পরিকল্পনাহীন স্বাস্থ্য বাজেট

ফরিদা আখতার || Sunday 14 June 2020

যখন বাংলাদেশে বাজেট ঘোষণা হয়েছে (১১ জুন), তখন এখানে নভেল করোনা ভাইরাসে সংক্রমণের সংখ্যা ৮০ হাজার ছাড়িয়েছে এবং মৃতের সংখ্যা হাজার ছাড়িয়েছে। নতুন সংক্রমণের শীর্ষ দশে বাংলাদেশ পৌঁছে গেছে। দুই সপ্তাহ আগেও একটু রয়ে-সয়ে বাড়ছিল। এখন টেস্টের সংখ্যা যেমন বাড়ছে, তেমনি শনাক্তের সংখ্যাও নমুনার ২০-২৫ শতাংশ হারে বাড়ছে। এ পরিস্থিতিতে সরকার একদিকে জীবিকার কথা বলে সারা দেশে লকডাউন শিথিল করছে আবার অন্যদিকে বিভিন্ন এলাকা সবুজ, হলুদ আর লাল জোনিং করে কঠোর ব্যবস্থা নিচ্ছে। মোট কথা, সরকার একটু বেসামালভাবেই কভিড-১৯ সংক্রমণ রোধ এবং আক্রান্তদের চিকিৎসার ব্যবস্থাপনা করছে। যা হচ্ছে তার দায়িত্বে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় রয়েছে।

কভিড-১৯-এর চেয়েও মরণঘাতী আরো অনেক রোগ থাকা সত্ত্বেও এই মহাসংক্রমণ বা মহামারী দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে নাড়িয়ে দিয়েছে। উন্মোচন করছে স্বাস্থ্য খাতের দুর্বলতা, দুর্নীতি ও পরিকল্পনাহীনতাকে। তাই আগামী অর্থবছরে (২০২০-২১) স্বাস্থ্য খাতের গুরুত্ব বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই, বরং দেখা দরকার যা দেয়া হয়েছে তা বর্তমান সময়ের বাড়তি চাপ মেটানোর জন্য যথেষ্ট কিনা। কভিডের লক্ষণ সংসদের বাজেট অধিবেশনেও দৃশ্যমান ছিল। মাত্র ৭৮ জন আইনপ্রণেতা মাত্র ৫২ মিনিটের এই অধিবেশনে উপস্থিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছেন, সামাজিক-শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার প্রয়োজনে। ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেট মাত্র ৪৭ মিনিটে পেশ করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, যা নজিরবিহীন।

বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে ২৯ হাজার ২৪৭ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে, যা আগের অর্থবছর ২০১৯-২০-এর তুলনায় ২৩ শতাংশ বেশি। স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২২ হাজার ৮৮৩ কোটি টাকা, কভিড-১৯ মোকাবেলায় জরুরি সেবার জন্য ১০ হাজার কোটি টাকা এবং স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণের জন্য রাখা হয়েছে ৬ হাজার ৩৬৩ কোটি টাকা। অন্যদিকে ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে মেডিকেল গবেষণার কাজে। সেই লক্ষ্যে ‘সমন্বিত স্বাস্থ্য-বিজ্ঞান গবেষণা ও উন্নয়ন তহবিল’ গঠন করার প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী। সব মিলিয়ে এ বছরের স্বাস্থ্য খাতের বাজেট বরাদ্দ মোট বাজেটের ৫ দশমিক ২ শতাংশ। গত বাজেটে (২০১৯-২০) স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ ছিল মূল বাজেটের ৪ দশমিক ৯ শতাংশ।

বাজেট ঘোষণার পর যেসব প্রতিক্রিয়া অর্থনীতিবিদরা দিয়েছেন, তারা খুব ভদ্র ভাষায় ‘প্রত্যাশার প্রতিফলন ঘটেনি’—এমন দায়সারাভাবেই বলছেন। সরাসরি বলছেন না যে স্বাস্থ্য খাতকে গুরুত্ব দেয়া হলেও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। অন্যদিকে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা স্পষ্টভাবেই উচ্চারণ করছেন। তারা প্রশ্ন তুলেছেন, বরাদ্দের পরিমাণ কত বাড়ল বা কমল তা নয়, স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার ভঙ্গুর দশা ঠিক করার কোনো পরিকল্পনা নেই কেন?

বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা যে কত ভঙ্গুর অবস্থায় আছে, তা আগে টের পাওয়া গেলেও নভেল করোনাভাইরাস সংক্রমণের পর চোখের সামনে স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। জনগণের স্বাস্থ্যসেবার জন্য সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থা দীর্ঘদিন ধরে গড়ে উঠেছে জনগণেরই টাকায় এবং তা কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকে শুরু করে গ্রাম পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে। প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা বলে যা কিছু আছে, তা একমাত্র পাওয়া যায় সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থায়। কিন্তু দীর্ঘ তিন দশকে উন্নয়ন সহযোগীদের অনেক ধার করা পরামর্শ নিয়ে এবং বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সঙ্গে সেবা খাত উন্মুক্ত করার চুক্তি করে, জনগণের স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার অধিকার উপেক্ষা করে সরকারি স্বাস্থ্য খাতকে একেবারে দুর্বল করে ফেলা হয়েছে এবং মুনাফাভিত্তিক স্বাস্থ্য‘সেবা’র ব্যবস্থা উন্মুক্ত করে দেয়া হয়েছে। স্বাস্থ্যসেবার মাত্র ৩০ শতাংশ প্রদান করা হয় সরকারি ব্যবস্থায়, আর বাকি ৭০ শতাংশ দিচ্ছে অনিয়ন্ত্রিত ‘প্রাইভেট সেক্টর’-এর মাধ্যমে; যারা একই সঙ্গে ওষুধ ব্যবসা ও হাসপাতাল ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হয়ে স্বাস্থ্যসেবাকে পণ্যে রূপান্তর করেছে। তাছাড়া সরকারি স্বাস্থ্যসেবা নিতে গেলেও রোগীকে খরচের দুই-তৃতীয়াংশ দিতে হয়। বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে কী দেয়া হলো, তা রোগীর দেয় অংশকে কমাচ্ছে নাকি বাড়াচ্ছে, এটি দেখা হচ্ছে না। বছরে ৪ শতাংশ মানুষ শুধু চিকিৎসা খরচ জোগাতে গিয়ে দারিদ্র্যের কবলে পড়ছে। গরিবদের গরু-ছাগল, জমিজমা ও মধ্যবিত্তদের ঘরবাড়ি বিক্রি করা এবং দেনায় পড়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটছে। বাজেটে কোথাও বলা নেই সরকারি স্বাস্থ্যসেবাকে উন্নত করে প্রাইভেট সেক্টরকে বিশেষ ধরনের চিকিৎসার জন্য নীতিমালা করা হবে। বাজেটে উল্লেখ নেই যে কভিড-১৯ মোকাবেলায় প্রাইভেট হাসপাতালকে সরকারের নিয়ন্ত্রণে এনে আগামীতে সম্ভাব্য সংক্রমণ মোকাবেলা করবে। তাহলে কি এই বাজেট শুধু ৩০ শতাংশ সেবার জন্য নির্ধারিত? বাকি ৭০ শতাংশ সেবার বিষয়ে সরকারের কোনো পরিকল্পনা থাকবে না? তাদের কি নিজের ইচ্ছামতো করোনা নিয়েও ব্যবসা করতে দেয়া হবে? বর্তমানে প্রাইভেট হাসপাতালে সরকারি হাসপাতালের চেয়ে দ্বিগুণ দামে করোনা টেস্ট করতে হয়। চিকিৎসা খরচ তো বলা বাহুল্য অনেক বেশি।

কভিড-১৯ মোকাবেলায় একটি বিশেষ চ্যালেঞ্জ স্বাস্থ্য খাতের সামনে এসেছে। তা হচ্ছে স্বাস্থ্যকর্মী, যাদের ফ্রন্টলাইন কর্মী বলা হয়। আমরা জানি কভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসা করতে গিয়ে নার্স, ডাক্তারসহ সব সহযোগী কর্মী নিজেরাই আক্রান্ত হচ্ছেন, বিশেষ করে স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় মাস্ক, পিপিই, গগলস ইত্যাদি সরবরাহের অভাবে। এমনকি মারাও গেছেন। পাঁচ শতাধিক চিকিৎসক, ১১৬ জন নার্সের কভিড পজিটিভ হওয়ার বিষয় এরই মধ্যে পত্রপত্রিকায় এসেছে। তাদের জন্য যদি কোনো ব্যবস্থা নেয়া না হয়, তাহলে ব্যাপক আকারে সংক্রমণ ঘটলে, যা আগামীতে আরো হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে, তখন চিকিৎসক, নার্স ও অন্যান্য কর্মীর ঘাটতি দেখা দেবে। এই আলোচনা এপ্রিল থেকেই হচ্ছে। টেলিভিশনের টকশোগুলো আলোচনা করতে গিয়ে ঝাল হয়েছে, কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। ফলে বাজেটে করোনা চিকিৎসায় নিয়োজিত চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের বিশেষ সম্মান বাবদ বরাদ্দ রাখা ১০০ কোটি টাকা আর কভিড-১৯ রোগে সংক্রমিত বা মৃত্যুর ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণ হিসেবে আরো ৭৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখার বিষয়টি কিছুটা পরিকল্পনাহীনভাবে হয়েছে। এই সুযোগ কারা পাবেন? বেসরকারি হাসপাতালে যারা কভিড-১৯ চিকিৎসার জন্য রাজি হয়েছেন, তারাও বড় অংকের প্রণোদনা দাবি করছেন।

স্বাস্থ্য জনবল বাড়ানো এবং যৌক্তিকভাবে ব্যবহারেরও কোনো দিকনির্দেশনা নেই। কভিড-১৯ মোকাবেলায় অনেক যন্ত্রপাতি কেনা হচ্ছে। কিন্তু শুধু যন্ত্রপাতি দিয়ে নয়, দক্ষ জনবল দরকার, টেস্ট করার জন্য টেকনিশিয়ান, আইসিইউ ও ভেন্টিলেটরের জন্য বিশেষ নার্স ও টেকনিশিয়ান এবং বাড়তি নার্স ও চিকিৎসক নিয়োগের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। তাদের প্রশিক্ষণ লাগবে। এসবের জন্য বাজেট আছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না। কাজেই স্বাস্থ্য খাতের এই বরাদ্দ কভিড-১৯-এর চিকিৎসা সরঞ্জাম কেনার কাজেই যেন ব্যয় হয়ে না যায়। এই সরঞ্জাম কাজে লাগাতে হলে দক্ষ জনবল তৈরি করার কোনো বিকল্প নেই।

আমরা জানি, স্বাস্থ্য জনবলের দিক থেকে বাংলাদেশে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানদণ্ডের চেয়ে অনেক কম রয়েছে। আমাদের রয়েছে ১০ হাজার মানুষের জন্য ৫ দশমিক ২৬ চিকিৎসক এবং প্রতি ১০ হাজার মানুষের জন্য রয়েছে মাত্র ৩ দশমিক শূন্য ৬ নার্স। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশে এই অনুপাত অনেক বেশি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা চিকিৎসক-নার্সসহ এই অনুপাত প্রতি ১০ হাজারে অন্তত ২৩ হওয়া উচিত মনে করে। আমাদের দেশের সমস্যা চিকিৎসকদের ক্ষেত্রে আরো অন্যখানে আছে। যেমন চিকিৎসকদের ৭০ শতাংশ থাকেন ঢাকা এবং অন্যান্য শহরে অথচ গ্রামে ৭৮ শতাংশ মানুষ বাস করে। অর্থাৎ মাত্র ২২ শতাংশ মানুষের জন্য ৭০ শতাংশ চিকিৎসক আছেন আর ৭৮ শতাংশ মানুষের জন্য আছেন মাত্র ৩০ শতাংশ চিকিৎসক। চিকিৎসক পাওয়ার সম্ভাবনার ওপরই নির্ভর করছে ভালো চিকিৎসার সুযোগ। তাই ঢাকা শহরে দূরদূরান্ত থেকে রোগীরা ছুটে আসছে। কারণ বড় ডাক্তাররা সব আছেন ঢাকা শহরে। এই ঢাকা এসে পৌঁছতে পৌঁছতেই অনেক রোগী মারা যায়। বাজেট বরাদ্দে কি চিকিৎসকদের গ্রামে যাওয়া এবং থাকার প্রণোদনা বা উৎসাহ ভাতা দেয়া যেত না?

নভেল করোনাভাইরাস বর্তমান শহরকেন্দ্রিক সংক্রমণের তথ্য, তার একটি প্রধান কারণ হচ্ছে সব টেস্ট ও শনাক্তের ব্যবস্থা ঢাকা এবং ঢাকার আশেপাশের জেলাতেই সীমাবদ্ধ হয়ে আছে। দেশে সংক্রমণের হার নিম্নগামী হচ্ছে কিনা এবং একপর্যায়ে করোনামুক্ত হতে পারবে কিনা, তার জন্য সারা দেশে টেস্টের সুযোগ তৈরির কোনো আভাস এই বাজেটে নেই।

বাজেটের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে কর বা ট্যাক্স। সরাসরি জনস্বাস্থ্যের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে তামাক সেবন। তামাকের কারণে বিভিন্ন ধরনের মরণঘাতী রোগে বছরে ১ লাখ ২৬ হাজার মানুষ মারা যায়। কভিড-১৯-এর প্রশ্নেও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে যে তামাক সেবন, বিশেষ করে ধূমপান কভিডের ঝুঁকি ১৪ গুণ বাড়িয়ে দেয়। বিষয়টি আমলে নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রতিদিনের ব্রিফিংয়ের শেষে সচেতনতার জন্য তামাক সেবন থেকে বিরত থাকার আহ্বানও জানানো হয়েছে। তামাক সেবন স্বাস্থ্য খাতেও বিশাল চাপ সৃষ্টি করে। তামাকজনিত রোগ ও অকালমৃত্যুর কারণে বাংলাদেশে প্রতি বছর ৩০ হাজার ৫৭০ কোটি টাকা খরচ হয়, যা মোট স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দের চেয়েও বেশি। তাই প্রতিবার বাজেটের সময় জনস্বাস্থ্য রক্ষার্থে তামাকপণ্যের ব্যবহার কমানোর একটি অন্যতম কার্যকর পদ্ধতি হিসেবে কর বৃদ্ধি করে দাম বাড়ানোর প্রস্তাব প্রতি বছরই রাখা হয়। এবারো রাখা হয়েছে এবং বিশেষ করে তামাক সেবনের স্বাস্থ্য ক্ষতি মোকাবেলায় ৩ শতাংশ সারচার্জ আরোপ করার দাবি জানানো হয়েছিল। যার মাধ্যমে সরকারের বাড়তি রাজস্ব আয় হতো। কিন্তু সেই প্রস্তাব অনুযায়ী কর বৃদ্ধি করা হয়নি।

স্বাস্থ্য খাতের বাজেট পরিকল্পনাহীন অর্থ বরাদ্দের বিষয় নয়, কভিড-১৯-এর এই মহামারী ঠেকাতে গিয়ে সরকার নিশ্চয়ই ভালোভাবে টের পাচ্ছে। স্বাস্থ্য বাজেট হতাশ করেছে।

লেখাটি প্রকাশিত হয় দৈনিক বণিক বার্তা ১৪ জুন, ২০২০

ফরিদা আখতার: নারী নেত্রী
নির্বাহী পরিচালক, উন্নয়ন বিকল্পের নীতিনির্ধারণী গবেষণা (উবিনীগ)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *