতি অগ্রসর চিন্তা ও ভাব এবং জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চার ক্ষেত্র ও উৎপাদন শক্তি বিকাশের উপায়। ঐক্য, গোষ্ঠভাব ও শক্তির সাধক নয়াকৃষি, তার সাধনা মানুষের জীবনে আনন্দ, সমৃদ্ধি ও বৈষয়িক উন্নতি। এই প্রজ্ঞা, জ্ঞান বা বিজ্ঞান চর্চার জন্য প্রকৃতিকে শুধু খণ্ড খণ্ড ভাবে বুঝলে চলবে না, বুঝতে হবে অখণ্ড, অভিন্ন বা সামগ্রিক ভাবে। এমনকি শুধু ‘প্রকৃতি’ রূপে চিনলেও চলবে না। প্রকৃতিকে সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ভাবেও বুঝতে হবে। প্রকৃতি অর্থাৎ জমি, পানি, তেল-গ্যাস কয়লাসহ খনিজ সম্পদ, বন, গাছ-পালা, পশু-পাখি, জীব-অণুজীব ইত্যাদি মুনাফাখোরদের মুনাফা কামানোর উপায় কিম্বা কাঁচামাল মাত্র এখন হানাদারি ও দখলদারির ক্ষেত্র, দুনিয়াব্যাপী হানাহানি, যুদ্ধ, হিংসা ও হত্যার কারণ। অন্যদিকে বিশ্বব্যাপী পুঁজিতান্ত্রিক যে আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা তাকেই আমরা স্বাভাবিক বা প্রাকৃতিক বলেই মনে করি। সকল দিক থেকেই প্রকৃতির এই বন্দী দুর্দশা জানতে, বুঝতে ও ব্যাখ্যা করতে হবে। একই সঙ্গে প্রকৃতির ঐতিহাসিক বিকাশ সম্পন্ন করবার জন্য লড়াইয়ের নীতি ও কৌশল নির্ধারণ করতে হবে। প্রকৃতিকে দখলদারি, হানাদারি ও ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করে মানুষসহ সকল প্রাণ, প্রাণীকূলের বিকাশ অর্থাৎ সৃষ্টির অসীম সম্ভাবনার বিবর্তন নিশ্চিত করাই নয়াকৃষির চর্চা ও রাজনীতি। সজ্ঞান ও সচেতন মানুষের পক্ষেই কেবল এই ভাবের বাস্তবায়ন সম্ভব।

মানুষ এই অর্থেই সৃষ্টির সেরা যে তার পক্ষেই এই ভাব চর্চা সম্ভব। আনন্দের কল্পনা, সংকল্প ও তা বাস্তবায়নের চর্চা করে মানুষ। হাতির শরীর মানুষের চেয়ে বড়,ঈগল খুব দূর আকাশে উড়তে সক্ষম,মহাসমুদ্রের বিশাল ও অপূর্ব সুন্দর তিমি গভীর পানিতে বিচরণ করে কিন্তু তাদের মধ্যে কোন কর্তাসত্তা নেই, তারা প্রকৃতি মাত্র। কিন্তু মানুষ প্রকৃতিমাত্র নয়, মানুষের মধ্যে নতুন কর্তাসত্তা আবির্ভারের স্বভাব আছে যে কারণে প্রাকৃতিক ইতিহাস ছাড়াও মানুষের নিজের একটা আলাদা ইতিহাস আছে, যা প্রকৃতির অপরাপর সত্তার মধ্যে আমরা দেখি না। মানুষ যা ছিল, বা যা আছে সেটাই তাঁর চরিত্র বা মনুষত্ব নয়, বরং যা সে এখনো হয় নি, কিন্তু সে হয়ে উঠতে পারে বা একদিন সে হয়ে উঠবে-সেই সুন্দর বা আনন্দের কল্পনা ও সংকল্পের মধ্যে সবসময় নতুন মানুষের আবির্ভাবের আওয়াজ শুনি আমরা। এই সম্ভাবনার ধারণা বা কল্পনা ছাড়া বিপ্লব কথাটার কোন মানে হয় না, যদিও বিপ্লব বলতে আমরা নতুন কিছু সৃষ্টি বুঝি। নয়াকৃষি মানুষের মধ্যে এই সৃষ্টিবান কর্তাসত্তার উদ্বোধন ও বিকাশের শিক্ষা দেয়।

নয়াকৃষি পুরানা আমলের কৃষি নয়

অতএব কৃৎকৌশলের দিক থেকে নয়াকৃষি পুরানা আমলের কৃষি, কিম্বা তথাকথিত ‘প্রাকৃতিক’ কৃষি বা চিরায়ত কৃষিও নয়। নয়াকৃষি সবসময়ই নতুন, সবসময়ই নিত্য নতুন প্রক্রিয়ার মধ্যে যা কিছুই সৃজন, সংরক্ষণ, পালন, বিকাশ ও উন্নতির পক্ষে নয়াকৃষি তাকে জানতে, নিজের করে নিতে, ধারণা করতে ও কাজে খাটাতে আগ্রহী। বিজ্ঞান ও কৃৎকৌশলের অভূতপূর্ব অগ্রগতির ফলে প্রাণ ও প্রাণের প্রক্রিয়া রক্ষা ও বিকাশের ক্ষমতা বেড়েছে মানুষের বহুগুণ। অতএব নয়াকৃষি অবশ্যই নিত্য নতুন অভিজ্ঞতা অর্জন ও জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চায় উৎসাহী ও আগ্রহী। কিন্তু যে ‘বিজ্ঞান’ দখলদারি, হানাদারি, ধ্বংস, যুদ্ধ, হত্যা ও সন্ত্রাসের সমার্থক, নয়াকৃষি তার সঙ্গে আপোষ করে না। প্রাণপণ লড়ে।

নয়াকৃষি আন্দোলন মানুষসহ গাছ-পালা, লতা গুল্ম, পশু-পাখি, কীট-পতঙ্গ- প্রতিটি প্রাণীর প্রতি ভালবাসা ও মায়া মমতার ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। নয়াকৃষি জীবন ও জগতের প্রতি আনন্দময় দৃষ্টিভঙ্গী। আনন্দময় জীবনযাপন। নয়াকৃষিই মানুষের ভবিষ্যৎ।

নয়াকৃষির অতি অগ্রসর বৈজ্ঞানিক ভিত্তি বুঝতে যাঁরা অক্ষম তাঁরা অনেকেই একে পুরানা জমানার কৃষি মনে করেন। পুরানা জমানার কৃষি কিন্তু আধুনিক কৃষির মতো ধ্বংসাত্মক নয়। তবে পুরানা জমানার কৃষি বলতে তাঁরা বোঝান নিম্ন মানের প্রযুক্তি এবং ল্যাবরেটরি মার্কা বিজ্ঞানের অনুপস্থিতি। তাদের ধারণা রাসায়নিক সার-বিষ, সেচের যন্ত্র এবং ল্যাবরেটরীতে উৎপাদিত এবং কোম্পানীর বাজারজাত বীজ ব্যবহার করলেই তাকে উন্নত প্রযুক্তি বলে মানতে হবে। বিষে ও পরিবেশ বিপর্যয়ে সবদিক ধ্বংস হলেও। নয়াকৃষির বিজ্ঞান ল্যাবরেটরি মার্কা খণ্ডিত বিজ্ঞান নয়, সামগ্রিক বিজ্ঞান।

বিজ্ঞানের বিপুল অগ্রগতির পরে ধ্বংসাত্মক কৃষির পথ পরিত্যাগ করা এখন সহজ, অথচ আধুনিক কৃষি তার হানাদারি ও মুনাফাখোর চরিত্রের কারণে মুনাফাবাজ কোম্পানির হাতিয়ার মাত্র, বিজ্ঞানকে প্রাণের রক্ষা ও বিকাশের কাজে ব্যবহার আধুনিক কৃষি জানে না, বরং আরো ধ্বংসাত্মক জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের প্রবর্তন করার জন্য তারা মরিয়া হয়ে উঠেছে। অতএব তথাকথিত আধুনিক কৃষিই আসলে পুরাতন ও পশ্চাতপদ কৃষি। সার ও বিষ ছাড়া ফসল উৎপাদন করা যায় এবং অতি সহজেই অধিক ফলন ফলানো সম্ভব সেই বিজ্ঞানের খবর আধুনিকদের কানে পৌঁছায় নাই। কিম্বা পৌঁছালেও কীটনাশক, সার ও পাম্প কোম্পানির স্বার্থে তারা সেটা বলেন না।


মানুষের জ্ঞান, বুদ্ধি ও অন্যান্য মানবিক বৃত্তির বিরুদ্ধে যে সকল প্রাচীন ও আধুনিক কুসংস্কার কাজ করে তার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে নয়াকৃষি। প্রাচীন কুসংস্কার যেমন, ঠিক তেমনি দেশীবিদেশী ব্যবসা ও বহুজাতিক কোম্পানির মুনাফাবাজি ও লুটতরাজকে বিজ্ঞান বলে চালানো এই কালের কুসংস্কার। এই সকল ভুয়া দাবি ও চাতুরির বিরুদ্ধে নয়াকৃষি সংগ্রাম করে।


মানুষসহ অন্য যে কোন প্রাণ বা প্রাণীর জন্যে ক্ষতিকর পদ্ধতি বাদ দেওয়া, পদার্থ বিজ্ঞান, জীব বিজ্ঞানসহ বিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রের নতুন আবিষ্কার ও অভিজ্ঞতা কৃষি কাজে ব্যবহার, প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষা ও বিকাশ এবং কৃষকের জ্ঞানের ভিত্তি, ক্ষমতা এবং সাংগঠনিক শক্তি বিকশিত করে তোলাই নয়াকৃষির মোদ্দা কথা।

মানুষের ভাব, প্রজ্ঞা, বিজ্ঞান ও কৃৎকৌশলের চর্চা যুগে যুগে কালে কালে বদলায়। উৎপাদন শক্তির বদল মানে খোদ প্রকৃতিরই রূপান্তর। কিন্তু এই বদল নয়াকৃষির ভাবের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ কিনা তার বিচার হবে সংরক্ষণ, সৃজন, প্রতিপালন, বিকাশ ও উন্নতির মানদণ্ড দিয়ে। বিবর্তন বা বিকাশ মানে প্রকৃতিকে তার ঐক্যে ও বৈচিত্র্যে একই সঙ্গে অনুধাবন, চর্চা ও বিকাশ – প্রকৃতির ধ্বংস বা বিনাশ নয়। প্রকৃতি একসময় নিজেই নিজে বিবর্তিত হয়েছে এবং মানুষ প্রকৃতিরই অংশ হয়ে বিকশিত হয়েছে। এখন মানুষকেই নিজের ও প্রকৃতির বিকাশ নিশ্চিত করতে হবে। ‘উৎপাদন শক্তির বিকাশ’ বলতে আমরা কী বুঝি সেই সম্পর্কে সুস্পষ্ট ও পরিচ্ছন্ন ধারণা না থাকলে মানুষের পক্ষে এই কর্তব্য পালন অসম্ভব। সেই কারণে বিজ্ঞান মাত্রই ভাল বা সব টেকনোলজিই মানুষের অগ্রগতির সহায়ক নয়াকৃষি তা মনে করে না। এই ধরণের একতরফা মূল্যায়ন ধ্বংসাত্মক। ঠিক তেমনি উৎপাদনের ক্ষেত্রে তথাকথিত ‘বিপ্লব’ ঘটলেই নয়াকৃষি তাকে ‘প্রগতি’ বা মানুষ ও প্রকৃতির এগিয়ে যাওয়া বলে গণ্য করে না। পৃথিবীতে প্রাণ ও প্রাণের প্রক্রিয়াই আজ ধ্বংসের সম্মুখিন।

মানুষ যদি এগিয়েই গিয়ে থাকে তাহলে যুদ্ধ, হত্যা, ধ্বংস ও হানাহানি কেন? কেন মারণাস্ত্র উৎপাদনই বিশ্ব অর্থনীতির কেন্দ্রে নিজের স্থান করে নিতে সক্ষম হোল ?

অর্থশাস্ত্র মানুষ ও প্রকৃতির সম্পর্ককে সাধারণ ভাবে ‘উৎপাদন সম্পর্ক’ বলে থাকে। কিন্তু নয়াকৃষি সব উৎপাদন সম্পর্ককে ‘আনন্দ’ বলে গণ্য করে না। যে উৎপাদন সম্পর্ক মানুষের সঙ্গে মানুষের বর্ণ, জাত, শ্রেণী ও নারীপুরুষ ভেদ বহাল রাখে – শোষণ, হিংসা, হানাদারি, দখলদারি ও যুদ্ধবিগ্রহই যে-উৎপাদন সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার ভিত্তি – নয়াকৃষি সেই উৎপাদন সম্পর্কের উৎখাত বা রূপান্তর ঘটাবার জন্য লড়াই করে। যে-উৎপাদন সম্পর্ক আনন্দের, ইহলোকে আনন্দময় জীবনযাপনের শর্ত, সেই সম্পর্ক রচনা ও জীইয়ে রাখা ও প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই – সংগ্রাম করে নয়াকৃষি।


বিজ্ঞান ও টেকনলজি বিকাশের নামে দুনিয়ার অল্প কিছু বহুজাতিক কোম্পানি আজ খোদ সৃষ্টিজগতকেই ধ্বংস করতে উদ্যত। দুনিয়া ধ্বংস হোক, তবুও তাদের মুনাফা কামানো চাই। কোম্পানির মুনাফার রক্ষা করতে গিয়ে জগতে খোদ প্রাণের ভিত্তিটাই আজ মহা বিপদের সম্মুখিন।


বিজ্ঞান ও টেকনলজি যখন ‘মুনাফা’ কামানোর উপায় ছাড়া অধিক কিছু নয়, এমনকি ধ্বংসাত্মক, তখন মুনাফাবাজদের কবল থেকে জ্ঞানবিজ্ঞানকে মুক্ত করাই নয়াকৃষির এখনকার প্রধান কাজ। যদি ‘বিজ্ঞান’ বা ‘টেকনলজি’ খোদ সৃষ্টিকেই ধ্বংস করে, সৃষ্টির প্রক্রিয়াকে বিনষ্ট করে, মানুষকে যন্ত্রের অধীন বা গোলামে পরিণত করে তাকে ‘বিজ্ঞান’ নয়, অজ্ঞানতা বলাই সঙ্গত। এই যুগে বিজ্ঞানবাদীদের বিরুদ্ধে লড়াই সাম্রাজ্যবাদবিরোধী লড়াইয়ের অংশ।

নয়াকৃষি আন্দোলনের শুরুর কথা

নয়াকৃষি এখনকার জন্য তো অবশ্যই সঙ্গে সঙ্গে ভবিষ্যতের জন্যও মানুষসহ পশুপাখি কীটপতঙ্গ জীব-অণুজীব সকলের জন্য খাদ্য, আহার বা প্রাণ ধারণের নিশ্চয়তা অর্জনের জন্য লড়াই করে। এই লক্ষ্যে নয়াকৃষি বাংলাদেশের জনগণের খাদ্য সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত করার মধ্য দিয়ে প্রাণের প্রতিরক্ষাও নিশ্চিত করে।

সকল প্রাণের প্রতিরক্ষা
বাংলাদেশের আত্মরক্ষা
দেশ ও দশের বাঁচামরা
              নয়াকৃষির পথ ধরা।

বাংলাদেশের কৃষকরা নয়াকৃষি আন্দোলন শুরু করেছেন সময়ের প্রয়োজনে। ১৯৯০ সাল থেকে শুরু হয়েছে এই আন্দোলন। পেছনের দিকে তাকালে এটা এখন অবিশ্বাস্য মনে হয়, কারণ শুরুটাই ছিল অসাধ্য সাধনের ব্রত নিয়ে। শুরুতে যেসব কৃষক নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তাঁদের অদ্ভুত জীব মনে করেছিল অনেকেই। কিন্তু তাঁরাই পথ দেখিয়েছিলেন, তাঁদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা গবেষণার ফলাফলের অভিজ্ঞতার ওপর নয়াকৃষি দাঁড়িয়েছে। নয়াকৃষি একান্তই কৃষকদের গবেষণার ফল, জ্ঞান-বিজ্ঞানের জগতে বাংলাদেশের কৃষকদের নিজস্ব অবদান। প্রাথমিক অভিজ্ঞতা লাভের জন্য কম পক্ষে পাঁচ ছয় বছর ব্যয় হয়েছে। তারপরই শুরু হয়েছে সফলতার আলোকে বিস্তারের কাজ। অতি অল্প সময়ের মধ্যে হাজার হাজার কৃষক পরিবার এই আন্দোলনের সঙ্গে আজ সরাসরি যুক্ত। ২০১১ সালের মাঝামাঝিতে সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩০০,০০০ (তিন লক্ষ) কৃষক পরিবার। অনুরাগী ও সমর্থক তো আছেই। এ সংখ্যা দিনে দিনে বাড়ছে।

নয়াকৃষি আন্দোলন এমন এক সময়ে শুরু হয়েছে যখন আধুনিক কৃষির নামে রাসায়নিক সার-বিষ ব্যবহার করে কৃষি কাজ করানো হচ্ছে। সেচের জন্যে শ্যালো এবং ডিপ টিউবওয়েল ব্যবহার করা হচ্ছে। ষাট দশক থেকে শুরু হয়ে এখন পর্যন্ত আধুনিক কৃষির নামে রাসায়নিক সার, বিষ এবং উচ্চ ফলনশীল বীজ এবং সেচের পানি ব্যবহার করে দেশের প্রায় ৫০ থেকে ৬০ ভাগ আবাদী জমি ইতিমধ্যেই ব্যবহার হচ্ছে। কৃষকরা সার ও বিষ ব্যবহারের ভয়াবহতা বা সেচের পানি তোলার ফলে ভূগর্ভের পানির ভয়াবহ সমস্যা অনেক আগেই টের পেয়েছিলেন। আর্সেনিকের বিষে বিশাল জনগোষ্ঠি এখন আক্রান্ত। এখন কি হবে? অধিক ফলনের নামে যারা লক্ষ লক্ষ মানুষ মারার অবস্থা সৃষ্টি করেছে এদের বিচার কে করবে? ওদিকে গরিব কৃষকরা চাইলেও আর নগদ টাকা দিয়ে সার-কীটনাশক কিনতে পারছেন না। এখন শুরু হয়েছে হাইব্রিড বীজের আমদানি। ফলে কৃষকের বীজব্যবস্থা ধ্বংস হচ্ছে। এছাড়া চলছে জিএমও বা বিকৃত বীজ উদ্ভাবনের চেষ্টা। এমন ভয়ানক প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে নয়াকৃষির কৃষক সংগঠিত হচ্ছেন।

কৃষক তাঁদের অভিজ্ঞতায় দেখেছেন যে আধুনিক কৃষির বিষয়টি কেবল প্রতারণামূলক। প্রথম দিকে ফলন বেশী হয়, তাও শুধু ইরি ধানের। পরে সেই এক ফসলের অভিজ্ঞতাও তিক্ত হয়ে ওঠে। ইতোমধ্যে মাছ মরে, পশু-পাখি কমে, স্বাস্থ্য নষ্ট হয় এবং কৃষক ধুঁকে ধুঁকে মরে। এখন কৃষক আর্সেনিকের বিষে মরছে। গরিব আরো গরিব হয়, জমিহারা হয়, ছেলে মেয়ে নিয়ে পথে বসে। একসময় দেখি সেই গ্রামের কৃষকই শহরে ছেলেমেয়ে নিয়ে হাত পাতছে পেটের ক্ষুধায়।


হুঁশিয়ার!! কৃষকের বীজব্যবস্থা ধ্বংস করে কোম্পানির হাইব্রিড বীজে বাজার সয়লাব করা হচ্ছে।


বাঁচার জন্য অনেক কৃষক অন্য পেশায় চলে যায়। অনেক কৃষক এখনও কষ্ট করে ফসল উৎপাদন করে চলেছেন। এমন অবস্থায় কৃষকদের কৃষি কাজে টিকিয়ে রাখার এবং বেঁচে থাকা নিশ্চিত করার জন্য ফসল উৎপাদনের জন্য একটা নতুন পথ খোঁজার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। বাঁচা মরার লড়াই থেকে নয়াকৃষি আন্দোলনের শুরু।

কোন বইপত্রের তত্ত্ব নিয়ে কিম্বা কারো কারিগরি পরিকল্পনা মাফিক নয়াকৃষি গড়ে ওঠে নি। নিজের সর্বনাশের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যই কৃষককে নতুন পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে হয়েছে। নয়াকৃষি আন্দোলনের প্রথম কাজ কৃষকের অসহায় অবস্থা থেকে মুক্ত করার জন্যে তাঁকে মানসিক বল দেয়া। সংকটের সমাধান যে তার হাতের কাছেই আছে সেই দিকটা তুলে ধরা। যেটুকু জমি তার আছে তাতেই নগদ কোন টাকা খরচ না করে কি করে অধিক ফসল ফলানো যায় তার কিছু প্রাথমিক পদ্ধতি আবিষ্কার নয়াকৃষির প্রথম সাফল্য। দ্বিতীয়ত কৃষকের নিজের জ্ঞান বুদ্ধি খাটিয়ে আরো পরীক্ষা নিরীক্ষা করে কি করে আরো উন্নত পদ্ধতিতে ফসল ফলানো যায় তার প্রক্রিয়া শুরু হয়। স্থানীয় জাত নিয়ে নানান ধরণের পরীক্ষা-নিরীক্ষা, মিশ্র ফসলের বিপুল ফলন বৃদ্ধির সাফল্য এবং সর্বোপরি পোকা-মাকড়, কীট-পতঙ্গ অপকার করা দূরে থাকুক, কৃষকের উপকারী প্রাণ সম্পদে পরিণত হওয়ায় বিপুল উৎসাহে নয়াকৃষি বেড়ে ওঠে। এখন নয়াকৃষি মাছ, গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি পালন, ফলমূল চাষ, মশলা চাষ, ওষুধি গাছ সংরক্ষণ প্রভৃতির মধ্য দিয়ে কৃষি পরিবারের দ্রুত আর্থিক ও বৈষয়িক সমৃদ্ধি আনয়নের পরীক্ষায় এগিয়ে গিয়েছে। নয়াকৃষি নিজের শক্তি ও আত্মবিশ্বাসের উপর এখন শক্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারো সাধ্য নেই তাকে এখন টলায়।


আগামি দিনের শিশুদের প্রাণ ও পরিবেশ রক্ষা এবং খাদ্য সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত করার শিক্ষা দেয় নয়াকৃষি।


কীটনাশক বন্ধ করার জন্যে কৃষকদের মধ্যে প্রথম থেকেই ঐক্যমত ছিল। বিশেষত মহিলারা নিজেদের ও শিশুদের স্বাস্থ্যের বিপর্যয়ের কথাটা প্রথম থেকেই বলছিলেন এবং তাঁরা কীটনাশক অবিলম্বে বন্ধ করার কথা তুলেছেন। কীটনাশক বন্ধ করার জন্য প্রথম দিকে যেসব কৃষকরা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে প্রধানত ছিলেন ক্ষুদ্র চাষী এবং মহিলারা। প্রথম অবস্থায় যোগদানের সঙ্গে সঙ্গে কৃষকরা দলে সংগঠিত হয়ে সবুজ সার তৈরি ও কম্পোষ্ট তৈরি করা এবং এর ব্যবহার নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে শুরু করলেন। তাঁরা কম্পোষ্ট তৈরি করতে লাগলেন কচুরি পানা দিয়ে এবং এ থেকে জৈব সার তৈরি সহজ হবার কারণে ধীরে ধীরে কম্পোষ্ট কৃষকদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠে। বর্ষাকালে এই কচুরিপানা প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়। স্বাস্থ্য সম্পর্কে বিশেষ আত্মোপলব্ধির কারণেই ফসল উৎপাদন বিশেষ করে খাদ্য উৎপাদনে কীটনাশকের ব্যবহার ও রাসায়নিক সারের ব্যবহার থেকে তাঁরা নিজেদের মুক্ত করতে পারলেন।

এটা ছিল নয়াকৃষি আন্দোলনের অগ্রযাত্রার একটা বাধা ভেঙ্গে বেরিয়ে আসার প্রথম ধাপ। কারণ দীর্ঘ চল্লিশ-পঞ্চাশ বছরের আধুনিক কৃষির প্রচার এবং সরাসরি কাজের অভিজ্ঞতার পর নতুন কোন ধারণা আছে কি না এই কথা বোঝা তাঁদের পক্ষে খুব কঠিন ছিল। কিন্তু কাজ করার অভিজ্ঞতা এবং সেই সাথে আত্মবিশ্বাস জন্মানোর কারণে তাঁরা নয়াকৃষি পদ্ধতির চাষ করাকে একটি আন্দোলনের রূপ দিলেন। এবং তাঁরা খাদ্য উৎপাদনের জন্য নয়াকৃষির সাধারণ কিছু নীতিও ঠিক করে নিলেন। কৃষকদের বিভিন্ন সভায় এবং তাঁদের নিজস্ব কাজের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে নয়াকৃষির নীতিগুলো কবিতার ছন্দ আকারে গড়ে উঠতে থাকে। কৃষকরা বলেন, নয়াকৃষি কোন যাদুগরি নয়, কলাকৌশলও নয়, কিংবা কোন নতুন প্রযুক্তির প্রচলনের জন্য বহুজাতিক কোম্পানির ধান্দা নয়। এটা আমাদের সুন্দরভাবে জীবন যাপনের এবং বেঁচে থাকার একটি আন্দোলন। বর্তমান অবস্থার পরিবর্তন করে নতুন কিছু করতে হলে সুনির্দিষ্ট নীতি আমাদের লাগবেই। আমরা আনন্দে থাকতে চাই সবাইকে নিয়ে, সব ধরণের প্রাণী নিয়ে। অধিক খাদ্য উৎপাদনের মিথ্যা কথা বলে অন্যান্য প্রাণ হত্যা করার উল্লাস কোন ভাবেই সমর্থন করা যায় না। এটা পিশাচের কাজ। নয়াকৃষি আন্দোলন মানুষসহ গাছ-পালা, লতা গুল্ম, পশু-পাখি, কীটপতঙ্গ- প্রতিটি প্রাণীর প্রতি ভালবাসা ও মায়া মমতার ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। নয়াকৃষি জীবন ও জগতের প্রতি একটি আনন্দময় দৃষ্টিভঙ্গী। পরম আনন্দই সজ্ঞান জীবনের লক্ষ্য।


খাদ্য, তন্তু, ঘর নির্মাণের উপকরণ, ওষুধ, জ্বালানি, সার ও শক্তি উৎপাদনের জন্য নয়াকৃষি। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে এখনো জ্বালানির জন্য জৈব উৎসের ওপর নির্ভরশীল। নয়াকৃষি জ্বালানি চাহিদা নিশ্চিত করবার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।


অন্যদিকে নয়াকৃষির অতি অগ্রসর বৈজ্ঞানিক ভিত্তি বুঝতে যাঁরা অক্ষম তাঁরা অনেকেই একে পুরানা জমানার কৃষি মনে করেন। পুরানা জমানার কৃষি কিন্তু আধুনিক কৃষির মতো ধ্বংসাত্মক নয়। তবে পুরানা জমানার কৃষি বলতে তাঁরা বোঝান নিম্ন মানের প্রযুক্তি এবং ল্যাবরেটরি মার্কা বিজ্ঞানের অনুপস্থিতি। এঁরা অবশ্যই কুসংস্কারাচ্ছন্ন। এঁদের ধারণা রাসায়নিক সার-বিষ, সেচের যন্ত্র এবং ল্যাবরেটরীতে উৎপাদিত এবং কোম্পানির বাজারজাত বীজ ব্যবহার করলেই সেটা ‘উন্নত’ প্রযুক্তি। বিষে পরিবেশ বিপর্যয় সহ সবদিক ধ্বংস হলেও যাঁরা আধুনিক কৃষির খাদ্য খান তাঁরা কি একবারও ভেবে দেখেছেন যে, প্রতিদিন পরিবারে ছেলেমেয়েকে তাঁরা বিষ খাওয়াচ্ছেন এবং নিজেও খাচ্ছেন। তথাকথিত ‘আধুনিক’ কৃষিই আসলে পুরাতন পশ্চাতপদ কৃষি। কারণ সার ও বিষ ছাড়া ফসল উৎপাদন করা যায় এবং অতি সহজেই অধিক ফলন ফলানো সম্ভব সেই বিজ্ঞানের খবর ‘আধুনিক’-দের কানে পৌঁছায় নাই। কিম্বা পৌঁছালেও কীটনাশক, সার ও পাম্প কোম্পানির স্বার্থে তাঁরা সেটা বলছেন না। চেপে যাচ্ছেন।

প্রাণ ও পরিবেশ ধ্বংস করে যে আধুনিক কৃষির চল হয়েছে নতুন জ্ঞানবিজ্ঞান ও আবিষ্কারের দিক থেকে তা এখন পশ্চাতপদ মান্ধাতার আমলের হয়ে গিয়েছে। এটা কৃষি না হয়ে কারখানা হয়ে উঠেছে। বিষ-সার-পাম্প মেরে ইনড্রাসট্রিয়াল ফুড প্রডাকশান (বা কারখানায় খাদ্য উৎপাদন) আর মাঠে ফসল ফলানো কৃষি এক কথা নয়। সার-বিষ-পাম্প মারলেই উৎপাদন বাড়ে এটা এক ধরণের কুসংস্কার ও অবৈজ্ঞানিক চিন্তা। অবৈজ্ঞানিক, কুসংস্কারবাদী ও বহুজাতিক কোম্পানির মুনাফা লুটের কৃষির বিপরীতে নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করার জন্য কৃষকরা তাঁদের আবিষ্কারের নাম দিয়েছেন নয়াকৃষি। মানুষের জন্য এবং অন্য যে কোন প্রাণীর জন্যে ক্ষতিকর পদ্ধতি বাদ দেওয়া, পদার্থ বিজ্ঞান, জীব বিজ্ঞানসহ বিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রের নতুন আবিষ্কার ও অভিজ্ঞতা কৃষি কাজে ব্যবহার, প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষা ও বিকাশ এবং সবচেয়ে বড় কথা কৃষকের জ্ঞানের ভিত্তি, ক্ষমতা এবং সাংগঠনিক শক্তি বিকশিত করে তোলাই নয়াকৃষির মোদ্দা কাথা।

প্রথম অবস্থায় কৃষকের পক্ষ থেকে উদ্যোগ ছিল রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহারের বিকল্প সন্ধান। প্রথমে তাঁরা জৈব সার এবং জৈব কীটনাশকের ব্যবহারও করেছেন। পরে দেখা গেলো আসলে শুধু রাসায়ানিক হলেই নয়, কীটনাশক জৈব হলেও ব্যবহারের প্রয়োজন পড়ে না। জৈব কীটনাশকও প্রাণ হত্যা করে। কৃষকরা নিজেরাই পদ্ধতি খুঁজে পেলেন। আসলে পোকা দমন বলে কিছু নেই, মূল কথা হচ্ছে কি করে ফসলের সাথে কীটপতঙ্গের ব্যবস্থাপনা একীভূত করা যায়। একক ফসল না করলে তো অনেক পোকাই আসে না। মিশ্র ফসলের ক্ষেত্রে এক ফসলে যা অপকারী, অন্য ফসলে তা উপকারী। তাহলে ফসলে পোকা লাগা কথাটার তো কোন মানে হয় না। তাছাড়া পাখি এবং অন্যান্য প্রাণী থাকলে তারাই নিজেদের আহার হিশেবে পোকা খেয়ে ফেলে। এভাবে নয়াকৃষির কৃষকদের মধ্যে এই ধারণা জন্ম নেয় যে তাঁরা কোন অবস্থাতেই প্রাণ হত্যাকারীর ভূমিকা নেবেন না। এই সিদ্ধান্তের যে নৈতিক আনন্দ তার তুলনা চলে না। মানুষ সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব, অতএব তাকেই সকল প্রাণ সংরক্ষণ, রক্ষা ও বিকাশের দায়িত্ব নিতে হবে, এই উপলব্ধি নয়াকৃষির কৃষকের জীবন বদলে দেয়। তার শ্রেষ্ঠত্বের অর্থ দাঁড়ায় সৃষ্টি রক্ষা ও বিকাশের নৈতিক দায়িত্ব গ্রহণে।

ফলে কেউ নয়াকৃষি করবেন বলে যদি সিদ্ধান্ত নেন তাহলে তাঁর প্রথম পরীক্ষা হয় তিনি কীটনাশক ব্যবহার বন্ধ করেছেন কি না। এভাবে নয়াকৃষিতে প্রথম নীতি হিশেবে স্থান পেলো কীটনাশক বন্ধের বিষয়টি। এরপর সার ব্যবহার, বীজ সংরক্ষণ করা, মাটির তলার পানি ব্যবহার। একে একে কৃষির ব্যবহারিক প্রতিটি ক্ষেত্রে একটি করে নীতি ঠিক হয়ে গেলো।

নয়াকৃষি দশ নীতি

নীতি মানে এককাট্টা একরকমের ‘মডেল’ নয়। প্রতিটি নয়াকৃষি কৃষক পরিবারই ভিন্ন, নয়াকৃষি মানেই বৈচিত্র্য। সেই জন্য কৃষক বলে:

নীতি শুধু ভাবগীতি,
অঞ্চল ভেদে চাষ নীতি।

নয়াকৃষির কৃষক ভাই ও বোনেরা ছন্দের মাধ্যমে, গানে গানে এবং কবিতায় যতোভাবে সম্ভব তাঁদের কথা আর দশজন কৃষকের কাছে পৌঁছে দিতে চান। সব কৃষক ছাপার অক্ষর পড়তে পারবেন না বলে তাঁরা কথা এবং গানের মাধ্যমকেই বেশী প্রাধান্য দিয়েছেন।

দশনীতি কৃষকরা ধীরে ধীরে নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলে ঠিক করেছেন। প্রথমে কথাগুলো তাঁরা সংক্ষিপ্ত ভাবে ভাবতে শুরু করেন। যতোই তাঁদের অভিজ্ঞতা বেড়েছে প্রতিটি নীতির পেছনে তাঁদের বৈজ্ঞানিক চিন্তাও হয়েছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় কৃষকরা নতুন নতুন গবেষণা এবং কাজে এখন অভিজ্ঞ হয়ে উঠেছেন। কৃষকের সংখ্যা বাড়ছে, নতুন এলাকার কৃষকরা নয়াকৃষি আন্দোলনে যুক্ত হবার জন্যে আগ্রহ প্রকাশ করছেন।

এটা দশনীতির পঞ্চম সংস্করণ। নয়াকৃষি আন্দোলনের কৃষকদের দীর্ঘ বছরের অভিজ্ঞতার ফসল হিশেবে নিশ্চিত বিষয়গুলো নীতি আকারে হাজির করবার কাজ কয়েক বছর পর পর করা হয়। প্রতিবারই নতুন চিন্তা ও অভিজ্ঞতার আলোকে নীতির বিকাশ ঘটে। নীতিগুলোকে এমন ভাবে সাজানো হয়েছে যে কৃষকের দিক থেকে সরল কৃষি ব্যবস্থা থেকে আরো জটিল কৃষি নকশা চর্চা করবার ধাপগুলোও যেন এতে ধরা পড়ে। নীতিগুলো চূড়ান্ত করবার সময় কৃষকরা সবসময়ই নিজেদের মধ্যে আলাপ করেছেন। শুধু কৃষক নয়, সকল এলাকার জেলে, তাঁতী, কামার, কুমারসহ গ্রামের প্রতিটি পেশার মানুষের পরামর্শও গ্রহণ করা হয়েছে। অন্যদিকে নয়াকৃষি আন্দোলনের সাথে যুক্ত কর্মী, নবপ্রাণ আন্দোলনের শিল্পীরা মিলেও দিনে রাতে বিস্তারিত আলাপ আলোচনা করে এই নীতিগুলো চুড়ান্ত করবার ক্ষেত্রে কৃষকদের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে সহযোগিতা করেছেন।

বীজ ও প্রাণবৈচিত্র্যকেন্দ্রিক কাজ নয়াকৃষির বিশেষ বৈশিষ্ট্য। সার ও কীটনাশকমুক্ত অন্যান্য জৈব চাষাবাদ পদ্ধতির সঙ্গে নয়াকৃষির পার্থক্য হচ্ছে নয়াকৃষি শুধু জৈব চাষাবাদই নিশ্চিত করে না, একই সঙ্গে এই পদ্ধতি- (১) প্রাণবৈচিত্র্য নির্ভর। (২) বাংলাদেশের কৃষকের ঘরে হাজার বছর ধরে বিকশিত করে তোলা অতি উন্নতমানের বীজ ব্যবহার করে, (৩) ফলে নয়াকৃষির ফসলের গুণ অপরিসীম, স্বাদে গন্ধে পুষ্টিতে অতুলনীয় এবং নিরাপদ (৪) প্রাকৃতিক শক্তির সঙ্গে অত্যাধুনিক জ্ঞানবিজ্ঞানের সমন্বয় ঘটিয়ে উন্নত পদ্ধতিতে চাষাবাদের কারণে নয়াকৃষি সুদক্ষ এবং (৫) গুণ ও মানে অতুলনীয় হবার কারণে ক্রেতার কাছে আদরণীয়।

নয়াকৃষি নীতি: ১

জমি নাশ প্রাণ নাশ
কীটনাশকে সর্বনাশ
নয়াকৃষির পথ ধর
বিষ ব্যবহার বন্ধ কর।

বিষ ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। সকল প্রকার কীটনাশকের ব্যবহার পুরোপুরি বন্ধ করা নয়াকৃষির প্রথম নীতি। এই ব্যাপারে কোন আপোষ নাই।

নয়াকৃষি কোন প্রকার বিষ ব্যবহারে বিশ্বাস করে না। এমন কি জৈব কীটনাশক ব্যবহার করাও নয়াকৃষি চাষাবাদে অপ্রায়োজনীয়।

নয়াকৃষি ফসলের ‘পোকা’ ও ‘রোগবালাই’ ব্যবস্থাপনার জন্য অত্যন্ত সফল ও কার্যকর পদ্ধতি চর্চা করে।

এক: স্থানীয় বা দেশী বীজ ঘরে রাখা চাই। কারণ দেশীয় বীজের রোগবালাই প্রতিরোধের ক্ষমতা অসামান্য।

দুই: মাটির পুষ্টি ও স্বাস্থ্য রক্ষা যাতে মাটি জীব, অণুজীব, কীটপতঙ্গ, কেঁচো কেন্নো নিয়ে জীবন্ত থাকে। বিষ, সার ব্যবহার ও ট্রাক্টর দিয়ে চাষ করলে মাটি মরে যায়।

তিন: মিশ্র ফসলের চাষ।

নয়াকৃষি কৃষকদের গবেষণাসহ বহু বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষায় প্রমাণিত ‘রোগবালাই’ প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পন্ন স্থানীয় জাতের বীজ ব্যবহার ও মিশ্রফসলের চাষ করলে জমিতে ‘পোকামাকড়ের আক্রমণ’ ও রোগবালাই হওয়া অসম্ভব।

সম্পদ সংরক্ষণ ও সমৃদ্ধি অর্জনের দিক থেকে বিষের ব্যবহারে শুধু কৃষক সমাজ নয় সামগ্রিক জাতীয় অর্থনীতি পঙ্গু হয়ে গিয়েছে। গাছপালা উদ্ভিদসহ মাছ, হাঁস-মুরগী, গরুবাছুর, মহিষ সকল ক্ষেত্রেই প্রাণসম্পদ আজ সংকটাপন্ন। ফলে জাতীয় প্রবৃদ্ধি ব্যাহত হচ্ছে। নয়াকৃষি বিশ্বাস করে প্রকৃতি জগতে প্রতিটি প্রাণীর হক আছে। তাই বিষ প্রয়োগে প্রাণ হত্যা শয়তান ছাড়া কোন মানুষ করতে পারে না বলে নয়াকৃষির কৃষক সমাজ বিশ্বাস করে।

দিনের দিন গেল শয়তানের কুমতলবে
ধর্ম আমার হোল কোথায়
নয়াকৃষির চাষের ক্ষেতে তোমার রূপে
সকল প্রাণীর প্রাণ জুড়ায় ॥

যারা প্রাণ হত্যা, প্রাণের ক্ষতিসাধন বা জীবন রক্ষা ও বিকাশে পরিবেশ ধ্বংস করে তারা শুধু মানুষের নয় সমস্ত প্রাণীজগত ও বিশ্বজগতের দুষমন। এ যুগে এরাই আসল শয়তান যারা কীটনাশক ব্যাপারি ও বহুজাতিক কোম্পানির মুনাফা রক্ষার জন্য সৃষ্টি প্রক্রিয়ার ভিত্তি ধ্বংস করতে উদ্যত হয়েছে। এদের বিরুদ্ধে কৃষকদের রুখে দাঁড়াতে হবে। আমাদের খাদ্য বিষাক্ত, পানি বিষাক্ত, জীবন চক্রের মধ্যে বিষ ঢুকে গিয়েছে। বিষে প্রাণবৈচিত্র্য ধ্বংস করে, মানুষের শরীরে প্রত্যক্ষভাবে বিষক্রিয়া ঘটায়। আমরা কি চাই আমাদের সন্তানেরা বিষে নীল হয়ে ও নানান দুরারোগ্য অসুখে মরুক? আমরা কি চাই নিরাপদ পানির অভাবে বাংলাদেশ কারবালা হয়ে যাক ?

অতএব আর বিষ ব্যবহার সহ্য করা যায় না।

নয়াকৃষি নীতি: ২

কৃষকের হাতে ঘরে গ্রামে পাড়া এলাকায়
বীজের সুরক্ষা ছাড়া কিছুতেই রক্ষা নাই

কৃষকের হাতে, ঘরে ও মাঠে বীজ রাখতে হবে। বীজই নয়াকৃষির ধ্যান, বীজ রক্ষাই নয়াকৃষির পথ। বীজেই বিপ্লব। বীজকে নিরিখে রেখে কৃষিকাজই নয়াকৃষির নীতি।

বীজ ও প্রাণবৈচিত্র্যকেন্দ্রিক কাজ নয়াকৃষির বিশেষ বৈশিষ্ট্য।

বীজেই প্রকৃতি, বীজেই সৃষ্টি। সৃষ্টির মূলেই বীজ। বীজ একদিকে প্রকৃতির পুনরুৎপাদনের উপায়, বীজ ছাড়া চাষাবাদ চলে না। অন্যদিকে বীজ নিজেই নিজের প্রক্রিয়ার ফল, অর্থাৎ বীজেই আবার ফসল। অতএব বীজ বা প্রাণকোষের মর্ম জানা, বোঝা এবং প্রাণের বিকাশ, বৈচিত্র্য ও সুরক্ষা নিশ্চিত করা নয়াকৃষির নীতি। এই লক্ষ্যে দেশী, বিদেশী ও বহুজাতিক কোম্পানির বীজডাকাতি ও বীজ পেটেন্ট করার বিরুদ্ধে নয়াকৃষি সংগ্রাম করে।

এক বীজে কোটি বীজ এক বীজে বিশ্ব
বীজ হাতছাড়া হলে হয়ে যাবে নিঃস্ব
চাষী মেয়ে জানে বীজে প্রকৃতি গুপ্ত
জগতের পুরো ছবি বীজে বীজে সুপ্ত
ঘরে ঘরে বীজ রাখো গ্রামে গড়ো বীজাগার
নারীর কর্তৃত্বে হবে সকলের উপকার।

দুনিয়াতে এখন তিন ধরণের সম্পদের ওপর দখলদারি কায়েমের জন্য যুদ্ধ চলছে: তেল, বীজ ও পানি। তেলের যুদ্ধ আমরা ইরাক, আফগানিস্তানসহ আরো বহু ক্ষেত্রে দেখছি। লক্ষ লক্ষ প্রাণ আত্মাহুতি দিয়েছে এবং ভবিষ্যতে আরো বহু প্রাণ শুধু ধনী দেশগুলোর জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করবার জন্য প্রাণ দেবে।

ধনী দেশগুলো ইতিমধ্যেই পানিকে ‘প্রাইভেটাইজেশান’ অর্থাৎ কোম্পানির হাতে তুলে দিচ্ছে যাতে বাজার থেকে কিনে কিম্বা কোম্পানিকে রয়্যালটি না দিয়ে কেউ পানি ব্যবহার করতে না পারে। বাংলাদেশে আমরা এখন বোতলের পানি বাজার থেকে কিনে খাচ্ছি। কিছুদিন পর অন্যান্য দেশের মতো আমাদের নদীনালাগুলোও কোম্পানির কাছে বিক্রি হয়ে যেতে পারে এবং তাদের ধার্য করা দাম, খাজনা বা রয়্যালটি না দিলে আমরা পানি ব্যবহার করতে পারব না।

লর্ড ক্লাইভ পলাশির যুদ্ধে ভূমি দখল করে ঔপনিবেশিক শাসন প্রতিষ্ঠা করেছিল। এই কালে ভূমি দখল করার প্রয়োজন নাই। এই কালের নব্য হানাদাররা যদি আমাদের বীজ দখল করে নেয় তাহলে কী দিয়ে আমরা চাষাবাদ করব? তাদের কোম্পানি ও এই দেশীয় এজেন্টদের কাছে আমাদের পুরো কৃষি ব্যবস্থা জিম্মি হয়ে যাবে। এই পরাধীনতা থেকে আমরা মুক্ত হব কীভাবে ?

বীজের ওপর পেটেন্ট বা প্রাণের ওপর কোম্পানির মালিকানা প্রতিষ্ঠার জন্য ধনী দেশ ও বহুজাতিক কোম্পানিগুলো মরিয়া হয়ে প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। অথচ বীজ হচ্ছে সকলের সম্পদ। যদি আমরা এই বীজ হারাই, হানাদার বা বীজ ডাকাতরা যদি আমাদের বীজ ডাকাতি করে নিয়ে যেতে পারে, কিম্বা বীজ পেটেন্ট করে বা বীজের ওপর বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তির অধিকার কায়েম করে তাহলে কৃষি ও খাদ্য ব্যবস্থার ওপর আমরা আমাদের সার্বভৌমত্ব হারাব, পরাধীন হয়ে যাব। ইংরেজ ঔপনিবেশিক শাসন, শোষণ ও পরাধীনতার চেয়েও এই পরাধীনতা হবে আরো মারাত্মক।

বীজে নাই কোম্পানির
পেটেন্টের অধিকার
বাংলার চাষী আজ
ঘরে ঘরে হুঁশিয়ার ॥

অতএব নিজের বীজ বা প্রাণসম্পদের ওপর সার্বভৌম অধিকার কায়েম ছাড়া আমাদের টিকে থাকার কোন পথই নাই। এই লক্ষ্যেই নয়াকৃষির নীতি হচ্ছে:

এক: কখনোই বা কোন অবস্থাতেই বীজ, প্রাণকোষ বা কোন প্রকার প্রাণ সম্পদ কৃষকের ঘর থেকে বা এলাকার সঞ্চয় থেকে হারিয়ে যেতে দেয়া যাবে না।

অতএব গ্রাম পর্যায়ে সকলে মিলে বীজ বা প্রাণ সম্পদ সংরক্ষণের উদ্যোগ কৃষকের বাঁচামরার লড়াই গণ্য করে গড়ে তুলতে হবে। কৃষক যদি বাঁচে, যদি আমরা খেয়ে-পরে বাঁচতে পারি তাহলে দেশ ও দশের মানুষও বাঁচবে।

দুই: সকল প্রাণসম্পদ কৃষকের ঘরে কিম্বা মাঠে কৃষকেরই নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।

সেই লক্ষ্যে কৃষক পরিবারকে বীজ সংরক্ষণ ও পুনরুৎপাদনের প্রধান কেন্দ্রবিন্দু হিশাবে গড়ে তুলতে হবে। গ্রাম পর্যায়ে সকলে মিলে, অতএব, অবিলম্বে বীজ, প্রাণকোষ বা প্রাণসম্পদ সংরক্ষণের ‘বীজাগার’ বা নয়াকৃষির ‘বীজসম্পদ’ গড়ে তুলতে হবে। জাতীয় বীজাগার বা জিন ব্যাংককে কৃষকের নিয়ন্ত্রণে কৃষকেরই স্বার্থ রক্ষার জন্য কাজ করতে হবে।

তিন: প্রাণের মালিকানা দাবি করা ভয়ানক অপরাধ।

অতএব বীজ, প্রাণকোষ বা প্রাণ সম্পদ পেটেন্ট করার দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চক্রান্ত রুখতে হবে। বীজ, প্রাণকোষ বা প্রাণসম্পদ বিদেশী কোম্পানি ও অন্যান্য বীজডাকাতদের চুরি করে নিয়ে যাওয়া বা দখল যেমন প্রতিহত করতে হবে, তেমনি চোরাই বীজ থেকে নতুন জাত উদ্ভাবন করে খোদ চাষীর কাছে বিক্রি করার বজ্জাতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। মুনাফার জন্য বাংলাদেশের কৃষিব্যবস্থাকে বীজ কোম্পানির অধীনস্থ করার ষড়যন্ত্র চলছে, তা প্রতিহত করার জন্য কৃষক ও অন্য সকলকেই সংগঠিত হতে হবে।

চার: কৃষক নিজের হাতে বীজ রাখতে পারেন না এমন বীজ বাজারজাতকরণ বা চাষ করা নয়াকৃষির নীতির পরিপন্থী। এ ব্যাপারে কোন আপোষ নাই।

অতএব উন্নত টেকনলজি বা উচ্চফলনশীলতার নামে পেটেন্ট করা বীজে বাজার সয়লাব করে বাংলাদেশের কৃষি ও বীজব্যবস্থা ধ্বংসের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। এই ক্ষেত্রে কৃষক ছাড়াও সকলকে সচেতন ও সংঘবদ্ধ করতে হবে।

পাঁচ: নারীর নেতৃত্ব মানতে হবে।

বীজ সংরক্ষণের জ্ঞান এবং কৌশল অত্যন্ত মূল্যবান। নয়াকৃষির কাছে গ্রামের মহিলাদের এই মৌলিক জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতার মূল্য অসাধারণ। বীজ এবং প্রাণ সম্পদ কৃষকের ঘরে কিংবা মাঠে নারীদের নিয়ন্ত্রণে থাকে। হাজার হাজার বছর ধরে নারীরা বীজ এবং প্রাণ সম্পদ নিজেদের ঘরে এবং ক্ষেতে সংরক্ষণ করছেন কি ?

নয়াকৃষি নীতি: ৩

জমির পুষ্টি মাটির স্বাস্থ্যে
সার-কেমিকেল মন্দ
জমির স্বাস্থ্য বজায় থাকলে
মন্দ কারবার বন্ধ।

সার-কেমিকেল অবিলম্বে বন্ধ করা নয়াকৃষির নীতি। নয়াকৃষিতে রাসায়নিক সার ব্যবহারের প্রয়োজন নাই। প্রথম অবস্থায় জৈব সার প্রয়োজন হতে পারে কিন্তু মাটির স্বাস্থ্য ও পুষ্টি বজায় রাখার ব্যবস্থাপনা জানলে মাটি নিজেই নিজের উর্বরতা রক্ষা করতে পারে।

নয়াকৃষি চাষাবাদের লক্ষ্য হচ্ছে মাটি যেন নিজেই নিজের পুষ্টি ও সার নিজেই তৈরি ও রক্ষা করে ক্রমে ক্রমে উর্বর হয়ে উঠতে সক্ষম হয় সেই চাষ পদ্ধতি অনুসরণ করা। নয়াকৃষি কৃষকরা দীর্ঘদিনের গবেষণায় দেখেছে পলিমাটির দেশ এই বদ্বীপে কোন প্রকার সার ছাড়া চাষাবাদ করাই স্বাভাবিক, সার ব্যবহার অস্বাভাবিক। এখনও এই অবস্থায় যাওয়া মোটেও কঠিন নয়। জৈব বা অজৈব কোন সারই সুস্থ ও সুপুষ্ট মাটির প্রয়োজন নাই। কিম্বা বাইরে থেকে কোন কম্পোষ্ট দেয়ারও প্রয়োজন পড়ে না। দরকার মাটির ব্যবস্থাপনা জানা ও শেখা এবং সেই জ্ঞান কাজে লাগালে মাটি নিজেই তখন নিজের পুষ্টি ও স্বাস্থ্য নিজেই রক্ষা করতে সক্ষম। দরকার হচ্ছে সঠিক ব্যবস্থাপনা।

বাইরে থেকে সার দেবার অভ্যাস তৈরি করেছে আধুনিক কৃষি। সেই কারণে এক অদ্ভুত কুসংস্কারও গেঁড়ে বসে আছে যে বাইরে থেকে সার না দিলে বুঝি চাষাবাদ হয় না। এগুলো বাজে কথা। সুস্থ মানুষকে স্যালাইন যেমন দেওয়া পাগলামি, সুস্থ ও উর্বর জমিতে সার দেওয়াও পাগলের বুদ্ধি ছাড়া আর কী!!

কোন কোন জমিতে অবিলম্বে সার-কেমিকেলের ব্যবহার বন্ধ করা সম্ভব না হলে ধাপে ধাপে পরিকল্পিতভাবে কমিয়ে এনে একসময় ব্যবহার সম্পূর্ণ বন্ধ করাই নয়াকৃষির পথ। বর্তমান কেমিকেল পদ্ধতি বাদ দিয়ে কৃষক নয়াকৃষি পদ্ধতি গ্রহণের সময় কম্পোষ্ট ও সবুজ সার ব্যবহার করে। কিন্তু মাটির রক্ষণাবেক্ষণ, জমির পুষ্টি ও খাদ্য সরবরাহ, জমিতে বসবাসকারী কেঁচো, কুঁচড়ো জীব ও অণুজীব রক্ষা, নীল, সবুজ, শ্যাওলা জন্মানোর পরিবেশ তৈরী করা, জমিতে নাইট্রোজেন বাড়াতে সক্ষম গাছপালা, লতাপাতা ও ঝোপঝাড়ের ব্যবহার ও জমির স্বাস্থ্য রক্ষার উন্নত কৌশল চাষী রপ্ত করার পর নয়াকৃষি পদ্ধতিতে একটা পর্যায়ের পর জমিতে কোন সার দেবারই প্রয়োজন পড়ে না। তখন,

কেঁচো করে হালচাষ
কীটে মই নিড়ানি
আলে বসে কৃষকের
ঘুমে চোখ ঢুলানি ॥


প্রাণবৈচিত্র্য ভিত্তিক জমির ব্যবহার নিশ্চিত করার মাধ্যমে একর প্রতি নয়াকৃষিতে ফলন যে কোন ধরণের চাষাবাদের চেয়ে বেশি। একই সঙ্গে চাষাবাদের সঙ্গে জমিতে গাছ-গাছালির চাষ ও মিশ্র ফসলের অত্যন্ত বিকশিত পদ্ধতি অনুসরণ করার মধ্য দিয়ে নয়াকৃষি প্রমাণ করে প্রাণবৈচিত্র্য ভিত্তিক উৎপাদন পদ্ধতিই বাংলাদেশে খাদ্যে সার্বভৌমত্ব অর্জন করতে পারে, কোম্পানির বীজে বা পরিবেশ বিধ্বংসী পাশ্চাত্যের ইনড্রাসট্রিয়াল ফুড প্রডাকশান বা কারাখানার খাদ্য উৎপাদন নয়।


নয়াকৃষি নীতি: ৪

জাত প্রজাতে মিশ্র ফসল, মিশ্র আবাদ করা
এক একরে হাজার একর ফসল আদায় করা

এককাট্টা ফসল অর্থাৎ এক প্রজাতি বা এক জাতের ফসল নয়াকৃষি করে না। সবসময়ই মিশ্রফসল ও শস্যাবর্তনে বাহারি ফসল চাষ করে এক একর থেকে হাজার একরের ফলন আদায় করা নয়াকৃষির নীতি।

কারণ (১) মিশ্র ফসল প্রাণ সম্পদের বিকাশ ঘটায়, (২) একর প্রতি জাত ও বৈচিত্র্য সংরক্ষণ করে ও বিকাশ ঘটায়, (৩) একর প্রতি সামষ্টিক বা সামগ্রিক ফলন বাড়ায়, (৪) যেহেতু একই জমিতে বারবার একই ফসল লাগানো হয় না অতএব ভিন্ন জাতের শস্য, গাছপালা মাটি থেকে ভিন্ন পুষ্টি নেয় বলে মাটির স্বাস্থ্য ভাল থাকে, (৫) কৃষক মাটির পুষ্টির জন্য জাত বা প্রজাতি নির্বাচন করতে পারে, (৬) একই সঙ্গে নিজের ও বাজারের ভোগ্য ফসল উৎপাদনের জন্য বিভিন্ন কার্যকর পরিকল্পনা গ্রহণ করতে পারে, (৭) মিশ্র ফসল চাষ করলে যেহেতু এক ফসলের ওপর কৃষকের ভাগ্য নির্ভর করে না অতএব কৃষক কখনই আবহাওয়ার ওঠানামা বা প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিপদে বা বিপর্যয়ে পড়ে না এবং তেমনি, (৮) একক ফসলের ওপর নির্ভর না করলে বাজারের ওঠানামার জন্য কৃষক কোন আর্থিক বিপর্যয়ে পড়ে না বা লোকসান দিয়ে সর্বস্ব হারায় না, (৯) ফসল উৎপাদন খরচ কম ফলন বেশি, (১০) শস্য কীটপতঙ্গ রোগ-বালাই মুক্ত থাকে। এই জন্যই নয়াকৃষি একক ফসলের পরিবর্তে মিশ্র ফসল ও শস্যাবর্তন পদ্ধতি অনুসরণ করে।

এক প্রজাতির আবাদ করা
জ্যান্তে মরার কাফন পরা
প্রকৃতির প্রাণবৈচিত্র্যে দীক্ষা
নয়া কৃষির আদি শিক্ষা ॥

একক ফসলের পরিবর্তে পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন ফসলের আবাদ করলে ফসলের বৈচিত্র্য ও ফলন যেমন বৃদ্ধি পায় তেমনি পোকা, মাকড় ও আগাছা ব্যবস্থাপনা সহজ হয়। মাটির গঠন ও প্রকৃতি পরিবর্তিত হয়। মাটি গঠনে সহায়তাকারী অণুজীবের বংশ বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। ফলে মাটির উর্বরতা শক্তি বেড়ে যায়।

অতএব নয়াকৃষি মানেই ঋতুর পর ঋতুতে এককাট্টা বা একই ধরণের জাত বা প্রজাতির আবাদ বাদ দিয়ে নানান জাত ও প্রজাতির বিচিত্র ও বাহারি চাষ। যেমম, এক সঙ্গে অনেক জাত ও প্রজাতির চাষ। অনেক ফসলের আবাদ বা মিশ্র চাষ; এক ফসলের মাঝখানে অন্য ফসল লাগানো একই জমিতে প্রতি মৌসুমে একই ফসল আবাদ না করে ফসল বদলের চক্র অনুসরণ। বিচিত্র ও বাহারি ফসলের চাষ কীটপতঙ্গের আক্রমণ ও রোগবালাইয়ের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার শ্রেষ্ঠ উপায়। নয়াকৃষি শুধু শস্য উৎপাদন করে না, বৈচিত্র্যও উৎপাদন করে। বিচিত্র ও বাহারি ফসল উৎপাদন করে প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদের বিকাশ ঘটায়, কৃষককে ধনশালী করে ও সকলের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। তাছাড়া বিচিত্র ও বাহারি চাষের ফলে বন্যা খরা হলেও চাষাবাদের ক্ষেত্রে কখনই কৃষকের চরম বিপর্যয় ঘটতে পারে না। যে কোন অবস্থাতেই চাষী কোন না কোন ফসল ঘরে তুলতে পারে। প্রাকৃতিক বিপর্যয় সব জাত বা প্রজাতির ধ্বংস সাধন করতে পারে না। সেই কারণে বন্যা খরার উপযোগী সঠিকজাত নির্বাচনও নয়াকৃষির প্রধান বৈশিষ্ট্য।

জমিতে মৌসুমি শস্য লাগানো ছাড়াও কৃষি জমিতে-বিশেষত জমির আইলে গাছ-গাছালি লাগানো নয়াকৃষিতে জমির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করার একটি পদ্ধতি। গাছ লাগানো মানেই হচ্ছে সবুজের উৎপাদন বাড়া।

গাছের পাতা সূর্যের আলোর সাহায্যে খাদ্য তৈরি করে। পাতার মধ্যে ক্লোরোফিল থাকার কারণে গাছ আলোর শক্তিকে নিজের ও অন্য সকল প্রাণীর খাদ্যে রূপান্তর করতে সক্ষম। চাষাবাদে নয়াকৃষির একটি প্রধান কৌশল হচ্ছে সূর্যের আলোর শক্তিকে যথাসাধ্য সবুজ শক্তিতে- অর্থাৎ গাছপালার সবুজে পরিণত করা। অতএব ‘উৎপাদনশীলতা’ বলতে নয়াকৃষি বোঝে কতো দ্রুত সূর্যের আলো গাছের সবুজে আমরা রূপান্তর ও ধরে রাখতে পারি। সূর্যের শক্তি সবুজ শক্তিতে রূপান্তর এবং সেই শক্তিকে সকল প্রাণের শক্তিতে রূপান্তরই নয়াকৃষির সাধনা।

কৃষির অর্থ শুধু শস্য উৎপাদন নয়, বন বা গাছগাছালিরও আবাদ। অতএব কৃষি জমিতে গাছ গাছালীর চাষ, বিশেষভাবে জমির আইলে গাছ লাগানো নয়াকৃষি উৎসাহিত করে। শুধু শস্য নয়, ফল-মূল, গোখাদ্য, খড়ি ও জ্বালানি, কাঠ বা ঘর তৈরির উপকরণ, ওষুধ ইত্যাদির উৎস এমন যে কোন লতাপাতা গাছ, বা ঝোপঝাড়ের আবাদ নয়াকৃষির চাষাবাদ কৌশলের অন্যতম দিক। মাটিতে নাইট্রোজেন তৈরিতে সক্ষম এমন গাছ, ঝোপঝাড় ও লতাপাতা ধান ক্ষেতের ও সবজি ক্ষেতের চারিদিকে লাগানো কিম্বা শুধুমাত্র সবুজ সারের জন্য সবুজের উৎপাদন নয়াকৃষির জমির উর্বরতা ব্যবস্থাপনার অন্যতম নীতি। নয়াকৃষি সব সময়ই স্থানীয় প্রজাতির গাছপালায় বিশেষভাবে মনোযোগী।

গাছের রান্না সূর্যে সারা
সূর্যে করো চাষ
আলে ক্ষেতে গাছ-গাছালির
ফসল বারো মাস ॥

নয়াকৃষি নীতি: ৫

আবাদি ও অনাবাদি দুই প্রকারে ফলাই ফসল
নয়াকৃষির বিধানে হয় একই কর্মে দুই গুণ ফল ॥

নয়াকৃষিতে কৃষি বা চাষাবাদের অর্থ একই সঙ্গে আবাদি ও অনাবাদি জায়গার ব্যবস্থাপনা- অর্থাৎ আবাদি ফসল উৎপাদনের ধরণেই এমন হতে হবে যেন একই সঙ্গে জমিতে প্রচুর অনাবাদি ফসল পাওয়া যায়। একমাত্র এই পদ্ধতিতেই বাংলাদেশের খাদ্য চাহিদা মেটানো সম্ভব এমনকি মেটানোর পরে রপ্তানিও সম্ভব।

নয়াকৃষি মানে একই সঙ্গে আবাদি ও অনাবাদি প্রকৃতির ব্যবস্থাপনা। মানুষ ও প্রকৃতি উভয়েরই সৃষ্টিশীলতার সুযোগ নেয় নয়াকৃষি।

নয়াকৃষির কারণে খালবিলে মাছ ও অনাবাদি শাকসবজি মিলিয়ে প্রায় চল্লিশ ভাগ খাদ্য শুধু কুড়িয়েই খাওয়া যায়।

গবেষণায় দেখা গেছে প্রাণ, প্রকৃতি ও পরিবেশ যেখানে বজায় ও বহাল রাখতে কৃষক সক্ষম হয়েছে সেখানে কম পক্ষে শতকরা ৪০ ভাগ খাদ্য মানুষ শুধু কুড়িয়েই খেতে পারে। এই খাদ্য উৎপাদনের জন্য আলাদা কোন পরিকল্পনা বা পরিশ্রম করতে হয় না। প্রকৃতি তার নিজস্ব গুণেই আবাদি ফসলের পাশাপাশি অনাবাদি ফসল কৃষককে উপহার দেয়। নয়াকৃষি পদ্ধতিতে চাষাবাদ করার অর্থই হচ্ছে বাংলাদেশের প্রকৃতি ও পরিবেশের কারণে যে খাদ্য আপনাতেই জন্মে তাকে রক্ষা করা। তাহলে চাষাবাদের উন্নত ধরণ ও সত্যি সত্যিই উন্নত কৃৎকৌশল আমরা তাকেই বলব যার ফলে কুড়িয়ে পাওয়া খাদ্যের প্রাপ্তিকে ক্ষতিগ্রস্ত না করে খাদ্য উৎপাদন আরও বাড়ানো সম্ভব হয়। তথাকথিত আধুনিক চাষাবাদে কুড়িয়ে পাওয়া খাদ্য প্রায় স¤পূর্ণই নষ্ট হয়ে যায়, বিশেষত বিষ ও আগাছা নাশকের কারণে ছোট মাছ সহ কুড়িয়ে পাওয়া শাক, ফল ও অন্যান্য খাদ্য পাওয়া যেমন কঠিন একই সঙ্গে তারা বিষাক্ত হয়ে যাবার কারণে খাদ্য হিশেবে তাদের আর ব্যবহার করা যায় না।

নয়াকৃষি নীতি: ৬

নদীনালা খাল বিল
বর্ষার বাংলায়
পাম্প মেরে পানি তোলা
ঘোরতর অন্যায় ॥

নয়াকৃষি মাটির তলার পানি ধ্বংস করা ও আর্সেনিকে পরিবেশ বিষাক্ত ও স্বাস্থ্য নষ্ট করার বিরোধী। বাংলাদেশ মিষ্টি পানিতে দুনিয়ার সবচেয়ে সমৃদ্ধ দেশ যার দাম তেল, দুধ এমনকি মদের চেয়েও বেশি। এই পানি নষ্ট করা ভয়ানক অপরাধ। পানি সুরক্ষা, সুষ্ঠ ব্যবস্থাপনা ও সেচের জন্য মাটির ওপরের পানির পরিমিত ব্যবহারই নয়াকৃষির নীতি।

মাটির তলার পানি বা ভূ-গর্ভস্থ পানি আমাদের সকলের সম্পদ। অথচ শুধুমাত্র ইরি, ব্রি ধান চাষের জন্য ভূ-গর্ভস্থ পানির ব্যবহারের ফলে বাংলাদেশ এখন ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয়ের সম্মুখিন। বিস্তীর্ণ চাষের জমির মধ্যে মরুভূমির চরিত্র লক্ষণ, মাটিতে লবণাক্ততা বৃদ্ধি এবং পানিতে আর্সেনিক দূষণ ভূ-গর্ভস্থ পানি ব্যবহারের ফল। মাটির উপরিভাগের পানি ব্যবহার ব্যবস্থাপনার বিকাশ ঘটানো নয়াকৃষির নীতি। শ্যালো ও ডীপ টিউবওয়েল বসিয়ে মাটির নীচে থেকে ইরি বোরো ধানের চাষের জন্য পানি তোলার ফলে সামগ্রিকভাবে পরিবেশের বিপর্যয় ঘটছে, অন্যদিকে অন্যান্য ফসলের আবাদ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ডীপ টিউবওয়েল দিয়ে পানি তুলে ফেলার কারণে ফলমূল গাছের ফলনসহ খড়ি গাছ, গোখাদ্যের উপযোগী গাছ, কাঠগাছসহ সবকিছুরই বিকাশ ও বৃদ্ধি ক্ষতিগ্রস্ত। সে করণে নয়াকৃষি নলকূপ বসিয়ে পাম্প দিয়ে মাটির তলা থেকে পানি তোলার বিরোধী। নয়াকৃষি পদ্ধতিতে মাটিতে আদ্রতা রক্ষার বিশেষ বিশেষ গাছ লাগানো, ফসল পরিকল্পনা, মাটি ঢেকে রাখা, বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করা এবং মাটির উপরিভাগের পানির ব্যবহার বাড়ানো হয় এবং পানি ব্যবস্থাপনার উন্নত পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়।

আর্সেনিকে মরছে মানুষ
ডীপ টিউবওয়েল বন্ধ কর
পানির খরচ হিশাব করে
নয়াকৃষির পথ ধর ॥

নয়াকৃষি নীতি: ৭

এক ফসলের হিশাব করা
বোকার স্বর্গে বাস করা,
সকল ক্ষেত্রে লাভ ও ক্ষতি
গুণলে বোকার হবে মতি ॥

শুধু শস্য নয়-খড়, পাতা, খড়ি, মাছ, মুরগী, পশু-পাখি, জীব-অণুজীবসহ সবকিছু হিশাব করলেই লাভালাভ জানা যায়। নয়াকৃষি এক ফসলের হিশাব দিয়ে চাষাবাদের সামগ্রিক লাভালাভের হিশাব করে না। একটি শস্যের পরিবর্তে কৃষকের খামারে সামগ্রিক ফলনের লাভালাভ এবং প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষা ও বিকাশের মধ্য দিয়ে পুরো গ্রাম বা জনগোষ্ঠির পরিবেশগত ও আর্থিক লাভের খতিয়ান করতে শেখা নয়াকৃষির প্রধান একটি নীতি।

শুধু জমিতে বোনা ইরি ধান নয়, ডাল ও তেল জাতীয়, মৎস্য, গবাদি পশু, হাঁসমুরগী, মাছ, ফলের গাছ, কাঠ গাছ, বাঁশের বাগান, খড়ি সংগ্রহের গাছসহ সমস্ত খামারে যে-উৎপাদন হয় সেই হিশাবই একটি কৃষি পদ্ধতি মূল্যায়নের মানদণ্ড।

আধুনিক কৃষিতে কৃষকের ক্ষতি হয়, অথচ লাভ হয় সার, বীজ ও কীটনাশক কোম্পানির, এই সত্য গোপন করবার জন্যই এক ফসলের হিশাবে লাভালাভ দেখানো হয়। ইরি, ব্রি ধান চাষ করতে গিয়ে অন্য সবকিছুর ভয়াবহ ক্ষতির অংক সব সময়ই গোপন রাখা হয়। তথাকথিত সবুজ বিপ্লবের অবৈজ্ঞানিক হিশাব পদ্ধতি ও মিথ্যা তথ্য আজ কৃষকের কাছেই পরিষ্কার হয়ে উঠেছে।

এক ফসলের হিশাব দিয়া
ডাকাতে সব লুটে নিল
কোম্পানির লাভ একশ কোটি
কৃষক ফুটা পয়সা পাইল ॥

নয়াকৃষি নীতি: ৮

আদর যত্নে ঘরে রাখি
হাঁসমুরগী পশু পাখি ॥

প্রাণ এবং প্রাণীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি, সম্পর্ক ও আচরণের মধ্য দিয়েই নয়াকৃষির কৃষক হওয়ার চর্চা ও নয়াকৃষির কৃষক হয়ে ওঠা নির্ভর করে। নয়াকৃষির নীতি হচ্ছে প্রাণ, প্রকৃতি আর নিজের ঘরের মধ্যে ব্যবধান মুছে দিয়ে প্রাকৃতিক নিয়মেই গৃহস্থের সামগ্রিক সম্পদ দ্রুত ও নিশ্চিত ভাবে বাড়ানোর সাধনা করা।

গরু-ছাগল, হাঁস মুরগীসহ সকল গৃহপালিত পশু-পাখি নয়াকৃষি পরিবারের সদস্য। স্থানীয় জাতের হাঁস-মুরগী, গরু-ছাগল, লালন পালন সহজ এবং লাভজনক।

নয়া কৃষির কৃষক পরিবারের কাছে গরু, ছাগল, হাঁস-মুরগীর মতো পুরোপুরি গৃহপালিত পশু-পাখি কিম্বা আধা-গৃহপালিত মহিষ, ভেড়া, কবুতর ইত্যাদি পরিবারের সদস্য হিশাবে গণ্য। প্রাণ এবং প্রাণীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি, সম্পর্ক ও আচরণের মধ্য দিয়েই নয়াকৃষির কৃষক হওয়ার চর্চা নির্ভর করে, শুধু ফসল ফলানো নয়। ভোগবাদী আধুনিক মানুষ সব কিছুকেই নিজের ভোগের বস্তু হিশাবে দেখে, অতএব পশু-পাখিকে তারা মাংস, ডিম বা দুধ ছাড়া ভাবতে পারে না। প্রতিটি প্রাণ বা প্রাণীর নিজস্ব সত্তা আছে, তাদের জীবনের নিজস্ব মূল্য আছে – মানুষের খাদ্য হওয়ার জন্য তাদের সৃষ্টি হয় নি। অতএব অপ্রয়োজনে বা নেহায়েতই ভোগের লিপ্সা মেটানোর জন্য তাদেরকে কসাইয়ের কারখানায় জবাই হওয়ার জন্য অপেক্ষা করে থাকা প্রাণী হিশাবে গণ্য করা অতিশয় নিষ্ঠুর একটি কাজ। এই অনৈতিক মন-মানসিকতা নয়াকৃষি বিরোধিতা করে। নয়াকৃষি আন্দোলন চাষীর বাড়ির খাদ্যের নিশ্চয়তা ও নিরাপত্তা অর্জন করতে বদ্ধ পরিকর কিন্তু এই বাড়িগুলো নিছক ডিম বা মাংস উৎপাদনের কারখানা নয়, বরং প্রাণের আশ্রয় হিশাবেই গণ্য।

ধানচাষের সঙ্গে হাঁস, মাছের সাথে হাঁস কিম্বা ধান, হাঁস ও মাছ এ তিনটাই একত্রে পালন একটি পরিচিত নয়াকৃষি পদ্ধতি। তেমনি বিলে চাষাবাদের ফলে বুনো হাঁস বা পাখির অভয় পরিবেশ তৈরির আরো উন্নত পদ্ধতিও নয়াকৃষি চর্চা করে। একে অন্যের ওপর কিভাবে বিভিন্ন প্রাণ ও প্রকৃতি নির্ভরশীল হয়ে আছে বা থাকে সেই পারস্পরিক সম্পর্ক বোঝা ও জানা নয়াকৃষির একটি প্রধান লক্ষ্য। প্রকৃতির মধ্যে প্রত্যেকেই একে অপরের সঙ্গে কোন না কোন সম্পর্কে আবদ্ধ বা নির্ভরশীল-এই বোধটা সকলের মধ্যে আবার তীব্র ভাবে জাগিয়ে তোলা এবং প্রাণের বৈচিত্র্য ও পরস্পরের বিচিত্র সম্পর্ক রক্ষা ও বিকশিত করাই নয়াকৃষির ধর্ম। প্রাণ উৎপাদনের এই আবাদকে অতএব ডিম উৎপাদনের ভাল পোলট্রি, মাংস উৎপাদনের ভাল কারখানা বা উৎপাদিত নানা ধরণের প্রচুর পণ্য থেকে ভাল টাকা আয় করার উপায় গণ্য করা মানে নিজের বিবেকের কাছে অপরাধী হওয়া। সে কারণেই নয়াকৃষি কখনোই একটা কৃষি পরিবারকে কৃষিপণ্য উৎপাদনের কারখানা আকারে দেখে না। নয়াকৃষি এই ধরণের ভোগবাদী জীবনের বিরোধিতা করে।

নয়াকৃষিতে নীতিগতভাবে স্থানীয় জাতের গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগী ও মাছের প্রাধান্য সব সময়। নয়াকৃষি তাদের বিলুপ্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে এবং প্রতিটি প্রজাতির বিকাশ নিশ্চিত করার চেষ্ট করে। স্থানীয় জাত পরিবেশের দিক থেকেও সহজে খাপ খায়।

নয়াকৃষি গৃহস্থালিতে স্থানীয় জাতের সকল ধরণের গৃহপালিত পশু-পাখি লালন পালন খুবই সহজ এবং লাভজনকও বটে। নয়াকৃষির কৃষকরা কৃত্রিম প্রজননকে নৈতিক এবং সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে মেনে নিতে পারেন না। এটাকে তীব্রভাবে সমালোচনা করেন। তবে তাঁরা প্রাকৃতিক সংকরায়নের বিপক্ষে নন। অর্থাৎ দুই জাতের প্রাকৃতিক মিলনের তাঁরা বিরোধী নন। সেটা অবশ্যই কাম্য। কিন্তু পশুর উপর যে কোন ধরণের কৃত্রিম পরীক্ষা নিরীক্ষার ফলাফল অতি তাড়াতাড়ি মানুষের উপরে গিয়ে বর্তায়। পশুর পরপরই বিজ্ঞানের নামে নারীর ওপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলে। পশুর উপর যে কোন ধরণের অনৈতিক পরীক্ষা পশুকে যেমন নিগৃহীত করে ঠিক তেমনি প্রকৃতির নারীমূলক সত্তাকেও অপমানিত করা হয়। নয়াকৃষির কৃষক নারীরা এই অপমানকে তাঁদের নারী সত্তার অপমান বলে মনে করেন। সন্তান জন্মদান একটি প্রাকৃতিক, আত্মীয় এবং নিবিড়ভাবে সাংস্কৃতিক চেতনার বিষয়। যে কোন কৃত্রিম যান্ত্রিক প্রজনন স্বাভাবিক নিয়ম নীতিকে অপমানিত, তুচ্ছ বা ক্ষুদ্র করে সাংস্কৃতিকবোধকে আহত করে। পশু-পাখির প্রাকৃতিক প্রজননে মানুষ যে-কৃত্রিম জবরদস্তি করে প্রকারান্তরে সেটা তার নিজের প্রতি অনাচার হয়ে দাঁড়ায়।

অন্যদিকে মানুষ, পশু-পাখি, পাছপালার কোন ‘বিশুদ্ধ জাত’ নাই। ‘বিশুদ্ধ’ জাত বা ‘বিশুদ্ধ জাতি’র ধারণা একটি বর্ণবাদী ধারণা। যদি ‘বিশুদ্ধ’ থাকা সম্ভবই হোত তাহলে প্রাকৃতিক বিবর্তন ঘটল কি করে? পৃথিবীতে প্রাণের উৎপত্তির ব্যাখ্যা বা বিবর্তনবাদের ইতিহাসও তখন মিথ্যে হয়ে যায়। এতে বলা হয় অনন্তকাল প্রকৃতি বুঝি একই রকম রয়ে যাবে, কোন প্রজাতির ধ্বংস বা নতুন প্রজাতির উদ্ভব হবে না। নয়াকৃষির কৃষকরা কোন ধরণের বিশুদ্ধ জাতের ধারণায় বিশ্বাস করে না। অতএব আমাদের স্থানীয় বীজ বা গাছ পালা যা কিছু আছে সবই ‘বিশুদ্ধ’ বা পুরো মাত্রায় এই দেশীয় এই প্রকার আজগুবি কল্পনার সাগরেও ভাসে না।

প্রকৃতির প্রাকৃতিক রীতি
যথায় জন্ম তথায় স্থিতি
যথায় প্রকাশ তথায় বিকাশ
সেথায় আপন পরিচিতি ॥

নয়াকৃষি নীতি: ৯

পানির মধ্যে পানির জীবন
পানির মধ্যে প্রাণ
পানির মর্ম না জানলে
নাই চাষের কাণ্ডজ্ঞান
জলের মধ্যে জলজ প্রাণ
মাছের ঘরবাড়ি
জেলের সঙ্গে চাষীর চলে
জলের খবরদারি ॥

জেলের সঙ্গে চাষীর পানির খবরাখবর নেয়া বা পানির খবরদারি করা নয়াকৃষির একটি প্রধান নীতি। যেন মাছসহ সকল জলজ প্রাণের সংরক্ষণ ও বিকাশ ঘটানো যায়। জল ও ডাঙা উভয়ের বৈচিত্র্য নিয়েই নয়াকৃষি।

নয়াকৃষির কারবার শুধু জমি নিয়ে নয়, পানি সম্পর্কে জ্ঞান ছাড়া কৃষির কা-জ্ঞান হয় না। সেচের ব্যাপার শুধু নয়, পানি বিশাল ও বিপুল জগৎ-যেখানে জলজ প্রাণীর জন্ম, নিবাস ও বিকাশ।

জলজ প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণের লক্ষ্যের মধ্যে মাছসহ সকল জলজ প্রাণের সংরক্ষণ ও বিকাশ ঘটানো নয়াকৃষির প্রধান একটি নীতি। নয়াকৃষিতে কৃষির অর্থ শুধু ফসল নয়, ডাঙায় ও পানির সমস্ত জগত নিয়েই নয়াকৃষি। ডাঙার কৃষি যেন পানিকে দূষিত না করে এবং একই ভাবে পানিতে মাছের লালনপালন বা চাষাবাদ যেন ডাঙার পরিবেশে ক্ষতিকর প্রভাব না ফেলে সেই দিকে নয়াকৃষির নজর প্রখর।

মাছ শুধু মানুষের খাদ্য বস্তু নয়, জলজ পরিবেশের অংশ। পানি সম্পকে সঠিক জ্ঞান লাভ এবং প্রকৃতি ও পরিবেশ সংরক্ষণ ও বিকাশের জন্য নয়াকৃষির কৃষক অবশ্যই জেলে সম্প্রদায়ের অভিজ্ঞতা ও জ্ঞানকে বিশেষ মূল্য দেয়। উভয়ের মৈত্রীর ওপর নয়াকৃষি আন্দোলনের ভবিষ্যৎ নির্ভর করে। নয়াকৃষি ফসল ফলায় ডাঙা ও পানি উভয়ে ক্ষেত্রেই। অতএব উভয় বিষয়ে সহজ ও সাবলীল জ্ঞান অর্জন, তাদের সুগভীর সম্পর্ক বিবেচনা এবং তার ভিত্তিতে উন্নত কৃষি সংস্কৃতি গড়ে তোলাই লক্ষ্য। একই সঙ্গে জেলে-চাষীসহ সকল জীবিকার সমন্বয় ঘটিয়ে নয়াকৃষি উন্নততর জীবন গড়ে তোলে। চাষীর পানির খবরাখবর নেয়া বা পানির খবরদারি করা নয়াকৃষির একটি প্রধান নীতি। যেন মাছসহ সকল জলজ প্রাণের সংরক্ষণ ও বিকাশ ঘটানো যায়। জল ও ডাঙা উভয়ের বৈচিত্র্য নিয়েই নয়াকৃষি।

নয়াকৃষির কারবার শুধু জমি নিয়ে নয়, পানি সম্পর্কে জ্ঞান ছাড়া কৃষির কা-জ্ঞান হয়। সেচের ব্যাপার শুধু নয়, পানি বিশাল ও বিপুল জগৎ-যেখানে জলজ প্রাণীর জন্ম, নিবাস ও বিকাশ।

চাষার সঙ্গে ডাঙার কথা
জেলের সঙ্গে জল
নয়াকৃষির আদান প্রদান
চলছে অবিরল ॥

নয়াকৃষি নীতি: ১০

কৃষক করে নয়াকৃষি
উন্নতি সবার জীবিকায়
নয়াকৃষির বদৌলতে
প্রকৃতির ধনে প্রত্যেকের আয়।

গ্রামের প্রাকৃতিক সম্পদ বৃদ্ধি করে জীবিকার নিশ্চয়তা বৃদ্ধি ও আয় উন্নতির সুযোগ বাড়ানো নয়াকৃষির নীতি। কৃষক পরিবারসহ নয়াকৃষি এলাকায় প্রত্যেকটি পরিবারকে আত্ম-নির্ভরশীল ও বাজারব্যবস্থার অধীনস্থ না হয়ে আর্থিক ও প্রাকৃতিক সম্পদ উভয় ক্ষেত্রে সম্পদশালী করা নয়াকৃষির নীতি।


জীবিকার লড়াইয়ে পিছিয়ে পড়া জেলে, কামার কুমারসহ সকলেরই ভরসা নয়াকৃষি


কৃষি কেবল মাত্র খাদ্য উৎপাদনের উৎস নয়। জ্বালানি কাঠ, আঁশ, গৃহনির্মাণ সামগ্রী এবং ওষুধ ইত্যাদির সরবরাহ ও কৃষির উপর নির্ভরশীল। নয়াকৃষি কৃষিকে কেবল মাত্র খাদ্য সরবরাহের উপায় হিশাবে দেখতে নারাজ। কৃষি বনায়ন, জ্বালানি কাঠ, সম্পদ রক্ষা, বহুবিধ ব্যবহার উপযোগী গাছ। ওষুধি গাছ, শাকসবজি সহ দৈনন্দিন জীবনের সার্বিক চাহিদার নিরিখেই কৃষি কাজ করতে হবে।

বনায়নের ক্ষেত্রে বিদেশ থেকে আমদানী করা গাছের চেয়ে স্থানীয় জাতের গাছের প্রতি অধিক গুরুত্ব দিতে হবে। নয়াকৃষির চাষীগণ নানা রকম গবেষণার মাধ্যমে স্থানীয় পরিবেশ উপযোগী গাছ, ফসল ও অন্যান্য কলাকৌশল নির্বাচন ও প্রচলন করেন।

এক নজরে ১০ নীতি

প্রাণ রক্ষা করুণ

নয়াকৃষি নীতি ১: বিষ ব্যবহার এখনই বন্ধ করতে হবে। সকল প্রকার কীটনাশকের ব্যবহার পুরোপুরি বন্ধ করা নয়াকৃষির প্রথম নীতি। এই ব্যাপারে কোন আপোষ নাই।


বিষ মুক্ত কৃষি আবাদ

নয়াকৃষি নীতি ২: কৃষকের হাতে, ঘরে ও মাঠে বীজ রাখতে হবে। বীজই নয়াকৃষির ধ্যান, বীজ রক্ষাই নয়াকৃষির পথ। বীজেই বিপ্লব।


নয়াকৃষির কৃষকের হাতে বীজ

নয়াকৃষি নীতি ৩: রাসায়নিক সার ব্যবহার ছাড়াই শুরুতে জৈব সার দিয়ে চাষাবাদ এবং ক্রমে ক্রমে মাটির সুস্থ ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করে বাইরের কোন সার ছাড়াই মাটির স্বাস্থ্য ও পুষ্টি নিশ্চিত করা নয়াকৃষির পথ।


জৈব সার তৈরি

নয়াকৃষি নীতি ৪: একাট্টা ফসল অর্থাৎ এক প্রজাতি বা এক জাতের ফসল নয়াকৃষি করে না। সবসময়ই মিশ্রফসল ও শস্যাবর্তনে বাহারি ফসল চাষ করে এক একর থেকে হাজার একরের ফলন আদায় করা নয়াকৃষির নীতি।


মিশ্র ফসল

নয়াকৃষি নীতি ৫: আবাদি ও অনাবাদি জায়গার ব্যবস্থাপনা – অর্থাৎ আবাদি ফসল উৎপাদনের ধরণেই এমন করা যেন একই সঙ্গে জমিতে প্রচুর অনাবাদি ফসল ঘরে তুলে বাংলাদেশের খাদ্য চাহিদা, এমনকি অন্য দেশের খাদ্য চাহিদা মেটানো নয়াকৃষির নীতি।


কুড়িয়ে পাওয়া খাদ্য
কুড়িয়ে পাওয়া খাদ্য

নয়াকৃষি নীতি ৬: পানির সুরক্ষা, সুষ্ঠ ব্যবস্থাপনা ও সেচের জন্য মাটির ওপরের পানির পরিমিত ব্যবহারই নয়াকৃষির নীতি। মাটির তলার পানি ধ্বংস করা ও আর্সেনিকে পরিবেশ বিষাক্ত ও স্বাস্থ্য নষ্ট করার বিরোধী নয়াকৃষি। বাংলাদেশ মিষ্টি পানিতে দুনিয়ার সবচেয়ে সমৃদ্ধ দেশ। পানির দাম তেল, দুধ এমনকি মদের চেয়েও বেশি। এই পানি নষ্ট করা ভয়ানক অপরাধ।


পানি

নয়াকৃষি নীতি ৭: নয়াকৃষি এক ফসলের হিশাব দিয়ে চাষাবাদের সামগ্রিক লাভালাভের হিশাব করে না। শুধু শস্য নয়-খড়, পাতা, খড়ি, মাছ, মুরগী, পশু-পাখি, জীব-অণুজীবসহ সবকিছু হিশাব করলেই লাভালাভ জানা যায়। একটি শস্যের পরিবর্তে কৃষকের খামারে সামগ্রিক ফলনের লাভালাভ এবং প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষা ও বিকাশের মধ্য দিয়ে পুরো গ্রাম বা জনগোষ্ঠির পরিবেশগত ও আর্থিক লাভের খতিয়ান করতে শেখা নয়াকৃষির প্রধান একটি নীতি।


খড়

নয়াকৃষি নীতি ৮: গরু-ছাগল, হাঁস মুরগীসহ সকল গৃহপালিত পশু-পাখি অর্থাৎ প্রাণ এবং প্রাণীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি, সম্পর্ক ও আচরণের মধ্য দিয়েই নয়াকৃষির কৃষক হওয়ার চর্চা ও নয়াকৃষির কৃষক হয়ে ওঠা নির্ভর করে। প্রাণ, প্রকৃতি আর নিজের ঘরের মধ্যে ব্যবধান মুছে দিয়ে প্রাকৃতিক নিয়মেই গৃহস্থের সামগ্রিক সম্পদ দ্রুত ও নিশ্চিত ভাবে বাড়ানোর সাধনাই নয়াকৃষির নীতি।


প্রাণ রক্ষা

নয়াকৃষি নীতি ৯: জলের সঙ্গে চাষীর পানির খবরাখবর নেয়া বা পানির খবরদারি করা নয়াকৃষির একটি প্রধান নীতি। যেন মাছসহ সকল জলজ প্রাণের সংরক্ষণ ও বিকাশ ঘটানো যায়। জল ও ডাঙা উভয়ের বৈচিত্র্য নিয়েই নয়াকৃষি।


জেলে

নয়াকৃষি নীতি ১০: গ্রামের প্রাকৃতিক সম্পদ বৃদ্ধি করে জীবিকার নিশ্চয়তা বৃদ্ধি ও আয় উন্নতির সুযোগ বাড়ানো নয়াকৃষির নীতি। কৃষক পরিবারসহ নয়াকৃষি এলাকায় প্রত্যেকটি পরিবারকে আত্মনির্ভরশীল ও বাজার ব্যবস্থার অধীনস্থ না হয়ে আর্থিক ও প্রাকৃতিক সম্পদ উভয় ক্ষেত্রে সম্পদশালী করা নয়াকৃষির নীতি।


কুমার

নয়াকৃষিই আমাদের ভবিষ্যৎ

কোন বইপত্রের তত্ত্ব নিয়ে কিম্বা কারো কারিগরি পরিকল্পনা মাফিক নয়াকৃষি গড়ে ওঠে নি। সর্বনাশের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যই কৃষককে নতুন পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে হয়েছে। নয়াকৃষি আন্দোলনের প্রথম কাজ ছিল কৃষকের অসহায় অবস্থা থেকে মুক্ত করার জন্যে মানসিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক শক্তি তৈরি করা। সংকটের সমাধান যে কৃষকের হাতের কাছেই আছে সেই দিকটা তুলে ধরাই ছিল শুরুর কাজ।

নয়াকৃষি আন্দোলন এমন এক সময়ে শুরু হয়েছে যখন আধুনিক কৃষির নামে রাসায়নিক সার-বিষ ব্যবহারই ফসল ফলানোর একমাত্র পথ বলে প্রতিষ্ঠিত। সেচের জন্যে শ্যালো এবং ডিপ টিউবওয়েল ব্যবহার করে মাটির নীচের পানি তোলা হয়েছে ওপরে। ষাট দশক থেকে শুরু হয়ে এখন পর্যন্ত আধুনিক কৃষির নামে রাসায়নিক সার, বিষ, উচ্চ ফলনশীল বীজ এবং সেচের পানি ব্যবহার করে দেশের অধিকাংশ আবাদি জমিতে চাষ হচ্ছে। সার ও বিষ ব্যবহারের ভয়াবহ সমস্যা কৃষকরা অনেক আগেই টের পেয়েছিলেন। আর্সেনিকের বিষে বিশাল জনগোষ্ঠি এখন আক্রান্ত। ওদিকে গরিব কৃষকরা চাইলেও আর নগদ টাকা দিয়ে সার-কীটনাশক কিনতে পারছেন না। এখন শুরু হয়েছে কৃষকের বীজ ব্যবস্থা ধ্বংস করার জন্য বিদেশী বীজ কোম্পানির কাছ থেকে হাইব্রিড বীজের আমদানি, বিকৃত বীজ বা জিএমও প্রবর্তনের পাঁয়তারা। ভয়ানক প্রতিকূল পরিস্থতির মধ্যে নয়াকৃষির কৃষক সংগঠিত হচ্ছেন।

একদিকে কৃষি ও কৃষিব্যবস্থা রক্ষার লড়াই, অন্যদিকে কৃষকের নিজের জ্ঞান বুদ্ধি খাটিয়ে আরো পরীক্ষা নিরীক্ষা। কি করে আরো উন্নত পদ্ধতিতে ফসল ফলানো যায়, ফলন বাড়ানো যায় তার প্রক্রিয়া। স্থানীয় জাত নিয়ে নানান ধরণের পরীক্ষা নিরীক্ষা, মিশ্র ফসলের বিপুল ফলন বৃদ্ধির সাফল্য এবং সর্বোপরি পোকামাকড়, কীটপতঙ্গ অপকার করা দূরে থাকুক, কৃষকের উপকারী প্রাণ সম্পদে পরিণত হওয়ায় বিপুল উৎসাহে নয়াকৃষি বেড়ে ওঠে। এখন নয়াকৃষি মাছ, গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি পালন, ফলমূল চাষ, মশলা চাষ, ওষুধি গাছ সংরক্ষণ প্রভৃতির মধ্য দিয়ে কৃষি পরিবারের দ্রুত আর্থিক ও বৈষয়িক সমৃদ্ধি আনয়নের পরীক্ষা নিরীক্ষায় এগিয়ে গিয়েছে। নয়াকৃষি নিজের শক্তি ও আত্মবিশ্বাসের ওপর এখন শক্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারো সাধ্য নেই তাকে এখন কেউ টলায়।

কীটনাশক বন্ধ করার জন্যে কৃষকদের মধ্যে প্রথম থেকেই ঐক্যমত ছিল। বিশেষত মহিলারা নিজেদের ও শিশুদের স্বাস্থ্যের বিপর্যয়ের কথাটা প্রথম থেকেই বলছিলেন এবং তাঁরা কীটনাশক অবিলম্বে বন্ধ করার কথা তুলেছেন। কীটনাশক বন্ধ করার জন্য প্রথমদিকে যেসব কৃষক নেতৃত দিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে প্রধানত ছিলেন ক্ষুদ্র চাষী এবং মহিলারা। প্রথম অবস্থায় যোগদানের সঙ্গে সঙ্গে কৃষকরা দলে সংগঠিত হয়ে সবুজ সার তৈরি ও কম্পোষ্ট তৈরি করা এবং এর ব্যবহার নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে শুরু করলেন। তাঁরা কম্পোষ্ট তৈরি করতে লাগলেন কচুরিপানা দিয়ে এবং এ থেকে জৈব সার তৈরি সহজ হবার কারণে ধীরে ধীরে কম্পোষ্ট কৃষকদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠে। বর্ষাকালে এই কচুরিপানা প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়। স্বাস্থ্য সম্পর্কে বিশেষ আত্মোপলব্ধির কারণেই ফসল উৎপাদন বিশেষ করে খাদ্য উৎপাদনে কীটনাশকের ব্যবহার ও রাসায়নিক সারের ব্যবহার থেকে তাঁরা নিজেদের মুক্ত করতে পারলেন। এটা ছিল নয়াকৃষি আন্দোলনের অগ্রযাত্রার একটা বাধা ভেঙ্গে বেরিয়ে আসার প্রথম অথচ গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। কারণ দীর্ঘ ত্রিশ চল্লিশ বছরের আধুনিক কৃষির প্রচার এবং সরাসরি কাজের অভিজ্ঞতার পর নতুন কোন ধারণা আছে কি না এই কথা বোঝা তাঁদের পক্ষে খুব কঠিন ছিল। কিন্তু কাজ করার অভিজ্ঞতা এবং সেই সাথে আত্মবিশ্বাস জন্মানোর কারণে তাঁরা নয়াকৃষি পদ্ধতির চাষ করাকে একটি আন্দোলনের রূপ দিলেন। এবং তাঁরা খাদ্য উৎপাদনের জন্য নয়াকৃষির সাধারণ কিছু নীতিও ঠিক করে নিলেন। কৃষকদের বিভিন্ন সভায় এবং তাঁদের নিজস্ব কাজের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে নয়াকৃষির নীতিগুলো কবিতার ছন্দ আকারে গড়ে উঠতে থাকে।


প্রাণবৈচিত্র্য নির্ভর উৎপাদন ব্যবস্থার চর্চা করে নয়াকৃষি। যেমন, যেটুকু জমি কৃষকের আছে তাতেই নগদ কোন টাকা খরচ না করে বিভিন্ন জাত ও প্রজাতির মিশ্রণ করে কি করে অধিক ফসল ফলানো যায় তার প্রাথমিক পদ্ধতি আবিষ্কার ছিল প্রথম সাফল্য।


প্রথম অবস্থায় কৃষকের পক্ষ থেকে উদ্যোগ ছিল রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহারের বিকল্প সন্ধান। প্রথমে তাঁরা জৈব সার এবং জৈব কীটনাশকের ব্যবহারও করেছেন। পরে দেখা গেলো আসলে শুধু রাসায়নিক নয়, কীটনাশক জৈব হলেও ব্যবহারের প্রয়োজন পড়ে না। জৈব কীটনাশকও প্রাণের ক্ষতি করে, প্রাণ হত্যা করে। কৃষকরা নিজেরাই পদ্ধতি খুঁজে পেলেন। আসলে পোকা দমন বলে কিছু নেই, মূল কথা হচ্ছে কি করে ফসলের সাথে কীটপতঙ্গের ব্যবস্থাপনা একীভূত করা যায়। একক ফসল না করলে তো অনেক পোকাই আসে না। মিশ্র ফসলের ক্ষেত্রে এক ফসলে যা অপকারী, অন্য ফসলে তা উপকারী। তাহলে ফসলে পোকা লাগা কথাটার তো কোন মানে হয় না। তাছাড়া পাখি এবং অন্যান্য প্রাণী থাকলে তারাই নিজেদের আহার হিশেবে পোকা খেয়ে ফেলে। এভাবে নয়াকৃষির কৃষকদের মধ্যে এই ধারণা জন্ম নেয় যে তাঁরা কোন অবস্থাতেই প্রাণ হত্যাকারীর ভূমিকা নেবেন না। এই সিদ্ধান্তের যে নৈতিক আনন্দ তার তুলনা চলে না। মানুষ সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব, অতএব তাকেই সকল প্রাণ সংরক্ষণ, রক্ষা ও বিকাশের দায়িত্ব নিতে হবে, এই উপলব্ধি নয়াকৃষির কৃষকের জীবন বদলে দেয়। তার শ্রেষ্ঠত্বের অর্থ দাঁড়ায় সৃষ্টি রক্ষা ও বিকাশের নৈতিক দায়িত্ব গ্রহণে।

প্রাণবৈচিত্র্যের সামাজিক ব্যবস্থাপনার সম্ভাবনা

নয়াকৃষি অনুশীলনে সুষম খাদ্যের সমৃদ্ধির লক্ষ্যে শর্করা, আমিষ, খনিজ লবণ, তৈল ও পানির সরবরাহ নিশ্চিত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। এ সকল উপাদানের সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য দানাদার শস্য, ডাল, তৈল, শাকসবজি, ফলমূল, মসল্লা ও ওষুধী গাছপালার আবাদ করা হয়। বৈচিত্র্যপূর্ণ এ সকল ফসল আবাদ করতে শস্যাবর্তন ও মিশ্রফসলের অনুশীলন করা হয়।

নয়াকৃষি শস্য পরিকল্পনায় বাড়ির আংগীনায় ও মাঠে চাষাবাদের বিন্যাস এমনভাবে করা হয় যাতে বছরের সবসময় কোন না কোন ফসল কৃষক ঘরে তুলতে পারে। এর মাধ্যমে একদিকে যেমন খাদ্য স্বার্বভৌমত্ব নিশ্চিত হয় অন্যদিকে উদ্বৃত্ত ফসল বিক্রি করে কৃষক বাড়তি আয় লাভ করতে পারে। পাশাপাশি মাটির উৎপাদিকা শক্তি সংরক্ষিত হয় এবং ফসলের ফলন বৃদ্ধি পায়।

নয়াকৃষি পরিবর্তিত প্রাকৃতিক পরিবেশে খাপ খাওয়ানোর জন্য সময় উপযোগী ফসল নির্বাচন করে। তাপমাত্রার হেরফের, বৃষ্টিপাত, খরা, জলাবদ্ধতা, কুয়াশা ইত্যাদি প্রতিকূলতার মধ্যেও টিকে থাকতে পারে এমন ফসলের চাষ করে।

নয়াকৃষিতে কৃষকরা প্রাণবৈচিত্র্য ব্যবস্থাপনায় বিশেষ করে বীজ সংগ্রহ, সংরক্ষণ, পুনরুৎপাদন ও ব্যবহারের ক্ষেত্রে তাদের অভিজ্ঞতা বিভিন্ন উপলক্ষ্যে অংশীদারিত্ব করে এবং নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে নয়াকৃষির বক্তব্য ও অভিজ্ঞতা তুলে ধরার ক্ষেত্র সৃষ্টি করে।

আধুনিক কৃষি ফলনের হিশাব প্রতারণামূলক

কেউ নয়াকৃষি করবেন বলে যদি সিদ্ধান্ত নেন তাহলে তাঁর প্রথম পরীক্ষা তিনি কীটনাশক ব্যবহার বন্ধ করেছেন কি না। এভাবে নয়াকৃষিতে প্রথম নীতি হিশেবে স্থান পেলো কীটনাশক ব্যবহার বন্ধের বিষয়টি। এরপর সার বীজ, মাটির তলার পানি ইত্যাদি ব্যবহারের প্রতিটি ক্ষেত্রে একটি করে নীতি ঠিক হয়ে গেলো।

আধুনিক কৃষি আসার পর প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে কৃষকের নিজস্ব জ্ঞান অস্বীকার ও বিলুপ্ত করে বিদেশ থেকে আনা প্রযুক্তির ওপর কৃষককে নির্ভরশীল করে তোলা হয়েছে। এর ফলাফল হিশেবে আমরা দেখেছি পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে। কৃষকের জ্ঞান হারিয়ে যাচ্ছে এবং কৃষক পরনির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। এই অবস্থার বিপরীতে নয়াকৃষির কৃষকরা নিজেদের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা থেকে শেখা কৃষি কাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে একটি করে নীতি প্রণয়ন করে নয়াকৃষির দশ নীতি এখন কৃষকের ঘরে ঘরে ছড়িয়ে যাচ্ছে। হাজার হাজার কৃষকরা একত্রিত হচ্ছেন, সংঘবদ্ধ হচ্ছেন।

কৃষক তাঁদের অভিজ্ঞতায় দেখেছেন আধুনিক কৃষির ফলনের হিশাব প্রতারণামূলক। প্রথম দিকে ফলন বেশী হয়, তাও শুধু ইরি ধানের, যে ফলন রাসায়নিক সার, বিষ, ভূ-গর্ভের পানির ব্যবহার ছাড়া পাওয়া অসম্ভব। হাজার হাজার স্থানীয় জাতের বৈচিত্র্যকে অল্প কয়েকটি উফশি জাতে নামিয়ে আনে আধুনিক কৃষি। অচিরেই এককাট্টা ধানের অভিজ্ঞতা তিক্ত হয়ে ওঠে। ইতোমধ্যে মাছ মরে, পশু-পাখি কমে, স্বাস্থ্য নষ্ট হয় এবং কৃষক ধুঁকতে থাকে অভাবে, অসুখে, মহামারিতে। এখন কৃষক আর্সেনিকের বিষে মরছে। গরিব আরো গরিব, ঘরহারা জমিহারা হয়ে বৌ ছেলে মেয়ে নিয়ে পথে বসে। একসময় গ্রামের কৃষকটিই শহরে ছেলেমেয়ে নিয়ে হাত পাতছে পেটের ক্ষুধায়। বাঁচার জন্য অনেক কৃষক অন্য পেশায় চলে যায়। অন্যরা কষ্ট করে ফসল উৎপাদন করে চলে, কারণ এছাড়া বেঁচে থাকার অন্য কোন পথ নাই বলে।

জিএমও ও হাইব্রিড বীজ নয়াকৃষি গ্রহণ করে না

বাংলাদেশের কৃষি এবং কৃষকের জীবিকা বহুজাতিক কোম্পানির ল্যাবরেটরীতে উদ্ভাবিত বীজ প্রবর্তনের মুখে আজ হুমকির মুখে পড়েছে। এদেশের প্রাণবৈচিত্র্য নির্ভর কৃষি এতোদিন তথাকথিত উচ্চফলনশীল ও হাইব্রিড বীজ এবং তার সাথে ব্যবহার করা রাসায়নিক সার, কীটনাশক, সেচ ব্যবস্থার কারণে মারাত্মক সমস্যার মধ্যে আছে। সেচ ও সার নির্ভর হওয়ার কারণে এখন বোরো ধান চাষ করা যাচ্ছে না। এমন অবস্থায় কৃষিতে এখন আরো নতুন প্রযুক্তি নিয়ে আসা হচ্ছে যা পরিবেশ, প্রাণবৈচিত্র্য এবং মানুষ ও প্রাণীকূলের জন্য মারাত্মক হুমকি। বহুজাতিক কোম্পানি এখন বিশ্বখাদ্য ব্যবস্থা নিজের কুক্ষিগত করবার জন্য টেকনোলজিকে অস্ত্র হিশাবে ব্যবহার করছে।


বিশ্বব্যাপী প্রতিবাদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে বাংলাদেশেও জিএমও বা বিকৃত বীজ প্রবর্তনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ চলছে।


জেনেটিক্যালি মডিফাইড অরগানিজম (জিএমও) বা বিকৃত প্রাণ ও বীজের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী প্রতিবাদ হচ্ছে কারণ এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে ইওরোপ, আমেরিকা, আফ্রিকা এবং ল্যাটিন আমেরিকার কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। ক্ষতি হচ্ছে পরিবেশের ও মানুষের স্বাস্থ্যের। জিএমও কারিগরি দিক থেকে অনৈতিকভাবে এক প্রাণীর জিন অন্য প্রাণীতে প্রতিস্থাপন করছে এবং প্রাণের প্রক্রিয়াকে মুনাফাখোর কোম্পানির লাভালাভের প্রতিযোগিতায় নামিয়ে এনেছে।

বাংলাদেশে জিএমও প্রবর্তক কোম্পানিগুলো খুব সক্রিয়ভাবে তাদের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে এবং তারা এখানে সরকারের সহযোগিতায় এই বীজ প্রচলন করতে চাইছে। এ পর্যন্ত জিএমও ফসলের কারণে কোনো দেশেরই কৃষকের উপকার হয় নি, হয়েছে গুটিকয় বহুজাতিক কোম্পানির। জিএম ফসলের সুফলের চেয়ে কুফল অনেক বেশি তা ভুক্তভোগী দেশের অভিজ্ঞতা থেকে বোঝা যাচ্ছে।

জিএমও ফসলের প্রবর্তন কৃষকের ঘরে রাখা বীজের ক্ষতি করবে এবং কৃষককে বহুজাতিক কোম্পানির ওপর নির্ভরশীল করে তুলবে। জিএমও বীজ আগাছানাশক ও অন্যান্য রাসায়নিক পদার্থের ওপর নির্ভরশীল এবং এক প্রাণীর জিন অন্য প্রাণীতে ঢুকিয়ে মানুষের সামাজিক সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের ওপরেও আঘাত হানছে।

বিটি-বেগুন

উদাহরণ হিশেবে বিটি-বেগুনের কথা বলা যেতে পারে। বেগুন মাত্রই বাংলার এমন সবজি, যাকে ছাড়া বাঙালির খাদ্য ব্যবস্থার কথা ভাবাই যায় না। দেশী বেগুন চাষে কীটনাশক দিতে হয় না। পোকা লাগলে ছাইয়ের ব্যবহারেই যথেষ্ঠ। বাণিজ্যিক, উফশী এবং হাইব্রিড বেগুনে কীটনাশক দিতে হয়। বাজারে বিভিন্ন নামের হাইব্রিড বেগুনের বীজ বিক্র হচ্ছে। এরই সঙ্গে নানা ধরণের কীটনাশকও বিক্রি হচ্ছে। এমন কি বাজারে বেগুন বিক্রি করার জন্য নিয়ে আসার আগেও বিষ দেয়া হয়।

বাংলাদেশের মৌসুম অনুযায়ী হরেক রকমের বেগুনের জাত রয়েছে। আমাদের দেশে এতো জাতের বেগুন থাকতে হাইব্রিড বেগুন এসে আমাদের অনেক ক্ষতি করেছে। বেগুনের বাণিজ্যিক চাষ করে বিষাক্ত করে ফেলেছে। বাণিজ্যিক বেগুন স্বাস্থ্যের জন্য নিরাপদ নয়। কিন্তু সেই পর্ব শেষ না হতেই এখন জিএম বেগুন প্রবর্তন-প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।

এখন বলা হচ্ছে, বেগুনকে বিষমুক্ত করার জন্য জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং করে বিটি-ব্রিনজাল বা বিটি-বেগুন প্রবর্তন করা হবে। ভারতের মহারাষ্ট্র হাইব্রিড সিড কোম্পানি (মাহাইকো) বহুজাতিক কোম্পানি মনসান্তোর কাছ থেকে কীট ব্যবস্থাপনার বিশেষ প্রযুক্তি ইঃ পৎু ১অপ মবহব ঃবপযহড়ষড়মু-এর লাইসেন্স পেয়ে ভারতে বিটি বেগুনের গবেষণা করেছে। মাহাইকো ভারতের দুটি সরকারি প্রতিষ্ঠানসহ ফিলিপাইন বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) এবং বেসরকারী বীজ কোম্পানি ইস্ট-ওয়েস্ট সিড বাংলাদেশের মাধ্যমে প্রবর্তন করার জন্য গবেষণা করছে। মনসান্তো-মাহাইকো বিটি বেগুনের প্রবর্তন শুধু ভারতের বাজারকে নিয়ে পরিকল্পনা করেনি, দক্ষিণ এশিয়া এবং দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় এর বাজারজাত করার লক্ষ্য নিয়েই এগোচ্ছে। এই প্রযুক্তি প্রবর্তনের জন্য অর্থনৈতিক সহযোগিতা দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য সংস্থা ইউএসএইড, অমৎরপঁষঃঁৎধষ ইরড়ঃবপযহড়ষড়মু ঝঁঢ়ঢ়ড়ৎঃ চৎড়লবপঃ ওও, (অইঝচওও) প্রকল্পের মাধ্যমে। ফলে বাংলাদেশের সরকারি প্রতিষ্ঠান বিদেশি সাহায্য পেয়েই এই প্রকল্পের কাজ করছে।

বিটি বেগুনের বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া হচ্ছে, ব্যাকটেরিয়া থেকে বিষাক্ত প্রোটিন উদ্ভাবনের জিন ব্যাকটেরিয়া থেকে আলাদা করে জেনেটিক প্রক্রিয়ায় বেগুনের জিনোমের মধ্যে প্রবেশ করানোর ফলে বেগুনের মধ্যেই একই ধরণের বিষাক্ত প্রোটিন উৎপাদিত হয়। ফলে বেগুনের মধ্যে সাধারণভাবে আমরা যে পোকা সব সময় দেখি, সেই ব্রিঞ্জাল ফ্রুট অ্যান্ড শুটবোরার বা লেদাপোকা বেগুনের গায়ে আক্রমণ করলে বা বেগুনের কোনো অংশ খেলে এগুলোর পুষ্টিনালি ছিদ্র হয়ে মারা যায়। কিন্তু বিটি বেগুন এতোই বিষাক্ত যে পোকা খাওয়ারও উপযোগী নয়, সেই বেগুন কী করে মানুষের খাওয়ার উপযুক্ত হতে পারে, সে প্রশ্ন কি তোলা উচিৎ নয়? বিটি প্রযুক্তির মাধ্যমে বিষ ব্যবহার না করার কথা মিথ্যা এবং প্রতারণা। আসলে বিষ ব্যবহার বন্ধ নয়, বরং বিষাক্ত বীজ ব্যবহার করা হচ্ছে, যা কোম্পানি বা উদ্ভাবক নিজেই কৃষককে করে দিচ্ছে।


গুটিকয় কোম্পানীর স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে এদেশের শতকরা ৭০ ভাগ জনগণ, যারা কৃষক, তাদের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলা আমরা কোন মতেই সমর্থন করতে পারি না। নয়াকৃষির কৃষকরা এর বিরোধিতা করে।


এরকম অবস্থায় খাদ্য উৎপাদনে বিষ ব্যবহার বন্ধের একটাই উপায় সেটা হচ্ছে স্থান ও পরিবেশের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ স্থানীয় বীজের ব্যবহার, মাটির উর্বরতা রক্ষা করা এবং বৈচিত্র্যপূর্ণ ফসলের উৎপাদন করা। কেননা প্রযুক্তি ব্যবহার করে বীজকে বিকৃত করলেই শস্য নিরাপদ হয়ে যায় না।

বাংলাদেশে বিটি বেগুন আসার অর্থ হচ্ছে, স্থানীয় জাতের বেগুন বিলুপ্ত হওয়ার পথ তৈরি করা। শুধু তাই নয়, মানুষের স্বাস্থ্য ও পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাবের কথা আর অস্বীকার করার উপায় নেই। তাহলে আমাদের এই বিতর্কিত এবং পরিবেশ ও মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর জিএম বেগুন আনতে হবে কেন? বিদেশি কোম্পানির লাইনেন্স প্রাপ্ত প্রযুক্তির ব্যবহার এবং বাংলাদেশে প্রাইভেট কোম্পানির ব্যবসায়িক স্বার্থ দেশের সাধারণ কৃষকের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হবে না; এটুকু অবশ্যই বোঝা যায়। শুধু কৃষক নয়, ক্রেতা ভোক্তাসহ সবাইকে হাইব্রিড ও জিএমও বীজের ব্যাপারে সতর্ক হওয়া প্রয়োজন।

আধি

নয়াকৃষি আন্দোলনে ক্ষুদ্র ও মাঝারি কৃষকের সংখ্যাই বেশী। কিন্তু যাঁদের মোটেও কোন জমি নেই, তাঁরা নয়াকৃষির দৃঢ় সমর্থক। এর কারণ নয়াকৃষি গ্রামে অনাবাদী বা কুড়িয়ে পাওয়া খাদ্যের নিশ্চয়তা বেশী এবং নয়াকৃষি কর্মসূচীতে তাঁদের অর্ন্তভুক্ত হবারও পথ আছে।

গ্রামে ভূমিহীন পরিবার যেমন আছে তেমনি আছে মহিলা প্রধান পরিবার যেখানে কোন পুরুষ উপার্জনকারী নেই। নিজেই আয় উপার্জন করে সংসারের খরচ চালান। ভূমিহীন পরিবারে পুরুষরা অকৃষি কাজে যুক্ত থাকেন, সেখানেও মহিলাদের ওপর সংসারের একটা বড় দায়িত্ব থাকে। এই ধরণের পরিবারকে সাধারণত কোন ঋণও দেয়া হয় না। কিন্তু নয়াকৃষিতে এঁরা সবাই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যুক্ত হয়ে পড়েন।

গ্রামে আগে থেকে বর্গা পদ্ধতিতে গরু, ছাগল, হাঁস-মুরগী পালনের নিয়ম ছিল, এখনও অনেক ক্ষেত্রে আছে। আধি মানে আধা বা অর্ধেক। কেউ কেউ বলে আধাআধি, বিশেষ করে ভাগের ক্ষেত্রে। বাংলাদেশের বিভিন্ন গ্রামাঞ্চলে আধি শব্দটি কৃষি ব্যবস্থার সাথে সম্পৃক্ত। যেমন, কোন কোন এলাকায় জমি বর্গা নিয়ে চাষ করাকে আধি বলে। আধি কথাটা এখন পর্যন্ত গ্রামীণ কৃষিভিত্তিক পরিবারগুলোতে ব্যবহার হয়। মোট কথা আধি মানে অর্ধেক। এই পদ্ধতিতে গরু, ছাগল, হাঁস-মুরগী মহিলাদের পালন করার জন্যে দেয়া হয়। তাঁরা নিজ খরচে গরু-ছাগল পালন করেন এবং পালনের সময়ে পাওয়া গোবর ইত্যাদি ব্যবহার করেন। বাছুর জন্মালে বাছুরটি রেখে মা-গরু বা মা-ছাগল একটি নির্দিষ্ট সময়ের পর ফেরত নেওয়া হয়। যা আবার ঐ গ্রামেরই অন্য কোন মহিলা প্রধান পরিবারকে দেয়া হয়। অসুখ-বিসুখ হলে বিক্রি করে দিয়ে নতুন গরু বা ছাগল কেনা হয়। গাভীন না হলেও নয়াকৃষি বদলিয়ে দেয়।

আধি পদ্ধতির মাধ্যমে পাওয়া গরু ছাগল পালনের জন্য ঐ গ্রামের কৃষকদের জমির ঘাস ও খড় সংগ্রহ করে মহিলারা গরু-ছাগল পালন করতে সক্ষম হচ্ছেন। অন্য দিকে ঐ সমস্ত আধি গ্রহীতাদের কাছ থেকে গরুর গোবর নিচ্ছেন কৃষকরা। কৃষি কাজে গরু দিয়ে হালের কাজে সহযোগিতা করছেন। এর ফলে আধি গ্রহীতাদের সঙ্গে কৃষকদের একটা সম্পর্ক গড়ে উঠছে যা প্রাণবৈচিত্র্য নির্ভর কৃষির জন্য জরুরী। গ্রামে গরু, ছাগলের জাত ও সংখ্যা বাড়ছে এবং গরু, ছাগল বৃদ্ধির কারণে সঠিকভাবে জমির উর্বরতা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং ফসলের বৈচিত্র্য বেড়েছে। বিশেষ করে গো-খাদ্যের উপযোগী ফসলের চাষ বাড়ছে।

আধি গরুর মাধ্যমে গ্রামের নয়াকৃষি পদ্ধতিতে চাষের গুণগত পরির্বতন হয়েছে।

নয়াকৃষির কৃষক ও আধি গ্রহীতাদের মঝে কাচা ঘাস ও গোবরের বিনিময়ের মাধ্যমে সম্প্রীতি গড়ে উঠেছে। মহিলারা গরু, ছাগলের দুধ বিক্রি করে বাচ্চাদের পড়াশুনার খরচ জুগিয়েছে।

প্রতি বাছুর বড় হওয়ার পর ঐ গরু থেকে পুনরায় বাছুর হয়েছে। ঐ বাছুর বিক্রি করে অনেকে জমি বন্ধক রেখেছেন এবং মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন।

নয়াকৃষি আন্দোলনের মাধ্যমে বিভিন্ন এলাকায়, যেমন- টাংগাইল, পাবনা, কুষ্টিয়া, সিরাজগঞ্জ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, কুড়িগ্রাম ও কক্সবাজার জেলার বিভিন্ন গ্রামে আধি গ্রহীতা রয়েছে।

নয়াকৃষি বিদ্যাঘর

নয়াকৃষি বিদ্যাঘর বিভিন্ন এলাকায় নয়াকৃষি কর্মকা-ের প্রাণকেন্দ্র। জ্ঞানচর্চার ঘর। এই বিদ্যাঘর কৃষক এবং সমাজের সকল পেশার জনগণের মধ্যে সেতু বন্ধন তৈরী করে।

বাংলাদেশের ভূ-প্রাকৃতিক অবস্থান অনুসারে সারা দেশের উত্তর থেকে দক্ষিণ পূর্ব থেকে পশ্চিম নয়াকৃষির কার্যক্রম বিস্তৃত। বাংলাদেশের টাঙ্গাইল, কক্সবাজার, পাবনা, কুষ্টিয়া, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, কুড়িগ্রাম, সিরাজগঞ্জ, শেরপুর এবং নোয়াখালী জেলায় বিদ্যাঘরের মাধ্যমে নয়াকৃষি আন্দোলনের কার্যক্রম সাফল্যের সঙ্গে পরিচালিত হচ্ছে।


নয়াকৃষি বিদ্যাঘরে দেশীয় জাতের প্রায় আড়াই হাজার ধানের বিভিন্ন দিক নিয়ে নিয়মিত গবেষণা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলে।


বিদ্যাঘরগুলোতে নিয়মিত পড়াশোনা, সভা আয়োজন, মাঠে সুনিদিষ্ট কৃষি গবেষণার কাজ, পরীক্ষা-নিরীক্ষা ইত্যাদির প্রয়োজনীয় সুবিধা রয়েছে। বিদ্যাঘরগুলোতে উবিনীগের কর্মীগণ নিজেদের জ্ঞান অর্জনের জন্য কৃষি কাজ চর্চা করে থাকেন এবং নয়াকৃষি আন্দোলনের কৃষকদের বিভিন্ন কৃষি কাজের পরীক্ষা-নিরীক্ষায় অর্জিত সাফল্যের ফলাফল নথিভুক্ত করা হয়ে থাকে। ইহা ছাড়াও বিদ্যাঘরগুলোর সঙ্গে জাতীয় কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান, বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, স্কুল, এনজিও এবং অন্যান্য সরকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজের সম্পর্ক বজায় রাখা হয়।

শস্য প্রবর্তনা

নয়াকৃষি কৃষকদের বাড়তি ফসল সচেতন ভোক্তাদের কাছে সুলভে পৌঁছিয়ে দেয় শস্য প্রবর্তনা। নয়াকৃষি আন্দোলন প্রাতিষ্ঠানিকভাবেও এই ফসল তাদের সদস্যদের কাছ থেকে সংগ্রহ করে। নয়াকৃষি বিদ্যাঘরগুলোতে শস্য সংগ্রহ ও মজুদের সুব্যবস্থা আছে। শস্য প্রবর্তনায় নিয়োজিত কর্মীরা নয়াকৃষি এলাকাগুলোতে গিয়ে নয়াকৃষি কৃষকের উৎপাদিত ফসলগুলোর মান পরীক্ষা ও ক্রয় করে নয়াকৃষি বিদ্যাঘরে নিয়ে আসেন। এখানে ফসলগুলো প্রক্রিয়াজাত করে ঢাকা শস্য প্রবর্তনায় সরবরাহ করা হয়।

পুষ্টিকর, সুস্বাদু এবং সর্বোপরী নিরাপদ খাদ্যের জন্য শস্য প্রবর্তনা দেশে বিদেশে সুখ্যাতি অর্জন করেছে। সার-কীটনাশকযুক্ত খাদ্যের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে সাধারণভাবে সচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছে তাই নয়াকৃষি পদ্ধতিতে উৎপাদিত ফসলের চাহিদা দিনে দিনে বাড়ছে। বিশেষ করে চাল, গম, সরিষার তেল, মুড়ি, ডাল, শাক-সবজির মসলা ইত্যাদি।

শস্য প্রবর্তনা থেকে খাদ্য কেনা মানে বাংলাদেশের প্রাণবৈচিত্র্য ও পরিবেশসম্মত কৃষিকে উৎসাহিত করা এবং নয়াকৃষি আন্দোলনে সহায়ক ভূমিকা পালন করা। এই ক্ষেত্রে নয়াকৃষি আন্দোলন শস্য প্রবর্তনার মাধ্যমে শহরে বিপুল শুভানুধ্যায়ীদের সহযোগিতা ও ভালবাসা অর্জন করে চলেছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *