ফরিদা আখতার || Sunday 28 February 2016
আমরা জানি না, অর্থনীতির আসলে কয়টি পা রয়েছে। তবে সবকিছুর পেছনে দুই পায়ের মানুষ নামক জীবের জন্যই অর্থনীতির সবকিছু আয়-ব্যয় করা হয় এবং তাদের ‘উন্নয়ন’ করাই দেশের লক্ষ্যে পরিণত হয়। এজন্য এক বিরাট সংখ্যক দুই পা-বিশিষ্ট মানুষ নামক প্রাণী হাড়ভাঙ্গা খাটুনি খাটে, অন্যদিকে মানুষ নামক ক্ষুদ্র বিশিষ্ট অংশ দেশের অর্থনীতির মূল মাখনটি খেতে পারে। এ পরিস্থিতির ব্যাখ্যা অর্থনীতির ভাষায় ধনী-গরিব ব্যবধানের চিত্র হিসেবে দেখানো হয়। বিশ্বের অন্য সব দেশের মতো এই অন্যায় — মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থার বিভাজন– বাংলাদেশেও রয়েছে। উন্নয়নের অনেক অগ্রগতি হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু অর্থনৈতিক অবস্থায় নিচের দিকে যারা আছেন, অর্থাৎ গরিবদের আয় ১ দশমিক ২ থেকে কমে শূন্য দশমিক ৮ শতাংশ হয়েছে ২০১০ সালে। এর তুলনায় উপরের দিকে থাকা ধনীদের আয় বেড়েছে ৫ থেকে ১৮ দশমিক ৩ শতাংশ। http://old.thefinancialexpress-bd.com/ 2014/07/09/44041/print
ধনী-গরিবের পার্থক্য বোঝার বিষয় শুধু টাকার অঙ্কে হয় না; তারা কী খায়, বিশেষ করে মাছ-মাংস কী পরিমাণ খেতে পারে, তা দিয়েও পরিমাপ করা হয়। গবেষকরা আর্থসামাজিক অবস্থা নির্ণয় করতে গিয়ে জানতে চান ডিম, দুধ, মাছ, মাংস সপ্তাহে বা মাসে কত দিন খেতে পারে। বলা বাহুল্য, ধনীদের বেলায় তা জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন পড়ে না; বরং তাদের রোগ নিরাময়ের জন্য অনেক সময় মাংস কম খেতে বলা হয়। এটা ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন! আর গরিবরা মাসে একদিন খেলেও অনেক ভালো আছে মনে করে। তাদের আনন্দ হয়।
কথাগুলো বলছি এ কারণে যে, সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছেন, ‘দেশে চতুষ্পদ জন্তু ছাগলের ক্ষেত্রে কিছুটা উন্নয়ন হলেও আমাদের গরুর অভাব রয়েছে। বিশেষ করে গরুর দুধের যে চাহিদা, আমরা তা পূরণ করতে পারছি না।’ (দেখুন, ‘ছাগলে উন্নয়ন হলেও আমাদের গরুর অভাব’ http://banglamail24.com/news/ 134573। শিরোনামটি বেশ আকর্ষণীয়।
অর্থমন্ত্রীর মুখে গরু-ছাগলের কথা! ব্যাংকের ঋণ, সুদ, দাতা সংস্থা সবকিছু ছাড়িয়ে এবার গরু-ছাগলের কথা যখন অর্থমন্ত্রীর কথায় উঠে এসেছে, তাতে আমি আশাবাদী হচ্ছি। তবে অর্থমন্ত্রীর উৎকন্ঠা এই চতুষ্পদ প্রাণী নিয়ে আদৌ নয়, আসলে দুই পায়ের মানুষ নামক প্রাণীর গরুর দুধের চাহিদা মেটাতে পারছেন না বলেই গরু-ছাগলের হিসাব। অর্থমন্ত্রী কৃষি খাতের অন্যান্য বিভাগের সঙ্গে তুলনা করে বলেছেন, ‘শস্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে আমরা আমূল পরিবর্তন করেছি। ৪৫ বছরে ১০ লাখ টন থেকে ৩ কোটি ৮০ লাখ টন শস্য উৎপাদনে সক্ষম হয়েছি। মৎস্য উৎপাদনেও ১০-১২ বছরে অনেক উন্নতি করেছি। তবে চতুষ্পদ জন্তুর ক্ষেত্রে ৪৫ বছর আগে যে অবস্থানে ছিলাম, এখনো সেখানেই আছি। এখানে আমরা উন্নতি করতে পারিনি। আমাদের যে প্রাকৃতিক সম্পদ আছে, এটাকে কাজে লাগিয়ে আমাদের গো-সম্পদ উন্নয়ন করতে হবে।’ অর্থমন্ত্রী গো-সম্পদ বাড়াতে চান, কিন্তু তাদের নিছক জন্তু ছাড়া তিনি কিছু মনে করেন না। অথচ গো-সম্পদ এ দেশের কৃষকের পরিবারের অংশ। গো-সম্পদ ছাড়া কৃষি সম্পর্কে ভাবনা সঠিক নয়। গো-সম্পদ বাড়াতে হলে যে শুধু উন্নত জাত লাগবে এমন কোনো কথা নেই। অর্থমন্ত্রী টার্গেট বেঁধে দিয়ে বলেছেন, ‘তিন বছরের মধ্যে আমাদের উন্নত মানের গরু উৎপাদন করতে হবে। গরু উৎপাদনে ভ্যারাইটি থাকতে হবে, সংখ্যা বাড়ানোর দিকে নির্দেশ দেয়া হবে। তিন বছরে এই কার্যক্রমগুলো হাতে নেয়ার চেষ্টা করেন। সহজ শর্তে গরুতে যে ঋণ দেয়া হচ্ছে, তা গ্রহণ করলে এ পরিবর্তন সম্ভব।’
দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, অর্থমন্ত্রী গরু বা ছাগলের সংখ্যা বাড়াতে চান কিন্তু সেটা নির্দেশ বা হুকুম দিয়ে। গো-সম্পদ বাড়াতে হলে দেশের বিদ্যমান অবস্থা জানার চেষ্টা করতে হবে। ২০১৪-১৫ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী গরুর সংখ্যা ছিল ২ কোটি ৩৬ লাখ ৩৬ হাজার আর ছাগলের সংখ্যা ২ কোটি ৫৬ লাখ ২ হাজার (প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর, ২০১৫)। গরু ও ছাগল উভয়ের সংখ্যাই ২০০৮-০৯ সালের তুলনায় বেড়েছে। মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে তুলনা করলে তেমন বাড়েনি। বর্তমানে বাংলাদেশে বেশির ভাগই সংকর জাতের গরু প্রতিপালিত হচ্ছে। আশির দশকে সরকার পাকিস্তান থেকে সাহিওয়াল ও সিন্ধি জাতের গরু আমদানি করে। এ জাতের সঙ্গে দেশীয় বিভিন্ন জাতের সংকরীকরণের মাধ্যমে একটি নতুন জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে। এটিই এখন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। অন্যদিকে অস্ট্রেলিয়ান ফ্রিজিয়ান জাতের গরুও রয়েছে। এগুলো দুধ বেশি দেয় কিন্তু হালচাষ হয় না।
গরু-ছাগলের মাংস গরিবরা খেতে পারে না, কিন্তু এত কাল গরিব মানুষ বিশেষ করে গরিব নারীরাই ঘরে গরু-ছাগল পালনের কাজটি করেছেন এবং বাজারে মাংস ও দুধের সরবরাহ করেছেন। গ্রামের নারীদের নিজস্ব যে অর্থনীতি, সেই অর্থনীতির এক বড় অংশই হচ্ছে পশু পালন। সচ্ছল পরিবারের নারীরা গরিব নারীদের ‘আধি নিয়মে’ গরু বা ছাগল দিয়ে নিজেদের মধ্যে আয়ের ভাগাভাগি করেছেন, অন্যদিকে বাজারে দুধ ও মাংসের চাহিদাও তারা মিটিয়েছেন। কৃষি ব্যবস্থার মধ্যে নারী কিভাবে তার নিজের অর্থনৈতিক প্রণোদনাকে কাজে লাগান তা নিয়ে গবেষণা খুব কমই হয়েছে। নারী আন্দোলনের দিক থেকেও এই দিকগুলো বোঝা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
অর্থমন্ত্রী শস্য উৎপাদনে অনেক উন্নতি হয়েছে বলে দাবি করছেন, কিন্তু এই তথাকথিত উন্নত শস্য উৎপাদন করতে সার-বিষ দিয়ে গো-খাদ্য নষ্ট হয়েছে। আধুনিক ধানের জাতটি এমন যে, খড়টিও গরুর ভাগ্যে জোটে না। গরু চরানোর কোনো জায়গা নেই, আগাছানাশক ব্যবহার করার কারনে গরুকে খাওয়ানোর মতো কোনো ঘাস বা গাছগাছালি, লতাপাতা রাখা হচ্ছে না। গরুর জন্য খাদ্য আসছে বাইরে থেকে আর সেখান থেকে অ্যানথ্রাক্সের মতো রোগ ছড়াচ্ছে। গরু আর তৃণভোজী থাকছে না। ‘ছাগলে কি না খায়’ বলে কথা প্রচলিত আছে, কিন্তু তাই বলে তাকে রাস্তার ধারে আবর্জনা হিসেবে পড়ে থাকা পলিথিনের ব্যাগ খাওয়ানো যাবে না। রাস্তার ধারে এখন আর আম-কাঁঠালের গাছ তেমন দেখা যায় না। দেখা যায় ইউক্যালিপটাস-একাশিয়ার পাতা— ছাগল এত পাগল হয়নি যে এই অখাদ্য ও ক্ষতিকর পাতা খাবে! কাজেই উন্নয়ন ও দারিদ্র্য বিমোচনের নামে দুই পায়ের মানুষ নামক প্রাণী (যাদের মধ্যে অনেকেই আবার অর্থনীতিবিদ), তারা এই ছাগল পালনের বিপক্ষে কর্মসূচি দিচ্ছেন। অর্থমন্ত্রী অবশ্য বলেছেন, ছাগলে কিছুটা উন্নতি হয়েছে, কিন্তু আমার তা মনে হয় না। কারণ ছাগল পালনের সুযোগ আগের তুলনায় অনেক কমে গেছে। কাজেই ছাগল পালনের জন্য যে বিচরণের ক্ষেত্র সহ গাছগাছালীর পাতা দরকার, তার জোগানও বাড়াতে হবে।
স্থানীয় জাতের মধ্যে বাংলাদেশের বিখ্যাত ছাগল হচ্ছে ব্ল্যাক বেঙ্গল; এলাকার মানুষ বলে দেশী ছাগল বা দেশাল ছাগল। এ ছাগল পালন খুব সহজ হওয়ার কথা যদি রাস্তার ধারে, পুকুরপাড়ে, পাহাড়ের ঢালে কিংবা পতিত জমিতে গাছ থাকে। দিনে ৮ থেকে ৯ ঘণ্টা এসব গাছের পাতা খেয়ে ছাগল সুন্দরভাবে বাঁচতে পারে। যদি পাতা পাওয়া না যায় তাহলে আধা থেকে এক কেজি সবুজ ঘাস ও পাতা খাওয়ালে অন্তত ২০ কেজি ওজনের ছাগল সুস্থভাবে থাকতে পারে। পাতা বা ঘাস ছাড়া অন্য খাদ্য— খুদ, কুঁড়া, ডালের ভাঙা, লবণ মিশিয়ে ২৫০-৩০০ গ্রাম খাইয়ে ছাগলকে সবল রাখা হয়। শুধু খাদ্য দিলেই হবে না, ছাগলকে দিনে এক লিটার পানি খাওয়াতে হয়। সুস্থ রাখতে হলে ছাগলকে গোসলও করাতে হয়। এছাড়া সিরোহী, বিটাল ও যমুনাপাড়ী নামক স্থানীয় ছাগল আছে, যা গ্রামের মানুষ নিয়মিতভাবে পালন করছে। ছাগলেও সংকর জাত প্রবর্তন করা হয়েছে।
অর্থমন্ত্রী যখন বলেন, উন্নত মানের গো-সম্পদ বাড়াতে হবে, তার অর্থ কী? বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায়, বর্তমানে দুই কোটির অধিক গরুর মধ্যে ৮০-৯০ শতাংশ দেশী জাতের, আর ১০-২০ শতাংশ সংকর জাতের। দেশী জাতের মধ্যে বিশেষ কোনো নাম ছাড়া গরু অনেক আছে, কিন্তু কিছু স্থানীয় গরু বিশেষভাবে পরিচিত, যেমন— পাবনা গরু, চট্টগ্রাম লাল গরু, মুন্সীগঞ্জের গরু, উত্তরবঙ্গের ধূসর গরু, নোয়াখালীর শিং ভাঙ্গা গরু। দেশী গরুর মধ্যে পাবনা ও চট্টগ্রামের লাল গরু অত্যন্ত জনপ্রিয়। নারীরা, যারা গরু পালেন, তারা গরুর কপালের চিহ্ন দিয়েও গরুর ভালমন্দ বিশেষভাবে চেনেন। যেমন চাঁদকপালী গরু। এ গরু দুধ বেশি দেয় এবং এতই পয়মন্ত যে, এটি থাকলে গৃহস্থবাড়ির গোয়াল ভরে যায়। অর্থাৎ গরুর সংখ্যা বাড়ে। অর্থমন্ত্রী দুধ উৎপাদন নিয়ে চিন্তিত। তাকে জানাতে চাই, দেশী গরুর অনেক জাত আছে, যেগুলোর দুধ উৎপাদন ক্ষমতাও অনেক বেশি। দিনে কমপক্ষে এক থেকে চার লিটার পর্যন্ত দুধ দিতে পারে। অথচ খুব সহজেই পালন করা যায়। সহজে পালন করারা অর্থ হচ্ছে এর জন্য সংকর গরুর ক্ষেত্রে যে রাক্ষসী খাবার ব্যবস্থার জোগাড় করতে হয়, এই গরুগুলোর জন্য তা করতে হয় না। বছরে ২২১ থেকে ২৫০ দিন পর্যন্ত এই গরুর দুধ পাওয়া যায়। তাদের খাদ্য কৃষক তার চাষাবাদ ব্যবস্থার মধ্যেই উৎপাদন ও সংগ্রহ করতে পারে। কিন্তু লম্বা খড়ের দেশী ধানের পরিবর্তে বামন বা বেঁটে আধুনিক ধানের জাত প্রবর্তন করারা ফলে গো খাদ্যের উৎপাদন কমেছে। ফলে গরুর উৎপাদনও কমেছে। নয়াকৃষি আন্দোলনের সুবাদে আমরা কৃষকের সঙ্গে ঘনিষথ ভাবে কাজ করি। কাজ করতে গিয়ে আমি দেখেছি, গ্রামের কৃষকের বাড়িতে গরু পালন করা কৃষিকাজের অংশ হিসেবেই বিবেচিত হয় এবং গরু তাদের আয়ের এক অন্যতম প্রধান সূত্র। সর্বোপরী কৃষক কী ধরণের ধানের জাত ব্যবহার করবে তার সঙ্গে গোখাদ্য উৎপাদনের প্রশ্ন জড়িত। কিন্তু দুই পায়ের জন্তরা যখন খাদ্য ব্যবস্থার কথা ভাবে তখন তারা শুধু তাদের খাদ্যের কথা ভাবে গরুছাগল হাঁস মুর্গি ইত্যাদির খাদ্যের কথা ভাবে না। তাই পশুপাখীর জীবন বিপন্ন করে যে আধুনিউক চাষাবাদ তারা করে সেই ব্যবস্থায় গরু ছাগল পশু পাখির সংখ্যা কমে। দ্বিপদেরা শুধু নিজেরা খাবার জন্য দুধের কথা বলে, অথচ কৃষকের জন্য হালচাষের গরু প্রয়োজন, গরুর গোবর ছাড়া তার চাষাবাদ অসম্ভব হয়ে পড়ে। বিপদে-আপদে খরচ মেটানোর জন্য গরু সবসময়ের ভরসা হয়ে থাকে। অনেকটা ব্যাংকে টাকা রাখার মতো। প্রয়োজনে হাটে নিয়ে গিয়ে বিক্রি বিক্রি করা হয়। দেশের অর্থনীতিতে প্রাণী সম্পদের অবদান কম নয়; গো-সম্পদ বা লাইভস্টক সেক্টরের জিডিপিতে ৩ শতাংশ অবদান আছে।
অর্থমন্ত্রী বলেছেন, আমাদের যে প্রাকৃতিক সম্পদ আছে, একে কাজে লাগিয়ে আমাদের গো-সম্পদ উন্নয়ন করতে হবে। এটি ভালো কথা। একই সঙ্গে তিনি বলেছেন, তিন বছরের মধ্যে আমাদের উন্নত মানের গরু উৎপাদন করতে হবে। প্রসঙ্গটি তিনি কীভাবে পরিকল্পনা করছেন, সেটি যদিও পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে না; ‘উন্নত’ মানের গরু ভূত না রোবট বোঝা গেলনা। অতীত ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখি, এই উন্নত জাতের গরুর চেষ্টা করতে গিয়ে স্থানীয় জাতের ক্ষতি হয়েছে। আমরা জানি, সাভার ডেইরি ফার্ম ১৯৬০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সিন্ধি, সাহিওয়াল ও থারপারকার জাতের গরু নিয়ে গবেষণা করার জন্য; বিশেষ করে দুধ উৎপাদন বাড়ানোর জন্য। ১৯৬৯ সালে জার্মান কারিগরি সহায়তা নিয়ে গো-সম্পদ প্রজনন বা ব্রিডিং কর্মসূচি নেয়া হয়েছিল। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৩ সালে সাভার ডেইরি ফার্মে ১২৫টি ফ্রিজিয়ান এবং জার্সি গরু-ষাঁড় আমদানি করা হয় অস্ট্রেলিয়া থেকে। দুধ উৎপাদন বাড়ানোর জন্য ১৯৭৩-৭৬ সাল পর্যন্ত দেশী গরুর সঙ্গে ক্রসব্রিড করা হয়। এ গবেষণার ফলাফল নিয়ে ১৯৮২ সালে ব্রিডিং পলিসি অনুমোদন করে তৎকালীন সরকার। এ নীতি অনুসরণ করে ৫০ শতাংশ ফ্রিজিয়ান এবং ৫০ শতাংশ সাহিওয়ালের রক্ত নিয়ে উন্নত জাতের ষাঁড় তৈরি করা হয়, বিশেষ করে দুধ উৎপাদনের জন্য। একই সঙ্গে কৃত্রিম প্রজনন পদ্ধতি (artificial insemination) প্রবর্তন করা হয়। মূল লক্ষ্য হচ্ছে— দুধ ও মাংসের উৎপাদন বাড়ানো। ধারণাটা অদ্ভূত। গরু যেন সামগ্রিক কৃষি ব্যবস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন। শুধু দুধ ও মাংস তৈরির কারখানা। কৃষি ব্যবস্থার উন্নত জাতের গরুর জন্য ‘উন্নত’ খাদ্য দরকার। গরু থেকে বেশি করে পেতে হলে তাকে সেভাবে খাওয়াতে হবে। বেশি দুধ দেয়া গরুর লাথিও নাকি ভালো। এখন দেখা যাচ্ছে, গো-খাদ্য হিসেবে ভুট্টার আবাদ বাড়ানো হচ্ছে। জার্মানি এবং অন্যান্য দেশে গো-খাদ্য হিসেবে জেনেটিক্যালি ইঞ্জিনিয়ার্ড সয়াবিন ও ভুট্টা উৎপাদন করা হয়। দুধের গরু ও মাংসের গরু আলাদাভাবে পালন করা হয়। গোখাদ্যের কারণে ম্যাড কাঊ ডিজিজ নামক বিপর্যয়ও ঘটে। অথচ পশপাখির উৎপাদন নিশ্চিত করা সহ অতি উচ্চ স্তরের একটি কৃষি সভ্যতার নমুনা ছিল এদেশে। এর সামগ্রিক চরিত্রটি বজায় রেখেই উন্নতর সম্ভাবনা ছিল অপার। কিন্তু আমরা অন্যের নকল করতে জানি, নিজেদের শক্তির হদিস নিতে জানি না।
এখন আমরা এমন এক অসভ্য পর্যায়ে পোঁছেছি যাতে গরু একটি প্রাণী হিসেবে মর্যাদা পায় না, সে জীবন্ত ফ্যাক্টরিতে পরিণত হয়। গরু দুধ দেবে মাংস দেবে। কিন্তু বাংলাদেশের কৃষি মানে যে হাজার বছর ধরে গড়ে ওঠা এমন এক ব্যবস্থা যেখানে গরু অবিচ্ছিন্ন অংশ — এটা আমরা আর ভাবতে পারি না। উন্নত মানের গো-সম্পদ বাড়াতে গিয়ে যেন সেই পথে আর না যাই। আমাদের নিজেদের কৃষি ব্যবস্থার ভুলত্রুটি সীমাব্যবস্থা অবশ্যই আছে, কিন্তু তার শক্তির ক্ষেত্রও কোন অংশে কম ছিল না। এখনও ক্ষয় পায় নি। সেই জ্ঞান একমাত্র কৃষক পরিবারই ধারণ করেন। তাদের সঙ্গে শলাপরামর্শ করেই কোন্ পথ আমাদের জন্য সঠিক সেটা খুঁজে বের করতে হবে।
দেশীয় জাতের গরু পালন সম্ভব এবং গরু পালন কৃষি ও কৃষকের সঙ্গে যুক্ত করেই করতে হবে। এর বাইরে চিন্তা করলে কোরবানি ঈদে মোটাতাজাকরণের মতো ক্ষতিকর বাণিজ্য আমরা দেখব, ভারত থেকে গরু আনতে গিয়ে সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে মারা পড়বে নিরীহ বাংলাদেশী নাগরিক।
আমাদের চতুষ্পদ প্রাণী অর্থনীতির বড় খুঁটি হতে পারে, হতে পারে সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকার উৎস। তাই একে শুধু দুধ কিংবা মাংস হিসেবে পরিমাপ না করে আরও বড় পরিসরে আমাদের ভাবতে হবে। দেশের বৈচিত্র্যময় গো-সম্পদ রক্ষারসহ প্রাণ ও পরিবেশের সুরক্ষা নিশ্চিত করার কথা যেমন ভাবতে হবে তেমনি কৃষি ব্যবস্থার সামগ্রিক উন্নয়নের কথাই ভাবনার কেন্দ্রবিন্দু হবে। কৃষি ব্যবস্থার সামগ্রিক উন্নয়নই দুধের কিম্বা প্রোটিনের নিশ্চয়তা দেবা। আশা করি আমরা আমাদের পথ চিনে নিতে পারব।