তামাক ছাড়ার অঙ্গীকার ঘোষণা

ফরিদা আখতার || Monday 31 May 2021

পৃথিবীর প্রায় ১০ কোটি মানুষ তামাক ছাড়ার চেষ্টা করছেন কিন্তু এ মরণঘাতি পণ্যের সেবনের অভ্যাস থেকে তারা নিজেদের মুক্ত করতে পারছেন না। এমন একটি পরিস্থিতিতে বিশ্ব তামাক মুক্ত দিবসে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রতিপাদ্য হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে “Commit to Quit” । বাংলাদেশে তামাক নিয়ন্ত্রণের যে সরকারি কার্যক্রম আছে তাতে এর বাংলা করা হয়েছে “আসুন আমরা প্রতিজ্ঞা করি, জীবন বাঁচাতে তামাক ছাড়ি” । বলা বাহুল্য, এতে পরিস্কার যে তামাক সেবনের সাথে মৃত্যুর সম্পর্ক আছে আর জীবন বাঁচাতে হলে তামাক সেবন ছাড়তেই হবে।

সারা বিশ্বে বছরে ৮০ লক্ষ মানুষ তামাক সেবনের কারণে মৃত্যুবরণ করে। বাংলাদেশে মারা যায় বছরে প্রায় দেড় লক্ষ মানুষ। এই মৃত্যুগুলো স্বাভাবিক নয়, অনেক ক্ষেত্রেই অকাল মৃত্যু। এটা একধরণের হত্যাকান্ড, কারণ এর সাথে জড়িয়ে আছে তামাক কোম্পানির ছলচাতুরি ও কৌশল। তারা একদিকে তামাক পণ্যের ব্যবহার বাড়াতে বিভিন্ন ধরণের আকর্ষণীয় প্যাকেট বাজারে ছাড়ে, যেসব দোকানে বিক্রি হয়, সেখানে নিজ নিজ ব্রান্ড যেন চেনা যায় সেভাবে সাজিয়ে দিয়ে আসা, তরুণদের জন্যে খেলাধূলা, কনসার্ট ইত্যাদীর আয়োজন করা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আন্তর্জাতিক সনদ ফ্রেমওয়ার্ক কনভেন অন টোবাকো কন্ট্রোল (এফসিটিসি) এবং স্বাক্ষরকারী দেশসমূহের জাতীয় আইন অনুযায়ি তামাক পণ্যের বিজ্ঞাপন নিষিদ্ধ, এমনকি পরোক্ষভাবে প্রভাবিত করার কর্মসুচি নেয়াও বে-আইনী। তামাক কোম্পানি এখন সরাসরি বিজ্ঞাপন না দিলেও পরোক্ষ কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। অন্যদিকে তারা সরকারের তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন যেন বাস্তবায়ন না হয় তার জন্যে বাধার সৃষ্টি করে। এসব কোম্পানি হচ্ছে জাপান টোবাকো ইন্টারন্যাশনাল, ব্রিটিশ আমেরিকান টোবাকো কোম্পানি, ফিলিপ মরিস ইন্টার ন্যাশনাল, ইম্পেরিয়াল টোবাকো। এর সাথে দেশেরও অনেক বড় বড় কোম্পানি তামাকের ব্যবসায় যুক্ত আছে এবং তামাক সেবনকারী বাড়ানোর জন্যে সব ধরণের কৌশল অবলম্বন করে। কাজেই তামাক ছাড়ার এই অঙ্গীকার তামাক কোম্পানির জন্যে একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিশেবেই আসার কথা।

আমরা কোভিড মহামারীতে সংক্রমণ এবং মৃত্যু নিয়ে উদ্বিগ্ন। গত বছর মার্চ গত বছর মার্চ ২৯ মে,২০২১ পর্যন্ত কোভিডের কারণে মৃতুয়র সংখ্যা ১২৫৪৯ জন, এবং সংক্রমিত হয়েছে ৭ লক্ষ ৯৭ হাজার ৩৮৬ জন। অর্থাৎ তামাক আগে থেকেই মহামারী আকারে রয়ে গেছে। বছরে এতো সংখ্যক অকাল মৃত্যু কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। তামাকের কারণে মানুষ অ-সংক্রামক রোগে ভুগে মারা যাচ্ছে, যা দিনে দিনে বাড়ছে। জাতীয় অধ্যাপক বিগেডিয়ার (অবঃ) এম , এ, মালিক.২৯ মে অনুষ্ঠিত তাবিনাজের একটি ওয়েবিনারে বলেন, কোভিড সংক্রামক রোগ থেকে বাঁচার চেষ্ট করছি, কিন্তু তামাকের কারনে যেসব অসুস্থতা সৃষ্টি হয় তা অ-সংক্রামক ব্যাধি, যেমন হার্টের রোগ, ট্রোক, শ্বাস কষ্টজনিত রোগ ইত্যাদী। তামাক সেবনের কারণে তার শরীরের প্রায় সকল অংগ ক্ষতিগ্রস্থ হয়।” সেদিক থেকে দেখতে গেলে কোভিড সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের আমাদের যতো চেষ্টা থাকছে, তামাক নিয়ন্ত্রণের জন্যে তার চেয়েও বেশি চেষ্টা থাকা উচিত। তামাক সেবন সংক্রামক নয়, কিন্তু তামাক সেবনের অভ্যাস সংক্রামকের মতোই কাজ করে। তরুণ বয়সের অধিকাংশই বন্ধু বান্ধবের পাল্লায় পড়েই অভ্যস্থ হয়ে পড়ে। সিগারেট সেবনকারীদের মধ্যে প্রতিযোগিতা হয় কে কত কায়দা করে ধোঁয়া ছাড়তে পারে তার ওপর তার পৌরষত্ব বা বীরত্ব প্রকাশ পায়। এটা একটা বিনোদন এবং বেশ আনন্দদায়ক।

অর্থাৎ অভ্যাসটি সংক্রামক, যা পণ্যটির কোম্পানি সেভাবেই আকৃষ্ট করার চেষ্টা করে। আর যারা সেবন করেন না, বিশেষ করে নারী, স্ত্রী, বান্ধবী, বোন কিংবা আশে পাশে যারা থাকে পরোক্ষ ধূমপান বা ইংরেজীতে Second Hand Smoking এর শিকার হয়ে নানা ধরণের অসুস্থতায় ভোগেন। সবচেয়ে দুঃখজনক হচ্ছে শিশুরা বাবা বা কাছের অত্মীয়ের ধূমপানের শিকার হয়, আর যে শিশু মায়ের গর্ভে থাকে, সে কি কোনভাবে ছাড় পায়? তাদের বাঁচাবে কে?

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এই ঘোষণার একটি সীমাবদ্ধতা হচ্ছে, এই প্রতিজ্ঞা বিশেষ করে ধূমপান ছাড়ার কথাই বলছে। ধূমপানের সমস্যা উন্নত বিশ্বের জন্যে বিশেষভাবে প্রযোজ্য অবশ্যই। সেখানে ধোঁয়াবিহীন তামাকের ব্যবহার খুব কম। পৃথিবীর ধোঁয়াবিহীন তামাক সেবনকারীর ৯০% আছেন দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে। এসব দেশে ধূমপানের পাশাপাশি ধোঁয়াবিহীন তামাকের উচ্চহারে ব্যবহার রয়েছে। যেমন বাংলাদেশে ২০১৭ সালের গ্যাটসএর পরিসংখ্যান অনুযায়ি প্রায় ২ কোটি ধূমপায়ি আছে, কিন্তু পানের সাথে জর্দা এবং সাদাপাতা খাওয়া এবং মাড়িতে গুল লাগানো প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের সংখ্যা হচ্ছে ২ কোটি ২০ লক্ষ। এর মধ্যে নারী এবং গরিব মানুষের সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশ ফুড সেফটি অথরিটির খাদ্য বিশেষজ্ঞ ড। এম এ আলীম তাবিনাজের ওয়েবিনারে বলেন “ধূমপানের কারনে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্থ হয় ফুসফুস, কারণ সিগারেটের ধোঁয়া ফুসফুসেই যায়, এবং কিছু বেরিয়ে আসে, কিন্তু জর্দা-সাদাপাতা খেলে তা সরাসরি পাকস্থলীতে যায়। ফলে শরীরে এর প্রভাব অনেক বেশি”। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এই প্রতিপাদ্য তাই শুধু ধূমপানের ক্ষেত্রে ব্যবহার করলে হবে না, ধোঁয়াবিহীন তামাকের ব্যবহার কি করে ছাড়ানো যায় তার দিকে নজর দিতে হবে। এখনো তামাক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমের মধ্যে বিষয়টি গুরুত্বের সাথে দেখা হচ্ছে বলে মনে হয় না।

ধূমপান হোক বা ধোঁয়াবিহীন তামাক হোক, তামাক ছাড়তে না পারার পেছনে মূল কারণ হচ্ছে এর মধ্যে নিকোটিন আছে। তামাকের পাতায় নিকোটিন আছে সেটাই তামাকদ্রব্যের মূল উপাদান। কিন্তু শুধু তামাকের পাতা দিয়ে যদি সিগারেট, বিড়ি, জর্দা ইত্যাদী তৈরি হোত তা সবার কাছে আকর্ষণীয় হোত না। তাই তারা অন্যান্য উপাদান মেশায়। জর্দার ক্ষেত্রে মেনথল , গ্লিসারিন, নানারকম মশলা ও সুগন্ধি কেমিকেল দিয়ে ভরিয়ে দেয়া হয়। এমনিতেই জর্দা ও সাদাপাতা ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ সিগারেট-বিড়ি নিয়ন্ত্রণের চেয়ে কঠিন, কারণ পানের সাথে জর্দা খাওয়া কেউ খারাপ চোখে দেখে না। সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য। দাওয়াতে বা বিয়ে বাড়ীতে পোলাও কোর্মা খাওয়ার পর পানের সাথে নানা ধরণের উপাদান মিশিয়ে পান না দিলে কনে বা বরের বাড়ীর লোকের বদনাম হয়।

জর্দা, সাদাপাতা এবং গুলের ব্যবহারে নানা ধরণের স্বাস্থ্য ক্ষতি আছে, বিশেষ মুখ-গহবরে ঘা, ক্যান্সার, মাড়ীতে ঘা, কন্ঠনালী সহ পাকস্থলীর নানা সমস্যা দেখা যায়। প্রজনন স্বাস্থ্যের দিক থেকে তামাক সেবন নারীর জন্যে এবং গর্ভের সন্তানের জন্যে অত্যন্ত ক্ষতিকর। কম ওজনের সন্তান জন্ম দেয়া এমন মৃত সন্তান প্রসব করে নারীর যে কত সমস্যা হয় তা ভক্তভুগি মাত্রই জানে।

তামাক ছাড়ার কথাই যদি বলি তাহলে কি এটা শুধু সেবনকারীর ব্যক্তি পর্যায়ের বিষয় হয়ে থাকবে? এর সাথে কি সমাজ বা রাষ্ট্রের কোন দায়িত্ব থাকবে না? তামাকে আশক্ত সেবন কারীর কাছে ক্ষতির সব তথ্য জানা নেই তাই সে খেতে শুরু করে। কিন্তু যদি রাষ্ট্র এর ব্যাবহারের নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা নেয় তবে নিশ্চয়ই সেবনকারীর জন্যে অত সহজ হবে না। ধোঁয়াবিহীন তামাক খুব সহযে এবং অল্প দামে পাওয়া যায়। ছোট ছোট প্যাকেটে, কম দামে যেখানে সেখানে কিনতে পাওয়া যায়। তাহলে কেউ ছাড়তে চাইলে কি ছাড়তে পারবে?

কাজেই তামাক সেবন ছাড়ার জন্যে সামাজিকভাবে এবং রাষ্ট্রীয় ভাবে জনগণের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করার সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করতে হলে তামাক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম জোরদার করতে হবে। কোম্পানির নানা ধরণের কৌশল থেকে বেরিয়ে জনস্বাস্থ্য রক্ষার প্রতিজ্ঞা করতে হবে।

সাম্প্রতিক দেশকাল-এ প্রকাশিত হয়: ৩১ মে ২০২১

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *