ফরিদা আখতার || Saturday 03 July 2021
করোনা মহামারিতেও মুনাফা করার যারা পরিকল্পনা করতে পারেন, তারা নিশ্চয়ই ‘সেবা’ বোঝেন না। কারণ, ‘সেবা’ তাদের মুনাফা কামানোর উপায় মাত্র।
একটি দৈনিকে মন্ত্রীপরিষদ বিভাগের বরাত দিয়ে জানানো হয়েছে, ‘দেশের সরকারি হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা এনজিওর হাতে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার’ [দৈনিক যুগান্তর, ২৫ জুন, ২০২১]। খবরটি নিঃসন্দেহে উদ্বেগজনক। প্রতিবেদনটিতে একইসাথে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের প্রতিক্রিয়ার কথাও দেয়া হয়েছে; তাঁরা মনে করেন ‘এ ধরনের সিদ্ধান্ত আত্মঘাতী এবং দেশের জন্য মারাত্মক খারাপ হবে, যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।’
প্রথম কথা হচ্ছে, কেন সরকারি হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা এনজিও’র হাতে যেতে হবে?
এনজিও কাগজে কলমে মুনাফাকারী প্রতিষ্ঠান নয়। নন-প্রফিট। কিন্তু বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। তাহলে এনজিওদের হাতে স্বাস্থ্যসেবা ছেড়ে দেওয়ার অর্থ স্বাস্থসেবাকে আরও বেসরকারিকরণ। তাহলে স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের ভূমিকা কী আসলে? আমাদের কাছে কি কোনো পরিসংখ্যান আছে যে এনজিও ব্যবস্থাপনা হলেই জনগণের স্বাস্থ্যসেবা পাওয়া উন্নত হবে? কোনো গবেষণা কি হয়েছে? এই সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে নিশ্চয়ই কোনো গবেষণা করতে হয়েছে। সেই সূত্র কি জনগণ জানে?
প্রতিবেদনে যতটুকু সূত্রের উল্লেখ আছে সেটা হচ্ছে, এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের হেলথ নিউট্রিশন অ্যান্ড পপুলেশন সেক্টর প্রোগ্রাম (এইচএনপিএসপি) বাস্তবায়ন সংক্রান্ত পরিস্থিতি পত্রের (স্ট্যাটাস রিপোর্ট সংক্রান্ত সভার) সিদ্ধান্ত হিসেবে এবং এটি একটি পাইলট প্রকল্প আকারে ‘কতিপয় সরকারি হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা যথাপদ্ধতিতে সক্ষম ও অভিজ্ঞ বেসরকারি সংস্থার (এনজিও) কাছে হস্তান্তরের ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।’
এই প্রকল্প সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে নয়, দাতাগোষ্ঠির অনুদানে হচ্ছে। বিশ্বব্যাংক-সহ বেশ কয়েকটি দাতাসংস্থা এর সাথে যুক্ত আছে। ফলে সিদ্ধান্তটাও সরকারের নিজস্ব না-ও হতে পারে। এ বিষয়ে আরও খোঁজ নেওয়া দরকার। তবে যেটাই হোক, প্রকল্প হোক আর নিজস্ব অর্থায়নেই হোক, এটা এ দেশের মানুষের স্বাস্থ্যসেবার সাথে যুক্ত একটি বিষয়। এর সাথে জনগণের স্বার্থ জড়িত।
‘এনজিও’ বলে ঢালাওভাবে ভালো বা খারাপ বলার সুযোগ নেই। বাংলাদেশে প্রায় ২৫০০-এর বেশি এনজিও সরকারিভাবে নিবন্ধনকৃত আছে। এর মধ্যে সব এনজিও স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে কাজ করছে না। যেসব এনজিও স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে কাজ করছে, তাদের মধ্যেও অনেক ভাগ আছে, যেমন নিরাপদ পানি নিয়ে কাজ, ইপিআই, পরিবার পরিকল্পনা, নারীর প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা, এবং কিছু এনজিও বিশেষ স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের কাজ করছে। তারা নিজ নিজ ক্ষেত্রে, নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠির মধ্যে ভালো কাজ করছে, সন্দেহ নাই। কিন্তু এর মানে এই নয় যে, তারা সরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের ব্যবস্থাপনায় বিশেষ পারদর্শী হয়ে উঠেছে। হাতে গোনা দুয়েকটি এনজিও সেবা প্রদানে তাদের নিজস্ব ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে, তা সত্ত্বেও তারাও সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার বিষয়ে তেমন অবদান রাখতে পারবে না।
তাহলে এনজিওদের সরকারি স্বাস্থ্যসেবার ব্যাবস্থাপনার দায়িত্ব দেওয়ার অর্থ হচ্ছে এটা বেসরকারিকরণের দিকে ঠেলে দেওয়া। নীতিগতভাবেই এই সিদ্ধান্ত গ্রহণযোগ্য হবে না। প্রতিবেদনে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা যে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন, তাতে প্রধান একটি বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। তারা বলছেন, ‘এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হলে দেশের স্বাস্থ্য ব্যয় আরও বাড়বে, যা সাধারণ জনগণের নাগালের বাইরে চলে যাবে। সেবা তো বাড়বেই না, বরং সরকারি স্বাস্থ্য খাতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে।’
তারা আরও যে প্রশ্ন তুলে ধরেছেন, সেটা হচ্ছে এনজিওদের সক্ষমতার প্রশ্ন। সরকার বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠির সেবা দিতে পারে, এনজিওগুলো নির্দিষ্ট এবং সীমিত সংখ্যক জনগোষ্ঠি নিয়ে কাজ করে বলেই তারা ভালো ব্যবস্থাপনা দেখাতে পারে, কিন্তু সরকারি হাসপাতালের বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠির ব্যবস্থাপনা কি তারা করতে পারবে? উত্তর হচ্ছে, এর আগের অভিজ্ঞতাগুলো দেখলে দেখা যাবে, তারা পারেনি। অতীত অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, বরং তারা সেবার খরচ বাড়িয়েছে এবং জনগণের ওপর খরচের বোঝা চাপিয়েছে।
স্বাস্থ্যসেবা পাওয়া জনগণের মৌলিক সাংবিধানিক অধিকারের মধ্যে থাকলেও গত ৫০ বছরে সরকারের সেবা প্রদান অনেকটা কমে গেছে। আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহের উদারনীতি পরামর্শ অনুযায়ী স্বাস্থ্য খাতকে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে মাত্র ৩০% স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করা হচ্ছে সরকারি স্বাস্থ্যসেবার মাধ্যমে। সত্তর ভাগই প্রাইভেট স্বাস্থ্য বেচা-কেনার মধ্যে পড়ে গেছে। এখানে ‘সেবা’ নয়, মুনাফা অর্জনই মূল লক্ষ্য। বাজার ব্যবস্থায় স্বাস্থ্যসেবা আর দশটা পণ্যের মতোই পণ্য।
বাংলাদেশের বর্তমান স্বাস্থ্যসেবার যে দুর্গতি, তার জন্যে সরকারি ব্যবস্থাপনাকে এককভাবে দায়ী করলে হবে না। বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবার জবাবদিহিতা নাই, ফলে তাদের স্বাস্থ্যসেবার মূল্যায়ন হচ্ছে না। তবু এখনো যে ৩০% সেবা সরকারি হাসপাতাল থেকে দেওয়া হয়, সেটাই সাধারণ মানুষের একমাত্র ভরসার জায়গা। এখানেও সেবা পেতে গিয়ে গরিব নাগরিকদের নিজের পকেট থেকে খরচ করতে হয় প্রায় ৬৪%। তবু ভালো। কারণ সরকারি হাসপাতালে আর কিছু না থাকুক, ভালো চিকিৎসক আছেন, ভালো নার্স আছেন, এবং আছেন টেকনিশিয়ান। যন্ত্রপাতিও এখানেই সবচেয়ে ভালো। বেড না পেয়ে ফ্লোরে সীট পেলেও চিকিৎসা হবে। এখানে যন্ত্রের দাম তোলার জন্যে অহেতুক টেস্ট ও চিকিৎসার পরামর্শ দেওয়া হয় না। কারণ এর সাথে চিকিৎসকের ব্যক্তিগত কোনো সুবিধার বিষয় জড়িত নয়। কিন্তু প্রাইভেট হাসপাতাল বা ‘এনজিও’ হলে এর সাথে ব্যসায়িক স্বার্থ জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনাই খুব বেশি।
কোভিড টেস্ট এবং চিকিৎসার ক্ষেত্রেও আমরা দেখেছি প্রথম অবস্থায় শুধুমাত্র সরকারিভাবে টেস্ট এবং চিকিৎসার পরিকল্পনা ছিল। তাতে করে ক্রমবর্ধমান মহামারি ঠেকানো যাবে না বলেই বেসরকারি চিকিৎসা সেবা প্রতিষ্ঠানকে অনুমতি দেওয়া হলো। এতে সামর্থবান মানুষদের চিকিৎসা সেবা পাওয়ার সুযোগ বেড়েছে বটে, কিন্তু কোনোভাবেই সাধারণ মানুষের উপকারে আসেনি।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের গবেষণায় করোনা চিকিৎসার খরচের একটি হিসাবে দেখা যাচ্ছে, সরকারি করোনা হাসপাতালে একজন রোগীর চিকিৎসায় সরকারি হাসপাতালে সাধারণ শয্যায় দৈনিক গড় খরচ যথাক্রমে ১২,৮১১ টাকা এবং আইসিইউতে ৫১,০০৬ টাকা। বেসরকারি হাসপাতালে দুই ধরনের শয্যায় দৈনিক গড় খরচ যথাক্রমে ৩৭,১২৮ টাকা এবং ৬৮,৮৮৫ টাকা। সরকারি হাসপাতালে ওষুধ খরচ হয় ১৫.৮% ও ও রোগনির্ণয় খাতে ২.৪%। বেসরকারি হাসপাতালে এই হার যথাক্রমে ৩০% ও ১৭.৭% [প্রথম আলো, ১ মে, ২০২১]।
সরকারি সেবার চেয়ে বেসরকারি হাসপাতালে এত বেশি টাকা নেওয়ার কী কারণ থাকতে পারে, তার কোনো ব্যাখ্যা নেই। করোনা মহামারিতেও মুনাফা করার যারা পরিকল্পনা করতে পারেন, তারা নিশ্চয়ই ‘সেবা’ বোঝেন না। কারণ, ‘সেবা’ তাদের মুনাফা কামানোর উপায় মাত্র।
সরকারি স্বাস্থ্যসেবায় অব্যাবস্থাপনার কারণগুলো দেখা যাক। একটি বড় কারণ হচ্ছে আমলা নির্ভরতা এবং এর সাথে যুক্ত দুর্নীতি। তাছাড়া কেন্দ্রীয়ভাবে সব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী ওষুধপত্র ও যন্ত্রপাতি দেওয়া হয় না। বিশেষজ্ঞ জনবল নাই, বাজেট বরাদ্দ অপ্রতুল। এসব কারণ দূর করা কঠিন কিছু নয়। কিন্তু সেটা করা হয় না।
কাজেই, সরকারের এই সিদ্ধান্ত আশা করি আর বেশি দূর এগোবে না। জনস্বার্থে সরকারি স্বাস্থ্যসেবাকে উন্নত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করাই হবে উত্তম কাজ।