ফরিদা আখতার || Sunday 31 March 2019
রিদয়পুর বিদ্যাঘরে টাঙ্গাইলের বিভিন্ন গ্রাম থেকে কৃষকেরা এসে আমাদের সাথে একদিন আড্ডা দিয়েছেন। চৈত্র মাসের ১৩ তারিখ (১৪২৫ সাল)। সংখ্যায় বেশি নয়, বারোজন, কিন্তু নয়াকৃষি আন্দোলনের অঙ্গে যুক্ত বলে বীজ নিয়ে তাঁদের চর্চা ও জ্ঞান অসামান্য। আলোচনা হয়েছে সারা বছর বিভিন্ন উৎসবে কী কী ধরণের খাবার তৈরি হয় এবং সে জন্য কি জাতের ধান কৃষক ব্যবহার করেন।
বাংলাদেশের কৃষক প্রধানত ধান চাষের ওপরই নির্ভরশীল। বেশির ভাগ, (প্রায় ৭০%) কৃষকই ক্ষুদ্র কৃষক যাদের জমির পরিমাণ এক হেক্টরের কম। এই জমিতে আমন, আউশ ও বোরো ধান ও শীতকালীন সব্জি, তেল, ডাল ইত্যাদি চাষ করেন। নিজের পরিবারের প্রয়োজন মিটিয়ে তারা কিছু বাজারেও বিক্রি করেন। বাকী ২৫% মধ্যম ও ৫% বড় কৃষক আছেন যারা বাণিজ্যিক চাষেও নিয়োজিত। তারা সকলেই নিজে চাষ করেন না, বর্গা বা লীজ দিয়ে জমি চাষ করেন। কাজেই জমি, ফসল ও নিজেদের ব্যক্তিগত জীবন ধারণের বিষয়গুলো ক্ষুদ্র কৃষকদের মধ্যেই বেশি পাওয়া যায়। ধান তাদের জীবনের অর্থনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয় ও পারিবারিক সব প্রয়োজনের সাথেই যুক্ত।
কৃষক ধানের বিভিন্ন জাত উৎপাদন করেন, এর মধ্যে সারা বছরের ভাত খাওয়ার ধান প্রধান হলেও তারা অনেক সুগন্ধি, চিকন ও নানান বৈশিষ্ট্য ও গুণসম্পন্ন ধান চাষ করে। শখ করে নয়, সেটাও প্রয়োজনে। সারা বছর অনেক ধরণের ধর্মীয় ও পারিবারিক অনুষ্ঠান থাকে। যেমন মুসলমানদের জন্যে ঈদুল ফিতর, ঈদুল আজহা, শবে বরা্ত, হিন্দুদের দুর্গা পুজা, লক্ষ্মী পুজা, ভাইফোঁটা, দোলপূর্ণিমা ইত্যাদি। আবার বিয়ে শাদী, বিয়ের পর মেয়ে-জামাই ফিরানি, বিভিন্ন সময়ে জামাইকে খাওয়ানো সাধারণ ভাতের চালে হবে না। এর জন্যে চাই বিশেষ ধানের জাত।
টাঙ্গাইলের নয়াকৃষি কৃষকদের সাথে আড্ডা দিতে গিয়ে তেমনি অনেক কথা জানা গেল। মার্চের ২৭ তারিখে বিষ্ণুপুরে নয়াকৃষি বিদ্যাঘরে তাঁরা এসেছিলেন। দেখা গেল নারী কৃষকদের জ্ঞান এ ব্যাপারে বেশি টনটনে। কৃষকের বাড়ী যেন সব সময়ই উৎসবে মূখর। সারা বছরই কিছু না কিছু অনুষ্ঠান লেগেই থাকে। এই অনুষ্ঠানে মূল আকর্ষণ হচ্ছে বিশেষ খাবারের আয়োজন। এবং সেই বিশেষ খাবারে ভিন্ন ভিন্ন জাতের চালের ব্যবহার হয়।
অত্যন্ত প্রাণবন্ত আলোচনার একটি সারমর্ম এখানে পেশ করছি।
ধর্মীয় অনুষ্ঠানঃ মুসলমানদের পাঁচটি অনুষ্ঠান ঈদুল ফিতর, ঈদুল আজহা, শবে বরাত, বার্ষিক সিন্নি, বার্ষক জিকিরের অনুষ্ঠানে প্রায় ১১ পদের খাবার তৈরি করা হয়, যার জন্যে ২০ জাতের ধানের ব্যবহার হয়। এই ১১ পদের খাবার হচ্ছে; পায়েস, ক্ষীর, রুটি, গোস্ত-রুটি, পিঠা,পাকান পিঠা, হাতে কাটা সেমাই, খিচুড়ি, পোলাও, ইত্যাদি। টাঙ্গাইলে যে জাতের ধান সাধারণত ব্যবহার হয় সেইসব হচ্ছে কালিজিরা, চিনিগুঁড়ি, হিজল দিঘা, দিঘা, কার্তিক ঝুল, ঝুল ধান, চামারা, নাজিরশাইল, হিজলদিঘা, ভাতুরি, পইটা ঢেপর, পাটজাগ, কাজলি বোরো, টেপাবোরো, ভাওইলাদিঘা, কালামানিক, ময়নাগিরি ও লাল শাইল।
হিন্দু পরিবার থেকে দু’জন কৃষক ছিলেন। তাঁরা জানালেন চারটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান যেমন দুর্গা পুজা, লক্ষ্মী পুজা, ভাইফোঁটা, রথ যাত্রা, দোল পুর্ণিমায় ৭ পদের খাবারের কথা। এই সকল অনুষ্ঠান ও উৎসবে ৭ জাতের ধানের ব্যবহার হয়।
এই ৭ পদের খাবার হচ্ছে খিচুড়ি, পায়েস, মুড়ির মোয়া, চিড়ার মোয়া, পিঠা, পোলাও ও খিচুড়ি এবং ৭ জাতের ধান হচ্ছে চামারাদিঘা, কালিজিরা, পাটজাগ, পাতিশাইল, হিজলদিঘা, বিন্নি ও দিঘা।
সারা বছরে বিভিন্ন মাসে, বিশেষ করে ভাদ্র মাসের পর থেকে চৈত্র-বৈশাখ পর্যন্ত, বিভিন্ন ধরণের পিঠার উৎসব হয়। শীতের সময় নতুন ধান ওঠে। বিবাহিত মেয়ে ও জামাইকে আনতে হয়, এবং তাদের পিঠার আপ্যায়ন করতে হয়। শ্বশুর-শ্বাশুড়ি বেঁচে থাকলে জামাই বুড়ো হয়ে গেলেও পিঠার দাওয়াত বাদ যায় না। এই প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে পুরুষ কৃষকরা কিছুটা লাজুকভাবে স্বীকার করেন যে তাঁরা বুড়ো বয়সেও শ্বশুড় বাড়ীর পিঠা খেতে যান। যেসব নারী কৃষক নতুন শ্বাশুড়ী হয়েছেন, মনে হচ্ছিল তাদের এখনকার ব্যাস্ততার মূল কারণ হচ্ছে জামাইকে পিঠা খাওয়ানো, এবং এই আধুনিক যুগেও নানা রকম পিঠা তৈরি করে তারা আপ্যায়ন করছেন। শুধু তাই নয়, বিভিন্ন মাসে পিঠা তৈরি করে আত্মীয় স্বজনদের খাওয়ানোটাও রেওয়াজ হয়ে গেছে।
শীতকালীন পিঠা অনুষ্ঠান (পৌষ ও মাঘ মাস) ১৪ পদের পিঠা ও ১১ জাতের ধানের কথা উল্লেখ করেন কৃষকরা। এই পিঠাগুলো হচ্ছে, ভাপা পিঠা, দুধের পিঠা, খিচুড়ি, দুধ পুলি, সিদ্ধ কুলি, ভাজা কুলি, দইলা পিঠা, মুঠা পিঠা, চালের আটার রুটি, পায়স, তেলের পিঠা, পাটিসাপটা, চিতই পিঠা ও চিড়া এবং ধানের জাত হচ্ছে কার্তিক ঝুল, লাল শাইল ধান, দিঘা, চামারা, দুধ কলম, হিজল দিঘা, আবছায়া, ঢেপা, পাতিশাইল, হিজলদিঘা, কালিজিরা, ইত্যাদি।
ভাদ্র মাসে তেড়াবেড়া অনুষ্ঠানে ৬ পদের পিঠা করা হয়। তালের পিঠা, তালের বড়া, চাপড়া, তেলের পিঠা, তালের রসের পিঠা ও তালের ক্ষীর। এই পিঠা তৈরি করতে ১১ জাতের ধান ব্যবহার করা হয়, যেমন কার্তিকঝুল, হিজলদিঘা, ঢেপা, ঢেপর, পাটজাগ, জাগলি বোরো, টোপাবোরো, চামারাদিঘা, ভাওয়াইলা দিঘা, পাটজাগ ও পাতিশাইল।
অগ্রহায়ণ মাস আসতেই পিঠা বানানো শুরু হয়ে যায়। এই সময় ৭ পদের পিঠার নাম কৃষকরা জানিয়েছেন। এগুলো হচ্ছে ভাপাপিঠা, মুইটা পিঠা, খিচুড়ি, সিদ্ধকুলি, মুড়ি, দুধ কুলি ও রুটি। এগুলো তৈরিতে ব্যবহার করা হয় ৯ জাতের ধান: ঝুলধান (সুগন্ধি ধান), হিজলদিঘা, কার্তিকঝুল, চামারাদিঘা, দিঘা, ভাওয়াইলাদিঘা, পাটজাগ, ঢেপা ও কার্তিক শাইল।
ফাল্গুন- চৈত্র মাসেও প্রায় ১৬ পদের পিঠা বানানো হয় এবং আত্মীয় স্বজনদের দাওয়াত দিয়ে খাওয়ানো হয়। এই পিঠাগুলো হচ্ছে রুটি, ভাজাকুলি, সংসার পিঠা, খিচুড়ি, মুকশালা পিঠা, আমরসা পিঠা, সাজপিঠা, ফুলপিঠা, মুড়ি, আন্দাসা, পাটিসাপটা, ছিটরুটি, ক্ষীর, গোস্ত রুটি ও খোরমা পিঠা। এইসব তৈরিতে ১২ জাতের ধান ব্যবহার করা হয়; হিজলদিঘা, সাদাদিঘা, কালাবোরো, বড়দিঘা, লালশাইল, দিঘা, ভাওয়াইলাদিঘা, হরহরি, দুধকলম, চামারা, কার্তিকঝুল ও ঢেপর।
বৈশাখ মাসে হিজল দিঘা চালের পান্তা ভাত খুবই সুস্বাদু। এই পান্তা ভাত ইলিশ দিয়ে খাওয়া লাগে না, শুধু মেখে খেলেও স্বাদ লাগে।
গ্রামে কৃষকের বাড়ীতে বিয়ে শাদীতে নানা পদে খাবার বিশেষ করে পিঠার আয়োজন থাকে। এই আড্ডায় কৃষকরা ১০ পদের খাবারের কথা বলেছেন, যেমন পোলাউ, পায়েস, ডাবরডালা পিঠা, কাচি খোচা পিঠা, বেলন যাতা পিঠা, মুরগী রুটি, ছাগল নতা পিঠা, বুলবুল পিঠা, বাইনজাত পিঠা ও খিচুড়ি। এই খাবার তৈরিতে ১০ জাতের ধান ব্যবহার কর হয়; কালিজিরা, চামারা, ভাওইলাদিঘা, পাটজাগ, দিঘা, সাদা ঢেপর, লাল ঢেপর, চিনিগুরি, কার্তিকঝুল ও হিজলদিঘা।
মেয়ে বিয়ে দিলে ফিরানী আনা একটি বড় অনুষ্ঠান, বিশেষ করে খাবারের আয়োজনের দিক থেকে। এই সময় ১০ পদের খাবার যেমন কুলি পিঠা, তেলের পিঠা, রুটি পিঠা, রুটি, সাজপিঠা, সমসের পিঠা, পোলাউ, পায়েস, পিঠা, আম-মুড়ি (আমের মৌসুম হলে)। এর জন্যে ৯ জাতের ধানের ব্যবহার হয়; চামারা, ঢেপর, হিজলদিঘা, পাতিশাইল, কার্তিকঝুল, পাটজাগ, ময়নাগিরি, কালিজিরা ও চিনিগুঁড়ি।
হিন্দু পরিবারে জামাই ষষ্ঠীতে খিচুড়ি ও পায়েস করা হয়, এবং তার জন্যে চামারা-দিঘা, কালিজিরা ও হিজলদিঘা ধান ব্যবহার করা হয়।
এই ছোট একটি আড্ডায় প্রায় ৩০ জাতের ধানের নাম পাওয়া গেছে, যা দৈনন্দিন ব্যবহারের পাশাপাশি নানা ধরণের পিঠা, পায়েস, পোলাও, খিচুড়ি ইত্যাদি তৈরিতে ব্যবহার হয়। কিন্তু সব ধান কৃষক পর্যায়ে যথেষ্ট পরিমান চাষ হয় না। তাই কয়েকটি ধান, যেমন কালিজিরা, হিজল দিঘা, দিঘা, চামারা দিঘা, পাটজাগ, ভাওইয়াল্লা দিঘা, চিনিগুড়ি, ঢেপা ও লাল ও সাদা শাইল এর মতো ১০টি জাত বেশি ব্যবহার হয় বলে কৃষকেরা উল্লেখ করেছেন, অথবা বলা যায় এগুলো কৃষকরা এখনো যথেষ্ট পরিমাণে আবাদ করছেন। এই আবাব্দ ধর্ম, উৎসব ও সাংস্কৃতিক বোধের ও চর্চার সঙ্গে যুক্ত। অন্যদিকে কিছু জাতের ধান মাত্র ঈদুল আজহাতেই ব্যবহারের কথা উল্লেখ আছে, যেমন নাজিরশাইল, ভাতুরি, পইট্টা ঢেপর ও কালামানিক। নারিকেলবাদী ধান শবে-বরাতে রুটি-পিঠার জন্যে ব্যবহার হয়, কিন্তু সব কৃষকের কাছে এই ধান নেই। হিন্দুদের লক্ষ্মী পুজা ও দোল পুর্ণিমায় বিন্নি এবং রথ যাত্রায় কাজল দিঘা ধানের ব্যবহারের কথা বলেছেন দুজন কৃষক। তাঁরা নিজেরা এই ধান উৎপাদন না করলেও অন্যদের কাছ থেকে কিংবা বাজার থেকে কিনে হলেও ব্যবহার করেন। ভাদ্র মাসের তেড়া-বেড়া অনুষ্ঠানে জাগলি বোরো ধান ব্যবহার হয়, কিন্তু এই ধান অন্য কোন উৎসবে বা অনুষ্ঠানে ব্যবহারের কথা এই কৃষকদের কাছে শোনা যায় নি। এটাও প্রায় হারিয়ে যাওয়া ধানের একটি। দেখা যাচ্ছে তেড়া-বেড়া অনুষ্ঠানের সাথে জাগলি বোরো ধানের সম্পর্ক রয়েছে। সাদা দিঘা ও হরহরি নামের দুটি ধান ফাল্গুন চৈত্র্ মাসের পিঠার জন্যে ব্যবহার হয়।
বিশেষ জাতের ধানে বিশেষ পিঠা বা খাবার তৈরির কারণ আছে। কৃষক তার বর্ণনাও দিলেন। যেমন তালের পিঠা দিঘা ধানের চাল দিয়ে করলে মচমচায়। নদী ও বিল বাওরে হয় এমন ধান ঢেপর, পাটজাগ, জাগলি বোরোর ধানের চাল দিয়ে পিঠা ভাল ফোলে, খেতেও ভাল লাগে। ভাপা পিঠা যে কোন দিঘা (আমন) ধান দিয়ে করা যায়, যেমন চামারা দিঘা। চামারা চালে লাল আবরণ থাকে তাই পিঠা নরম হয়। কার্তিক ঝুল ধানের চাল দিয়ে করলে গন্ধ সুন্দর হয়। ভাওয়াইল্লা দিঘা চাল দিয়েও ভাপা পিঠা হয়। চিতই পিঠা কার্তিক ঝুল ও ঢেপর চালে করা হয়। দুধের পিঠা (দুধ কুলি, সিদ্ধ্ কুলি, ভাজা কুলি) দিঘা, চামারা ও দুধকলম চাল দিয়ে করা হয়। খিচুড়ি করতে হলে দিঘা (আমন), ভাওয়াইল্লা দিঘা, ভাতুরি, পুইটা ঢেপর ও চামারা চাল (আতপ ও সিদ্ধ) দিয়ে করা ভাল। আমন ধানে খিচুড়ি খেতে স্বাদ বেশি। যেমন চামারা দিঘা। কালামানিক চাল দিয়েও খিচুড়ি করা হয়। পোলাও কালিজিরা, চিনিগুড়ি চাল দিয়ে করা হয়। রুটি পিঠা কার্তিক ঝুল চালের গুরা দিয়ে করা হয়। এর সাথে নারিকেল বাদী চাল দিয়ে মেশালে রুটি আরও স্বাদ হয়। ক্ষীর করতে জাগলি বোরো, টোপা বোরো আর কার্তিক ঝুলের চাল ভাল। কার্তিক ঝুলের ক্ষীর একটু আঠা আঠা হয়, তাই খেতে ভাল লাগে। পায়েস চিনিগুড়ি ও কালিজিরা চাল দিয়ে করা হয়। ছিট পিঠা কার্তিক ঝুলের চাল দিয়ে করা হয়। কার্তিক ঝুল দিয়ে আরো কয়েকটি পিঠা হয় যেমন খরমা পিঠা, মুখশালা, আমরসা, সমসের পিঠা, ইত্যাদি। মুড়ি-খৈয়ের জন্যে ঢেপর ও পাটজাগ ধান লাগে। তবে খৈ মধুশাইল, বিন্নি, কার্তিক কাইকা দিয়ে ভাজলে খেতে মজা বেশি। মোয়া হিজল দিঘার মুড়ি দিয়ে বানানো হয়। পায়েস কার্তিক ঝুল (আতপ), চিনিগুড়ি চালে ভাল লাগে। পান্তা ভাত হিজল দিঘা চালে মজা বেশি।
পিঠা ও অন্যান্য খাবার দিঘা (আমন) ধান দিয়েই বেশি হয়, এবং এই ধানের বৈচিত্র্য অনুযায়ি পিঠা, পায়েস, রুটি, খিচুড়ির স্বাদ, গন্ধ সব কিছু নির্ভর করে।
একদিকে এই আড্ডার মাধ্যমে এটূকু বোঝা গেল কৃষক, তা সে যতো ক্ষুদ্রই হোক, শুধু ভাত খাওয়ার জন্যে ধান উৎপাদন করেন না। তাঁরা বিশ্বাস করেন পিঠা ও নানা ধরণের খাবার তৈরি করে আত্মীয় স্বজন, পরিবার ও পাড়াপ্রতিবেশিদের দাওয়াত দিয়ে খাওয়ালে সংসারে আয় বাড়ে, পরিবারের সদস্যদের আয়ুও বাড়ে। কৃষকের ধান চাষের পরিকল্পনায় সারা বছরের আনন্দ উৎসব, আত্মীয়তা, সামাজিকতা, ধর্ম পালন এবং গুরুত্বপুর্ণ পারিবারিক দায়িত্ব পালনের বিষয় সামনে থাকে, তার যতোটুকু উঁচু-নিচু জমি আছে, সেসব মিলিয়ে বিভিন্ন জাতের ধান আউশ-আমন –বোরো মৌসুমে চাষ করা হয়। জমির স্বল্পতা ও জমির ধরণের ভিন্নতার কারণে সব প্রয়োজনীয় ধান প্রত্যেক কৃষক নিজে চাষ করতে পারেন না বটে, কিন্তু একই গ্রামে অন্য কৃষক আবাদ করলেও তাঁরা খুশি, কারণ বিনিময় করতে পারেন। সেকারণে এই আড্ডায় কৃষকরা এমন ধানের নামও বলেছেন যা তাঁরা নিজেরা করেন না, কিন্তু অন্য কৃষক করে।
তবে এর মধ্যে দুটি বিষয় ঢুকে পড়েছে। এক, বাজার এবং দুই, আধুনিক খাবার, যেমন কেক, মিষ্টি, পানীয় ইত্যাদি। বাজারে পোলাওয়ের চাল কালিজিরা, চিনিগুঁড়ি ইত্যাদি পাওয়া যায়, ফলে কৃষকের না থাকলে পয়সা দিয়ে বাজার থেকে কেনা যায়। এই চাল দিয়েই সব রকম পিঠা, পোলাও করা হয়। কিন্তু ভয়ংকর হচ্ছে আধুনিক যুগের ছেলে মেয়েরা ধানের জাতের সাথে বিভিন্ন পিঠার স্বাদের পার্থক্য করতে পারেন না। কৃষকরা হাসি মুখেই একটু অনুযোগ করেছেন ছেলের বৌয়েরা পিঠা বানাতে কম জানে; বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শ্বাশুড়ি শিখিয়ে দেয়। তবে একটূ বেশি শিক্ষিত মেয়েরা ( যেমন গ্রাজুয়েট পাশ) পিঠা বানানো শিখতেও আগ্রহী নয়। একই সাথে গ্রামে এখন আধুনিক খাবার এসে গেছে। মেহমান বা জামাই আসলে কেক, মিষ্টি ইত্যাদি দেয়া সহজ। পিঠা নয়, এইসব দেওয়াই আধুনিকতার পরিচয় হয়ে উঠেছে।
পিঠাসহ নানা ধরণের খাবারের সাথে ধানের জাতের সম্পর্ক অবিচ্ছিন্ন। ধানের জাত পিঠার স্বাদ-গন্ধ সব পালটে দেয়। এমন কি খিচুড়ির জন্য আলাদা জাতের হিজল দিঘা বা চামারা দিঘাঢ় ব্যবহার নির্ভর করে খিচুরি কিভাবে রান্না হবে তার ওপর। ধানের (চালের) জাতও রেসিপির উপকরণের অংশ। কাজেই ঘরে তৈরি খাবার ও পিঠা হারালে ধানের জাতও তার কদর হারাবে, তার চাষও কমে যাবে এবং এক সময় অনিবার্য ভাবেই বিলুপ্ত হবে। আগামি প্রজন্ম বঞ্চিত হবে বৈচিত্র্যময় খাদ্য থেকে।
তবে এটা ঠিক কৃষক নিজের প্রয়োজনে হলেও এখনো বিভিন্ন জাতের ধান টিকিয়ে রেখেছেন এবং ব্যবহার করছেন। এমন কি, আধুনিক কৃষিতে যারা একাট্টা (monoculture) এবং নম্বরী ধান চাষ করেন তাঁরাও তাদের অল্প কিছু জমিতে নিজেদের জন্যে প্রয়োজনীয় চিকন ও সুগন্ধি ধান চাষ করেন।
কৃষকের বৈচিত্র্যময় উৎপাদনে সহায়তা করতে হলে শহরের মানুষকেও এগিয়ে আসতে হবে।
যারা এই আড্ডায় অংশগ্রহণ করেছেন তাঁরা হলেন জাহানারা বেগম, মনোয়ারা বেগম, সুরিয়া বেগম, গোলাপী, ওসমান গনি, মোঃ মনির, আক্কাস আলী, শাহনাজ বেগম, কমলা রানী নন্দী, নবকুমার দে, কছিমউদ্দিন ও নবিরন বেগম। এঁরা এসেছেন টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার উপজেলার কয়েকটি গ্রাম পাচুরিয়া, মুসুয়রিয়া, স্বল্পনাড়ু, হিংগানগর, বাবুপুর, ফাজিলহাটি, গজিয়াবাড়ি ও চিনাখোলা থেকে।
প্রতিবেদন লিখেছেন ফরিদা আখতার, সহযোগিতায় সীমা দাস সীমু ও ফাহিমা খাতুন লীজা
২৭ মার্চ, ২০১৯