ফরিদা আখতার || Wednesday 18 January 2017
‘তামাক মৃত্যু ঘটায়’— এটি এখন কোনো কথার কথা নয়, বাস্তবে প্রমাণিত সত্য। শুধু মৃত্যু নয়, তামাক সেবনের কারণে ব্যবহারকারী যেসব মারাত্মক রোগের শিকার হয়, তা ভুক্তভোগীমাত্রই আমাদের অনেকের চেয়ে ভালো জানে। কিন্তু তামাক নেশাদ্রব্য, সহজে ছাড়া যায় না। বিষয়টি এখন বিশ্বে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। প্রতিরোধযোগ্য এ রোগ ও মৃত্যু ঠেকাতে তাই বিশ্বব্যাপী তামাক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম চলছে এবং অনেক ক্ষেত্রে সফলভাবে তামাক সেবন নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে। বাংলাদেশ সরকারও এ লক্ষ্যে কাজ করছে, কিন্তু তামাক কোম্পানির আগ্রাসী প্রভাবে এখনো কাঙ্ক্ষিত ফল পাওয়া যাচ্ছে না। কোম্পানি তামাক নিয়ন্ত্রণ হোক— এটা চায় না। তাতে তাদের ব্যবসায়িক ক্ষতি। তাই নিত্যনতুন কারসাজিতে ব্যবহারকারীকে তামাক সেবনে আকর্ষণ করছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০০৩ সালে ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোল বা সংক্ষেপে এফসিটিসি প্রণয়ন করে স্বাক্ষরকারী দেশে তামাক নিয়ন্ত্রণের নানা কর্মসূচি নেয়ার ব্যবস্থা করেছে। বাংলাদেশ এ সনদে স্বাক্ষরকারী দেশ এবং এফসিটিসির আলোকে তামাকজাত দ্রব্য উৎপাদন ও ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। কিন্তু এই এফসিটিসি বাস্তবায়নের দিক থেকে কতখানি সফল হতে পেরেছে? এ নিয়ে মূল্যায়নমূলক গবেষণা এত দিন হয়নি। তবে তামাকের অর্থনীতি ও তামাক নিয়ন্ত্রণের অর্থনীতি বোঝার জন্য এবার যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ন্যাশনাল ক্যান্সার ইনস্টিটিউট (এনসিআই) বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সহায়তায় ‘The Economics of Tobacco and Tobacco Control’ শীর্ষক মনোগ্রাফ (২১ নম্বর) প্রকাশ করেছে, যা বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে দেখানো হয়েছে যে, তামাক নিয়ন্ত্রণ অর্থনীতি তামাকের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে সক্ষম। আশা করা যায়, নীতিনির্ধারণী মহলে বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নেয়া হবে। আমি এ লেখায় সেই ২১ নম্বর মনোগ্রাফের তথ্য ব্যবহার করছি।
তামাক উৎপাদন থেকে শুরু করে সেবন পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট সবাই স্বাস্থ্য ও আর্থিক ঝুঁকির শিকার হয়। দুর্ভাগ্য হচ্ছে, তামাক ব্যবহারকারী বিশেষ করে ধূমপায়ীদের ৮০ শতাংশ নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশে বাস করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০৩০ সালের মধ্যে ৩০ শতাংশ তামাক সেবনের পরিমাণ কমানোর লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে, কিন্তু তামাক কোম্পানির উদ্যোগ এমন দ্রুতগতিতে নতুন সেবনকারী নিয়োগে ব্যস্ত যে, এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা কঠিন হয়ে যেতে পারে। বরং ২০৩০ সালের মধ্যে তামাক সেবনজনিত কারণে মৃত্যুর সংখ্যা ৬০ লাখ থেকে বেড়ে ৮০ লাখ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, যার ৮০ শতাংশ হচ্ছে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশের মানুষ। গবেষণাটি আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে হলেও প্রাপ্ত তথ্য বাংলাদেশের মতো দেশের জন্যই বেশি প্রযোজ্য। বাংলাদেশে তামাক সেবনের কারণে মৃত্যুর সংখ্যা ১ লাখ বলে হিসাব করা হচ্ছে। আরো কয়েক লাখ মানুষ মৃত্যুবরণ না করলেও তারা নানা রোগে ধুঁকে ধুঁকে মরছে কিংবা পঙ্গুত্ব বরণ করে জীবন কাটাচ্ছে। সরকারের একটি কার্যকর তামাক নিয়ন্ত্রণ নীতি পারে লক্ষ মানুষের প্রাণ বাঁচাতে বা তাদের সুস্থ জীবন দিতে।
তামাকজাত দ্রব্যের নানা ধরন (ধোঁয়াযুক্ত ও ধোঁয়াবিহীন) ব্যবহার হচ্ছে, তবে সিগারেটের ব্যবহার বিশ্বে সর্বোচ্চ (৯২.৩%) এবং ধূমপান তামাক ব্যবহারজনিত রোগ ও মৃত্যুর প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত। এ কথা এখন প্রায় সবারই জানা যে, ধূমপান শুধু ব্যবহারকারীকেই ক্ষতিগ্রস্ত করে না, যারা তাদের আশপাশে থাকে, তারাও এর ক্ষতি থেকে মুক্ত থাকতে পারে না। অর্থাত্ তারাও পরোক্ষভাবে ধূমপান করছে, কাজেই স্বাস্থ্যের ক্ষতি তাদের হবেই। পরোক্ষ ধূমপান সংক্রামক ও অসংক্রামক উভয় রোগ সৃষ্টি করে এবং বিশেষ করে নারী স্বাস্থ্যের ও গর্ভের সন্তানের ক্ষতি হয়। অনেক দেশে ১৫-৫০ শতাংশ নারী, পুরুষ ও শিশু পরোক্ষ ধূমপানের ঝুঁকির মধ্যে থাকে; কোনো কোনো দেশে প্রায় ৭০ শতাংশ জনগোষ্ঠী পরোক্ষ ধূমপানের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
তামাক সেবন ৩০ বছরের বেশি বয়সের মানুষের মৃত্যুর কারণের ১২ শতাংশ হিসেবে চিহ্নিত এবং অসংক্রামক রোগ যেমন— ক্যান্সার, হার্ট অ্যাটাক, ফুসফুসের রোগের কারণে মৃত্যুর মধ্যে ১৪ শতাংশ দায়ী। বর্তমানে বিশ্বে ১৫ বছরের বেশি বয়সের জনসংখ্যার ২১ শতাংশ ধূমপায়ী (সংখ্যায় ১০০ কোটির বেশি বা ১.১ বিলিয়ন); পুরুষদের ৩৫ শতাংশ এবং নারীদের ৬ শতাংশ ধূমপান করছে। অর্থাত্ পুরুষদের মধ্যে প্রতি তিনজনের একজন ধূমপান করছে। নারীরা এক্ষেত্রে সংখ্যায় কম। ধোঁয়াবিহীন তামাকজাত দ্রব্য যেমন— জর্দা, গুল, নস্যি ব্যবহারকারীর সংখ্যা বিশ্বব্যাপী ৩৪ কোটি ৬০ লাখ, যার বেশির ভাগ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বাস করে। নারীদের মধ্যে ধোঁয়াবিহীন তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবহার বেশি পাওয়া যায়, তা বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও দেখা গেছে।
বিশ্বে ধূমপায়ীর দুই-তৃতীয়াংশ মাত্র ১৩টি স্বল্পোন্নত দেশে বাস করে। এর অর্থ হচ্ছে, তামাকের ব্যবহার ধনী দেশ থেকে কমে গিয়ে ক্রমে নিম্নআয়ের দেশে আসছে এবং যেখানে তামাক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম সক্রিয় নেই, সেখানে জেঁকে বসছে। আশার কথা যে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এফসিটিসি নীতিমালা বাস্তবায়নের কারণে তামাক নিয়ন্ত্রণ পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে এবং ধূমপায়ীর সংখ্যা কমছে, বিশেষ করে উন্নত বিশ্বে। উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, যদিও বিশ্বব্যাপী ধূমপানের হার কমছে কিন্তু নতুন ব্যবহারকারীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় মোট সংখ্যা কমছে না। তাই অত্যন্ত কঠোরভাবে তামাক নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির বাস্তবায়ন করা জরুরি।
তামাক সেবনের কারণে স্বাস্থ্যের যে ক্ষতি হয়, তার চিকিত্সা এবং ব্যবহারকারীর উৎপাদনশীলতার ক্ষতি বিবেচনা করলে বছরে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় ১ হাজার কোটি ডলার। প্রকৃত ক্ষতির পরিমাণ এর চেয়েও বেশি হতে পারে। কারণ অনেক রোগের চিকিত্সা করানো হয় না, আর অনেক রোগ বা মৃত্যুর কারণের সঙ্গে তামাক ব্যবহারের যে সম্পর্ক আছে, তা ধরা হয় না। এত ব্যাপক ক্ষতি থেকে রক্ষা পাওয়ার একটি প্রধান উপায় হচ্ছে— তামাক নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি কার্যকর করা।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এফসিটিসি এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্যভিত্তিক গাইডলাইন দিচ্ছে, যার মাধ্যমে স্বাক্ষরকারী দেশগুলো সরকারিভাবে তামাক নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি গ্রহণ করতে পারে। নিজ দেশের পরিস্থিতি অনুযায়ী উপযুক্ত পন্থা অবলম্বন করে সরকার তামাকজাত দ্রব্যের চাহিদা কমিয়ে এনে তামাক সেবনের হার কমাতে পারে। এর মধ্যে পরীক্ষিত কয়েকটি পন্থা হচ্ছে— উচ্চহারে করারোপ করা, তামাক কোম্পানির বাণিজ্য বাড়ানোর কৌশলের ওপর নিষেধাজ্ঞা, দৃশ্যমান ছবিযুক্ত সতর্কতা বাণী, ধোঁয়ামুক্ত করার নীতি এবং তামাক সেবন বন্ধের জন্য কার্যক্রম গ্রহণ করা। তামাকজাত দ্রব্যের ওপর করারোপ করে যথেষ্ট রাজস্ব আয় হয়। যেমন ২০১৩-১৪ সাল বিশ্বে তামাকপণ্য থেকে রাজস্ব আয়ের পরিমাণ ছিল ২৬৯ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু এত বিশাল অংকের রাজস্ব পেয়েও সরকারিভাবে তামাক নিয়ন্ত্রণে ব্যয় করা হয়েছে মাত্র ১ বিলিয়ন ডলার।
একদিকে করারোপ যেমন ইতিবাচক ফল আনতে পারে, তেমনি তামাক কোম্পানির অবৈধ ব্যবসা নিয়ন্ত্রণও কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। কিন্তু বিশ্বের অনেক দেশেই দেখা গেছে, তামাক কোম্পানির অবৈধ ব্যবসা নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নেই এবং দুর্নীতির কারণে করারোপ করেও বাস্তবায়ন সম্ভব হয় না। সিগারেটের আন্তর্জাতিক বাজারের ৮৫ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করছে মাত্র পাঁচটি কোম্পানি, অর্থাত্ এ কোম্পানিগুলো তাদের প্রভাব খাটাচ্ছে পুরো আন্তর্জাতিক বাজারে এবং বিভিন্ন দেশের অভ্যন্তরীণ নীতিতে। এবং তারা অবৈধ বাণিজ্যের আশ্রয় নিচ্ছে।
মনে করা হয়, তামাক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম নেয়া হলে অনেকেই চাকরি হারাবেন বা কর্মসংস্থানের ক্ষতি হবে। কিন্তু এটা সম্পূর্ণ সত্য নয়। তামাক উৎপাদন এখন অনেকটা প্রযুক্তিনির্ভর হয়ে পড়েছে, ফলে তামাক উৎপাদন নতুন কাজ সৃষ্টি করছে না। অন্যদিকে তামাক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমের ফলে যদি কিছু কাজ আপাতদৃষ্টিতে কমেও যায়, সার্বিক দিক থেকে দেখলে তা কমবে না। যেসব দেশে তামাক চাষ হচ্ছে, সেখানে তা বন্ধের উদ্যোগ নিয়ে কৃষকদের বিকল্প ফসল ও জীবিকার ব্যবস্থা করলে নতুন কর্মসংস্থান হবে। ধূমপানমুক্ত এলাকার নীতি গ্রহণ করেও হোটেল, রেস্তোরাঁর ব্যবসায় ক্ষতি হতে দেখা যায়নি।
তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবহারকারী বর্তমানে বেশির ভাগ গরিব ও নিম্নআয়ের মানুষ। তাদের জন্য তামাক সেবন একদিকে অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টি করে, অন্যদিকে তামাকজনিত রোগের কারণে চিকিত্সা খরচ বেড়ে যায়। এভাবে গরিব আরো গরিব হয়ে পড়ে। ফলে সার্বিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় ধনী-গরিবের যে বৈষম্য রয়েছে, তা আরো বেড়ে যায়। কিন্তু তামাক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম গরিব মানুষকে তামাক সেবন থেকে সরিয়ে আনতে পারে। ফলে তার দারিদ্র্য ও স্বাস্থ্যসেবায় বৈষম্য দূর হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়।
তামাকের ক্ষতি যত বড়ই হোক, তা প্রতিরোধযোগ্য এবং এর নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা নেয়ার পক্ষে আন্তর্জাতিক সনদ রয়েছে, যা বাস্তবায়ন করে স্বাক্ষরকারী দেশের সরকার লক্ষ প্রাণ অকালমৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাতে পারে এবং আরো কয়েক লাখ মানুষকে রোগের কষ্ট থেকে দূরে রাখতে পারে। সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে এ বিষয়ে গুরুত্বারোপ করা এখন অতি জরুরি হয়ে পড়েছে। তাই আর দেরি নয়।