ফরিদা আখতার || Tuesday 17 September 2019
জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত আন্তদেশীয় কমিটি বা IPCC (Intergovernmental Panel On Climate Change) এ বছর আগস্ট মাসে কৃষি সংক্রান্ত, বিশেষ করে খাদ্য উৎপাদন নিয়ে, সতর্কতামূলক একটি প্রতিবেদন দিয়েছে। এতে বলা হয়েছে কৃষি এবং খাদ্য উৎপাদনের সাথে জড়িত কর্মকাণ্ড বৈশ্বিক গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের (GHG) ক্ষেত্রে ৩৭% দায়ি। এই প্রতিবেদন তৈরি করেছেন বিশ্বের ১০০ জন বিজ্ঞানী; তাঁরা কৃষিতে জমির ব্যবহার এবং এর কারণে জলবায়ুতে কি ধরণের প্রভাব পড়ছে তা খতিয়ে দেখেছেন। তাঁরা হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন বিশ্বের উষ্ণতা কমাতে হলে খাদ্য উৎপাদনের ব্যবস্থা ঢেলে সাজাতে হবে। সুনির্দিষ্টভাবে তাঁদের প্রস্তাব হচ্ছে জমির সঠিক ব্যবহার, খাদ্য তালিকায় মাংস কমিয়ে আনা এবং খাদ্য অপচয় কমানোর মতো বিষয়ে অগ্রাধিকার দিয়ে কাজ করতে হবে। গ্রীন হাউস গ্যাস নির্গমনে খাদ্য উৎপাদনে জমির ব্যবহারের ধরণ, প্যাকেজিং এবং পরিবহন – এসব কিছুই ভুমিকা রাখে। তাঁরা আরো বলেছেন যে বিশ্বের উষ্ণতা যেভাবে বাড়ছে এবং লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী কমাতে হলে অন্যান্য পদক্ষেপের পাশাপাশি কৃষিকেও টেকসই করতে হবে। অর্থাৎ শিল্প কারখানার মতো কৃষি নয়, প্রকৃতির সাথে খাপ খাওয়ানো কৃষি বিশ্বের তাপমাত্রা কমানোতে ইতিবাচক ভুমিকা রাখতে পারে।
এই প্রতিবেদন তৈরী করতে বিজ্ঞানীরা হাজার হাজার গবেষণা প্রতিবেদন পর্যালোচনা করেছেন। কিন্তু এখনো এই প্রতিবেদন নীতি নির্ধারণী আলোচনার জন্যে চুড়ান্ত রূপ দিতে বাধা দেয়া হচ্ছে। যদিও আগস্টের ৮ তারিখে এটা প্রকাশিত হয়ে গেছে। এই বাধা আসছে বায়োফুয়েল এবং গবাদীপশু ভিত্তিক ইন্ডাস্ট্রির পক্ষ থেকে। এরা নিজেদের কৃষি হিশেবেও পরিচয় দেয় না। খাদ্য উৎপাদন তাদের কাছে কারখানার পণ্য উৎপাদনের মতো। এর সাথে প্রাণ-প্রকৃতির কোন সম্পর্ক তারা মানতে নারাজ। তারা মাংস উৎপাদন করে সারা বিশ্বে ব্যবসা করতে চায়, তাতে ব্যাপকভাবে কার্বন নিঃসরণ ঘটে ঘটুক। অন্যদিকে খাদ্য পণ্য যেমন সয়াবিন, আখ উৎপাদন হয় মানুষের খাদ্য হিশেবে নয়, এর থেকে গাড়ীর জ্বালানী তৈরি হয়, যার নাম দেয়া হয়েছে বায়োফুয়েল। অর্থাৎ মানুষের বেঁচে থাকার জন্যে খাদ্য নয়, এই মাংস উৎপাদন হচ্ছে বার্গার, স্টেক ও অন্যান্য ফাস্ট ফুডের জন্যে যা স্বাস্থ্যের জন্যে ক্ষতিকর একই সাথে এর উৎপাদন পরিবেশ ধ্বংস করে।
এই প্রতিবেদনে যেটা গুরুত্বপুর্ণ বিষয় হিশেবে এসেছে তা হচ্ছে ইন্ডাস্ট্রিয়াল কৃষিতে জমির ব্যবহার। সাধারণত মাটি কার্বন নিঃসরণ করার তুলনায় কার্বন গ্রহণ করতে পারে বেশি। কিন্তু কৃষি কাজের জন্যে যেভাবে মাটি নষ্ট ও রাসায়নিক পদার্থের ব্যবহারে দুষিত করা হচ্ছে এবং বন ধ্বংস করা হচ্ছে তাতে মাটির কার্বন হজম করার শক্তি থাকছে না। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে ২০০৭ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত কৃষি, বনায়ন এবং অন্যান্য ভাবে জমির ব্যবহার মানুষ-সৃষ্ট গ্রীন হাউজ গ্যাসের প্রায় ২৩ ভাগ দায়ি। এই সময়কালে বায়ুতে ১২ বিলিয়ন টন গ্রীন হাউজ গ্যাস নিঃসরণ হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ১৩% কার্বন ডাই অক্সাইড, ৪৪% মিথেন গ্যাস এবং ৮২% নাইট্রাস অক্সাইড রয়েছে। কৃষিতে রাসায়নিক সার ব্যবহারে নাইট্রাস অক্সাইড এবং ধান চাষ ও গরু পালনের কারনে মিথেন গ্যাস নিঃসরণ হয়।
ইতিমধ্যে আমরা দেখতেই পাচ্ছি বন্যা, খরা, অতি বৃষ্টিসহ আবহাওয়ার এক নৈরাজ্য শুরু হয়ে গেছে। তাপমাত্রাও বেড়ে গেছে অনেক বেশি। ফসলহানী ঘটছে, এর ফলে খাদ্য নিরাপত্তাও হুমকির মুখে পড়েছে।
‘মাংস খাওয়া’ কত ভয়ানক ক্ষতির কারণ হতে পারে তা ব্রাজিলে আমাজন ফরেস্টের আগুনের ঘটনা দিয়েই বোঝা যায়। আমাজনকে বলা হয় বিশ্বের ফুসফুস, কারণ এই রেইন ফরেস্ট বিশ্বের ২০% অক্সিজেন উৎপাদন করে। এই ফুসফুস এখন আগুনে পুড়ে ছাই হচ্ছে। ঠিক যেমন সিগারেটের ধোঁয়ায় যেমন মানবদেহের ফুসফুস জ্বলেপুড়ে যায়, এবং তা মৃত্যুর কারণ হয়ে যেতে পারে। আমাজনে প্রায় ২.১ মিলিয়ন বর্গমাইল জুড়ে যে বন রয়েছে, তা একদিকে সারা বিশ্বের জন্যে যেমন অক্সিজেন উৎপাদন করে, অন্যদিকে ১৭% কার্বন ডাই অক্সাইড গ্রহণ করে। প্রকৃতির এই বিশাল উপকারকারি আমাজন রেইন ফরেস্ট ধ্বংস করা হচ্ছে, আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে ফেলা হচ্ছে কারণ ব্রাজিল থেকে গবাদিপশুর মাংস রপ্তানি এখন সবচেয়ে বড় ব্যবসা। ব্রাজিল বিশ্বের সর্ববৃহৎ গরুর মাংস (বীফ) রপ্তানিকারক। যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগ (USDA) এর হিশাবে বিশ্বের মোট বীফ রপ্তানীর ২০% ব্রাজিল থেকে হয়। ব্রাজিল ২০১৮ সালে ১.৬৪ মিলিয়ন টন বীফ রপ্তানি করে ৬.৫৭ বিলিয়ন ডলার আয় করেছে। বীফের চাহিদার প্রায় ৪৪% আসে মূলত চীন এবং হংকং থেকে। ইওরোপ, আমেরিকা ও অন্যান্য দেশ থেকেও বীফের চাহিদা বাড়ছে। ব্রাজিলের সুবিধা হচ্ছে তাদের অনেক প্রাকৃতিক সম্পদ এবং বিস্তর ঘাসের জমি রয়েছে, যা পশুপালনের জন্যে সহায়ক। কাজেই ব্রাজিলের এই ব্যবসা আরো বাড়বে। এবং পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হবে।
পশুপালনের জন্যে বেশ কয়েক বছর ধরে আমাজন ফরেস্টে আগুন লাগিয়ে জংগল পরিস্কার করা হচ্ছে। এবছর আগুনের সংখ্যা ৮০% বেড়েছে। আগে ছোট ছোট পশু পালনের খামারীরা আগুন দিতো, এখন বড় বড় কোম্পানি এসে যোগ দিয়েছে। তাই তারা দ্রুত গতিতে জংগল পরিস্কারের জন্যে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। যে আগুন মাস জুড়ে চলছে, সারা বিশ্ব তোলপাড় করে প্রতিবাদ হলেও তারা থামে নি। ইতিমধ্যে আমাজন অঞ্চলের প্রাকৃতিক পরিবেশ ও প্রাণ বৈচিত্র্যের ব্যাপক ক্ষতিসাধন হয়েছে।
মাংস (বীফ) উৎপাদন গ্যাস নির্গমনের পাশাপাশি পরিবেশের ওপর কি রকম চাপ সৃষ্টি করে তা একটি ছোট পরিসংখ্যানে দেখানো হয়েছে। এক পাউন্ড বীফ উৎপাদন করতে গড়ে ২৯৮ বর্গ ফুট জমি এবং ৮০০ লিটার পানির প্রয়োজন হয়। একটি গরুতে গড়ে ৪০০ পাউন্ড মাংস হয়। অর্থাৎ মাত্র একটি গরুর জন্যেই ৮৪,০০০ জগ পানি এবং দুটি ফুটবল ময়দানের সমান ফসলী জমির প্রয়োজন হয়। কাজেই বীফের চাহিদা বাড়ার অর্থ হচ্ছে জমির প্রয়োজনও বেড়ে যাওয়া, ফলে জংগল কেটে সাফ করে সেই জমিতে গরু পালতে হবে। এই তথ্যটি নিয়েছি Cayte Bosler এর লেখা Protecting the Amazon Requires Changing Policy and Eating Less Beef থেকে। https://blogs.ei.columbia.edu/2019/08/27/amazon-rainforest-fires-beef-policy/
আইপিসিসি প্রতিবেদনে আধুনিক ও রাসায়নিক কৃষির কারণে জমির অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার সম্পর্কে সাবধান করা হয়েছে। এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে বিশ্ব তাপমাত্রাকে নিরাপদ মাত্রায় রাখতে হলে খাদ্য উৎপাদনের ধরণ পাল্টাতেই হবে। একই সাথে তাঁরা কৃষি কাজের ধরণ ও জমির ব্যবহার নিয়ে টেকসই পদ্ধতি অবলম্বনের ইঙ্গিত দিয়েছেন। সোজা কথায় কৃষিকে কৃষির মতোই প্রকৃতির সাথে সম্পর্ক রেখে করতে হবে, একে ইন্ডাস্ট্রি বানালে হবে না। খাদ্যের ধরণও সেই অনুযায়ী হতে হবে। প্রবীণ মৃত্তিকা বিজ্ঞানী রত্তন লাল প্রথম দেখিয়েছিলেন যে ধ্বংসাত্মক কৃষির কারনে মাটির কার্বন ক্ষয় হয় এবং ফলে বায়ুতে কার্বন ডাই অক্সাইড নিঃসরণ ঘটে। তিনি এবং তাঁর সহকর্মীরা গবেষণা করে দেখিয়েছেন যে আগামি ৮০ বছরে পৃথিবীর মাটিতে ১৫০ গিগাটন ( ১ গিগাটন = ১ বিলিয়ন টন) কার্বন পুনরুদ্ধার করা সম্ভব। এভাবে ক্ষতিগ্রস্থ মাটি এবং ইকো সিস্টেম রক্ষা করা যাবে। কিন্তু তার জন্যে দরকার ধ্বংসাত্মক কৃষি বাদ দিয়ে পরিবেশ সম্মত ও টেকসই কৃষির প্রবর্তন করার। প্রযুক্তি নির্ভর বীজ (বিশেষ করে জিএমও) এবং রাসায়নিক সার ও যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা আগামি দিনের জন্যে কোন সুখবর বয়ে আনবে না। বিজ্ঞানী রত্তন লালের তথ্য অনুযায়ি কৃষি লাভজনক কিনা বিচার করতে হবে শুধু ফলন দিয়ে নয়, মাটিতে কার্বন ও জৈব পদার্থ দিয়েছে কিনা তার বিচারে।
এবার বাংলাদেশের কথায় আসি। বাংলাদেশের কৃষি ধান উৎপাদনের ওপর প্রধানত নির্ভরশীল এবং আধুনিক কৃষিতে ধান উৎপাদনে ব্যাপকভাবে রাসায়নিক সারের ব্যবহার হচ্ছে। আধুনিক কৃষি প্রবর্তনের আগে (১৯৫০) আউস আমন ধান চাষে গরুর গোবর, বোন মিল ইত্যাদি জৈব সার ব্যবহার হোত। কিন্তু কৃত্রিম সার হিশেবে ১৯৫৭ সালে ২৬৯৮ টন এমোনিয়াম সালফেট, ফসফেট এবং মিউরিয়েট অব পটাশ আমদানি করা হয়, এবং তা ১৯৫৯ সালে কৃষক পর্যায়ে ব্যবহারের জন্যে দেয়া হয়েছিল। এরপর ১৯৬৫ সালে ‘অধিক খাদ্য ফলাও’ কর্মসুচি প্রবর্তনের মাধ্যমে সার-কীটনাশক-ডিপ টিউব ওয়েলের সেচ দিয়ে উচ্চ ফলনশীল IR5 & IR8 ধান প্রবর্তন করা হয়। বাংলাদেশে পরিবেশ ও জলবায়ুর জন্যে ধ্বংসাত্মক কৃষির এখানেই শুরু।
ধান চাষের জন্যে জমি ব্যবহারের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে স্থানীয় জাতের ধান, যেগুলোতে সার-কীটনাশকের ব্যবহার করতে হয় না, সেগুলোর জন্যে জমি কম ব্যবহার হচ্ছে, অন্যদিকে সার-কীটনাশক নির্ভর উচ্চ ফলনশীল জাতের ধানের জন্যে জমির ব্যবহার ক্রমেই বেড়েছে। যেমন কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের (২০০৮-২০০৯) সালের তথ্য মতে আউশ স্থানীয় জাত ২৮.৬৭%, উফশী ৭১.৩৩% জমিতে চাষ হয়েছে। আমন ধান স্থানীয় ৩২.১১%, উফশী ৬৭.৮৯% এবং বোরো ধান স্থানীয় জাত ২.২৯%, উফশী ৭৮.৫৬% এবং হাইব্রীড ১৯.১৬% জমিতে চাষ হয়েছে। অর্থাৎ আউশ, আমন ও বোরো ধানের স্থানীয় জাতের জন্যে জমি কম ব্যবহার হচ্ছে, অন্যদিকে উফশী ও হাইব্রীডে জমির ব্যবহার বাড়ছে। এগুলোতে রাসায়নিক সার, কীটনাশক ও মাটির তলার পানি ব্যবহার করা হচ্ছে। ১৯৭১-৭২ থেকে এ পর্যন্ত ধানের উৎপাদন বেড়েছে ঠিকই, কিন্তু তার সাথে তাল মিলিয়ে বেড়েছে সারের ব্যবহার। একই জমিতে একই পরিমান ফলন পেতে গিয়ে সারের ব্যবহার বাড়াতে হয়েছে কয়েক গুন। ১৯৭৫-৭৬ সালে প্রতি হেক্টর জমিতে ০.৩৬ কেজি সার দিতে হোত, ২০০৭ সালে এক হেক্টরে দিটে হয়েছে ২৯৮ কেজি সার। মাটির উর্বরতা অনেক কমে গেছে, যা আরো বেশি সারের ব্যবহারের দিকে ঠেলে দিচ্ছে কৃষককে।
কৃষি জমিতে তামাকের চাষ মাটির ব্যাপক ক্ষতি সাধন করছে। তামাকে অনেক রকম সার ও কীটনাশক ব্যবহার করতে হয়। তামাক গাছটাও নিকোটিন উৎপাদনকারি যা মাটিকেও দুষিত করে। দীর্ঘদিন কোন জমিতে তামাক চাষ করলে সেই মাটি উর্বরতা হারায়, যা ফিরে আনতে অনেক বেগ পেতে হয়। তামাক খাদ্য নয়, অথচ রবি ফসল বাদ দিয়ে তামাক চাষ যেমন খাদ্য ঘাটতি সৃষ্টি করে তেমনি পরিবেশের ক্ষতি করে এবং জলবায়ু পরিবর্তনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
তবে বাংলাদেশ এখনো খাদ্য উৎপাদনে সম্পুর্ণরূপে ইন্ডাস্টিয়াল হয়ে ওঠে নি, কাজেই এখানে সুযোগ রয়েছে কৃষিকে পরিবেশ সম্মত করার, টেকসই করার। নয়াকৃষি আন্দোলন প্রাণবৈচিত্র নির্ভর কৃষি দীর্ঘদিন ধরে দেশের বিভিন্ন এলাকায় করে আসছে এবং এ রকম পরিবেশ সম্মত কৃষির ছোট বড় যেসব উদ্যোগ দেশে আছে তাদের নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। এখনো আমাদের সময় আছে। বিশ্বে যে তাপ বাড়ছে তা কমাতে হলে প্রত্যেককে তার খাদ্য অভ্যাস, খাদ্য উৎপাদন সব পরিবর্তন করতে হবে।
দৈনিক বণিক বার্তা’য় ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৯ এ লেখাটি প্রকাশিত হয়।