টাংগাইল শাড়ীর বর্তমান অবস্থা

রবিউল ইসলাম চুন্নু || Thursday 21 December 2017

টাংগাইল শাড়ী, যার আলাদা একটা কদর আছে সারা দেশে। টাংগাইল জেলায় বিভিন্ন এলাকায় শাড়ী তৈরী হলেও আসল টাংগাইল শাড়ী উৎপাদন হয় পাথরাইল এলাকার কয়েকটি গ্রামে। যেমন- পাথরাইল, নলশোধা, চন্ডি, ধুলটিয়া, নলুয়া, মঙ্গলহর সহ আরো কয়েকটি গ্রামে।

এখানকার তাঁতীরা টাংগাইলের নকশী বুটি, টাংগাইল জামদানী, বালুচুরি, টাংগাইল সিল্ক ও জ্যাকাট তাঁতের বিভিন্ন ডিজাইনের শাড়ী তৈরী করে থাকে। ঈদ, পূজা, ১লা বৈশাখ সহ বিভিন্ন উৎসবকে সামনে রেখে তাঁতীরা ভিন্ন ভিন্ন ডিজাইনের শাড়ী তৈরী করে। তাঁতীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, এবারে সুতার মূল্য বেশী থাকায় ক্ষুদ্র তাঁতীরা উৎপাদন পুঁজির অভাবে শাড়ী উৎপাদন কম করেছে। অনেক তাঁতীর সুতার অভাবে তাঁতও বন্ধ ছিল। ছয় মাস আগে যে সুতা ৪০ টাকা মোড়া ছিল সেই সুতা বর্তমানে ১১০ টকায় কিনতে হচ্ছে। শুধু সুতার দাম না, এর সাথে পাল্লা দিয়ে গত ছয় মাসে বেড়েছে তাঁতের বিভিন্ন উপকরণের দাম। ৩০০ টাকার সানা বর্তমানে ৫৫০ টাকা। ৫০ টাকার মাকু ১১০ টাকা। ১০০ টাকার ছিটা ২৫০। বও সুতা তাঁত প্রতি লাগত ৫০ টাকা বর্তমানে ১০৫ টাকা। ২০ টাকা জোরা ম্যারা বর্তমানে ৩৫ টাকা। শাড়ীতে মার দেওয়ার খইয়ের ধান ২০ টাকা কেজি ছিল বর্তমানে ৩৫ টাকা কেজি। ১২০০ টাকার ফয়ছাল বর্তমানে ২২০০ টাকা। ১৫০ টাকার নরদ বর্তমানে ৩০০ টাকা। ২০০০ টাকার প্যাচা বর্তমানে ৩০০০ টাকা।

এছাড়াও ঈদের বাজারের ঠিক আগ মুহূর্তে এক নাগারে প্রায় ২০/২৫ দিন বৃষ্টির কারণে শাড়ীর উৎপাদন কমে যায়। কারণ বৃষ্টির সময় তাঁতের বুনা নরম হয়ে যায়, মাকু চলে না। শাড়ীতে মার দেওয়া যায় না। যার কারণে ঈদের বাজারে শাড়ীর প্রচুর চাহিদা থাকার পরও তাঁতীরা শাড়ী দিতে পারে নি। ঈদের দুই হাট আগেই সমস্ত শাড়ী বিক্রি হয়ে যায়। শাড়ীর দামও ছিল অন্যান্য বছরের তুলনায় বেশী। এবারের ঈদে যে সব বুটি শাড়ী বেশী চলেছে তা হলো- বেকি বুটি, রথবুটি, হাতিমাথা বুটি, কামরাঙ্গা বুটি, আম বুটি ইত্যাদি।

টাংগাইল বল্লা এলাকার সব চেয়ে কম মূল্যে ২৮০ টাকার শাড়ী ৩৭০ থেকে ৪০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। পাথরাইল তাঁতের ৮০০ টাকার শাড়ী ১০০০ থেকে ১১০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। তবে শাড়ী বিক্রির লাভের অধিকাংশ টাকাই চলে গেছে মহাজনদের পকেটে। কারণ এক এক জন মহাজনের ৩০০ থেকে শুরু করে ১২০০ পর্যন্ত তাঁতের দাদন দেওয়া আছে। এই দাদন নেওয়া তাঁতীরা মহাজনের কাছ থেকে সারা বছর সুতা ও টাকা নেয় এবং তৈরী শাড়ী মহাজনকে দিয়ে দেয়। শাড়ীর মূল্য বৃদ্ধির সাথে এদের কোন সম্পর্ক নাই। তাঁতীরা শুধু শাড়ী উৎপাদনের মুজুরী পায়। মহাজনরা এই শাড়ী বেশী দামে বিক্রি করলেও এবারের ঈদে ক্ষুদ্র তাঁতীদের মূলত কোন লাভই হয়নি।

সম্প্রতি টাংগাইল শাড়ির সংকটের অন্যতম কারণ হলো পাথরাইলের কিছু বসাক ভারতে তাদের আত্মীয়স্বজন ও কাপড় ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে টাংগাইলের শাড়ী ভারতে নিয়ে বিক্রি করছে। অনেক বসাকের আত্মীয়- স্বজন ভারতে থাকে, ভারতীয় ব্যবসায়ীরা তাদের অগ্রীম টাকা দিয়ে রাখে। টাকা পেয়ে ভারত থেকে বসাকরা বাংলাদেশের বসাকদের শাড়ি দিতে বলে। আবার ভারতের অনেক ব্যবসায়ী পাথরাইলে শাড়ী ব্যবসায়ীদের বাড়িতে রাতে থেকে পরের দিন পছন্দ মতো শাড়ি কিনে নিযে যায়। বৈধ এবং অবৈধ দুইভাবেই ভারতে শাড়ি যাচ্ছে এবং প্রতি বছরই টাংগাইল থেকে প্রায় ৩০০ শ্রমিক ভারতে যাচ্ছে।

পাথরাইলের শাড়ি ব্যবসায়ীরা বলছেন- ভারতের সমুদ্রগড়, ফুলিয়া, শান্তিপুর, নবদ্বীপ, ধাত্রীগ্রাম এই সমস্ত এলাকায় সুতার শাড়ী তৈরী হতো। এখন আর এই সব এলাকায় সুতার শাড়ী তৈরী হচ্ছে না বললেই চলে। এর অন্যতম কারণ দিন দিন শ্রমিকের মুজুরী বৃদ্ধি এবং তাঁতীরা তাঁত শ্রমিক পেশা থেকে বেশী টাকা পাওয়ার আশায় অন্য পেশায় চলে যাচ্ছে। বাংলাদেশের সাথে ভারতের টাকার বাট্টার কারণেও এটা হচ্ছে। ভারতে যে শাড়ী উৎপাদন করতে ৭০০ টাকা খরচ হয় সেই শাড়ী টাংগাইল থেকে ৫০০ শত টাকায় কিনতে পারে।

ভারতের সুতীর শাড়ীর উৎপাদন কমে যাওয়া এবং ভারতের বাজারে প্রচুর চাহিদা থাকার কারণে টাংগাইলের উৎপাদিত শাড়ী ভারতে চলে যাচ্ছে। শুধু পাথরাইল থেকেই সপ্তাহে ১,০০,০০০ পিস শাড়ী ভারতে যাচ্ছে। আর ভারতীয় ব্যবসায়ীরা পাথরাইল থেকে যে সমস্ত ডিজাইনের শাড়ী নিচ্ছে তা হলো- টাংগাইল সুতী জামদানী, জ্যাকাট পার বুটি, টাংগাইল সিল্কের বালুচুরি ও সুতী বালুচুরি। অনেক সময় মহাজনরা টাংগাইল শাড়ী না পেলে পাবনা থেকে শাড়ী কিনে পাথরাইলে প্যাকেট করে টাংগাই শাড়ী বলে ভারতের ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করছে।

পাথরাইল থেকে প্রতি মাসে কমপক্ষে ৩২ কোটি টাকার শাড়ী ভারতে যাচ্ছে। এই শাড়ীগুলো পাথরাইল থেকে ট্রাকে বেনাপোল যায় এবং বেনাপোল থেকে ভারতীয় ট্রাকে করে ভারতের কলকাতা ও বিভিন্ন শহরে য়ায়। পাথরাইল থেকে শাড়ি ভারতে পৌঁছানো পর্যন্ত প্রতি পিছ শাড়ি ১৫ টাকা করে খরচ হয়। শাড়ী ব্যবসায়ীরা বলছে EPB এর অনুমোদন নিয়ে এল সি করে শাড়ী ভারতে পাঠানো হচ্ছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *