উবিনীগ || Monday 10 May 2021
উবিনীগ (উন্নয়ন বিকল্পের নীতিনির্ধারণী গবেষণা) এর একটি অনুসন্ধানমূলক গবেষণা
ধোঁয়াবিহীন তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবহার
বাংলাদেশে প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে ধোঁয়াবিহীন তামাকজাত দ্রব্য (জর্দা, গুল ও সাদা পাতা) প্রাপ্তবয়স্ক জনগোষ্টির মধ্যে ব্যবহারকারীর সংখ্যা শতকরা ২০.৬ ভাগ (২ কোটি ২০ লক্ষ)। ধোঁয়াবিহীন তামাক ব্যবহারকারী নারীদের মধ্যে বেশী (২৮%) প্রাপ্তবয়স্ক নারী। ব্যবহারকারীর মধ্যে ধোঁয়াযুক্ত তামাক ব্যবহারকারীর ১৮% এর বেশী (১ কোটি ৯২ লক্ষ)। [গ্যাটস, ২০১৭] ভারত এবং নেপালের পরেই ৯টি দক্ষিণ পূর্ব এবং দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলির মধ্যে ধোঁয়াযুক্ত তামাক ব্যবহারের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়। ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন ২০০৫, সংশোধিত ২০১৩ এ তিনটি ধোঁয়াবিহীন তামাকজাত দ্রব্য যেমন – জর্দা, গুল ও সাদাপাতা তামাকের সংজ্ঞায় আর্ন্তভুক্ত করা হয়েছে এবং আইনের আওতায় এনে ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থাও করা হয়েছে।
ধোঁয়াবিহীন তামাক কারখানা এবং কর্মরত শ্রমিকদের সমিক্ষা
উবিনীগ বাংলাদেশের ৮টি বিভাগ থেকে ২৯টি জেলায় ৮৮টি ধোঁয়াবিহীন তামাক উৎপাদন কারখানার তথ্য সংগ্রহ করেছে। সেইসব কারখানার তথ্য সংগ্রহ করা হয় যে সব ধোঁয়াবিহীন তামাক (জর্দা, গুল) দ্রব্য উৎপাদনকারী কারখানাগুলি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে বর্তমানে কর প্রদান করছে না। কর প্রদানের তথ্যের পাশাপাশি তথ্য নেওয়া হয় কারখানার উৎপাদন ব্যবস্থা, কাজের পরিবেশ এবং শ্রমিকদের মজুরী প্রদানের নিয়ম- সম্পর্কে। তাবিনাজ গবেষকরা সাক্ষাতকার গ্রহণ করেন কারখানার মালিক বা ম্যানেজারের কাছ থেকে। কারখানার কোন শ্রমিকের কাছ থেকে সাক্ষাতকার গ্রহণ করা হয় নাই। অন্য আর একটি গবেষণায় তামাক কারখানায় নারী শ্রমিকদের সম্পর্কে ডেস্ক সমিক্ষা করা হয়। ক্যাম্পেইন ফর টোবাকো ফ্রি কিডস্ (সিটিএফকে) এর সহায়তায় এই গবেষণার কাজটি পরিচালিত হয়। তথ্য সংগ্রহের কাজ করা হয়েছিল আগষ্ট থেকে নভেম্বর, ২০২০ সালে।
ফলাফল:
ধোঁয়াবিহীন তামাক কারখানা এবং উৎপাদিত তামাক পণ্য সম্পর্কে তথ্য
- ৬১% কারখানায় কোন ফ্যাক্টরি ভবন নাই। মালিকের বাড়ির এক অংশ কারখানা আকারে ব্যবহার কবা হয়। যা ৫০০ বর্গফুটের কম জায়গা।
- ৩৩% কারখানার কোন বৈধ লাইসেন্স নাই।
- ৯৮% কারখানার সামনে কোন সাইনর্বোড ছিল না।
- ৯১% কারখানায় কোন মেশিন নাই, হাতে কাজ করা হয়।
- ৮৮টি কারখানায় ১৩১টি জর্দা এবং ৭টি গুল ব্রান্ড উৎপাদন করে। ৩৭% কারখানায় একাধিক জর্দা, গুল ব্রান্ড উৎপাদন করে।
- জর্দা ও গুলের মধ্যে ১০ গ্রাম ওজনের কৌটা বেশি তৈরি করা হয়। গুলের ৭০% ই ১০ গ্রামের।
- দামের দিক থেকে গুলের দাম ১০ টাকারও কম।
শ্রমিক সম্পর্কে তথ্য
- ৮০% কারখানার মালিকেরা শ্রমিক সম্পর্কে তথ্য প্রদান করেছেন।
- ৮৮টি কারখানা ৬৩১ জন পূর্ণকালিন শ্রমিক পাওয়া যায়। অর্থাৎ জর্দা-গুল কারখানা কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে না।
- শ্রমিকের মধ্যে নারীর সংখ্যা ৫৬%, পুরুষ ৩৭%।
- প্রতি কারখানা গড় শ্রমিক সংখ্যা ৯ (পুরুষ ৩.৪ এবং নারী শ্রমিক ৫)
- ২০% কারখানার মালিক খন্ডকালিন শ্রমিক সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন।
- ১৮টি কারখানায় খন্ডকালিন শ্রমিক আছে যার মধ্যে ২২ জন (৩৯%) পুরুষ এবং ৩৪ জন নারী (৬১%) শ্রমিক রয়েছে।
- খন্ডকালিন নারী শ্রমিকদের সংখ্যা পুরুষ খন্ডকালিন শ্রমিকদের চেয়ে বেশী।
পূর্ণকালিন এবং খন্ডকালিন শ্রমিক সংখ্যার দিক থেকে নারী শ্রমিকদের সংখ্যাই বেশী। অর্থাৎ এই কারখানাগুলো গরীব নারীদের শ্রমিক হিসাবে নিয়োগ করে।
নারী, পুরুষ শ্রমিকের কাজের বিভাজন
পুরুষ শ্রমিক:
পুরুষ শ্রমিকেরা উৎপাদন পূর্ব কাজ যেমন, কাঁচামাল বহন, তামাক পাতা সংগ্রহ, অন্যান্য উপকরণ সংগ্রহ, রাসায়নিক দ্রব্য সংগ্রহ এবং যাবতীয় মালামাল বস্তাবন্দী করা ইত্যাদি কাজ করে থাকেন।
পুরুষ শ্রমিকেরা প্রস্তুতকৃত জর্দা-গুলে কৌটা আনা নেওয়ার কাজ করেন এবং বিক্রেতাদের কাছে উৎপাদিত পণ্য পৌঁছে দেওয়ার কাজ করে থাকেন।
নারী শ্রমিক:
নারী শ্রমিকেরা তামাক পাতা শুকানো, কেটে টুকরা এবং গুড়া করা, “ওষুধ” মেশান, অন্যান্য উপকরণ মেশান (সুগন্ধি, স্বাদ বাড়ানো, নেশা বাড়ানো) ইত্যাদি যাবতীয় উপকরণ একত্রে করার কাজ করেন।
বিভিন্ন সাইজের কৌটায় তামাকের মিশ্রিত উপকরণগুলি ভড়ানোর কাজ করে থাকেন।
নারী শ্রমিকদের সাথে শিশু শ্রমিকেরা কৌটা প্যাকেট করা এবং পেটি করার কাজে সাহায্য করে। নারী শ্রমিকেরা যতক্ষণ কারখানায় কাজ করে শিশু শ্রমিকদেরও ততোক্ষণ কারখানায় কাজ করতে হয়।
কাজের ঘন্টা ও মুজুরি
- ৬৩% কারখানায় পূর্ণকালিন এবং খন্ডকালিন শ্রমিক ৮ ঘন্টার বেশী সময় কাজ করেন।
- ২৯% কারখানায় দৈনিক ভিত্তিতে শ্রমিকদের মজুরী প্রদান করা হয়। এদের মধ্যে ২৮% সাপ্তাহিক ভিত্তিতে এবং ৫১% মাসিক ভিত্তিতে।
- ৭৪% কারখানায় পূর্ণকালিন শ্রমিকেরা সাপ্তাহিক ছুটি ভোগ করেন, ১৭% শ্রমিকদের সাধারণ ছুটি দেন।
- কেবল মাত্র ৪ (৫%) টি কারখানায় মাতৃত্বকালিন ছুটির ব্যবস্থা আছে।
- নারীরা বেশী কাজ করলেও পুরুষের চেয়ে কম মুজুরি পান।
ক্যাটাগরী | পুরুষ শ্রমিক টাকা | নারী শ্রমিক টাকা |
গড় মজুরী/ প্রতি মাসে | ৫৪১৬ | ৪৭১৮ |
নিম্ন মজুরী/ প্রতি মাসে | ১০০০ | ৮০০ |
সর্বোচ্চ মজুরী/ প্রতি মাসে | ১২০০০ | ৯৬০০ |
তামাক উৎপাদনে শ্রমিকের কাজের পরিবেশ
- জর্দা এবং গুল তৈরী হচ্ছে ঘরের ভেতরে। মালিকের নিজ বাড়ির একটি রুম অথবা অন্য কোন বাড়ির একটি রুম ভাড়া নিয়ে।
- দরজা, জানালা বন্ধ রেখে, কিংবা একটি মাত্র দরজা খোলা রেখে সেই ঘরে তামাক (জর্দা, গুল) উৎপাদনের কাজ করা হয়। বাইরের বাতাস ঢোকে না।
- কারখানার ভিতরে তামাক উৎপাদনের প্রধান কাজগুলোর মধ্যে-তামাক পাতা গুড়া করা, ওষুধ (কেমিক্যাল) মেশান, বিভিন্ন সাইজের কৌটায় ভরা এবং লেবেল লাগানো।
- তামাকের গন্ধ ও ধুলায় ঘর ভরে থাকে।
- এক নাগারে ফ্লোরে বসে কাজ করতে হয়।
- অল্প জায়গায় শ্রমিকেরা ঘন হয়ে পাশাপাশি বসে জর্দা, গুল উৎপাদনের কাজ করে থাকে।
- বেশীর ভাগ কারখানাগুলিতে শ্রমিকেরা কোন প্রতিরোধক ব্যবহার করে না।
[তথ্য সূত্র: ধোঁয়াবিহীন তামাকজাত দ্রব্য জর্দা ও গুল উৎপাদন একটি অনুসন্ধান-২০১৪; উবিনীগ]
তামাক কাজে শিশু শ্রমিক
ময়মনসিংহের ১০টি জর্দা কারখানায় দেখা যায় ৩৭ জন শিশু [১৮ বছরে নিচে] পূর্ণকালিন শ্রমিক হিসাবে কাজ করছে। শিশু শ্রমিক হিসাবে এদের মজুরী কম, ২০০ টাকা প্রতিদিন। আসলে এই শিশু শ্রমিকদের স্বাভাবিক মজুরী কত টাকা তা জানা যায় না। সবসময় যে এই শিশু শ্রমিকদের মজুরী প্রতিদিন ২০০ টাকা থাকে তা নয়। কখনও এর কমও হয়, তবে ২০০ টাকার উর্ধ্বে কখনও হয় না। তারা দিনে ৮ ঘন্টা কাজ করে কখনও ১০ ঘন্টাও কাজ করে। এছাড়া বিড়ি কারখানায় শ্রমিক নিয়োগ হয়। তামাক পাতা পোড়ানোর আগে শিশুরা স্কুলে যাওয়া বন্ধ রেখে কাজ করে।
একটি তুলনামুলক স্বাস্থ্য ঝুঁকির চিত্র : তামাকের কাজ ও অন্যান্য কাজ
তামাক কাজ
- জর্দা-গুল শ্রমিক
- তামাক চাষে শ্রমিক
- বিড়ি কারখানার শ্রমিক
স্বাস্থ্য ঝুঁকি
- জর্দা-গুল শ্রমিকদের খাওয়ার রুচি থাকে না। তলপেটে ব্যথা, মাজা ব্যথা। মাথা ঘুরে। এক ধ্যানে কাজ করতে হয়- চোখ ঘোলা হয়ে আসে, ঝাপসা দেখা যায়।
- তামাক চাষে শ্রমিকদের তামাক পাতার কষে হাত কালো হয়ে যায়, খাবারে রুচি থাকে না। শ্বাস কষ্ট হয়। শরীর দূর্বল লাগে। হাত, পা জ্বালা পোড়া করে। মাথা ঘুরে, বমি বমি লাগে। ঘুম নাই, মানসিক অস্থিরতা।
- বিড়ি কারখানার শ্রমিকদের হাঁপানি, শ্বাসকষ্ট সহ শ্বাসতন্ত্রের বিভিন্ন রোগে ভুগছে।
অন্যান্য কাজ
- মিল চাতালে নারী শ্রমিক
- পাপস মিলে নারী শ্রমিক
- পেপার মিলে নারী শ্রমিক
- নির্মান কাজে নারী শ্রমিক
- ইট ভাঙ্গা নারী শ্রমিক
- মাটি কাটা নারী শ্রমিক
স্বাস্থ্য ঝুঁকি [ বিভিন্ন গবেষণা থেকে পাওয়া তথ্য]
- মিল চাতালে নারী শ্রমিকদের কামড়ে ব্যথা। পাজর, বুকে ব্যথা। মুখে রুচি থাকে না। শরীর শুকিয়ে যায়। ঘুম কম হয়।
- পাপস মিলে নারী শ্রমিকদের শ্বাসকষ্ট, কোমড়ে ব্যথা। চোখে সমস্যা- ঝাপসা দেখা। বেশীরভাগ শ্রমিকদের জন্ডিসের কথা শুনা যায়।
- পেপার মিলে নারী শ্রমিকদের কোমড়ে ব্যথা, শ্বাস কষ্ট।
- নির্মান কাজে নারী শ্রমিকদের টয়লেটের সুবিধা নাই। মাজা ব্যথা ও পায়ে ব্যথা।
- ইট ভাঙ্গা নারী শ্রমিকদের টয়লেটের সুবিধা নাই। মাথা ও মাজা ব্যথা। পায়ে ও হাতে ব্যথা।
- মাটি কাটা নারী শ্রমিকদের টয়লেটের সুবিধা নাই। মাথা ও মাজা ব্যথা। পায়ে ও হাতে ব্যথা।
তামাক কাজে নিয়োজিত নারী শ্রমিকের অবস্থা
- তামাক কাজে নিয়োজিত নারীদের কোন স্বীকৃতি নেই। তারা যে কাজ করছে এই তথ্য সংশ্লিষ্ট বিভাগে নেই।
- সব ধরণের কাজেই নারী-পুরুষ শ্রমিকের মুজুরি বৈষম্য আছে কিন্তু তামাক উৎপাদনের কাজে নারীকে পারিবারিক শ্রমিক এবং অদক্ষ শ্রমিক হিসেবেই দেখা হয়।
- তামাক একটি ক্ষতিকর পণ্য। এই পণ্য উৎপাদনে যারা নিয়োজিত তারাও স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে থাকে, এই বিষয়টি সংশ্লিষ্ট নীতি নির্ধারণী মহলে আলোচনা হয় না।
কয়েকটি সুপারিশ
তামাকের মতো ক্ষতিকর পণ উৎপাদনের সাথে নারীদের শ্রমিক হিসাবে যুক্ত থাকাটাই অমানবিক। তবুও যদি তারা এই কাজে থাকে তাহলে-
১. তামাক উৎপাদনে নিয়োজিত শ্রমিক, বিশেষ করে নারী ও শিশু শ্রমিকদের নিয়োগ করতে স্বাস্থ্য সুরক্ষা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
২. তামাক উৎপাদনে শিশু শ্রমিক নিয়োগ নিষিদ্ধ করতে হবে।
৩. তামাক উৎপাদন কারখানায় শ্রম মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে নিয়মিত পর্যবেক্ষণ ও মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা করা।