একটি তামাক করনীতি প্রণয়ন এখন সময়ের দাবি

ফরিদা আখতার || Saturday 11 May 2019

সব দিক বিবেচনায় তামাক একটি ক্ষতিকর পণ্য। অথচ এখনো এর ব্যবহার প্রাপ্তবয়স্ক জনগোষ্ঠীর মধ্যে ৩৫ দশমিক ৩ শতাংশ। সিগারেট, বিড়ি, জর্দা, সাদাপাতা ও গুলের ব্যবহার এমন পর্যায়ে চলে গেছে, যেন মনে হয় এগুলো দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজনীয় অংশ। অথচ আন্তর্জাতিকভাবেই এসব পণ্যের ক্ষতির দিক প্রমাণিত। তাই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তামাক নিয়ন্ত্রণের সনদ মেনে অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও ২০০৫ সাল থেকে তামাক নিয়ন্ত্রণের সুনির্দিষ্ট আইন আছে। এর ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থাও আছে। তা সত্ত্বেও তামাক ব্যবহারের এ হার বিশ্বের অন্যান্য দেশের চেয়ে অনেক বেশি এবং ক্রমাগতভাবে নতুন প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে ছড়াচ্ছে। অর্থাৎ তামাক কোম্পানির সক্রিয় চেষ্টা তামাক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমকে ব্যাহত করছে।

তামাকের ক্ষতি নিয়ে গবেষণা কম হয়নি। দেশে ১৫ লাখের বেশি প্রাপ্তবয়স্ক নারী ও পুরুষ তামাক সেবনের কারণে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়। এখন রোগের মধ্যে নতুন একটি নাম যুক্ত হয়েছে, তা হচ্ছে তামাকজনিত রোগ। সে রোগগুলো অধিকাংশই অসংক্রামক রোগের তালিকার অন্তর্ভুক্ত, যেমন হূদরোগ, স্ট্রোক, শ্বাসযন্ত্রের দীর্ঘস্থায়ী অসুস্থতা, যক্ষ্মা, ফুসফুস ক্যান্সার, স্বরযন্ত্রের ক্যান্সার ও মুখগহ্বরের ক্যান্সার। তামাকজনিত রোগের কারণে মৃতের সংখ্যা ২০০৪ সালে ছিল ৫৭ হাজার, তা বেড়ে ২০১৮ সালে হয়েছে ১ লাখ ২৬ হাজার। অর্থাৎ এসব অকাল ও প্রতিরোধযোগ্য মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছেই। সম্প্রতি বাংলাদেশ ক্যান্সার সোসাইটির গবেষণায় দেখা গেছে, তামাকের স্বাস্থ্য ক্ষতির কারণে বছরে ৩০ হাজার ৫৭০ কোটি টাকা বা ৩ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার খরচ হয়ে যাচ্ছে, যা জিডিপির ১ দশমিক ৪ শতাংশ। গত অর্থবছরে (২০১৮-১৯) স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বরাদ্দ ছিল ২৩ হাজার ৩৮৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ তামাকে এক বছরে যে ক্ষতি হচ্ছে, তা দেশের মোট স্বাস্থ্য বরাদ্দের চেয়ে ৭ হাজার ৩৮৭ কোটি টাকা বেশি। শুধু তাই নয়, অনেক ক্ষতির অর্থনৈতিক দিক নিরূপণ করা না হলেও এগুলো ক্রমেই দৃশ্যমান হয়ে উঠছে। দেশের প্রায় ৫০ হাজার হেক্টর জমিতে তামাক চাষ হচ্ছে। এ জমিতে কৃষকের শীত মৌসুমের খাদ্য ফসল উৎপাদনের কথা কিন্তু তামাক চাষের কারণে সেখানে খাদ্য ফসলের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। গাছ কেটে তামাক পাতা পোড়ানো এবং অতিরিক্ত সার ও কীটনাশক ব্যবহারের কারণে পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। অনেক মূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদ শেষ হয়ে যাচ্ছে।

তামাক শুধু সেবনকারীরই ক্ষতি করে না, যারাই কোনো ধূমপায়ীর আশপাশে থাকে, তাদের শরীরেও মরণঘাতী রোগ আক্রমণ করে। সবচেয়ে দুঃখজনক, আশেপাশে থাকা নিষ্পাপ শিশুরাও রক্ষা পায় না। এক হিসাবে দেখা গেছে, দেশে ৬১ হাজারের অধিক শিশু পরোক্ষ ধূমপানে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর মধ্যে ১৪ শতাংশ বাড়িতে বাবা, ভাই কিংবা নিকটাত্মীয়ের ধূমপানের শিকার হচ্ছে। এটা জঘন্য অপরাধ। তামাক চাষেও পারিবারিক শ্রম হিসেবে শিশুদের ব্যবহার করার কারণে তাদের শরীরে নিকোটিনের সংক্রমণ হয় এবং তারা তামাকজনিত রোগের শিকার হয়। বিড়ি কারখানা শিশুদের সস্তা শ্রমিক হিসেবে ব্যবহার করে তাদের মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে। জর্দা ও গুলের কারখানায়ও শিশুদের দিয়ে কাজ করানো হয়। শিশুদের ক্ষতির ব্যাপারে সেবনকারীরা সচেতন হলে তামাক ছাড়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত দ্রুত নিয়ে নেন। এ পর্যন্ত যারা ধূমপান ছেড়েছেন, তাদের মধ্যে অনেকেই যখন জেনেছেন যে, এ অভ্যাস তার শিশুর জন্য কত ভয়ানক হতে পারে, তখন এদিক-সেদিক তাকাননি, তামাক সেবন ছেড়ে দিয়েছেন। সন্তানের প্রতি মায়া নিকোটিনের আসক্তিকে অতিক্রম করে যায়। কিন্তু তামাক উৎপাদনকারীরা শিশুর জীবনের চেয়ে মুনাফাকেই বেশি গুরুত্ব দিয়ে যাচ্ছে। এটা মহাপাপ।

তামাকপণ্যের দাম বাংলাদেশে খুব কম। কম দাম এবং সহজলভ্য হলে এর ব্যবহারকারীর সংখ্যা বাড়বে সন্দেহ নেই। অথচ স্বল্প আয়ের মানুষ দাম বেশি হলে কিনতে গিয়ে একটু হলেও ভাবত। তামাকে খরচ করে ফেললে অন্য জরুরি পণ্য কেনা হবে না। দাম কম হলেও পরিবারের জরুরি খরচ থেকে একটু-আধটু ব্যবহার হয়ে যায়। কিন্তু তা খুব দৃশ্যমান হয় না। ব্যবহারকারী একটা ধোঁকার মধ্যে থাকে। গ্রামের নারীদের অভিযোগ করতে শুনেছি স্বামীকে দিয়ে নিজের ঘরে পালা মুরগির ডিম বাজারে বিক্রি করতে দিলে পুরো দাম তিনি পান না, কারণ স্বামী চা-সিগারেট-পান-জর্দায় খরচ করেছেন। স্বামী মনে করেছেন, বেশি টাকা তো খরচ হয়নি! একটু গল্পগুজব করতে গিয়ে ‘সস্তা’ পেয়ে সিগারেটে টান দিয়েছেন এবং পানের সঙ্গে জর্দা খেয়েছেন। নারীরাও সজাগ হয়ে গেছেন। তাই অনেক নারী বেপারির কাছে একটু কম দামে ডিম বিক্রি করাটাই এখন বেশি পছন্দ করেন।

বাজেটে প্রয়োজনীয় পণ্যের ওপর কর কমানো এবং বিলাসী ও ক্ষতিকর পণ্যের ওপর উচ্চহারে করারোপ ও বৃদ্ধি করা সরকারের নৈতিক দায়িত্ব। সরকারের বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্যে বাজেট বরাদ্দ, করারোপ সরকারের জনসম্পৃক্ততার দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। তামাক জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হিসেবে প্রমাণিত। কাজেই এর ব্যবহার কমানোর জন্য উচ্চহারে করারোপ করা সরকারের স্বাস্থ্যসেবার কর্তব্যের মধ্যেই পড়ে। কিন্তু এটা সবসময় হয় না। তাই বাজেটের সময় হলেই দাবি ওঠে তামাক নিয়ন্ত্রণ সংগঠনগুলোর কাছ থেকে। কেউ কঙ্কাল-মানববন্ধন করে বোঝায় এ তামাক কত মৃত্যু ঘটায়। এর দাম বাড়িয়ে মানুষের জীবন বাঁচান। স্বাক্ষর সংগ্রহ করা থেকে শুরু করে মতবিনিময় সভা করা, রাজস্ব বোর্ডের সামনে গিয়ে দাঁড়ানো—কোনো কিছুই বাদ যায় না। এ বছরের স্লোগান দিয়েছে—‘দাম বাড়ান তামাকের, জীবন বাঁচান আমাদের।’

সরকারকে হিসাব কষে দেখাতে হয়, এতে সরকারের একদিকে যেমন দায়িত্ব পালন করা হয়, অন্যদিকে রাজস্ব আয়ও হয়। তামাক কোম্পানিও এ সময় সক্রিয় থাকে যেন কর বৃদ্ধি করা না হয়। তাদের আশঙ্কা এতে সিগারেট-বিড়ি-জর্দার দাম বেড়ে যাবে। ফলে ব্যবহার কমে যাবে। তারা এমনই নিষ্ঠুর, নিজেদের মুনাফার কথা বিবেচনা করে মানুষের মৃত্যু বা রোগাক্রান্ত হওয়ার বিষয়কে অগ্রাহ্য করে। তারা তামাকপণ্যের ওপর কর যেন বাড়ানো না হয়, তার জন্য সরকারকে লোভ দেখায় যে তাদের মাধ্যমে সরকারের রাজস্ব আয় হচ্ছে ২২ হাজার ৮১০ কোটি টাকা। অথচ এ টাকা তামাকের ক্ষতির চেয়ে অনেক কম, সেদিক তারা তুলে ধরে না। আমাদের দেশের অর্থনীতিবিদরাও হিসাব কষে দেখিয়েছেন তামাক কর বৃদ্ধির যে প্রস্তাব দেয়া হয়েছে, তা বাস্তবায়ন করা হলে ৬ হাজার ৬৮০ কোটি থেকে ১১ হাজার ৯৮০ কোটি টাকা অতিরিক্ত রাজস্ব আয় হবে (সূত্র: প্রজ্ঞা, ২০১৯)। তাহলে এ প্রশ্ন অবান্তর যে করারোপের ফলে রাজস্ব আয়ের ক্ষতি হবে।

বিড়ির ওপর করারোপ না করার জন্য বিড়ি কারখানার মালিকরা শ্রমিকের কাজের দোহাই দিয়ে সভা করেছেন মে মাসের ২ তারিখে। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, বাম নেতাদেরও দেখা গেছে। সেখানে বিড়ি বনাম সিগারেটের তুলনা করে এমন একটি বক্তব্য হাজির করছেন যে তারা অনেক প্রগতিশীল। শিল্প বাঁচাও, শ্রমিক বাঁচাও নামে প্রতারণামূলক স্লোগান দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করা হচ্ছে। কোন শিল্প? যে শিল্প নারী ও শিশুর স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ? যে শ্রমিক দারিদ্র্যের কারণে এ কারখানায় কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন এবং নানা রোগের শিকার হচ্ছেন, তাদের জন্য? তারা তামাক নিয়ন্ত্রণের কার্যকলাপকে ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখার চেষ্টা করছেন। অথচ তারা নিজেরাই জানেন না যে এভাবে বিড়ি কারখানার শ্রমিক ও বিড়ি সেবনকারী উভয়কেই মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছেন। তাদের দাবি হওয়া উচিত বিড়ি কারখানার শ্রমিকদের জন্য বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা এবং শ্রমিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা করা। এ দাবি তামাক নিয়ন্ত্রণ সংগঠনেরও, এমনকি আন্তর্জাতিকভাবেও বিকল্প কর্মসংস্থানের দাবি উঠেছে।

তামাক নিয়ন্ত্রণে নিয়োজিত জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলো বাংলাদেশে তামাকের ওপর করারোপের সুনির্দিষ্ট সুপারিশ করেছে (সূত্র: প্রজ্ঞা, ২০১৯), যার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হলো সব তামাকপণ্যে ‘খুচরা মূল্যে’র (এমআরপি) ভিত্তিতে করারোপ করা। বর্তমানে সব তামাকপণ্যের ওপর মূল্যের শতাংশ হারে সম্পূরক শুল্ক ধার্য করা হয়। তাছাড়া এখানে চার স্তরবিশিষ্ট কর কাঠামো বেশ জটিল, এটি কমিয়ে দুটি স্তর করার প্রস্তাব করা হয়েছে। করারোপ প্রক্রিয়া সহজ করতে বিদ্যমান বিভাজন তুলে দিতে হবে। যেমন ফিল্টার, নন-ফিল্টার, জর্দা ও গুলের বিভাজন অহেতুক জটিলতা সৃষ্টি করে। একই সঙ্গে সব তামাকপণ্যের ওপর একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক (স্পেসিফিক ট্যাক্স) আরোপ করতে হবে। এটা ধোঁয়াবিহীন তামাকপণ্যের জন্য আরো বেশি জরুরি। জর্দা, গুলের কারখানাগুলো এমনভাবে কাজ করে যে তাদের খুঁজেই পাওয়া যায় না এবং করের আওতায় আনা যায় না। সরকার বিশাল অংকের কর থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

সরকারের একটি তামাক করনীতি প্রণয়ন করা এখন সময়ের দাবি। উদ্দেশ্য একটাই—জনস্বাস্থ্য রক্ষা করা, মানুষের জীবন বাঁচানো।

দৈনিক বণিকবার্তা’য় প্রকাশিত হয় ১১ মে ২০১৯

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *