মাটিতে রাসায়নিক সার প্রয়োগের পরিনাম

ড. এম. এ সোবহান || Wednesday 13 April 2016

ফসল উৎপাদনের জন্য কম পক্ষে ২১ টি মৌলিক উপাদান প্রয়োজন। এর মধ্যে তিনটি ম্যাক্রনিউট্রিয়ন্ট যেমন কার্বন, হাইড্রোজেন এবং অক্সিজেন বাতাস ও পানি থেকে পাওয়া যায়। তিনটি প্রাইমারী ম্যাক্রনিউট্রিয়ন্ট যেমন নাইট্রোজেন, ফসফরাস এবং পটাশিয়াম মাটি থেকে পাওয়া যায়। তিনটি সেকেন্ডারি ম্যাক্রনিউট্রিয়ন্ট যেমন সালফার, ক্যালশিায়াম এবং ম্যাগনেশিয়াম মাটি থেকে পাওয়া যায়। এ ছাড়া আরো আছে ১২ টি মাইক্রোনিউট্রিয়ন্ট যেমন আয়রন, মলিবডেনাম, বোরোন, কপার, ম্যাঙ্গানিজ, সোডিয়াম, জিঙ্ক, নিকেল, ক্লোরিন, কোবাল্ট, এ্যালমুনিয়াম এবং সিলিকন যা মাটিতে থাকা প্রয়োজন।

আধুনিক কৃষি প্রবর্তনের পর থেকে মাটিতে মৌলিক উপাদানের ঘাটতি দেখা দিচ্ছে। যেমন ১৯৫১ সালে এ দেশের মাটিতে নাইট্রোজেনের ঘাটতি দেখা দেয়। ১৯৫৭ সাল থেকে ঘাটতির তালিকায় নাইট্রোজেনের সাথে ফসফরাস যুক্ত হয়। ১৯৬০ সাল থেকে এ তালিকায় পটাশিয়াম যুক্ত হয়। ১৯৮০ সাল থেকে সালফার ও ঘাটতির তালিকায় যুক্ত হয়। ১৯৮২ সাল থেকে জিঙ্ক ঘাটতি তালিকায় যুক্ত হয়। ১৯৯৫ সাল থেকে বোরোন ঘাটতির তালিকায় যুক্ত হয়। ২০০০ সাল থেকে ঘাটতির তালিকা আরো দীর্ঘ হয়েছে। এখন আটটি মৌলিক পদার্থ যেমন নাইট্রোজেন, ফসফরাস, পটাশিয়াম, সালফার, জিঙ্ক, বোরোন, ম্যাগনেশিয়াম এবং মলিবডেনামের ঘাটতি নিয়ে চলছে বাংলাদেশে কৃষি উৎপাদন। এখন যেভাবে চলছে এ ভাবে কৃত্রিম সার নির্ভর কৃষি উৎপাদন পরিচালিত হলে অদূর ভবিষ্যতে অন্তত ১৮ টি মৌলিক পদার্থ প্রয়োগ করেই এ দেশে ফসল উৎপাদন করতে হবে।

মাটিতে নাইট্রোজেনের ঘাটতি পূরনের জন্য ইউরিয়া প্রয়োগ করা হয়। ইউরিয়ার মধ্যে ৪৫% নাইট্রোজেন। ইউরিয়া ব্যবহারের ফলে গাছ দ্রুত বাড়ে। গাছ এত দ্রুত বাড়ে যে গাছ দুর্বল হয়ে পড়ে। ফলে গাছের উপর এক ধরনের চাপ সৃষ্টি হয়। মাটিতে বিদ্যমান অণুজীব যেমন ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক, শেওলা, প্রটোজোয়া ইত্যাদি মারা যায়। গাছ দুর্বল হওয়ার কারণে রোগ বালাই এর প্রকোপ বেড়ে যায়। খাদ্য শস্যের মধ্যে মানুষ এবং অন্যান্য প্রাণীর প্রয়োজনীয় খাদ্য মানের ঘাটতি হয়। তবে রোগ বালাইএর উপযোগী খাবার সরবরাহ বেড়ে যায়।

সাধারণ ভাবে মনে করা হয় যত বেশী ইউরিয়া (নাইট্রোজেন)দেওয়া যায় ততই ভাল। এটি একটি ভ্রান্ত ধারণা। লক্ষ্য করার বিষয় প্রকৃতিতে নাইট্রোজেন কিভাবে সরবরাহ হয়। গাছপালা ও মাটিতে বিদ্যমান জীব অণুজীব কিভাবে তা ব্যবহার করে। মুক্ত পরিবেশে নানা ভাবে নাইট্রোজেন তৈয়ার হয়। জৈবসার নাইট্রোজেন সরবরাহের সবচেয়ে সহজ উপায়। মাটিতে বিদ্যমান ব্যাকটেরিয়া গাছপালার উপযোগী নাইট্রোজেন তৈয়ার করে। শিকড়ের মাধ্যমে সে খাদ্য গাছে সরবরাহ করে। কিছু ব্যাকটেরিয়া ডাল জাতীয় ফসলের শিকড়ে বাস করে এবং গাছকে নাইট্রোজেন সরবরাহ করে। তাছাড়া প্রকৃতি তার নিজস্ব প্রক্রিয়ায় বজ্র পাতের মধ্যমেও গাছ পালার উপযোগী নাইট্রোজেন উৎপাদন করে।

প্রাকৃতিক ভাবে উৎপাদিত নাইট্রোজেন গাছপালা যথা নিয়মে যখন যেমন প্রয়োজন তেমন গ্রহণ করে। কিন্তু ইউরিয়া দেওয়া মাত্র গাছপালা প্রয়োজন না থাকলেও দ্রুত বেগে অধিক পরিমাণে গ্রহণ করে। ফলে গাছপালার দেহ অভ্যন্তরে এক ধরণের চাপ এবং পুষ্টির ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি হয়।

উচ্চ মাত্রায় ইউরিয়া দেওয়ার ফলে মাটিতে বিদ্যমান ব্যাকটেরিয়া যারা মাটি থেকে খাদ্য গ্রহণে গাছকে সহায়তা করে তারাও মারা যায়। আস্তে আস্তে মাটি নির্জীব হয়ে পড়ে। ফলে গাছপালা বাহির থেকে সরবরাহকৃত খাদ্য নির্ভর হয়। ফসলের উৎপাদন খরচ ও বেড়ে যায়।

রাসায়নিক সার প্রয়োগের ফলে এক দিকে যেমন মাটিতে ফসল উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় উপাদানের ঘাটতি হচ্ছে অন্যদিকে মাটিতে ভারী পদার্থ , নাইট্রেট এবং অন্যান্য ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ জমা হচ্ছে যা উৎপাদিত খাদ্য শস্য যেমন শাকসবজি, দানাশস্য, ফলমূলে অনুপ্রবেশ করছে এবং মারাত্বক খাদ্য দূষণ ঘটছে।

মাটিতে ব্যাকটেরিয়াসহ অন্যান্য অণুজীবের উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। ব্যাকটেরিয়ার প্রয়োজনীয় খাবার দিতে হবে। ব্যাকটেরিয়া অন্যান্য গাছ পালা ও ফসলকে খাওয়াবে।

জীবন মৃত্যুর প্রবাহমান চক্রের মধ্যে জৈবসার ব্যবহারের যে প্রথা চলে আসছিল তা হঠাৎ করে নাইট্রোজেন,ফসফরাস ও পটাশিয়াম ভিত্তিক উৎপাদন ব্যবস্থা প্রবর্তনের ফলে বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়েছে। যান্ত্রিক চাষাবাদের মাধ্যমে কৃষি ব্যবস্থা ক্ষুদ্র কৃষক থেকে কর্পোরেট বাণিজ্যের দখলে চলে যাচ্ছে। জৈব দ্রব্য বর্জিত রাসায়নিক সার নির্ভর কৃষি তাত্ত্বিক সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। মাটিতে ৫% জৈব পদার্থ থাকা প্রয়োজন। তবে বর্তমানে বাংলাদেশে মাটিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ ১% এর নীচে চলে গেছে। সাধারণভাবে মাটিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ ০.৮% এর কম হলে সে মাটি কৃষি উৎপাদনের অনুপযোগী হয়ে যায়। এখনই বাংলাদেশের অনেক অঞ্চলে মাটি ফসল উৎপাদনের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে।

বর্তমান অবস্থা থেকে দেশের মাটি, কৃষি ব্যবস্থা তথা খাদ্য নিরাপত্তার স্বার্থে রাসায়নিক সার নির্ভর উৎপাদন ব্যবস্থা থেকে বেড়িয়ে এসে প্রাণবৈচিত্র্য ভিত্তিক প্রাকৃতিক কৃষি ব্যবস্থা বা “নয়াকৃষি” কায়েম করা প্রয়োজন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *