নয়াকৃষি আন্দোলন || Monday 24 April 2017
বহুজাতিক কম্পানির প্রাণ বিনাশী ভূমিকা
একালে মানুষসহ সকল প্রাণের চরম হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে গুটিকয়েক বহুজাতিক কর্পোরেশান। তাদের বিষ, রাসায়নিক দ্রব্য ও নানান ক্ষতিকর পণ্য উৎপাদন ও ব্যবহার প্রকৃতি ও পরিবেশ ধ্বংস করছে। প্রকৃতি ও পরিবেশ তারা বিষাক্ত করে তুলছে। প্রাণ আজ সর্বত্রই বিপন্ন। আগে তাদের প্রধান ব্যবসা ছিল ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ এবং বিশেষ ভাবে কীটনাশক বা বিষ বেচা। এখন তারা বীজের ব্যবসা ও কৃষিতে ঢুকেছে। সারা দুনিয়ার খাদ্য ব্যবস্থা তারা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেবার জন্য উন্মাদ হয়ে উঠেছে। মানুষ না খেয়ে বাঁচতে পারবে না। খাদ্য ব্যবস্থা – অর্থাৎ উৎপাদন থেকে শুরু করে বিপণণ ও ভোগের প্রতিটি চক্রের ওপর তারা তাদের একচেটিয়া কায়েম করতে চাইছে। তাদের বিপণন ব্যবস্থা আগ্রাসী। শক্তিশালী রাষ্ট্র – বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন নিয়ে দুর্বল দেশে তারা ক্ষতিকর বিষ, রাসায়নিক পদার্থ এবং পরিবেশ ও প্রকৃতির জন্য ক্ষতিকর নানান পণ্য ও টেকনলজি চাপিয়ে দিচ্ছে। বিশ্বব্যাপী এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হচ্ছে।
এদের সাম্প্রতিক তৎপরতা জেনেটিক কারিগরি দ্বারা ফসলের প্রকৃতির মধ্যে বিকৃতি ঘটিয়ে ‘জি এম ও’ বা বিকৃত বীজ বাজারজাত করণ। জিএমও প্রাণ ও প্রকৃতির জন্য ধ্বংসাত্মক বিপদ হয়ে দেখা দিয়েছে। খোদ কৃষির জন্য হুমকি হয়ে উঠেছে। জিএমও বা বিকৃত বীজের বিপদ সম্পর্কে আন্তর্জাতিক বৈজ্ঞানিক মহল সতর্ক, প্রাণের জেনেটিক পর্যায়ে বিকৃতির সম্ভাব্য বিপদ আছে বলেই এর জন্য অতিরিক্ত সতর্কতার কথা আধুনিক বিজ্ঞান বলে থাকে। কিন্তু বহুজাতিক কম্পানি তা মানতে চায় না। বিকৃত বীজ প্রবর্তনের আন্তর্জাতিক বিধি বিধান ও বৈজ্ঞানিক সতর্কতা সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে বাংলাদেশে বিকৃত বেগুনের চাষ করা হয়েছে। বিকৃত বেগুন নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা নিদারুন ব্যার্থ হবার পরেও কৃষক ও পরিবেশবাদীদের তীব্র প্রতিবাদের মুখে তা জোর করে কৃষকদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। বহুজাতিক কম্পানির এই ধরণে চরম অনৈতিক ভূমিকার কারনে বিশ্বব্যাপী প্রতিবাদ দীর্ঘদিনের। প্রাণের সুরক্ষার লড়াই এখন গুটি কয়েক বহুজাতিক কম্পানির বিরুদ্ধে জনগণের ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ে রূপ নিচ্ছে। ক্রমে ক্রমে তা বৈশ্বিক রূপ পরিগ্রহণ করছে।
লুন্ঠন ও সকল প্রকার বিকৃতির হাত থেকে এই দেশের প্রাণ সম্পদ রক্ষার লড়াইয়ে বাংলাদেশের কৃষকরা অগ্রগণ্য। বাংলাদেশে নয়াকৃষি আন্দোলন দেশীয় বীজ রক্ষা এবং সকল প্রকার বিষ ও বিষাক্ত পদার্থ ব্যবহার না করে উন্নত উপায়ে কৃষি চর্চার পথ দেখিয়ে কৃষি ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক রূপান্তরের পথ দেখাচ্ছে। তারা বিকৃত বেগুন চাষের প্রতিবাদ জানাচ্ছে। বাংলাদেশে নানান নামের নানান স্বাদের নানান মৌসুমে ও বিভিন্ন জমিতে চাষ করার উপযোগী বিভিন্ন জাতের বেগুন চাষ করে তারা প্রমাণ করছে বাংলাদেশ একটি প্রাণ বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ দেশ।
ভাবুন, আপনার ভূখণ্ড আছে, কিন্তু লাগাবার কিম্বা চাষের বীজ নাই। সেটা আছে বহুজাতিক কম্পানির নিয়ন্ত্রণে। ভাবুন রাসায়নিক সার ও বিষ দিয়ে চাষাবাদ করায় এবং হাইব্রিড বীজে বাজার সয়লাব হবার কারণে আপনার জমির উর্বরতা কমছে, ক্রমে ক্রমে আপনি কিছুই আর উৎপাদন করতে পারছেন না। মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো বাজারজাত করা হচ্ছে জিএমও বা বিকৃত বীজ। আপনার পানি বিষাক্ত। আপনি কারবালার মতো পানির পিপাসায় হাহাকার করে মরছেন! প্রাণ, প্রকৃতি ও পরিবেশ ধ্বংস করে যে সকল কর্পোরেশান সারা দুনিয়ার মানুষকে জিম্মি করে ফেলতে চাইছে তাদের বিরুদ্ধে তখন আপনার কি করা কর্তব্য?
এই পরিপ্রেক্ষিতে বহুজাতিক কম্পানি মনসান্তোর বিরুদ্ধে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ শুনানীর জন্য ২০১৬ একটি আন্তর্জাতিক ট্রাইবুনাল গঠিত হয়েছিল। নয়াকৃষি আন্দোলন ও উবিনীগের ( উন্নয়ন বিকল্পের নীতি নির্ধারনী গবেষনা) পক্ষ থেকে ফরিদা আখতার সেই ট্রাইবুনালে বাংলাদেশে মনসান্তোর অপরাধের সাক্ষী হিসাবে হাজির ছিলেন। দুই হাজার ষোল সালের ১৪ থেকে ১৬ তারিখের মধ্যে পাশাপাশি আরেকটি জনসভারও (People’s Assembly) উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। ট্রাইব্যুনালের পাশাপাশি একই সময়ে ইওরোপ, আমেরিকা, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা ও এশিয়ার প্রতিনিধিরা Peoples’ Assembly তে অংশগ্রহণ করেন। এই সমাবেশে বীজের ওপর দখলদারি প্রতিহত করে বীজের স্বাধীনতার (Seed Freedom) দাবি উঠে আসে জোরালোভাবে। বীজের স্বাধীনটা প্রতিষ্ঠায় আগামিতে তাদের কাজ কি হবে তার পরিকল্পনাও করে নেয়।
মনসান্তো ট্রাইবুনাল কি?
ট্রাইবুনাল কথাটার মানে হচ্ছে আদালত। তবে মনসান্টো ট্রাইবুনাল হচ্ছে গণমানুষের ট্রাইবুনাল বা গণমানুষের আদালত। যেহেতু এটা রাষ্ট্র কর্তৃক গঠিত ট্রাইবুনাল নয়, ফলে এর রায় ‘বলবৎ’ যোগ্য নয়। কিন্তু ইতিহাসে রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রাম এবং আইনী বিচার ব্যবস্থার মাঝখানে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের বিচারের জন্য গণ আদালত গঠনের বিস্তর উদাহরণ আছে। মনসান্তো বিশ্বব্যাপী পরিবেশ, প্রকৃতি ও প্রাণের যে ক্ষতি সাধন করেছে তার দুটো দিক আছে এক. ‘মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ’- মনসান্তোর কর্মকাণ্ডে মানুষের প্রাণের ক্ষতি হবে জেনেও কম্পানি নিজ স্বার্থে সেই ক্ষতি করে যাচ্ছে। দুই. ইকোসাইড (Ecocide) বা প্রাণের ব্যবস্থাপনার বিনাশ যে অর্থে ‘জেনোসাইড’ বা গণহত্যা কথাটা আমরা বুঝি ঠিক সেই ভাবেই প্রাণ ও প্রকৃতি হত্যাকে বুঝতে হবে। মানুষ হত্যা যে মাত্রায় অপরাধ, তার চেয়ে শতগুণে অপরাধ হচ্ছে ইকোসাইড বা প্রাণের বিনাশ। কারন এই ক্ষেত্রে শুধু মানুষ নয়, যা টিকে না থাকলে কোন প্রাণই বাঁচতে পারে না সেই জগতটাকেই ধ্বংস করে দেওয়া হচ্ছে। বলাবাহুল্য এই দুই ভয়ানক অপরাধের বিচার হওয়া উচিত। তারই নৈতিক ও রাজনৈতিক যৌক্তিকতা তুলে ধরার জন্য মনসান্তোর বিরুদ্ধে ট্রাইবুনাল বা ‘আন্তর্জাতিক গণ আদালত’ গঠনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছিলো।
মনসান্তো ট্রাইব্যুনাল অনুষ্ঠিত হয়েছিল ২০১৬ সালের অক্টোবর ১৫ এবং ১৬ তারিখে নেদারল্যান্ডের রাজধানী দ্যা হেগ-এ। দুইদিন ব্যাপী ট্রাইবুনালে শত শত দর্শক উপস্থিত হয়েছিলেন ইন্সটিটউট অব সোসাল স্টাডিস (ISS) এর সম্মেলন কক্ষে । পাঁচজন আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন বিচারকমন্ডলীর সামনে বিশ্বের ৫টি মহাদেশের ৩০ সাক্ষী ও বিশেষজ্ঞ তাঁদের বক্তব্য তুলে ধরেন। এর মধ্যে বাংলাদেশের পক্ষ থেকেও একজন সাক্ষী্র উপস্থাপনা ছিল। বিভিন্ন দেশ থেকে আসা মনসান্তোর প্রাণ বিধ্বংসী কুকর্মের অভিযোগ ট্রাইবুনালের বিচারকরা শুনেছেন।
মনসান্তো ট্রাইবুনালে মনসান্তো কম্পানিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল এবং তাদের বক্তব্য তুলে ধরার সুযোগ দেবার আশ্বাসও ছিল, কিন্তু মনসান্তো আসেনি, বরং একটি খোলা চিঠি দিয়ে জানিয়েছে যে তারা মনে করে এই ট্রাইবুনালের রায় পুর্ব নির্ধারিত হয়ে গেছে। একথা প্রথম থেকেই পরিস্কারভাবে বলা হয়েছিল যে মনসান্তো ট্রাইবুনাল কোন রায় দেবে না, কাজেই পুর্ব নির্ধারিত হবার কোন সুযোগ নেই। তবে এই ট্রাইবুনালে ভুক্তভোগী ও সাক্ষীদের কথা শুনেছেন পাঁচজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিচারকমন্ডলি। http://en.monsantotribunal.org/tribunal/judges এঁরা হলেন Dior Fall Snow (Senegal), Jorge Fernandez Souza (Mexico), Eleonora Lamm (Argentina), এবং Steven Shrybman (Canada) এঁদের নেতৃত্ব দিয়েছেন বেলজিয়ামের বিচারক ফ্রান্সোয়া টুলকেন্স (Francoise Tulkens)। তিনি ইওরোপিয়ান কোর্ট অব হিউম্যান রাইটস-এর বিচারক ছিলেন ১৪ বছর এবং ২০১২ সালে কসোভো সংক্রান্ত জাতি সংঘের Human Rights Advisory Panel – এ নিযুক্ত হয়েছেন।
মনসান্তো ট্রাইবুনালের শুরুতেই বিচারক ফ্রান্সোয়া টুলকেন্স বলে দিয়েছেন, এই ট্রাইব্যুনাল প্রকৃত আদালতের মতো রায় না দিলেও যে সব সাক্ষী ও ভুক্তভোগীদের বক্তব্য শোনা হচ্ছে তার মধ্য দিয়ে সমাজে মনসান্তোর কার্যকলাপ এর প্রভাব সম্পর্কে জানা যাবে এবং আন্তর্জাতিক আইনে নতুন ধারণা তৈরিতে সহায়ক ভুমিকা রাখবে। বিশেষ করে ব্যাবসায় মানবাধিকার কিভাবে লংঘিত হয় ইত্যাদী। এভাবে নতুন ট্রাইব্যুনাল সৃষ্টির উদাহরণ হয়ে যেতে পারে। নতুন ধারণা তৈরি হতে পারে বিশেষ করে কর্পোরেশন সমূহের মানবাধিকার লংঘন না করার জন্যে কি ধরণের দায়িত্ব দয়া হবে তারই আইন হতে পারে।
এই ট্রাইব্যুনালের তাৎপর্য বুঝতে হলে যুদ্ধ সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল যা রাসেল ট্রাইব্যুনাল সম্পর্কে পরিচিতি থাকা জরুরি। যুদ্ধে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ গণ আদালতে বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ১৯৬৬ সালের ভিয়েতনাম যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে গঠিত হয়েছিল। এই আদালতের উদ্দেশ্য শুধু বিচার করা ছিল না, তার চেয়েও বেশী গুরুত্বপুর্ণ ছিল গণহত্যা প্রশ্নে সাক্ষ্যের প্রেক্ষিতে সত্য উদ্ঘাটন করা এবং ন্যায়বিচারের আলোকে বিচারকদের মতামত তুলে ধরা।
মনসান্তো ট্রাইবুনালে বিচারকদের সিদ্ধান্ত
ট্রাইব্যুনালের সম্মানিত বিচারকরা দীর্ঘ ছয় মাস ৩০টির অধিক সাক্ষী ও বিশেষজ্ঞ মতামত পর্যালোচনা করে ১৮ এপ্রিল, ২০১৭ নেদারল্যান্ডের রাজধানী দ্যা হেগ- এ তাদের আইনী মতামত Legal Opinion তুলে ধরেছেন। দীর্ঘ দুই-আড়াই ঘন্টা তারা উপস্থিত সাংবাদিক, আইনজীবি, বিজ্ঞানী, পরিবেশ কর্মীসহ এক সভায় তাদের মতামত তুলে ধরেন। বিচারক ফ্রান্সোয়া টুলকেন্সের সঞ্চালনায় পাঁচজন বিচারক এই আইনী মতামতের ব্যাখ্যা দেন। এবং পরে তারা উপস্থিত দর্শকদের প্রশ্নের উত্তর দেন। এই ভিডিওটি http://www.monsanto-tribunal.org/main.php?obj_id=281601562 লিঙ্কে পাওয়া যাবে।
মনসান্তো ট্রাইবুনালে জেনেটিকালি মডিফাইড ফসল (GM Crop) হিসেবে ভারত ও বুরকিনা ফাসোর বিটি কটন (Bt Cotton), বাংলাদেশের বিটি বেগুন (Bt Brinjal) এবং কানাডার জিএম কানোলার (GM Canola) উদাহরণ তুলে ধরা হয়। জেনেটিকালি মডিফাইড বীজ উদ্ভাবনকারি কোম্পানি হিসেবে বিশ্বে বর্তমানে মনসান্তো এক নম্বরে আছে। অন্যান্য কোম্পানি যেমন সিনজেন্টা, বায়ার, ডু-পন্ট ইত্যাদী বাজারে আছে তবে মনসান্তোর চেয়ে তাদের দাপট কম। বাংলাদেশেও মনসান্তোর সক্রিয় কার্যক্রম শুরু হয়েছে সরকারি প্রতিষ্ঠানের সাথে সরাসরি জেনেটিকালি মডিফাইড বিটি বেগুন প্রবর্তনের মাধ্যমে যা কৃষক ও কৃষির ক্ষতির আশংকা সৃষ্টি করেছে ।
এই ট্রাইবুনালের মাধ্যমে সারা বিশ্বে মনসান্তোর উদ্ভাবিত জিএম ফসল ও তার সাথে ব্যবহার হওয়া মনসান্তো উৎপাদিত আগাছানাশক গ্লাইফোসেট বা রাউন্ড-আপ রেডী (Round-Up Ready) কিভাবে জনস্বাস্থ্য, পশু স্বাস্থ্য, মাটির স্বাস্থ্য, প্রাণবৈচিত্র ও পরিবেশের ক্ষতি ঘটানো হচ্ছে তার বিস্তর উদাহরণ, বর্ণনা ও সাক্ষ্য দেয়া হয়। বিশেষ করে জিএম সয়াবিন, জিএম কানোলা, জিএম ভূট্টা উৎপাদন করতে গিয়ে আমেরিকা, কানাডা, ফ্রান্স, ব্রাজিলসহ বিভিন্ন দেশে কৃষক স্বাস্থ্যগতভাবে কত ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন তার মর্মান্তিক বর্ণনা তুলে ধরা হয়।
মনসান্তোসহ বড় বড় কোম্পানিগুলো তাদের পণ্যের ব্যবহারের কারণে সৃষ্ট স্বাস্থ্য ও পরিবেশগত ক্ষতি্র কোন তোয়াক্কা করে না। তাদের এই ধ্বংসাত্মক কাজ আড়াল করার জন্যে তারা সেই দেশের নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা,সরকারি কর্মকর্তার সাথে লবি করা,মিথ্যা তথ্যের ব্যবহার করা,দুর্নীতির আশ্রয় নেয়া,স্বাধীন বিজ্ঞানীদের ওপর চাপ প্রয়োগ করা,নিজেরা বানোয়াট বৈজ্ঞানিক গবেষনা তৈরি করা এবং সংবাদ মাধ্যমকে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করার মতো হীন কাজে লিপ্ত থাকে।
আমেরিকান বহুজাতিক কোম্পানি মনসান্তো বিরুদ্ধে সারা বিশ্বে অনেক অভিযোগ রয়েছে । এর কর্মকাণ্ডে খোদ আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশের মানুষ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। কিন্তু ভুক্তভোগিরা কোথাও বিচারের জন্যে যেতে পারছে না,তাদের সে আর্থিক সংগতিও নেই। যেখানেই কেউ তাদের বিরুদ্ধে মামলা করেছে তারা আদালতের বাইরেই তাদের সাথে বোঝাপড়া করে মামলা তুলতে বাধ্য করেছে। এভাবে মনসান্তোর মত কম্পানির বিরুদ্ধে কোন প্রকার আইনী প্রক্রিয়া নেয়ার কোন উদাহরণ সৃষ্টি করা যায়নি। আইনীভাবে তাদের যেন কেউ ধরতে না পারে তার জন্যে মনসান্তো প্রতিবছর বিশাল অংকের অর্থ ব্যয় করে। তাদের মুনাফা ঠিক রাখতে গিয়ে যদি দুই-একজন ভুক্তভোগিকে হাজার হাজার ডলার ক্ষতিপুরণ দিতে হয় মনসান্তো তা করতেও পিছপা হয় না। কিন্তু তারা তাদের ক্ষতিকর পণ্য জিএম বীজ ও রাউন্ড-আপ রেডি ইত্যাদি বাজারজাত করা থেকে বিরত থাকে না।
বর্তমানে মনসান্তো জিএম ফসলের মধ্যে একচেটিয়া ব্যবসা করছে,বিশেষ করে জিএম ভুট্টার ৮০% এবং জিএম সয়াবিনের ৯৩% মনসান্তো একাই উৎপাদন করছে। এর ফলে সংশ্লিষ্ট দেশের দেশীয় ফসলের বৈচিত্র ধ্বংস হয়েছে এবং কৃষক সর্বশান্ত হয়েছে। প্রাণবৈচিত্রের মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে। এছাড়া মনসান্তো জিএম তুলা, বিটি বেগুন ইত্যাদীতে হাত দিয়েছে। এতো ক্ষতির কারণ হয়েও মনসান্তো এবং অন্যান্য বায়োটেক কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত করতে চায় যে তাদের গায়ে কোন আচঁড় লাগবে না। তারা যতই পরিবেশ ও মানুষের ক্ষতি করুক না কেন তারা আইনের উর্ধ্বে।
ট্রাইবুনাল লক্ষ্য করেছে যে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন এবং কর্পোরেট জবাবদিহিতার মধ্যে বড় ধরণের ফারাক আছে, সে কারণে মানবাধিকার এবং পরিবেশ রক্ষার জন্যে জাতীয় পর্যায়ে নীতি ও আইন প্রণয়ন এবং বাস্তবায়নে বহুজাতিক কম্পানি বাধা সৃষ্টি করছে। বিজ্ঞ ট্রাইবুনাল মনে করে যে মানবাধিকার এবং পরিবেশ অধিকার আইনকে আন্তর্জাতিক লিগাল ফ্রেমওয়ার্কের আওতায় আনা দরকার । বহুজাতিক কম্পানিকে তাদের কার্যকলাপের জন্যে জবাবদিহি করতে হবে এবং তারা যদি মৌলিক অধিকার হরণ করার মতো কাজ করে তাহলে তাদের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে বিচার করতে হবে। এক্ষেত্রে মনসান্তোর আচরণ বৈজ্ঞানিক গবেষণায় অনিবার্য স্বাধীনতা খর্ব করেছে।
সারাবিশ্বের কৃষক আন্দোলন এবং পরিবেশ আন্দোলনের কর্মীরা এতোদিন যে সকল দাবি করে আসছেন মনসান্তো ট্রাইবুনালের যুগান্তকারি আইনী মতামতে (Legal Opinion) তার প্রতিফলন ঘটেছে। কৃষিতে ইন্ডাস্ট্রিয়াল মডেলের ব্যবহারের ফলে একাট্টা ফসল উৎপাদন, ব্যাপকভাবে রাসায়নিক সার, কীটনাশকসহ ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্যের ব্যবহার, জেনেটিকালি মডিফাইড বীজের ব্যবহার ইত্যাদি মানুষের স্বাস্থ্য নষ্ট করছে; মাটি, পানি এবং প্রাণবৈচিত্র ধবংস করছে। বিশ্বের নানা দেশে কৃষক জমি হারাচ্ছে, মাটি বিষাক্ত হচ্ছে, এবং এরই মধ্যে বহুজাতিক কোম্পানি এসে বীজ ও খাদ্য উৎপাদনে নিজেদের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করছে। অথচ তারা মোট খাদ্য চাহিদার মাত্র এক ক্ষুদ্রাংশ উৎপাদন করছে। অবাধ ও মুক্ত বাজার অর্থনীতি বহুজাতিক কোম্পানির এই কাজকে আরো সহজ করে তুলেছে। মনসান্তো ট্রাইবুনালের মতামত বহুজাতিক কোম্পানির এই ক্ষতিকর কাজসমূহকে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করার প্রস্তাব করছে। এর ফলে পৃথিবীর বেশিরভাগ মানুষের জন্যে যারা বিষ-মুক্ত, পুষ্টিকর এবং বৈচিত্র্যময় খাদ্য উৎপাদন করে, এশিয়া, আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশের সেই ক্ষুদ্র কৃষকদের জয় হোল। পিপলস এসেম্বলীতে এসে তারা জানান দিয়েছেন বহুজাতিক কম্পানির কোন দরকার নেই, ভবিষ্যত খাদ্য উৎপাদন ক্ষুদ্র কৃষকদের হাতেই থাকবে। তারা কৃষিতে ইন্ডাস্ট্রিয়াল মডেল নয়, ইকোলজিকাল মডেল অনুসরণ করেন যার মাধ্যমে পরিবেশ রক্ষা, মানুষ ও সকল প্রাণীর স্বাস্থ্য রক্ষা হবে এবং দারিদ্র ও পুষ্টিহীনতা দূর হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে যে দুর্যোগের সৃষ্টি হচ্ছে তা নিরসন করা যাবে । বিজ্ঞ ট্রাইবুনাল অনেক সাক্ষী ও বিশেষজ্ঞদের কথা শুনে এবং বিশ্লেষণ করেই একটি আইনী মতামত তুলে ধরেছেন। বলাবাহুল্য বহুজাতিক কোম্পানির জন্যে এটা এক বিরাট ধাক্কা, কারণ এখন বিশ্বের কৃষক, পরিবেশবাদী, ভোক্তা এবং সাধারণ নাগরিকদের বিষমুক্ত খাদ্য, জিএমও কোম্পানির পেটেন্টমুক্ত বীজ পাওয়ার অধিকার আদায়ের লড়াই আরো জোরদার হবে।
মনসান্তো ট্রাইবুনালের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে বহুজাতিক কোম্পানির উৎপাদিত বিষাক্ত রাসায়নিক দ্রব্য যেমন Round Up (Glyphosate) & Basta (Glufosinate), neonicotinoids, atrazineসহ বিভিন্ন কীটনাশক ও আগাছা নাশকের কারনে বহু ক্ষতি হচ্ছে; যেমন, মাটি ও পানি নষ্ট হয়েছে, মৌমাছি হারিয়ে যাচ্ছে,অন্যদিকে ক্যান্সার, শ্বাস কষ্ট এবং বিশেষ করে বিকলাংগ শিশুর জন্ম হওয়ার ঘটনা বেড়ে গেছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (International Criminal Court) ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ঘোষণা দিয়েছে যে সকল কার্যকলাপের কারণে পরিবেশ ধবংস হয়, প্রাকৃতিক সম্পদ ক্ষতিগ্রস্থ হয় এবং ভুমির ওপর অবৈধ দখলদারিত্ব ঘটে সেসব কার্যকলাপ অপরাধ হিসেবে ধরা হবে। এগুলো মানবতা বিরোধি অপরাধের আওতায় অন্তর্ভুক্ত করা হবে।
মনসান্তো ট্রাইবুনালের এই আইনী মতামতের গুরুত্ব আন্তর্জাতিক আইনী ফ্রেমওয়ার্কের মধ্যে মানবাধিকার এবং পরিবেশ রক্ষার অধিকারের প্রাধান্য দেয়ার বিষয়টি একটি নৈতিক দায়িত্ব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। আন্তর্জাতিক আইনকে পরিবেশ সুরক্ষা (protection of the environment) এবং প্রকৃতি হত্যা (ecocide) বিষয়ে সক্রিয় উদ্যোগ নিতে হবে। এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে তা স্বীকৃতি পেলে এই কথা বলা যায় যে মনসান্তোর কার্যকলাপ ইকোসাইডের মতো অপরাধের আওতায় পড়ে। ফলে যারা এই নিয়ে আন্দোলন করছেন তাদের জন্যে মানুষ ও প্রকৃতি রক্ষার জন্যে আইনী প্রতিকার পাওয়ার এক নতুন দিক উন্মোচিত হোল।
মনসান্তো ট্রাইবুনাল তিনটি গুরুত্বপুর্ণ বিষয় তুলে ধরেছেঃ
১. মনসান্তোর কার্যকলাপ মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ করছে। একে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনে্র এখতিয়ারের আনা দরকার। তাদের অপরাধের বিচার করবার সুযোগ না থাকার কারনে তা ‘মানবাধিকার’-এর ধারণাকে খাটো করছে।
২. বহুজাতিক কোম্পানির ভুক্তভুগিদের আইনী সুরক্ষা প্রয়োজন, তার জন্য যথাবিহিত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
৩. জেনোসাইড বা পরিকল্পত ভাবে কোন মানব গোষ্ঠিকে হত্যা যেমন মানবতাবিরোধি অপরাধ ঠিক একই ভাবে ‘ইকোসাইড’ পরিকল্পিত ভাবে প্রাণ ও প্রকৃতির বিনাশ করাও ‘হত্যা’ মতো অপরাধ। এই জঘন্য কাজকে অবশ্যই ‘অপরাধ’ গণ্য করতে হবে এবং আন্তর্জাতিক আইনের অন্তর্গত করতে হবে। আন্তর্জাতিক আদালতগুলোকে প্রাণ ও প্রকৃতি হত্যা (ecocide) কে অপরাধ হিসেবে অবিলম্বে গণ্য করা উচিত। প্রাণ ও প্রকৃতির বিনাশকে আন্তর্জাতিক আইনের আওতায় আনা অতি জরুরি হয়ে পড়েছে।