আন্তর্জাতিক নারী দিবস: নারীর সমতা অর্জনে বড় বাধা ‘তামাক’

ফরিদা আখতার || Wednesday 04 March 2020

কর্মক্ষেত্রে নারীর প্রতি বৈষম্য ও শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে গিয়েই শ্রমিক নারীদের আন্দোলন শুরু হয়েছিল নিউ ইয়র্কের সুঁই কারখানায়। ১৯১০ সালে জার্মাণীর সমাজতান্ত্রিক নেত্রী ক্লারা জেৎকিন মার্চের ৮ তারিখ আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিশেবে ঘোষণা দিয়েছিলেন। যদিও দিনটির পালন সে সময় থেকে গত শতাব্দির সত্তুর দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত কেবল সোভিয়েত রাশিয়াসহ বিভিন্ন সমাজতান্ত্রিক দেশেই গুরুত্ব দেয়া হোত। জাতিসংঘ ১৯৭৫ সালে ৮ই মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার পর থেকে সরকারি-বেসরকারিভাবে পালন করা হচ্ছে।

সমতার ভিত্তি তৈরি আন্তর্জাতিক নারী দিবসে বিশেষভাবে আলোচনার বিষয়। একই সাথে নারী মুক্তি আন্দোলন ও সংগ্রামের অংশ। সমতা অর্জন করার জন্যে নারীকে শত বছর ধরে সংগ্রাম করতে হচ্ছে। বলতে হয়েছে যে কাজ পুরুষ করতে পারে নারীও সুযোগ পেলে একইভাবে করতে পারবে। কাজের মর্যাদা ও মজুরিতে বৈষম্য রাখা যাবে না। শ্রমিক নারীর এই দাবির সাথে যুক্ত হয়েছে কাজের সার্বিক পরিবেশ, নারীর সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক অধিকারের প্রশ্ন। অর্জনও করেছি অনেক, পিছিয়েও গিয়েছি খানিকটা। একসময় পুরুষ এবং পুরুষতন্ত্রের বিরোধিতাই মূখ্য ছিল, দেখতে পাইনি যে এরই মধ্যে ঢুকে পড়েছে পুঁজিতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। এখন আমরা পুরুষতন্ত্র ও পুঁজিতন্ত্র –দুটোর সমন্বয়ে শোষিত হচ্ছি।

পুঁজিতন্ত্রের চাকচিক্য মধ্যবিত্ত ও উচ্চ শ্রেণীর নারীদের স্বাধীনতার ধারণায় নতুন ধরণের ভাব তৈরি করেছে। পার্থক্য তৈরি হোল শ্রমিক নারী ও মধ্যবিত্ত শিক্ষিত শ্রেণীর নারীদের দাবির মধ্যে। শ্রমিক নারীদের মতো তাদের জীবন-জীবিকার লড়াই নেই, কিন্তু একই শ্রেণীর পুরুষের সাথে বৈষম্য আছে। আছে প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য শোষণ। পুঁজিবাদ মধ্যবিত্ত নারীর এই বোধ ও আকাঙ্ক্ষা তাদের মুনাফা অর্জনের কাজে লাগিয়েছে। ফেমিনিজম বা নারীবাদের সব ধারা বা চিন্তা একরকম নয়। সব মধ্যবিত্ত নারীও একভাবে স্বাধীনতা বোঝেন না। যেমন একটি ‘জনপ্রিয়’ অথচ নিকৃষ্ট ধারণা হচ্ছে নারীবাদ মানে পুরুষের পোষাক এবং পুরুষের বদ স্বভাব রপ্ত করা। বদ স্বভাবটি হচ্ছে ধূমপান। নারী-পুরুষ সমতার দাবি, এবং নারী স্বাধীনতার দাবি যখন থেকে পশ্চিমা দেশে উচ্চারিত হতে শুরু করেছে, তখন থেকেই তামাক কোম্পানি নারীদের পিছু নিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব সাউথ কেরোলিনার নার্সং বিভাগ থেকে সম্প্রতি নারীদের ধুমপা্নের ১০০ বছর নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সেই গবেষণায় দেখা যাচ্ছে ১৯২০ সাল থেকেই আমেরিকা্র তামাক কোম্পানি নারীর জন্যে সিগারেট বানাতে শুরু করে দিয়েছিল। ইওরোপ-আমেরিকায় নারীদের মাঝে সে সময় ধুমপান খুব কম ছিল, থাকলেও তা খুব ভাল চোখে দেখা হোত না। অর্থাৎ সামাজিক বাধা ছিল। কিন্তু যতোই নারীদের সমধিকারের দাবী বাড়তে থাকে ততই নারীদের মাঝে ধুমপানের হারও বেড়ে যায়। প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের স্ত্রী ফার্স্ট লেডি এলিনর রুজভেল্ট একজন ফেমিনিস্ট আইকন ছিলেন। তামাক কোম্পানি এমন আইকনদের তামাক সেবনে ব্যবহার করে ফেমিনিস্টদের মাঝে ব্যবসার প্রসার ঘটিয়েছিল ।

নারী জন্য বিশেষ সিগারেট মাইল্ড বা হাল্কা বানানোর মিথ্যে আশ্বাস


সেবনকারি নিজে জানুক বা না জানুক তামাক কোম্পানি জানে ধুমপান স্বাস্থ্যের জন্যে ভাল নয়। তাই তারা ধুমপানে আকৃষ্ট করলেও দেখাতে চেয়েছে পুরুষ যে সিগারেট সেবন করে নারী তা করছে না। তাদের জন্যে “মাইল্ড” যাতে মনে হয় সিগারেট “হাল্কা”, “নরম” ব্রান্ডের সিগারেট বাজারে ছাড়া হয়েছে। কোম্পানির এই কৌশলে কাজ হয়েছিল ভালই; ১৯২০ থেকে ১৯২৯ পর্যন্ত নারী ধুমপায়িদের সংখ্যা দ্বিগুন হয়ে গেল। দিত্বীয় বিশ্ব যুদ্ধের পর কর্মক্ষেত্রে নারীর যোগদান বেড়ে গেল, যা নারী স্বাধীনতার দিক থেকে এক ধাপ এগিয়ে গেল; একই সাথে নারীদের ধুমপানও বাড়তে থাকলো।

নারীদের আকৃষ্ট করতে ধুমপানের সাথে ওজন কমে যাওয়ার বিষয়টি তাদের বিজ্ঞাপনে প্রচার করতে থাকলো। Lucky Strike নামক সিগারেটের বিজ্ঞাপনে প্রখ্যাত বৈমানিক এবং লেখিকা Amelia Mary Earhart এর ছবি ব্যবহার করেছিল। আমেলিয়ার কারণে অনেক নারী বৈমানিক পেশায় আগ্রহী হয়েছিল। গ্রেটা গার্বো, জোয়ান ক্রানফোর্ড এর মতো প্রখ্যাত নায়িকারা সিগারেটের বিজ্ঞাপনে ব্যবহৃত হয়েছিলেন। সুন্দরী এবং আধুনিক হতে হলে নির্দিষ্ট ব্রান্ডের সিগারেট খাওয়া নারীদের জন্যে আকর্ষণীয় বিষয় হয়ে গেল। বলাবাহুল্য, সিগারেট কোম্পানী টার্গেট করেছিল মধ্যবিত্ত নারীদেরই যাদের হাতে পয়সা খরচ করার ক্ষমতাও আছে ।

পুরুষের সাথে সমতা অর্জন ধুমপানে। আমরাও পারি। কিন্তু সমতা এসেছে রোগে, সুস্থ জীবনে নয়


আধুনিক নারীবাদীদের ধুমপান বেড়ে গেল; ১৯৬৫ সালের যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং সমাজ কল্যানের একটি পরিসংখ্যানে দেখা ৪১.৯% নারী ধুমপান করছেন। ইতিমধ্যে ধুমপানের ক্ষতিকর প্রভাব নিয়েও যথেষ্ট আলোচনা শুরু হোল। তাই সরকারের পক্ষ থেকে সিগারেটের ওপর সতর্কতা লেবেল “Caution: Cigarette Smoking May Be Hazardous to Your Health,” দেয়া বাধ্যতামুলক করা হোল। এর ফলে কিছুটা ব্যবহার কমে গেলেও, কোম্পানি তার কৌশল অব্যাহত রাখলো। এই সময় (১৯৬৮) তারা ভার্জিনিয়া স্লিম সিগারেটে চালু করলো। আশির দশক পর্যন্ত তাদের রমরমা ব্যবসা চললো। ফিলিপ মরিস ইন্টারন্যাশনাল (PMI) বিশেষভাবে নারী স্বাধীনতার প্রতীক হিশেবে সিগারেট খাওয়াকে উৎসাহিত করলো। একটি বিশেষ স্লোগান “You’ve come a long way, baby” (তুমি অনেক অগ্রসর হয়েছো, বেবি) দিয়ে বিজ্ঞাপন দেয়া হোল, যেখানে ছবি ব্যবহার করা হোল যে ১৯১৫ সালে নারী গোপনে ধুমপান করতো কিন্তু এখন তারা স্বাধীন। প্রকাশ্যে ধুমপান করতে পারে। কোম্পানি বড় বড় বিল বোর্ড ও টিভি বিজ্ঞাপনে এই শ্লোগান ব্যবহার করতে লাগলো। ফেমিনিজমের সমতার ধারণার সাথে তাল মিলিয়ে এই বিজ্ঞাপন নারীদের আকৃষ্ট করলো – স্বাধীনতা, স্লিম হওয়া এবং গ্লামারের মিশ্রণ। হ্যাঁ, পুরুষের সাথে সমতা অবশ্যই অর্জিত হয়েছিল। সেটা হচ্ছে, আগে বেশির ভাগ পুরুষ ফুসফুসের ক্যান্সারে মারা যেতো, ধুমপানের কারনে যুক্তরাষ্ট্রে নারীদের মধ্যে ফুসফুসে ক্যান্সারের কারণে মৃত্যুর হার বেড়ে গেল, প্রায় পুরুষের সমান হয়ে গেল। সমতার উৎকৃষ্ট উদাহরণ বটে, যা তামাক কোম্পানি নারীদের উপহার দিল!

কিন্তু ১৯৭৯ সালের দিকে যখন বিজ্ঞাপন দেয়া নিষিদ্ধ করা হোল, নারীদের মধ্যে ধুমপানের হার ৩০% হয়ে গেল। এবং যতোই স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে সতর্কতা জারী করা হতে লাগলো , ততই ধুমপানের হার মধ্যবিত্ত নারীদের কমতে থাকলো। নব্বুইয়ের দশকে ২২% হয়ে গেল।

এই খবরে তামাক কোম্পানি মোটেও বিচলিত না হয়ে তারা মধ্যবিত্ত, শিক্ষিত ও সচেতন নারীদের দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে গরিব ও অল্পবয়সী নারীদের দিকে নিবদ্ধ করলো। তাদের জন্যে স্লিম হবার দরকার নেই, বরং সিগারেটের সাথে নানা ধরনের আর্থিক সুবিধা দিতে শুরু করলো। এর ফলে নারীদের ধুমপান বেড়ে দাড়ালো ৪০%। মেডিকেল তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে নারীদের মধ্যে ফুসফুসের ক্যান্সারে মৃত্যুর প্রধান কারণ ধুমপান। এবং এই ক্ষেত্রে পুরুষের তুলনায় নারীর ঝুঁকি অনেক বেশি।

বাংলাদেশে নারীর সমতার দাবি দীর্ঘদিনের। এখানেও নারীবাদের একটি ধারা আধুনিকতা ও স্বাধীনতার প্রতীক হিশেবে ধুমপান করে। তবুও মোট ধুমপায়িদের মধ্যে নারীর সংখ্যা পুরুষের তুলনায় অনেক কম; পুরুষ ৩৬.২%, নারী ০.৮%। এর মধ্যে ভাগ করলে দেখা যাচ্ছে নারী সিগারেট সেবনকারির হার ০.২% ; এবং বিড়ি সেবন কারি হচ্ছে ০.৬% । অর্থাৎ গরিব ও খেটে খাওয়া নারীদের মধ্যেই ধুমপান হচ্ছে। কিন্তু এখানে নারী অন্যভাবে ধুমপানের ক্ষতিকর প্রভাবের শিকার হচ্ছে। যেমন পুরুষের ধুমপানের কারণে কর্মক্ষেত্রে ১৯.২% , স্বাস্থ্য কেন্দ্রে ১১.৪% , অফিস-আদালতে ২২.৮%, গণপরিবহনে ৩৮.২%, রেস্তোরায় ২২.৪%, স্কুলে ৫.২% এবং নিজ বাড়ীতে ৩৬.৫% নারী পরোক্ষ ধুমপান বা Second Hand smoking দ্বারা ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। আরো ভয়াবহ ভাবে আসছে ই-সিগারেট, যা এখনো তরুণদের মধ্যে বেশি ব্যবহার হলেও তরুণীদের হাতেও উঠছে এবং ধারণা দেয়া হচ্ছে এগুলো সিগারেটের মতো ক্ষতিকর নয়।

বাংলাদেশের নারীরা ধুমপানে কম হলেও ধোঁয়াবিহীন তামাক (জর্দা, সাদাপাতা, গুল) ব্যবহারে পুরুষের তুলনায় এগিয়ে আছে। এখানেও নারীকে একভাবে বোঝানো হয় যে বিয়ের পর তাকে স্বামীর কাছে আকর্ষণীয় হতে হলে ঠোট লাল করে রাখতে হবে। নিম্নবিত্ত নারী এই ফাঁদে পড়ে একসময় আশক্ত হয়ে যায়। তখন সে নিজেই সেবন করতে থাকে। সবচেয়ে বেশি কষ্ট লাগে যখন দেখা যায় সিগারেটের জন্যে ভার্জিনিয়া পাতা চাষ করতে গিয়ে নারীকেই পাতা তোলা, স্টীক করা, পোড়ানো কিংবা রোদে শুকানো কাজ করতে হয়। তার শারিরীক পরিশ্রম হয়, একনাগারে বসে বসে কাজ করতে গিয়ে কোমরে ব্যাথা হয়, তামাক পাতার গন্ধে বমি আসে, পেটে বাচ্চা থাকলে অনেক সময় নষ্ট হয়ে যায় ইত্যাদি নানা ধরণের স্বাস্থ্য ক্ষতির শিকার হয়। স্বামীকে যদি কোন স্ত্রী বলে যে তামাক চাষ করে তার এবং তার সন্তানদের স্বাস্থ্য ক্ষতি হচ্ছে তাহলে সে শুনবে না কারণ তামাক থেকে নগদ লাভ হয়। যে তামাক কোম্পানি একসময় নারীকে সমতা অর্জনের জন্যে আমেরিকার মতো দেশের নারীর হাতে সিগারেট তুলে দিয়ে ফুসফুসের ক্যান্সারের রোগী বানিয়েছিল, সেই তামাক কোম্পানি বাংলাদেশের মতো দেশের নারীকে তামাক পাতা উৎপাদনে ব্যবহার করে স্বামীকে লাভের লোভ দেখিয়ে স্ত্রীর সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার কেড়ে নিচ্ছে। এবং নারীকে দিচ্ছে নানা রকম রোগ।

তামাক সেবন এবং উৎপাদন পুঁজিতান্ত্রিক ও পুরুষতান্ত্রিক শোষণের হাতিয়ার, কোন অবস্থাতেই নারীর সমধিকারের মাধ্যম হতে পারে না। এই সহজ সত্যটি বুঝতে হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *