রবিউল ইসলাম চুন্নু, আজমিরা খাতুন, ফাহিমা খাটুন লিজা এবং গোলাম মোস্তফা || Monday 26 August 2019
সারা বছরই কৃষকরা বিভিন্ন উৎসব করে থাকেন। এর মধ্যে মুসলমানদের ধর্মীয় বড় উৎসব ঈদ-ঊল ফিতর এবং ঈদ-ঊল আযহা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এবার ঈদুল আযহা হয়ে গেল আগস্ট মাসের ১২ তারিখে (২৮ শ্রাবণ, ১৪২৬, ১০ জিলহজ্জ ১৪৪০)। উৎসব মানেই খাবারের আয়োজন এবং কৃষক পরিবারে তা আসে নিজস্ব উৎপাদিত ধান থেকে। গৃহস্থ বাড়ীতে নানা ধরণের পিঠা, পায়েশ, পোলাও, খিচুরির আয়োজন থাকে এবং তা তৈরি করতে ভিন্ন ভিন্ন জাতের ধানের প্রয়োজন। সেই ধান কৃষক উৎপাদন করছেন কিনা বা করতে পারছেন কিনা, নয়াকৃষির দিক থেকে তা দেখা খুব জরুরি। নয়াকৃষির কাজের অন্যতম প্রধান দিক হচ্ছে বীজের বৈচিত্র্য রক্ষা এবং হারিয়ে যাচ্ছে এমন বীজ সনাক্ত করে তার চাষের ব্যবস্থা করা। বিভিন্ন উৎসবে ধানের জাত সম্পর্কে জানার মাধ্যমে কৃষকের ব্যবহারিক জীবনে ধানের জাতের গুরুত্ব বোঝা যায় এবং সে অনুযায়ি ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়। এবারের ঈদুল আযহাতে দেলদুয়ার (টাঙ্গাইল), ঈশ্বরদী (পাবনা) এবং বড়াইগ্রাম (নাটোর) এর নয়াকৃষির কৃষকদের খাদ্য তৈরিতে কি কি ধান ব্যবহার করেছেন এবং সেই ধানের উৎপাদনের কি অবস্থা সেই তথ্য নিয়ে এই প্রতিবেদন । এঁরা সবই ক্ষুদ্র ও মাঝারি কৃষক। তাদের খুব বেশি পরিমাণ জমি নেই। আউশ, আমন ও বোরো মৌসুমে স্থানীয় জাতের ধান চাষের একটা পরিকল্পনা তাদের থাকে। জমির উঁচু, নীচু, মাঝারি অবস্থান, পানি থাকা না থাকা অনেক কিছুই ধান চাষের সিদ্ধান্তের সাথে জড়িয়ে আছে।
টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার উপজেলার কৃষকরা যে সকল ধানের চাল দিয়ে খাবার তৈরী করেছেন:
- পায়েশ: নাজিরশাইল, কালিজিরা, জামাই আদুরী, চিনিগুরি, পাইজাম, কার্তিকঝুল
- খিঁচুড়ী: কার্তিকঝুল, ভাওইলাদিঘা, পাতিশাইল, চামাড়া, হিজলদিঘা, পাটজাগ, নম্বরি ধান (ব্রি ধান-২৯)
- পোলাও: চিনিগুরি, কালিজিরা, বাঁশমতি
- চালের রুটি: লালঢেপা, সাদাঢেপা, জুলধান, হিজলদিঘা, চামাড়া, কার্তিকঝুল
- ভাত: চামাড়া, হিজলদিঘা, ব্রি ধান-২৯, হিজলদিঘা
- হাতে কাটা সেমাই পিঠা: পাটজাগ, লালঢেপা, সাদাঢেপা, চামাড়া, বড়দিঘা, সাদাদিঘা
- সংসার পিঠা/মাংসপিঠা: পাটজাগ, লালঢেপা, সাদাঢেপা, চামাড়া, হিজলদিঘা, কার্তিকঝুল, ঢেপর
- ফর্মা পিঠা, মুকশলা পিঠা, তেলের পিঠা: কার্তিকঝুল, চামাড়া, সাদাঢেপা, হিজলদিঘা
দেখা যাচ্ছে টাঙ্গাইলের নয়াকৃষির কৃষকরা ১৯ জাতের ধান উৎপাদন করছেন বিভিন্ন ধরণের খাদ্যের প্রয়োজনে। কিন্তু বাস্তব অবস্থা অনুযায়ি কৃষক সব জাত বেশি জমিতে করতে পারেন না, এবং সব কৃষকরাও করেন না। নিম্নের টাঙ্গাইলের গ্রামে ছবিতে সেই বিষয়টি উঠে এসেছে।
টাঙ্গাইলের গ্রামে বিভিন্ন জাতের ধান কত কৃষক কত জমিতে করছেন
ছবিতে দেখা যাচ্ছে ১১ জাতের ধান কম কৃষক কম জমিতে করছেন। অর্থাৎ গ্রামের সব কৃষক এই সব ধান আবাদ করতে পারছেন না। তাঁরা একে অপরের সাথে বিনিময় করে বা কিনে খাবার তৈরি করেছেন। এই ধানগুলো হচ্ছে, নাজিরশাইল, হিজলদিঘা, পাতিশাইল, ঢেপর কালিজিরা, জামাই আদুরি, বড় দিঘা, ঝুল্ধান, বাঁশমতি এবং চিনিগুরি। কৃষকরা বলছেন এর কয়েকটি কারণ আছে, যেমন ফলন কম, মাঝারি এবং উচুঁ জমি লাগে। এ রকম জমির ধরনও সব কৃষকের থাকে না। যেটুকু জমিতে করতে পারে সেটা নিজেদের খাওয়ার জন্য করে। আবার কালজিরা, জামাই আদুরি ইত্যাদী ধান এমন যে যারা রবি ফসল করতে তাদের জন্য সমস্যা, ধান কাটার পর রবি ফসল করার সময় পাওয়া যায় না। অন্য ধানের তুলনায় শেষে আসে। আর একটি গুরুত্বপুর্ণ কারণ হচ্ছে অনেক কৃষকের কাছে এই সব ধানের বীজ নাই, বিশেষ করে জামাই আদুরি, পাইজাম বাঁশমতির বীজ সব কৃষকের নাই। বাঁশ মতি ধানের একটি সমস্যা হচ্ছে এর খড় খাটো এবং পরিমানে কম হয়। অতএব গরুর খাদ্য হয় না। জুলধানের বিশেষ সমস্যা হচ্ছে মাঠে ঠিক মত পানি না হওয়ার কারনে কম কৃষক আবাদ করে। সব কৃষকের হাতে এ বীজ নাই। ধানে শুং/ঝুল আছে। সিদ্ধ করে মেশিনে ভাঙ্গাতে চাইলে শুং/ঝুলের কারণে ভাঙ্গাতে চায় না। চাউল মোটা হয়। কিন্তু পিঠা, পায়েশ ভাল হয়। ঢেপর এলাকায় কম কৃষকের কাছে এ বীজ আছে। লেবু ক্ষেত হওয়ায় ধানের জমি কমে গেছে। টান জমিতে হয়। যেসব জমিতে অর্ধেক পানি হয় সেই জমিতে চাষ করা যায়। এই ধরনের জমি যার আছে সেই কৃষক এই ধান করে।
ছয় জাতের ধান যেমন কার্তিক ঝুল, ভাওয়াইল্লা দিঘা, সাদা দিঘা, সাদা ঢেপা, লাল ঢেপা ও পাটজাগ কম কৃষক করে তবে বেশি জমিতে করে। এগুলো ডোবা জমি, বেশি পানিতে হয়। ধান মোটা, ফলন ভাল। কৃষকের ভাতের প্রয়োজন মেটাতে পারে। এ ধান চর বিল এলাকায় কৃষকরা করে। এর মধ্যে পাটজাগ ধানটি এমন যে যেখানে একটু পানি থাকে সেখানেই আবাদ করা যায়। সাধারন বৃষ্টির পানিতেও বিলে এ ধানের আবাদ করা যায় । মেয়াদকাল বেশি। তবে ফলন ভাল বলে কৃষক করে। যদিও আলু, মুলা রবি ফসল করা যায় না। সাদা ঢেপা ধানে মোটা চাউল, মোটা ভাত হয়। পিঠা, মুড়ির জন্য করে। বিল ও বন্যা হয় এমন জায়গায় আবাদ করা হয়। ফলনও ভাল হয়। যেহেতু পানি বেশী লাগে এ জন্য বন্যার পানি হলে এবং বিলের মাঝ খানে পানি আছে এমন জায়গায় কম কৃষক বেশী করে আবাদ করে। সাদাদিঘা পানি কম হলেও এ ধান হয়। এই কারনে কম কৃষক করে। জমির ধরন বুঝে করে, মাঝারী জমিতেও এ ধান ভাল হয়। গরুর খড় ভাল হয়।
মাত্র দুই জাতের ধান চামারা ও ব্রি ধান ২৮ ও ২৯ বেশি কৃষক এবং বেশি জমিতে করে। চামারা বেশি পানির ধান। বেশি পানিতে অন্য ফসল করা যায় না। রবি ফসলও করা যায় না। অগ্রায়ণ মাসের শেষে ধান ওঠে। কৃষকের হাতে বীজ বেশী আছে। ব্রি ধান ২৮ , ২৯ চিকন ধান। বীজতলা থেকে শুরু করে ১৪০দিন মেয়াদকাল। এই ধান কেটে পাট, ধইঞ্চা করতে পারে। সব ধরনের জমিতে এ ধানের আবাদ হয়। বাজারে ভাল চাহিদা আছে। কৃষকেরা হাতে বীজ রাখতে পারে।
নাটোর জেলার বড়াইগ্রাম উপজেলা এবং পাবনার ঈশ্বরদী ও আটঘরিয়া উপজেলার গ্রামে যে সকল ধানের চাল দিয়ে খাবার তৈরী করা হয়েছে
- পায়েশ, ফিরণী: বেগুন বিচি, কালিজিরা, বাশমতি
- খিচুরী: কালোবকরি, বাশমতি, আজলদিঘা, দল দিঘা, মাটি ভাঙ্গর, ব্রি ধান ২৮ ও ২৯ এবং হিদি
- চালের রুটি: কালোবকরি, পাকড়ী, কার্তিক শাইল, ভরিলটা, সাইনী ধান, আজলদিঘা, ব্রি ধান ২৮ ও ২৯
- পোলাও: কালিজিরা, চিনিগুড়ি, উকুন মধু (ব্রি ধান ৩৪)
এখানে ১৪ জাতের ধানের চাল দিয়ে খাবার তৈরি হয়েছে। যদিও পিঠা পায়েশ, পোলাও ইত্যাদী স্থানীয় জাতের ধানের চাল ব্যবহারই বেশি হয়, তথাপি দেখা যাচ্ছে আধুনিক জাতের ধানের ব্যবহার কিছুটা বাড়ছে। তার কারণ স্থানীয় জাতের ধান চাষ কমে যাওয়া। নয়াকৃষি কৃষকরা এই ধানগুলো ধরে রেখেছেন তাঁদের নিজ চেষ্টায়। এই ১৪ জাতের ধান কত কৃষক কত জমিতে করেছেন তা নিম্নের ছকে দেখানো হয়েছে।
পাবনা ও নাটোরের গ্রামের বিভিন্ন জাতের ধান কত কৃষক কত জমিতে করছেন
ছবিতে দেখা যাচ্ছে ৮ জাতের ধান কম কৃষক কম জমিতে করছেন। অর্থাৎ গ্রামের সব কৃষক এই সব ধান আবাদ করতে পারছেন না। এই ধানগুলো হচ্ছে কালিজিরা, আজলদিঘা, কালোবকরি , ধলাদিঘা, শাইনী, মাটিভাংগর, ভরি লোটা ও চিনিগুড়ি। চিকন ধান হিশেবে চিনিগুড়ি ও কালিজিরার ফলন অন্য ধানের তুলনায় কম। আবার এদিকে নম্বরী ব্রি ধান ৩৪ বা উকুন মধু নামের ধান দেখতে চিকন কিন্তু কালিজিরার মতো সুস্বাদু নয়। তবুও এই ধানের চাষ বেড়ে গিয়ে কালিজিরার চাষ কমে গেছে। কালো বকরী ধানের জন্য উপযুক্ত উচু জমি দরকার। উচু জমি কম হওয়ায়। এবং খরা অবস্থা কম থাকায় কালো বকরি ধান কমে গেছে। অর্থাৎ খরা সহনশীল আউশ ধানের সময় শুকনো অবস্থা না থেকে বৃষ্টি বেশি হলে ধানের জন্যে ভাল নয়। আজল দিঘা ও ধল দিঘা ধান চাষ করতে বেশি পানি দরকার হয়। ফলনও অন্য ধানের চেয়ে কম হয়। গভীর পানির জমি কৃষকদের কম থাকায় কম কৃষক কম জমিতে চাষ করেন। মাটি ভাংগর ধান কম পানিতেও হয় ,তবে চাষ করতে সময় বেশি লাগে। ফলনও কম হয়। এ কারনে কৃষকরা কম করেন। ভরি লোটা ও শাইনী ধান গুলো অগাত পানির ধান। এরকম জমি কৃষকের কম। এজন্য কম জমিতে কম কৃষক চাষ করেন।
ছয় জাতের ধান বেশি কৃষক বেশি জমিতে চাষ করেন। এই ধানগুলো হচ্ছে কার্তিকশাইল, হিদি, ব্রি ধান ২৮ ও ২৯, বাঁশ মতি, উকুন মধু (ব্রি ধান ৩৪) ও পাকরী। বাশমতি ধান উচু ও মাঝারী দুই ধরনের জমিতে চাষ করা যায়। ধানটি বোরো এবং আমন দুই মৌসুমে চাষ হয়। ফলনও অনেক বেশি হয়। দাম ভাল পাওয়া যায়। এজন্য বেশি কৃষক বেশি জমিতে চাষ করেন। হিদি ধান বেশি কৃষক বেশি জমিতে করেন। এই ধানের ভাত কৃষকের খুব প্রিয়। এই ধান ছাড়া কৃষকরা ভাবতেই পারেন না। উচু ও নিচু দুই ধরণের জমিতে হয়। ফলনও ভাল হয়। তাঁরা বলেন ‘তরকারি ছাড়াই লবন দিয়ে খাওয়া যায়’। আরও বলেন “যদি না থেকে হিদি, গুষ্টি পালবি কি দি?
পাকড়ী ধান বেশি কৃষক বেশি জমিতে করেন। উচু ও নিচু দুই জমিতে হয়। পানির সাথে পাল্লা দিয়ে হয়, আবার পানি কম হলেও সমস্যা হয় না। কৃষকরা নির্ভয়ে চাষ করতে পারেন। ফলনও ভাল হয়। এ্ই ধানের ভাত, মুড়ি, চিড়া, পিঠা কৃষকের খুব প্রিয়। কার্তিক শাইল ধান কৃষকের অন্যতম প্রিয় ধান। এই ধান কম পানিতেও হয় আবার বেশি পানিতেও হয়। একক ভাবে চাষ করা যায়, আবার আউশ ধান কালোবকরির সাথে মিশ্রও করা যায়। কার্তিক মাসে যখন কৃষকের অভাব থাকে। ঘরে কোন ধান থাকে না, তখন আগাম এই ধান দিয়ে কৃষকরা অভাব মেটায় ।এই ধানের ভাত এবং পিঠা খেতে খুবই স্বাদ। এজন্য বেশি কৃষক বেশি জমিতে এই ধান করেন। উকুন মধু একটি নাম্বারী ধান। কৃষকরা উকুন মধু নামে ডাকে। অনেক কৃষক ব্রি ধান ৩৪ বলে জানে। ধান দেখতে চিনিগুড়ির মতো হলেও স্বাদ, গন্ধ চিনিগুড়ির মতো এতো ভাল না। কালিজিরা, চিনিগুড়ি, বেগুনবিচি এসকল ধানের চেয়ে ফলন বেশি হওয়ায় কৃষকরা লোভে পড়ে চাষ বেশি করছে। ব্রি ধান ২৮ ও ২৯ ধান কৃষকরা বেশি করে ফলন বেশি পাওয়ার লোভে। এই ধান চাষ করতে অনেক খরচ হয়। কিন্তু কৃষকের মাথায় বেশি ধান পাওয়ার লোভ। তাই বেশি কৃষক বেশি জমিতে চাষ করেন।
একটি মাত্র বেগুন বিচি ধান বেশি কৃষক করেন তবে কম জমিতে। কম বেশি প্রত্যেক কৃষকের ঘরে এই ধান থাকে। বেগুন বিচি ধান সাধারনত কৃষকরা করে থাকেন বিভিন্ন উৎসবে ব্যবহার করার জন্য। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ও আত্বীয় স্বজনরা আসলে এই ধান ব্যবহার করে। এই ধান করতে উচু জমির দরকার হয়। পোলাও পায়েশ বিরানী ফিরণী করতে এই চাল ব্যবহার করা হয়। সবারই লাগে তবে পরিমানে কম হলেও চলে। এ কারনে বেশি কৃষক করে তবে কম জমিতে।
মোট কথা হচ্ছে নয়াকৃষির কৃষকরাই নানা জাতের স্থানীয় জাতের ধান চাষ করে এই জাতগুলো টিকিয়ে রেখেছেন। তবে নানা প্রতিকুলতার কারণে বেশ কয়েকটি জাত স্থানীয় পর্যায়ে হারিয়ে যাবার আশংকা সৃষ্টি হয়েছে। অন্যদিকে কিছু আধুনিক জাত প্রবর্তন করা হচ্ছে যা ফলন ও অন্যান্য দিক আকর্ষণীয় করে তুলে কৃষককে লোভে ফেলে দিচ্ছে। সব ধানের বীজ সব কৃষকের নাই, যার কারণে তারা ইচ্ছে থাকলেও চাষ করতে পারছেন না। আরো গুরুত্বপুর্ণ বিষয় হচ্ছে ধানের জাতের সাথে জমি উঁচু, নীচু বা মাঝারি হওয়া, পানি থাকা না থাকারও সম্পর্ক আছে। সেসব বদলে যাচ্ছে। জমির ধরণের পরিবর্তনের কারণে বীজ থাকলেও চাষ করা যাচ্ছে না। জলবায়ু পরিবর্তনের খরা, বন্যা, শীত একই রকম নেই। কাজেই সেই জাতের ধানগুলোও চাষ করা কঠিন হয়ে পড়ছে।