হাসেম ফুড প্রডাক্টস কারখানায় অগ্নিকাণ্ড: কিছু প্রশ্ন

ফরিদা আখতার

আমাদের নীতি নির্ধারক আগুনে পুড়ে মরা এবং আগুনে আহত হওয়ার পর পোড়া মানুষের জন্যে নতুন নতুন হাসপাতাল তৈরিতে যত মনোযোগ দেন, আগুন যেন না লাগে, লাগলেও সে ভবনগুলো থেকে উদ্ধারের ব্যবস্থা উন্নত করার জন্যে তত মনোযোগী নন।

নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে হাসেম ফুডস কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে ৯ জুলাই, ২০২১ তারিখে। এতে ৫২ জনের কয়লার মতো লাশ পাওয়া গেছে, যা আজও শনাক্তের অপেক্ষায় আছে। নিখোঁজ রয়েছে আরও অনেকেই। এদের সন্ধান কখনো আর পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ। এদের অধিকাংশই শ্রমিক। কারখানায় প্রাপ্তবয়স্ক নারী শ্রমিকের পাশাপাশি ছিল অনেক শিশু শ্রমিক। অর্থাৎ এই কারখানায় অনেক শিশু শ্রমিক কর্মরত ছিল যা দেশে বিরাজমান আইনের পরিপন্থি। পত্রিকার খবর এবং টেলিভিশনের প্রতিবেদনে এটা পরিস্কার যে নিহত শ্রমিকদের অনেকের বয়স ১৮ বছরের নীচে।

হাসেম ফুড প্রডাক্টস সজীব গ্রুপের বিভিন্ন ধরণের “খাদ্য” সামগ্রী উৎপাদন করে যা মূলতঃ শিশুরাই বেশি খায়। এর মধ্যে আছে ট্যাং, কুলসন, সেজান ম্যাঙ্গো জুস, সজীব নুডলস, পটেটো ক্র্যাকার্স, চকলেট, কর্ন ফ্লেক্স, লিচুর জুস ইত্যাদি। তারা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ব্রান্ডের পানীয় ও খাদ্য পণ্য উৎপাদন করে।

রূপগঞ্জের এই কারখানা ভবনটি ৬ তলা; একেকটি ফ্লোর ৩৫ হাজার স্কয়ার ফিটের। সিঁড়ি ছিল মাত্র দুটি। সিঁড়িতেও আগুন ছিল, ফলে অনেকে বের হতে পারেনি। ফায়ার সার্ভিসও পঞ্চম ও ষষ্ঠ তলায় যেতে পারে নি। অনেক বড় ফ্লোর এবং ভেতরে খোপ খোপ কক্ষ থাকায় আগুন নেভাতে সমস্যা হয়েছে। রাসায়নিক দ্রব্যের আগুনের ধোঁয়ার কারণে ছাদে উঠতে পারেনি অনেক শ্রমিক। কারখানায় আগুন লাগে ৮ জুলাই (বৃহস্পতিবার) বিকাল সাড়ে ৫টার দিকে, ফায়ার সার্ভিসের ১৮টি ইউনিট ৯ তারিখ (শুক্রবার) বিকাল ৪টার পর আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। অর্থাৎ প্রায় ২৪ ঘন্টা লেগে যায়। 

আগুনের ভয়াবহতা ও হতাহতের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার পেছনে কারখানা ভবনের অবকাঠামো, অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থার অপ্রতুলতা, ভবনের আকার অনুযায়ী বের হবার সিঁড়ি যথেষ্ট না থাকা এবং সর্বোপরি বের হবার গেইটে তালা খুলতে না পারা শ্রমিক হত্যার সামিল বলে সকলে গণ্য করছেন। এবং কর্তৃপক্ষের দিক থেকে তালার ব্যাখ্যা এমনও এসেছে যে শ্রমিকরা (বেশির ভাগ শিশু) তাদের এই সকল আকর্ষণীয় শিশু খাদ্য চুরি করে নিয়ে যেতে পারে। তাই কোম্পানি এই কাজ করেছে। এমন কথা আমরা এর আগে সারাকা গার্মেন্টের ভবনের গেটে তালা লাগানো অবস্থায় আগুন লেগেছিল বলে অনেক শ্রমিক নিহত হবার পর শুনেছি যে শ্রমিকরা কাপড় চুরি করতে পারে তাই গেইটে তালা লাগাতে হয়। শ্রমিকরা এই কাপড় নিয়ে কি করবে? ওদের দরকার কাজের, আয়ের ব্যবস্থা করা। সেখানে একবার কাপড় চুরি করে তারা কি বড় লোক হয়ে যাবে? এমন উদ্ভট চিন্তাও কর্তৃপক্ষের মাথায় ছিল। ভেবেছিলাম এই চিন্তার অবসান হয়েছে। কিন্তু না, একই ঘটনা আমরা দেখছি ফুড প্রডাক্টসের বেলায়। গেটে তালা না থাকলে এবং বের হবার জন্যে যথেষ্ট সিঁড়ি থাকলে শ্রমিকরা নিজেরাই নিজেদের প্রাণ বাঁচাতে পারতো। অন্ততপক্ষে হতাহতের ঘটনা অনেক কম হতো।  

শ্রমিকদের পরিচয় জানার জন্যে ডিএনএ টেস্ট করতে সময় লাগবে। এই শ্রমিকদের আত্মীয় স্বজন তাদের মরা মুখটিও দেখতে পাচ্ছে না, কবর দিয়ে তার শেষ ঠিকানাও নির্ধারণ করতে পারছে না, এমনই হতভাগ্য তারা।

যেসব প্রশ্ন তোলা দরকার সেটা হচ্ছে বাজারে যেসব “জনপ্রিয়” শিশু খাদ্য রয়েছে, সেগুলো শিশুদের স্বাস্থ্যের জন্যে নিরাপদ কিনা। এ প্রশ্ন এর আগে তুলেছেন নিরাপদ খাদ্য নিয়ে যারা কাজ করেন তারা। কারণ এই খাদ্য পণ্যগুলোর খাদ্য-মান রক্ষার চেয়ে বেশি মনোযোগ দেয়া হয় চকচকে প্যাকেটজাত করার জন্যে। এতে ব্যাপক প্লাস্টিকের ব্যবহার হচ্ছে। প্লাস্টিকে থাকা এই খাদ্যগুলো যেভাবে রাস্তার পাশের দোকানে ঝুলে থাকে, রোদ-বৃষ্টি সব অবস্থায় বিভিন্ন তাপমাত্রায় সেই জুস, চিপস, ক্রেকার খাওয়া কতখানি নিরাপদ সেটা নিয়ে কেউ ভাবছে না। এই খাদ্য দীর্ঘদিন যেন দোকানে ভাল থাকে, তার জন্যে যেসব উপাদান মেশানো হয় তার স্বাস্থ্যগত দিক কারা দেখছে? আমরা দেখেছি দুর্ঘটনা কবলিত কারখানায় এই সব প্যাকেট তৈরির জন্য প্রচুর প্লাস্টিক, কেমিক্যাল, কার্টনসহ দাহ্য পদার্থ মজুত ছিল। সে কারণে আগুন ভয়াবহ হয়ে উঠেছিল। এত দাহ্য পদার্থ থাকলে আগুন লাগার সম্ভাবনা থাকে বলে কারখানা আইন অনুযায়ী সুরক্ষার জন্যে যথেষ্ট অগ্নি নির্বাপক ব্যবস্থা থাকার কথা ছিল, কিন্তু ফায়ার সার্ভিস সে বিষয়ে নিশ্চিতভাবে বলতে পারে নি।



পত্রিকার খবরে জানা গেছে, চকলেট এবং হেজেলনাটের ‘নোসিলা’ নামক স্প্রেড তৈরির জন্য কাঁচামাল হিসেবে যে ভোজ্যতেল ব্যবহার করা হয় তার কারণেই ২৪ ঘন্টা ধরে আগুন জ্বলেছে। তিন তলায় এই স্প্রেডটি তৈরি হচ্ছিল। ফ্যাক্টরিতে পাইপ লাগিয়ে এই তেল অন্যান্য ফ্লোরেও সরবরাহ করা হয়। যে কোন তেলেই আগুন জ্বলতে পারে, কিন্তু দেখার বিষয় হচ্ছে এগুলো একদিকে দাহ্য পদার্থ, অন্যদিকে স্বাস্থ্যের জন্যেও কতখানি নিরাপদ তা দেখার কি কোন সরকারি প্রতিষ্ঠান আছে কিনা। ২০১৯ সালের একটি প্রতিবেদনে বিএসটিআই ২৬টি কোম্পানির খাদ্য পণ্যকে নিম্ন মানের বলে চিহ্নিত করেছিল, তার মধ্যে হাসেম গ্রুপের কুলসন সেমাই অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। শুধু হাসেম গ্রুপ নয়, স্বাস্থ্যের জন্যে ক্ষতিকর উপাদান অন্যান্য কোম্পানিরও আছে। এবং সেসব কারখানায় নিরাপত্তার জন্যে কোন ব্যবস্থা আছে কিনা আমরা জানি না। নাকি আর একটি দুর্ঘটনা না ঘটলে আমাদের হুঁশ হবে না।  

শিশুদের খাদ্য পণ্য উৎপাদন করানো হচ্ছে শিশু শ্রমিকদের অ-নিরাপদ পরিবেশে কাজ করিয়ে। এই কারখানায় দুর্ঘটনা ঘটবার সকল শর্ত বিদ্যমান ছিল এবং তাদের সতর্কও করা হয়েছিল, তারপরও কোন ব্যবস্থা নেয়া হয় নি। কারখানায় কাজের পরিবেশ নিরাপদ থাকা দীর্ঘদিনের শ্রমিক আন্দোলনের দাবী। গার্মেন্ট শিল্পে তাজরীন ও রানা প্লাজার ঘটনার পর আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের চাপে কাজের পরিবেশ কিছুটা উন্নতি হয়েছে, নজরদারী এবং সচেতনতাও বেড়েছে। কিন্তু অন্যান্য পণ্যের ফ্যাক্টরিতেও কাজের পরিবেশের প্রশ্ন এখনও আছে । হাসেম ফুড প্রডাক্টস ফ্যাক্টরির বেঁচে যাওয়া শ্রমিকরা অভিযোগ করেছেন যে কারখানায় তাদের কাজের পরিবেশ নিরাপদ নয়। প্রায় ৭০০০ শ্রমিক হাসেম ফুড লিঃ এ কাজ করত। যারা মারা গেছে তারা তিন তলায় আটকে ছিল, যেখানে দাহ্য পদার্থ এবং প্লাস্টিক স্টোর করে রাখা ছিল। বের হবার সিঁড়ি না থাকা, সিঁড়ি দিয়েই দাহ্য পদার্থ ওঠানো-নামানো এসব দেখে মনে হচ্ছে শ্রমিকদের মৃত্যুকূপেই রাখা হয়েছিল। 



সবচেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, এই সব কারখানায় শিশু শ্রমের ব্যবহার করে সস্তা শ্রম দিয়ে অধিক মুনাফা কামানোর চেষ্টা করা হয়েছে। বিশ্ব শ্রম সংস্থার তথ্য মতে প্রতি বছর বাংলাদেশে ১১,০০০ শ্রমিক কারখানার দুর্ঘটনায় মারা যায় এবং ২৪,৫০০ শ্রমিক অ-স্বাস্থ্যকর কাজের পরিবেশের কারণে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়। প্রায় ৮০ লক্ষ শ্রমিক নানাভাবে আহত হয় এবং কেউ কেউ স্থায়ীভাবে পঙ্গুত্বের শিকার হয়। হাসেম ফ্যাক্টরির ছয়তলা থেকে যারা প্রাণ বাঁচাবার জন্যে লাফ দিয়েছে তাদের অনেকের ছবি দেখেছি হাসপাতালে পায়ে প্লাস্টার/ব্যান্ডেজ অবস্থায় আছে। তারা সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক জীবনে যেতে পারবে তো? নাকি টাকার অভাবে চিকিৎসা সম্পূর্ণ না করেই বাড়ী ফিরে যেতে হবে আর বাকি জীবন পঙ্গুত্ব বরণ করে থাকতে হবে? তাছাড়া এমন একটি ঘটনায় মানসিক স্বাস্থ্য বিপর্যয় প্রচুর ঘটে। তাজরীন ও রানা প্লাজার অনেক শ্রমিক সেই মানসিক যন্ত্রণা এখনও কাটিয়ে উঠতে পারে নি।  

হাসেম গ্রুপের এই দুর্ঘটনা সম্পর্কে অন্তর্জাতিকভাবেও উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। খুব দুঃখজনক হচ্ছে হাসেম গ্রুপের ফ্যাক্টরিতে ডিপার্টমেন্ট অফ ইন্সপেকশন ফর ফ্যাক্টরিস অ্যান্ড এস্টাবলিশমেন্টস (ডাইফ) এর কর্মকর্তারা ৮ জুন, ২০২১ তারিখে পরিদর্শনে এসে সেখানে শিশু শ্রমিকের ব্যবহার এবং অ-নিরাপদ কাজের পরিবেশ দেখে নোটিশ দিয়েছিলেন। কিন্তু হাসেম গ্রুপ তা আমলে নেয় নি। একমাসের মধ্যেই দুর্ঘটনা ঘটে গেল। অথচ তাদের সুপারিশ অনুযায়ী ব্যবস্থা নিলে এই দুর্ঘটনা ঠেকানো যেত।

আমাদের নীতি নির্ধারক আগুনে পুড়ে মরা এবং আগুনে আহত হওয়ার পর পোড়া মানুষের জন্যে নতুন নতুন হাসপাতাল তৈরিতে যত মনোযোগ দেন, আগুন যেন না লাগে, লাগলেও সে ভবনগুলো থেকে উদ্ধারের ব্যবস্থা উন্নত করার জন্যে তত মনোযোগী নন। প্রশ্ন হচ্ছে, কেন?  

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *