সীমা দাস সীমু এবং ফরিদা আখতার || Wednesday 25 November 2020
দেখতে দেখতে একটা বছর চলে গেল। ২০২০ সালের ২৭ নভেম্বর পলাশের মৃত্যুর এক বছর পূর্ণ হলো। গত বছর এই তারিখে উবিনীগের কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য পলাশ চন্দ্র বড়াল ২৭ নভেম্বর, ২০১৯ তারিখে ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৫৭ বছর। তিনি দীর্ঘদিন কিডনি রোগে আক্রান্ত ছিলেন। তিনি এক মেয়ে অস্মিতা ক্লারা বড়াল,এক ছেলে,ফেডরিক নিঃস্বর্গ বড়াল এবং স্ত্রী অঞ্জলী জাসিন্তা কস্তাসহ বহু সহকর্মী, বন্ধু এবং শুভানুধায়ি রেখে গেছেন। অস্মিতা এবং নিঃস্বর্গকে নিয়ে পলাশের অনেক আশা ছিল, তাদের নিয়ে একজন গর্বিত পিতা ছিলেন তিনি।
পলাশের দেশের বাড়ি পিরোজপুর শহরে। পড়াশুনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন বিভাগে। উবিনীগ যখন ১৯৮৪ সালে শুরু হয় তখন থেকেই পলাশ উবিনীগের সাথে জড়িত। ১৯৮৩ সালে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে যুক্ত ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে ফরহাদ ভাইয়ের (ফরহাদ মজহার) অনানুষ্ঠানিক ভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের যে পাঠচক্র বা আলোচনা সভা হোত তার মাধ্যমে পলাশ পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন। তার আগে অবশ্য পলাশের ছোট ভাই জু্রান বড়াল এই পাঠচক্রে সক্রিয় ছিলেন। পরে জুরানও উবিনীগে যুক্ত হন। অত্যন্ত দুঃখের বিষয় যে ২০১৭ সালের ৩রা মার্চ জুরান বড়ালও কিডনি রোগে মারা যান।
পলাশ এবং জুরান দুজনেই উবিনীগ ছাড়া কোথাও কাজ করেন নি। পলাশ দীর্ঘ ৩৪ বছর উবিনীগের সাথে যুক্ত ছিলেন। প্রথম থেকেই পলাশ উবিনীগের একজন নিরলস কর্মী হয়ে উঠেন। কাজ পাগল মানুষ ছিলেন পলাশ। উবিনীগের সব কাজেই পলাশের অংশগ্রহণ ছিল। সবাইকে সাথে নিয়ে কাজ করতে ভীষণ পছন্দ করতেন, সেই সময় হাসাহাসি করা, গল্প বলা, সবই চলতো।
পলাশ বড়াল: সদস্য,উবিনীগ কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপনা কমিটি
উবিনীগ কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য হিসাবে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন পলাশ বড়াল। তাঁর, প্রজ্ঞা এবং বিচক্ষণতা সবসময় প্রতিষ্ঠানকে একটা প্রতিষ্ঠিত জায়গায় নিয়ে যেতে সহায়তা করেছে।
উবিনীগের স্কুল:
১৯৮৯ সালের মাঝামাঝিতে রিং রোড, বারাবো মাহানপুর, শ্যামলীতে বস্তির বাচ্চাদের কিছু পড়াশোনা শেখানোর একটা ব্যবস্থা নেয়ার কথা চিন্তা করা হয়। ফরহাদ ভাইয়ের আইডিয়া নিয়ে বস্তিবাসী মায়েদের সাথে আলোচনা করে সম্ভাবতা যাচাই-এর কাজটি পলাশ নিজ দায়িত্বে নিয়েছিলেন। পলাশের মৌখিক রির্পোটের ভিত্তিতেই কয়েকদিনের মধ্যে বস্তির বাচ্চাদের জন্যে সকালে স্কুল শুরু হয়। স্কুলে নাম দেয়া হয়েছিল শিখিপড়ি বিদ্যালয়। পলাশ নিজে এবং অন্যান্য সহকর্মীদের নিয়ে এই স্কুলের শিক্ষক হিসেবে সময় দেন। দীর্ঘদিন এই স্কুল পরিচালিত হয়েছিল এবং মূল দায়িত্ব নিয়ে কাজ করেছিলেন পলাশ বড়াল। গবেষণা কাজের পাশাপাশি এই স্কুলের দায়িত্বে কখনও তাকে বিচলিত বা বিরক্ত হতে দেখা যায় নাই। আজ এই এলাকার অনেক বাচ্চারা, যারা এখন বড় হয়ে গেছে, তারাই নিজেরা এসে পরিচয় দেয়, যে তারা শিখিপড়ি বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী ছিল।
উবিনীগের বিদ্যাঘর:
টাংগাইল, পাবনা (ঈশ্বরদী),কুষ্টিয়া,শেরপুর,চাঁপাইনবানগঞ্জ,কুড়িগ্রাম(চিলমারী),কক্সবাজার জেলায় উবিনীগের বিদ্যাঘর গড়ে ওঠার সাথে পলাশের সম্পৃক্ততা ছিল। এই বিদ্যাঘরের কর্মীদের সাথে যোগাযোগ, কাজের খোঁজ খবর নেওয়া,কর্মীদের ব্যক্তিগত কোন সমস্যা আছে কি না- সবধরণের খবর রাখতেন পলাশ বড়াল। সহকর্মীদের সাথে তার ছিল একটা আত্মিক সম্পর্ক। প্রতিটা কর্মী গভীর শ্রদ্ধার সাথে আজ অনুভব করে পলাশের শুন্যতা। তাদের সবার প্রিয় পলাশ’দা বা শুধু “দাদা” ।
শুধু উবিনীগ নয়, প্রবর্তনা, শস্য প্রবর্তনা, নারী গ্রন্থ প্রবর্তনা সব প্রতিষ্ঠানের গড়ে ওঠার সাথে পলাশ আপনা থেকে জড়িয়ে যেতেন। কোন সমস্যা হলে পলাশেরই খোঁজ পড়তো। এ ছাড়া উবিনীগের আন্তর্জাতিক যোগাযোগ রক্ষায় পলাশ ছিলেন সবচেয়ে সক্রিয়। সবাই পলাশকে এক নামে চেনে। তাদের অনেকের কাছে পলাশ মানে উবিনীগ হয়ে যেতো। দেশে এবং বিদেশে বিভিন্ন নেটওয়ার্কের সাথে তার সম্পর্ক খুব ভাল ছিল। তবে পলাশের রাজনৈতিক বিচক্ষণতা ছিল। সেখানে পলাশের কোন আপোষ ছিল না। পাক্ষিক চিন্তা পত্রিকা প্রকাশনার কাজেও পলাশের অনেক অবদান ছিল। সত্যি কথা বলতে গেলে উবিনীগের এবং সকল সহযোগী প্রতিষ্ঠানের সব কাজেই পলাশের কোন না কোন অবদান থাকতোই।
বীজ বিস্তার ফাউন্ডেশানের প্রতিষ্ঠার সাথে যুক্ত ছিলেন এবং শেষ দিন পর্যন্ত বীজ বিস্তার ফাউন্ডেশানে কোষাধক্ষ হিশেবে কাজ করেছেন।
পলাশ গান খুব ভালবাসতেন। উবিনীগের সকাল-সন্ধ্যার গানের আসরে গানের অনুরোধ করা হলে পলাশ লালনের গান “সাঁইর লীলা বুঝবি ক্ষ্যাপা কেমন করে”, না হলে নজরুলের “কাবেরী নদী জলে কে গো বালিকা” গাইতেন। নিঃসর্গ এবং অস্মিতাকে গান শিখিয়েছন শিক্ষক রেখে। নবপ্রাণ আন্দোলনেও পলাশের সক্রিয়তা ছিল।
মৃত্যুর আগে মাত্র দু’তিন দিন হাসপাতালে ছিলেন। হাসপাতালে যাবার আগের দিন পর্যন্ত তিনি অফিসে কাজ করেছেন। কেন জানতো পলাশ এতো তাড়াতাড়ি চলে যাবেন!!
পলাশ বড়ালের এই অকাল প্রয়াণে উবিনীগ প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে তাঁকে জানাই গভীর শ্রদ্ধা।
[ লিখেছেন সীমা দাস সীমু এবং ফরিদা আখতার]