ফরিদা আখতার || Monday 04 July 2016
ঈদের বাজার এখন রমরমা। রমজান মাসের রোজার শেষে ঈদ আসবে— তারই প্রস্তুতি চলে সারা মাস ধরে। মাসজুড়ে কাপড় এবং সঙ্গে অন্য সামগ্রীর কেনাকাটাতেই আনন্দ। এ কেনাকাটায় অনেক দুর্ভোগ পোহাতে হয়, আর এখন তো যানজট বাড়তি ভোগান্তির সৃষ্টি করে। তবুও কারো কেনাকাটা থেমে থেকেছে বলে শুনিনি। সেটা গুলিস্তান বা ফার্মগেটের ফুটপাতের বাজার হোক বা বড় বড় শপিং মলের বাজার হোক। এবার রমজান মাস মোটামুটিভাবে গরমে কেটেছে। তাই শপিং মলে ভিড় একটু বেশি, কারণ সেখানে এসি চলে। দাম বেশি হলেও আরামে কাপড় কেনা যায়। এখন আষাঢ় মাস চলছে, কিন্তু বৃষ্টির চেহারা তেমন দেখা যাচ্ছে না। ওদিকে নীল শাড়ি ও পাঞ্জাবি পরে বর্ষার গানও গাওয়া হয়ে যাচ্ছে। ফুল ফুটুক বা না ফুটুক বসন্ত ঠিকই আসবে, এখন দেখছি বৃষ্টি হোক বা না হোক, নীল শাড়ি তবুও পরতে হবে।
এ বর্ণনা ক্রেতার কথা বোঝানোর জন্য দিলাম। কিন্তু বিক্রেতা বা তারও পেছনে যারা আছেন, তারা রোজার মাস নয়, সারা বছর ধরে চেয়ে থাকে ঈদের বাজারের দিকে। তারা ঈদের চাহিদা মাথায় রেখে কাপড় উত্পাদন করেছেন রাত-দিন খেটে। বছরে ঈদুল ফিতরের বাজারেই সবচেয়ে বেশি কাপড় বিক্রি করা যায়, পূজা ও অন্যান্য উত্সবে নানা ধরনের কাপড়ের চাহিদা থাকলেও ঈদের বাজারই তাদের টিকে থাকার জন্য সবচেয়ে জরুরি। আমি এখন দেশীয় উত্পাদনকারীদের পক্ষে ক্রেতাদের মিনতি করলেও খুব কাজ হবে না। কারণ ঈদের কেনাকাটা যা হওয়ার তা হয়ে গেছে। কিন্তু না লিখে পারছি না, কারণ কয়েকটি পত্রিকায় ঈদের বাজার সম্পর্কে যে প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে, তা দেশের অর্থনীতির জন্য উদ্বেগজনক। তাই দেশীয় উত্পাদকদের কোনো উপকারে না আসতে পারলেও বাজারে যা ঘটেছে, তার একটি পোস্টমর্টেম তো হতে পারে।
কালের কণ্ঠ পত্রিকার একটি শিরোনাম ‘ঈদ ঘিরে ৮০০ কোটি টাকার টাঙ্গাইল শাড়ি’ দেখে মনটা খুব ভরে গেল। টাঙ্গাইল প্রতিবেদকের লেখায় টাঙ্গাইল জেলা তাঁত মালিক সমিতির সাবেক সভাপতি রঘুনাথ বসাকের সূত্রে জানা গেল, ‘ঈদ সামনে রেখে টাঙ্গাইলের শাড়ি ব্যবসায়ীরা ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। শাড়ির কারিগররা দিন-রাত পরিশ্রম করছেন শাড়ি তৈরিতে। জমে উঠেছে শাড়ির বাজার। টাঙ্গাইল শাড়ির পাইকারি ক্রেতারা দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে জেলার দেলদুয়ারের পাথরাইল এসে শাড়ি নিয়ে যাচ্ছেন। ক্রেতাদের ভিড় বাড়ছে তাঁতসমৃদ্ধ গ্রাম পাথরাইলে। এ বছর ঈদ কেন্দ্র করে টাঙ্গাইল জেলায় প্রায় এক কোটি পিস শাড়ি উঠেছে। গড় হিসাবে এর মূল্য হবে প্রায় ৮০০ কোটি টাকা। বিভিন্ন ধরনের সুতা মিশিয়ে শাড়ির বৈচিত্র্য আনা হয়েছে, যা দেশের বিভিন্ন দোকানে নেয়ার পর ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন নামে বিক্রি করেন। কতগুলো তাঁতে কী পরিমাণ শাড়ি তৈরি হচ্ছে, তার সঠিক পরিসংখ্যান নির্ণয় করা কঠিন। শাড়ির দামেও অনেক হেরফের রয়েছে। তবে প্রতিবেদনে প্রাথমিকভাবে ধারণার ভিত্তিতে বলা হয়েছে, ৭০০-৮০০ কোটি টাকা মূল্যের এক কোটি শাড়ি ঈদ বাজারে এসেছে। এ তথ্যগুলো গুরুত্বপূর্ণ, দেশের উত্পাদকরা কোনো প্রকার সহায়তা ছাড়া নিজেরা কীভাবে পরিকল্পনা করে কাজ করতে পারেন, তারই একটি ছোট্ট উদাহরণ। এভাবে যদি দেখা যায়, তাহলে নিশ্চয়ই জামদানি, কুমিল্লার খাদি এবং অন্যান্য তাঁত বস্ত্রের কোটি কোটি টাকার বাজারের হিসাব পাওয়া যাবে। তাছাড়া কম দামি শাড়ি, লুঙ্গি ও জামাকাপড়ের বাজার কম নয়। দেশ শুধু খাদ্য স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়, বস্ত্র উত্পাদনেও স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার মতো ক্ষমতা রাখে।
তাই প্রতিবেদনটি খুব উত্সাহব্যঞ্জক। দেশের তাঁতের কাপড়ের উত্পাদনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এ শিল্পে জড়িত তাঁতিদের জীবন-জীবিকা। দেশী কাপড় যত বিক্রি হবে, তাঁতি মাকুও তত চলবে। এবং তাদের সংসারের চাকাও ঘুরবে। কিন্তু আমাদের দেশের ক্রেতারা যখন কেনাকাটা করেন তখন তাদের পকেট বা পার্সের টাকার জোর এবং তাদের পছন্দটাই প্রাধান্য পায়। দেশের শিল্প রক্ষার কোনো দায় তারা নিতে চান না। তাই এ প্রতিবেদনের শেষ অংশে তারই আভাস পেয়ে দুঃখ পেলাম। রঘুনাথ বসাকসহ শাড়ি ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করেছেন, ‘ভারতীয় শাড়ির প্রভাবে টাঙ্গাইলের শাড়ির চাহিদা আগের চেয়ে কমেছে। এটি প্রভাবমুক্ত হতে পারলে টাঙ্গাইল শাড়ির বাজার আরো জমে উঠত। বিক্রিও হতো অনেক বেশি।’ তারা বলেছেন, ‘ভারতীয় শাড়ি দেখতে চকচকে। কিন্তু সেগুলো অস্থায়ী। এক বছরের ভারতীয় শাড়ি পরের বছর আর চলে না। অথচ টাঙ্গাইল শাড়ির ডিজাইন ও রঙ স্থায়ী। ক্রেতারা তুলনামূলক কম দামে ভারতীয় শাড়ি কিনে প্রতারিত হচ্ছেন।’
তাদের অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেল আর একটি অনলাইন পত্রিকার খবরে। এখানে শিরোনাম ‘দেশের পোশাকের বাজার দখল করল ভারত!’ http://www.bd24live.com/ bangla/article/94854/index.html
এ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘রাজধানীর বিভিন্ন বিপণিবিতান ঘুরে দেখা যায়, নামি-দামি অনেক ভারতীয় পোশাকের পসরা নিয়ে বসেছেন বিক্রেতারা। এসব পোশাকের নাম যেমন ব্যতিক্রমী, তেমনি দামেও রয়েছে বৈচিত্র্য।’ বিদেশের কাপড় দেশে বিক্রির ক্ষেত্রে কোনো বাধ্যবাধকতা এ যুগের অর্থনীতিতে নেই। খোলা বাজার অর্থনীতি! দেশীয় শিল্প রক্ষায় বিদেশের কাপড় আমদানি নিয়ন্ত্রণের কোনো নীতিও কখনো নেয়া হয়নি। কিন্তু যখন আমরা দেখি, প্রতিবেদনে বিক্রেতাদের ভাষায় ‘দেশের বাজারে ভারতীয় পোশাকের আধিপত্যের কারণে দেশী পোশাকের কদর কমেছে’ এবং ‘ভারতীয় পোশাকের প্রতি ক্রেতাদের আলাদা নজর থাকে’ তখন মনে হয়, এ অবস্থায় সরকারেরও কিছু দায়িত্ব বর্তায়। ঢাকা ট্রিবিউনের প্রতিবেদনে জানা যায় শুধু ভারত নয়, বিদেশী কাপড় আসছে পাকিস্তান, চীন ও থাইল্যান্ড থেকে। পোশাকের বাজারে শুধু শাড়ি নয়, শালোয়ার-কামিজ, পাঞ্জাবি, লেহেঙ্গাসহ পশ্চিমা কাপড়েও আধুনিক শহুরে মানুষের নজর আছে। চীন ও থাইল্যান্ডের টি-শার্ট, জিন্স ও শিশুদের সিনথেটিক কাপড় আসছে এবং দেদার বিক্রি হচ্ছে। অথচ বাংলাদেশের গার্মেন্ট ও নিটওয়ার শিল্পের বানানো কাপড় সারা বিশ্বে বিক্রি হচ্ছে।
এ পত্রিকার হিসাবে ঈদের বাজারের ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ চাহিদা বিদেশী কাপড়ের, যার মধ্যে ভারতের কাপড় সবচেয়ে বেশি। ভারতীয় জনপ্রিয় সিরিয়ালের চরিত্রের কাপড় বাজারে দিয়ে তারা মানসিকভাবে তরুণ-তরুণীদের বিজ্ঞাপন ছাড়াই দখল করতে পারে। কাজেই বাজার তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকবেই, এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। একজন তরুণ ক্রেতার কথা এমন: ‘দেশের কাপড়ের মান ভালো, কিন্তু আকর্ষণীয় নয়’। যে কথা উত্পাদকের পক্ষে বসাক বলেছেন ক্রেতাও কাপড়ের মান সম্পর্কে একই কথা বলছেন। তার অর্থ হচ্ছে, বিদেশের কাপড় মান দিয়ে নয়, আকর্ষণীয় করে ক্রেতাদের ভুলিয়ে বিক্রি করছে! তার অর্থ হচ্ছে খোলা বাজারের নিয়মনীতি অনুযায়ী দেশের উত্পাদকরা সমানে সমানে প্রতিযোগিতাও করতে পারছেন না। তাদের কোনো সহায়তা দেয়া হচ্ছে না— কাপড়ের মানের পাশাপাশি আকর্ষণীয় করা যায় কীভাবে।
শুধু ঢাকা শহরের বাজার নয়, চট্টগ্রামসহ দেশের প্রায় সব শহরেই বিদেশের কাপড়ে ছেয়ে গেছে। কক্সবাজারের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিদেশের কাপড় আমদানি করা হয়নি, চোরাই পথে আসছে বলে সরকারকে যথাযথ শুল্ক দিয়ে আসেনি। যারা নিয়ম মেনে আমদানি করেছেন, তারাও এদের কাছে দামের প্রতিযোগিতায় পারছেন না। কোনো আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী নজরদারি নেই। http://www.observerbd.com/2016/06/22/157664.php
এ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিদেশী কাপড়ের ৮০ শতাংশই চোরাই পথে এসেছে, অর্থাত্ তারা আমদানির নিয়ম মানেনি। সরকার বঞ্চিত হয়েছে রাজস্ব থেকে।
একদিকে দেশের উত্পাদকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন বাজারে অসম প্রতিযোগিতায়, অন্যদিকে সরকার বঞ্চিত হচ্ছে রাজস্ব থেকে আর ক্রেতারা কাপড়ের আকর্ষণে পড়ে মানের দিক থেকে প্রতারিত হচ্ছেন। এ ত্রিমুখী ক্ষতির বিষয় সরকারের দেখার দরকার আছে।
ঈদের সময় কে কী কাপড় কিনবে এবং কোন কাপড়ে আনন্দ পাবে, তা নিতান্তই ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। এখানে চাপিয়ে দেয়ার কিছু নেই। কিন্তু দেশের অর্থনীতি বিকাশের পরিকল্পনা যারা করেন, তাদের কি দায়িত্ব নয় বছরের এই একটি বিশেষ সময়ের এত বড় বাজারের হিসাব-নিকাশ করে যাদের যা সহায়তা দেয়ার কথা, তাদের সেটি দেয়া? অসম ও অনৈতিক উপায়ে বাজার সয়লাব করছে বিদেশের ব্যবসায়ীরা, সে ব্যাপারে উদ্যোগ নেয়া কি উচিত নয়?
ঈদের পর কোনো প্রতিবেদন প্রকাশিত হবে কিনা জানি না, দেশের কাপড়ের উত্পাদনের কত ভাগ শেষ পর্যন্ত তারা বিক্রি করতে পেরেছেন। জানতে পারব কি তারা তাদের সম্ভাব্য বিক্রির হিসাব যা করেছিলেন, তার কত ভাগ বিক্রি করতে পেরেছেন? জানতে পারব কি চোরাই পথে ব্যাপক পরিমাণ কাপড় এনে সরকারের আয় কত লোকসান হয়েছে?
এ হিসাব-নিকাশ ঈদের বাজারের সময় না হলেও ঈদের পর অবশ্যই হতে হবে। কারণ এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে এ দেশের মানুষের জীবন-জীবিকার প্রশ্ন। দেশের অর্থনীতি বিকাশের প্রশ্ন। আর ‘মায়ের দেয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নে রে ভাই’ গান গেয়ে কাপড় কিনতে গিয়েও দেশপ্রেমের পরিচয় দেয়ার কথা নাইবা বললাম।
শেষে আর একটি কথা বলি। নিরাপদ খাদ্য যেমন আছে, তেমনি নিরাপদ কাপড় বলেও কিছু আছে। সিনথেটিক কাপড় শিশুদের জন্য বিশেষ করে ক্ষতিকর হতে পারে, নারী ও পুরুষরাও রঙিন ও চকমকে সিনথেটিক কাপড় পরে খুব সুস্থ থাকতে পারবেন না। এ নিয়ে অনেক গবেষণা হয়নি বটে তবে যা হয়েছে তার পরিপ্রেক্ষিতে সাবধানবাণী অবশ্যই উচ্চারণ করা যায়।
ঈদের শুভেচ্ছা রইল।