উবিনীগ || Tuesday 08 June 2021 ||
স্থান: বানতিয়ার, সোনাতনী, শাহজাদপুর, সিরাজগঞ্জ
প্রকল্প: জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক দূর্যোগের পরিপ্রেক্ষিতে নয়াকৃষি কৃষকের ফসল পরিকল্পনা ও দূর্যোগ (নদী ভাঙ্গন, বন্যা, খরা, জলাবদ্ধতা) মোকাবেলার উদ্যোগ।
এ বছর (২০২১) যমুনা নদীর মাঝখানে বানতিয়ার, বালিয়াডাঙ্গা ও ঘোরজান গ্রামের কৃষক, শিক্ষক, ইউপি সদস্য ও ব্যবসায়ীদের সাথে কয়েক দফা আলোচনার পরে ২৭ মে ২০২১ প্রাকৃতিক দূর্যোগ ও নদী ভাঙ্গন রোধে বাঁশের ছটকা নির্মানের কাজ শুরু হয়েছে। প্রতি বছরই এই চরের মানুষেরা প্রাকৃতিক দূর্যোগ এবং নদী ভাঙ্গনের মুখোমুখি হয়।
অনেক বছর ধরে উবিনীগ প্রাইমেট’স ওয়ার্ল্ড রিলিফ এন্ড ডেভেলাপমেন্ট ফান্ড (PWRDF) এর সহায়তায় নদী ভাঙ্গন রোধে নয়াকৃষি আন্দোলনের কৃষকদের সাথে একত্রে কাজ করে আসছে। পাশাপাশি নতুন জেগে ওঠা চরগুলোতে নয়াকৃষির কৃষকেরা প্রাণবৈচিত্র্য নির্ভর চাষাবাদ করছে। উবিনীগ বছরের পর বছর চরের নয়াকৃষি আন্দোলনের এই সব কৃষকদের পাশে থেকে বাঁশের ছটকা নির্মাণ করে কৃষকদের বাড়ি ঘর রক্ষা এবং নদীতে ছটকা দেওয়ার মাধ্যমে নতুন চর তৈরী করে সেই চরে প্রাণবৈচিত্র্যপূর্ণ নয়াকৃষি ফসল উৎপাদনে সহায়তা করে আসছে।
খড়স্রোতা যমুনা নদীতে প্রতি বছরই চরের বিভিন্ন গ্রাম ভেঙ্গে যায়। কৃষক হারায় তাদের ফসলি জমি ও ঘরবাড়ি। এই প্রাকৃতিক দূর্যোগ ও নদী ভাঙ্গন মোকাবেলা করে নয়াকৃষির কৃষকেরা যমুনা নদীতে বাঁশের ছটকা দিয়ে নতুন চর তৈরী ও নদী ভাঙ্গন রোধ করে দীর্ঘ দিন ধরে নয়াকৃষি পদ্ধতিতে চাষাবাদ করে আসছে। বাঁশের এই ছটকা দেওয়ার কারণে প্রতিবছরই নদীতে জেগে উঠছে শতশত একর জমি।
২০১৯ সালের বাঁশের ছটকা দেওয়ার ফলে প্রায় ২০০ একর নতুন চর তৈরী হয়েছে। নতুন চরে যেখানে পলিমাটি ছিল সেখানে প্রায় ২৫ থেকে ৩০ একর জায়গায় বন্যায় পলি পড়েছিল। জমি জেগে উঠার সাথে সাথেই গ্রামের নয়াকৃষি কৃষকেরা একত্রে সেই জমিতে করচা ঘাস লাগিয়ে দেয়। পরবর্তী বছর নদীর ঘোলা পানি করচা ঘাসের সাথে জমে পলি পড়ে চর উচুঁ হতে থাকে। হালকা পলি ও বালি মিশ্রিত জমিতে নয়াকৃষি কৃষকেরা আবাদ করতে থাকে বাদাম, মিশ্র ভাবে তিল, কাউন ও বিভিন্ন জাতের বন্যা সহনশীল আমন ধান। যেমন- বকঝুল, হিজলদিঘা, লাল ঢেপা। আবার যেখানে ঘন পলি পড়ে সেখানে মাসকালাই ছিটিয়ে দেয়। প্রচুর মাসকলাই হয়েছিল পলি মাটিতে।
সেই জমিতে এ বছর বোয়ালী বরো ধানের আবাদ করা হয়েছিল। পলি-কাদাতে এই ধান ভাল হয়েছে। বোয়ালী বরো ধান আবাদের জন্য কোন পানির প্রয়োজন হয় নাই। অনেক পরিবারের ২/৩ মাসের খাবার যোগান হয়েছে। যেখানে কম পলি পড়েছে সেই জায়গাতে কৃষককেরা বাদাম, তিল ও কাউনের আবাদ করেছে।
এ ভাবে কয়েক বছরে যমুনা নদীর মাঝখানে চার থেকে পাঁচটি গ্রামে কৃষকেরা ৭০০ থেকে ৮০০ একরেরও বেশী জমিতে ফসল আবাদ করে আসছে। জ্যৈষ্ট মাসের প্রথমেই নদীর ধারের বোয়ালী বোরো ধান কাটা হয়ে গেছে। এখন কৃষকেরা বাদাম উঠানো শুরু করেছে। চরে এখন নারী-পুরুষ, ছেলে মেয়েরা খুব ব্যস্ত, বাদাম গাছ থেকে বাদাম ছড়ানোর কাজে। কারন কৃষকেরা জমি থেকে বাদাম তোলার পর বাড়ির ছেলে-মেয়েসহ নারীরাই বাদাম ছড়ানো ও শুকানোর কাজগুলো করে। চরে হাঁটলে চোখে পড়বে বাড়ির সবাই নদীর ধারে বসে বাদাম ছাড়াচ্ছে। নদীর পানিতে বাদাম ধুয়ে রোদে শুকাচ্ছে।
এবারের খরায় চরে তিল ভাল হয়েছে। এটা খরা সহনশীল চারশিরা তিল, কৃষকেরা আশা করছে ফলন ভাল হবে। তিল গাছে ফুল ধরা শুরু হয়েছে। শ্রাবণ মাসে বন্যার পানি চরে উঠার আগেই তিল ও কাওন কাটা শুরু হবে। তাই ছটকা দেওয়ার ফলে নতুন জেগে ওঠা চরে আবাদ করতে পেরে নয়াকৃষির কৃষকেরা খুবই খুশি।
এ বছর (২০২১) যমুনা নদীর মাঝখানে বানতিয়ার, বালিয়াডাঙ্গা ও ঘোরজান গ্রামের কৃষক, শিক্ষক, ইউপি সদস্য ও ব্যবসায়ীদের সাথে কয়েক দফা আলোচনার পরে ২৭ মে ২০২১ প্রাকৃতিক দূর্যোগ ও নদী ভাঙ্গন রোধে বাঁশের ছটকা নির্মানের কাজ শুরু হয়েছে। এবারে কৃষকেরা সুনিদিষ্ট পরিকল্পনা করে ছটকা দেওয়ার কাজ করছে, সবার সাথে আলোচনার ভিত্তিতেই ছটকার জায়গা নির্বাচন করা এবং বর্ষার পানি ও নদীর স্রোতে যাতে ছটকা টিকে থাকে এটা কৃষকেরা মাথায় রেখেই ছটকার জায়গা নির্ধারণ করা হয়েছে। কি পরিমাণ পলি পড়ে নতুন চর তৈরী হতে পারে এ বিষয়ে কৃষকেরা প্রাথমিক একটা ধারণা করেছে। ছটকা তৈরীর শ্রমিকের পাশাপাশি কৃষকরাও তাদের শ্রম দিয়ে সহায়তা করছে, কেউ বস্তায় বালি ভরছে, কেউ রশি তৈরী করছে আবার কেই নদীতে নেমে বাঁশ পুঁতার কাজসহ নানা ধরনের কাজ করছে।
এ বছরে নতুন ছটকা দেওয়ার মাধ্যমে চরের মধ্যে একমাত্র হাই স্কুল, প্রাইমারী স্কুল ও বানতিয়ার বাজার রক্ষা করার পাশাপাশি পুরাতন চরের সাথে নতুন জেগে ওঠা চরের সংযোগ তৈরী করতে চায়। এই ছটকা দেওয়ার কারনে তারা আশা করছে ১০০ থেকে ১৫০ একর নতুন চর তৈরী হবে। যেহেতু বর্ষার শুরুতেই ছটকা দেওয়ার কাজ শুরু হয়েছে। তাই প্রথম থেকেই ঘোলা পানির সাথে যে পলি আসে সেগুলো ছটকার সাথেই জমতে থাকবে। যদি নতুন চর তৈরী হয় তাহলে পুরাতন চরের সাথে এটা মিশে যাবে এবং তিনটি গ্রামের কৃষি জমির পরিমাণ বেড়ে যাবে। কৃষকেরা অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবেন। তাদের বাড়িগুলো স্থায়ী হবে। একমাত্র বাজারটি টিকে থাকবে। প্রাইমারী ও হাইস্কুল মিলে ২৫০০ ছাত্র – ছাত্রীরা স্কুলে পড়াশুনা করতে পারবে।
রবিউল ইসলাম চুন্নু,
রিদয়পুর বিদ্যাঘর, টাঙ্গাইল, ৩১ মে ২০২১ ।