নয়াকৃষি আন্দোলন || Sunday 27 December 2015
প্রাণবৈচিত্র্য সংগ্রহ, রক্ষা, বিকাশ ও বিস্তারের নীতি ও কৌশল
প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষায় সামাজিক ব্যবস্থাপনা (Community Biodiversity Management) (CBM) ও উবিনীগ
ভূমিকা
কৃষকের ফসলের মাঠে বছরের পর বছর ফসল ফলে। তারা নিজেরা বীজ সংরক্ষণ করেন এবং প্রয়োজনমতো মৌসুম অনুযায়ী বীজ বোনেন। এটাই বাংলাদেশের কৃষি ব্যবস্থা। ফসলের বীজ নিয়ামানুযায়ী সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করার কারণেই আমরা নানা ধরণের ফসলের বৈচিত্র্য পাই। কৃষক পরিবারে নারীরা যুগ যুগ ধরে এই কাজ করে আসছেন। তাঁদের জ্ঞান এবং দক্ষতাই আজ প্রাণবৈচিত্র্য ও শস্যবৈচিত্র্য রক্ষার প্রধান মাধ্যম।
নয়াকৃষি আন্দোলন ১৯৯০ সাল থেকে কৃষকদের সংগঠিত করে দেশীয় বীজ রক্ষার কাজ করছে। এই কাজ করতে গিয়ে প্রধানত: জোর দিতে হয়েছে বীজ রক্ষার জন্য সুসংগঠিত বীজ ব্যবস্থাপনার ওপর। তাই গড়ে তোলা হয়েছে নযাকৃষি বীজ সংঘ, যার মাধ্যমে সামাজিক বীজ সম্পদ কেন্দ্র (Community Seed Wealth Center) এবং বীজ আখড়ার কাজ পরিচালিত হয়। কৃষকরা বীজ সংরক্ষণের নানা কৌশল নিয়ে মতবিনিময় করেন এবং বৈচিত্র্য বাড়াবার জন্যে কাজ করেন।
কৃষকদের নিজেদের মতো যে কাজ করা হয় তার মধ্যেও কিছু নিয়ম আছে যা তারা মেনে চলেন। বর্তমানে বাজারের নানা ধরণের প্যাকেটজাত বীজ প্রবর্তনের কারণে আধুনিক ও রাসায়নিক কৃষিতে বীজ সংরক্ষণের গুরুত্ব কমে যাচ্ছে। এবং এর সাথে কৃষকের বীজ রক্ষার জ্ঞানও হারাবার ভয় আছে।
তাই নয়াকৃষি কৃষকদের জ্ঞান এবং বীজ সংঘের কাজের দীর্ঘ দিনের অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে নয়াকৃষি বীজ ব্যবস্থারনা সহায়িকা তৈরী করা হয়েছে। এর সাথে কৃষি বিজ্ঞানীদের জ্ঞানও যুক্ত হয়েছে। এটা একই সাথে কৃষক এবং যে সব সংগঠন দেশীয় বীজ সংরক্ষণের কাজ করতে চান তাদের কাজে আসবে। ভুলক্রটি অবশ্যই থাকতে পারে, তবে কৃষকের চলমান জ্ঞানের চর্চার মধ্য দিয়ে সেই ভুলক্রটি শুধ্রে নেয়া যাবে।
সহায়িকাটি সামাজিক প্রাণসম্পদ ব্যবস্থাপনা (Community Biodiversity Management) প্রকল্পের সহযোগিতার করা হয়েছে। এজন্য আমরা তাদের কাছে কৃতজ্ঞ।
ফরিদা আখতার
নির্বাহী পরিচালক
উবিনীগ
১৫ নভেম্বর, ২০১১, ঢাকা
প্রথম অধ্যায়
নয়াকৃষি আন্দোলন
নয়াকৃষি মানে আনন্দ। নয়াকৃষির নিরিখ আনন্দ। নয়াকৃষি মনে করে এই বিশ্বজগত বা প্রকৃতি আনন্দময়। ভাবে, সংকল্পে ও কাজে এই আনন্দকে নিরিখে রেখে সৃষ্টি, সৃষ্টির শর্ত ও সৃষ্টি-প্রক্রিয়ার সুরক্ষা ও বিকাশই ধর্ম। আনন্দ আনন্দই-নিরানন্দ বা অসুখী অবস্থার বিপরীত কোন ধারণা নয়। তবে মানুষের সঙ্গে মানুষের এবং মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির সকল প্রকার হানাদারি সম্পর্কের বিনাশ বা বিলয় ছাড়া আনন্দের আবির্ভাব অসম্ভব। অতএব ব্যবহারিক ক্ষেত্রে কাজেকর্মে আচারব্যবহারে বিশ্বাসে সংস্কৃতিতে সকল প্রকার হানাদারির বিরুদ্ধে ব্যক্তি পর্যায়ে, পরিবারে, সমাজে ও সর্বত্র লড়াই সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে। আনন্দের শর্ত তৈরীর জন্যই সকল প্রকার হানাদারি সম্পর্কের অবসান চায় নয়াকৃষি।আনন্দের নিরিখে কৃষিকাজে সমৃদ্ধি ও উন্নতির জন্য দশটি কৃষিনীতির ব্যবহারিক প্রয়োগ করে নয়াকৃষি। সেই প্রয়োগ থেকে অভিজ্ঞতা অর্জন, নতুন শিক্ষালাভ, গবেষণা, পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং আবিষ্কারের দৈনন্দিন চর্চায় নয়াকৃষি বিকশিত হয়ে চলেছে।
কাজের সুবিধার জন্য পাঁচ ধরণের কর্মযোগের মধ্য দিয়ে নয়াকৃষি বিশ্বমানব হওয়ার চর্চা করে। এই কর্মযোগগুলো হচ্ছে – (১) সংরক্ষণ বা রক্ষা (২) সৃজন বা সৃষ্টি (৩) পালন ও প্রতিপালন (৪) বিকাশ ও (৫) উন্নতি। সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে এই পাঁচ কর্মযোগের প্রকাশ ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। এই আদর্শে যাঁরা মানুষের সঙ্গে মানুষের বিভেদ, শোষণ ও নির্যাতনের সম্পর্ক উচ্ছেদের জন্য সংগ্রাম করে নয়াকৃষি তাঁদের সঙ্গে মৈত্রীর বন্ধন দৃঢ় করে। নয়াকৃষি মনে করে এই মৈত্রীর চর্চাই নতুন ধরণের শ্রেণী চেতনা কিম্বা গোষ্ঠ ভাবের উদয় ঘটাবে, অনুৎপাদক ও পরজীবী শ্রেণীর বিরুদ্ধে সংগ্রাম তীব্র করবে, সকল প্রকার মহাজনগিরি, সুদখোরি, শোষণ ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে সামাজিক ও রাজনৈতিক ঐক্য প্রতিষ্ঠা করবে এবং দুনিয়াব্যাপী সাম্রাজ্যবাদ অর্থাৎ পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থার বিরুদ্ধে দেশে দেশে মানুষের লড়াই-সংগ্রামকে এক সূত্রে গাঁথবার শর্ত তৈরি করবে। এর ফলে জাতপাত, শ্রেণীভেদ ও নারীপুরুষের সম্পর্কের মধ্যে পুরুষতান্ত্রিক শোষণেরও অবসান ঘটবে।
কর্মযোগের এই মানুষ ও প্রকৃতির অভিন্ন বিকাশ নিশ্চিত করবার শর্ত। মানুষের সত্যিকারের ইতিহাস শুরু করার এই প্রতিজ্ঞা ও কর্মযোগের নিরিখই নয়াকৃষির কেন্দ্রীয় চালিকা শক্তি।
নয়াকৃষি পুরানা আমলের কৃষি নয়
নয়াকৃষি নিছক কোন কারিগরী বিদ্যা বা কৃৎকৌশল প্রবর্তনের নামে ভুয়া ও মিথ্যা জাদুকরির প্রতিশ্রুতি নয়। অথচ নয়াকৃষি অতি অগ্রসর চিন্তা ও ভাব এবং জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চার ক্ষেত্র ও উৎপাদন শক্তি বিকাশের উপায়। প্রকৃতিকে দখলদারি, হানাদারি ও ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করে মানুষসহ সকল প্রাণ, প্রাণীকূলের বিকাশ অর্থাৎ সৃষ্টির অসীম সম্ভাবনার বিবর্তন নিশ্চিত করাই নয়াকৃষির চর্চা ও রাজনীতি। সজ্ঞান ও সচেতন মানুষের পক্ষেই কেবল এই ভাবের বাস্তবায়ন সম্ভব। নয়াকৃষি সবসময়ই নতুন, সবসময়ই নিত্য নতুন প্রক্রিয়ার মধ্যে যা কিছুই সৃজন, সংরক্ষণ, পালন, বিকাশ ও উন্নতির পক্ষে নয়াকৃষি তাকে জানতে, নিজের করে নিতে, ধারণা করতে ও কাজে খাটাতে আগ্রহী। বিজ্ঞান ও কৃৎকৌশলের অভূতপূর্ব অগ্রগতির ফলে প্রাণ ও প্রাণের প্রক্রিয়া রক্ষা ও বিকাশের ক্ষমতা বেড়েছে মানুষের বহুগুণ। অতএব নয়াকৃষি অবশ্যই নিত্য নতুন অভিজ্ঞতা অর্জন ও জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চায় উৎসাহী ও আগ্রহী। কিন্তু যে ‘বিজ্ঞান’ দখলদারি, হানাদারি, ধ্বংস, যুদ্ধ, হত্যা ও সন্ত্রাসের সমার্থক, নয়াকৃষি তার সঙ্গে আপোষ করে না। প্রাণপণ লড়ে।
নয়াকৃষি আন্দোলন মানুষসহ গাছ-পালা, লতা গুল্ম, পশু-পাখি, কীট-পতঙ্গ- প্রতিটি প্রাণীর প্রতি ভালবাসা ও মায়া মমতার ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। নয়াকৃষি জীবন ও জগতের প্রতি আনন্দময় দৃষ্টিভঙ্গী। আনন্দময় জীবনযাপন। নয়াকৃষিই মানুষের ভবিষ্যৎ।
নয়াকৃষির অতি অগ্রসর বৈজ্ঞানিক ভিত্তি বুঝতে যাঁরা অক্ষম তাঁরা অনেকেই একে পুরানা জমানার কৃষি মনে করেন। পুরানা জমানার কৃষি কিন্তু আধুনিক কৃষির মতো ধ্বংসাত্মক নয়। তবে পুরানা জমানার কৃষি বলতে তাঁরা বোঝান নিম্ন মানের প্রযুক্তি এবং ল্যাবরেটরি মার্কা বিজ্ঞানের অনুপস্থিতি। তাদের ধারণা রাসায়নিক সার-বিষ, সেচের যন্ত্র এবং ল্যাবরেটরীতে উৎপাদিত এবং কোম্পানীর বাজারজাত বীজ ব্যবহার করলেই তাকে উন্নত প্রযুক্তি বলে মানতে হবে। বিষে ও পরিবেশ বিপর্যয়ে সবদিক ধ্বংস হলেও। নয়াকৃষির বিজ্ঞান ল্যাবরেটরি মার্কা খণ্ডিত বিজ্ঞান নয়, সামগ্রিক বিজ্ঞান।
বিজ্ঞানের বিপুল অগ্রগতির পরে ধ্বংসাত্মক কৃষির পথ পরিত্যাগ করা এখন সহজ, অথচ আধুনিক কৃষি তার হানাদারি ও মুনাফাখোর চরিত্রের কারণে মুনাফাবাজ কোম্পানির হাতিয়ার মাত্র, বিজ্ঞানকে প্রাণের রক্ষা ও বিকাশের কাজে ব্যবহার আধুনিক কৃষি জানে না, বরং আরো ধ্বংসাত্মক জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের প্রবর্তন করার জন্য তারা মরিয়া হয়ে উঠেছে। অতএব তথাকথিত আধুনিক কৃষিই আসলে পুরাতন ও পশ্চাতপদ কৃষি। সার ও বিষ ছাড়া ফসল উৎপাদন করা যায় এবং অতি সহজেই অধিক ফলন ফলানো সম্ভব সেই বিজ্ঞানের খবর আধুনিকদের কানে পৌঁছায় নাই। কিম্বা পৌঁছালেও কীটনাশক, সার ও পাম্প কোম্পানির স্বার্থে তারা সেটা বলেন না।
মানুষের জ্ঞান, বুদ্ধি ও অন্যান্য মানবিক বৃত্তির বিরুদ্ধে যে সকল প্রাচীন ও আধুনিক কুসংস্কার কাজ করে তার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে নয়াকৃষি। প্রাচীন কুসংস্কার যেমন, ঠিক তেমনি দেশীবিদেশী ব্যবসা ও বহুজাতিক কোম্পানির মুনাফাবাজি ও লুটতরাজকে বিজ্ঞান বলে চালানো এই কালের কুসংস্কার। এই সকল ভুয়া দাবি ও চাতুরির বিরুদ্ধে নয়াকৃষি সংগ্রাম করে।
মানুষসহ অন্য যে কোন প্রাণ বা প্রাণীর জন্যে ক্ষতিকর পদ্ধতি বাদ দেওয়া, পদার্থ বিজ্ঞান, জীব বিজ্ঞানসহ বিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রের নতুন আবিষ্কার ও অভিজ্ঞতা কৃষি কাজে ব্যবহার, প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষা ও বিকাশ এবং কৃষকের জ্ঞানের ভিত্তি, ক্ষমতা এবং সাংগঠনিক শক্তি বিকশিত করে তোলাই নয়াকৃষির মোদ্দা কথা।
অর্থশাস্ত্র মানুষ ও প্রকৃতির সম্পর্ককে সাধারণ ভাবে ‘উৎপাদন সম্পর্ক’ বলে থাকে। কিন্তু নয়াকৃষি সব উৎপাদন সম্পর্ককে ‘আনন্দ’ বলে গণ্য করে না। যে উৎপাদন সম্পর্ক মানুষের সঙ্গে মানুষের বর্ণ, জাত, শ্রেণী ও নারীপুরুষ ভেদ বহাল রাখে – শোষণ, হিংসা, হানাদারি, দখলদারি ও যুদ্ধবিগ্রহই যে-উৎপাদন সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার ভিত্তি – নয়াকৃষি সেই উৎপাদন সম্পর্কের উৎখাত বা রূপান্তর ঘটাবার জন্য লড়াই করে। যে-উৎপাদন সম্পর্ক আনন্দের, ইহলোকে আনন্দময় জীবনযাপনের শর্ত, সেই সম্পর্ক রচনা ও জীইয়ে রাখা ও প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই – সংগ্রাম করে নয়াকৃষি।
বিজ্ঞান ও টেকনলজি বিকাশের নামে দুনিয়ার অল্প কিছু বহুজাতিক কোম্পানি আজ খোদ সৃষ্টিজগতকেই ধ্বংস করতে উদ্যত। দুনিয়া ধ্বংস হোক, তবুও তাদের মুনাফা কামানো চাই। কোম্পানির মুনাফার রক্ষা করতে গিয়ে জগতে খোদ প্রাণের ভিত্তিটাই আজ মহা বিপদের সম্মুখিন।
বিজ্ঞান ও টেকনলজি যখন ‘মুনাফা’ কামানোর উপায় ছাড়া অধিক কিছু নয়, এমনকি ধ্বংসাত্মক, তখন মুনাফাবাজদের কবল থেকে জ্ঞানবিজ্ঞানকে মুক্ত করাই নয়াকৃষির এখনকার প্রধান কাজ। যদি ‘বিজ্ঞান’ বা ‘টেকনলজি’ খোদ সৃষ্টিকেই ধ্বংস করে, সৃষ্টির প্রক্রিয়াকে বিনষ্ট করে, মানুষকে যন্ত্রের অধীন বা গোলামে পরিণত করে তাকে ‘বিজ্ঞান’ নয়, অজ্ঞানতা বলাই সঙ্গত। এই যুগে বিজ্ঞানবাদীদের বিরুদ্ধে লড়াই সাম্রাজ্যবাদবিরোধী লড়াইয়ের অংশ।
নয়াকৃষি দশ নীতি
নীতি মানে এককাট্টা একরকমের ‘মডেল’ নয়। প্রতিটি নয়াকৃষি কৃষক পরিবারই ভিন্ন, নয়াকৃষি মানেই বৈচিত্র্য।
নয়াকৃষির কৃষক ভাই ও বোনেরা ছন্দের মাধ্যমে, গানে গানে এবং কবিতায় যতোভাবে সম্ভব তাঁদের কথা আর দশজন কৃষকের কাছে পৌঁছে দিতে চান। সব কৃষক ছাপার অক্ষর পড়তে পারবেন না বলে তাঁরা কথা এবং গানের মাধ্যমকেই বেশী প্রাধান্য দিয়েছেন।
দশনীতি কৃষকরা ধীরে ধীরে নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলে ঠিক করেছেন। প্রথমে কথাগুলো তাঁরা সংক্ষিপ্ত ভাবে ভাবতে শুরু করেন। যতোই তাঁদের অভিজ্ঞতা বেড়েছে প্রতিটি নীতির পেছনে তাঁদের বৈজ্ঞানিক চিন্তাও হয়েছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় কৃষকরা নতুন নতুন গবেষণা এবং কাজে এখন অভিজ্ঞ হয়ে উঠেছেন। কৃষকের সংখ্যা বাড়ছে, নতুন এলাকার কৃষকরা নয়াকৃষি আন্দোলনে যুক্ত হবার জন্যে আগ্রহ প্রকাশ করছেন।
বীজ ও প্রাণবৈচিত্র্যকেন্দ্রিক কাজ নয়াকৃষির বিশেষ বৈশিষ্ট্য। সার ও কীটনাশকমুক্ত অন্যান্য জৈব চাষাবাদ পদ্ধতির সঙ্গে নয়াকৃষির পার্থক্য হচ্ছে নয়াকৃষি শুধু জৈব চাষাবাদই নিশ্চিত করে না, একই সঙ্গে এই পদ্ধতি- (১) প্রাণবৈচিত্র্য নির্ভর। (২) বাংলাদেশের কৃষকের ঘরে হাজার বছর ধরে বিকশিত করে তোলা অতি উন্নতমানের বীজ ব্যবহার করে, (৩) ফলে নয়াকৃষির ফসলের গুণ অপরিসীম, স্বাদে গন্ধে পুষ্টিতে অতুলনীয় এবং নিরাপদ (৪) প্রাকৃতিক শক্তির সঙ্গে অত্যাধুনিক জ্ঞানবিজ্ঞানের সমন্বয় ঘটিয়ে উন্নত পদ্ধতিতে চাষাবাদের কারণে নয়াকৃষি সুদক্ষ এবং (৫) গুণ ও মানে অতুলনীয় হবার কারণে ক্রেতার কাছে আদরণীয়।
এক নজরে ১০ নীতি
নয়াকৃষি নীতি ১:
বিষ ব্যবহার এখনই বন্ধ করতে হবে। সকল প্রকার কীটনাশকের ব্যবহার পুরোপুরি বন্ধ করা নয়াকৃষির প্রথম নীতি। এই ব্যাপারে কোন আপোষ নাই।
নয়াকৃষি নীতি ২:
কৃষকের হাতে, ঘরে ও মাঠে বীজ রাখতে হবে। বীজই নয়াকৃষির ধ্যান, বীজ রক্ষাই নয়াকৃষির পথ। বীজেই বিপ্লব।
নয়াকৃষি নীতি ৩:
রাসায়নিক সার ব্যবহার ছাড়াই শুরুতে জৈব সার দিয়ে চাষাবাদ এবং ক্রমে ক্রমে মাটির সুস্থ ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করে বাইরের কোন সার ছাড়াই মাটির স্বাস্থ্য ও পুষ্টি নিশ্চিত করা নয়াকৃষির পথ।
নয়াকৃষি নীতি ৪:
একাট্টা ফসল অর্থাৎ এক প্রজাতি বা এক জাতের ফসল নয়াকৃষি করে না। সবসময়ই মিশ্রফসল ও শস্যাবর্তনে বাহারি ফসল চাষ করে এক একর থেকে হাজার একরের ফলন আদায় করা নয়াকৃষির নীতি।
নয়াকৃষি নীতি ৫:
আবাদি ও অনাবাদি জায়গার ব্যবস্থাপনা – অর্থাৎ আবাদি ফসল উৎপাদনের ধরণেই এমন করা যেন একই সঙ্গে জমিতে প্রচুর অনাবাদি ফসল ঘরে তুলে বাংলাদেশের খাদ্য চাহিদা, এমনকি অন্য দেশের খাদ্য চাহিদা মেটানো নয়াকৃষির নীতি।
নয়াকৃষি নীতি ৬:
পানির সুরক্ষা, সুষ্ঠ ব্যবস্থাপনা ও সেচের জন্য মাটির ওপরের পানির পরিমিত ব্যবহারই নয়াকৃষির নীতি। মাটির তলার পানি ধ্বংস করা ও আর্সেনিকে পরিবেশ বিষাক্ত ও স্বাস্থ্য নষ্ট করার বিরোধী নয়াকৃষি। বাংলাদেশ মিষ্টি পানিতে দুনিয়ার সবচেয়ে সমৃদ্ধ দেশ। পানির দাম তেল, দুধ এমনকি মদের চেয়েও বেশি। এই পানি নষ্ট করা ভয়ানক অপরাধ।
নয়াকৃষি নীতি ৭:
নয়াকৃষি এক ফসলের হিশাব দিয়ে চাষাবাদের সামগ্রিক লাভালাভের হিশাব করে না। শুধু শস্য নয়-খড়, পাতা, খড়ি, মাছ, মুরগী, পশু-পাখি, জীব-অণুজীবসহ সবকিছু হিশাব করলেই লাভালাভ জানা যায়। একটি শস্যের পরিবর্তে কৃষকের খামারে সামগ্রিক ফলনের লাভালাভ এবং প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষা ও বিকাশের মধ্য দিয়ে পুরো গ্রাম বা জনগোষ্ঠির পরিবেশগত ও আর্থিক লাভের খতিয়ান করতে শেখা নয়াকৃষির প্রধান একটি নীতি।
নয়াকৃষি নীতি ৮:
গরু-ছাগল, হাঁস মুরগীসহ সকল গৃহপালিত পশু-পাখি অর্থাৎ প্রাণ এবং প্রাণীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি, সম্পর্ক ও আচরণের মধ্য দিয়েই নয়াকৃষির কৃষক হওয়ার চর্চা ও নয়াকৃষির কৃষক হয়ে ওঠা নির্ভর করে। প্রাণ, প্রকৃতি আর নিজের ঘরের মধ্যে ব্যবধান মুছে দিয়ে প্রাকৃতিক নিয়মেই গৃহস্থের সামগ্রিক সম্পদ দ্রুত ও নিশ্চিত ভাবে বাড়ানোর সাধনাই নয়াকৃষির নীতি।
নয়াকৃষি নীতি ৯:
জলের সঙ্গে চাষীর পানির খবরাখবর নেয়া বা পানির খবরদারি করা নয়াকৃষির একটি প্রধান নীতি। যেন মাছসহ সকল জলজ প্রাণের সংরক্ষণ ও বিকাশ ঘটানো যায়। জল ও ডাঙা উভয়ের বৈচিত্র্য নিয়েই নয়াকৃষি।
নয়াকৃষি নীতি ১০:
গ্রামের প্রাকৃতিক সম্পদ বৃদ্ধি করে জীবিকার নিশ্চয়তা বৃদ্ধি ও আয় উন্নতির সুযোগ বাড়ানো নয়াকৃষির নীতি। কৃষক পরিবারসহ নয়াকৃষি এলাকায় প্রত্যেকটি পরিবারকে আত্মনির্ভরশীল ও বাজার ব্যবস্থার অধীনস্থ না হয়ে আর্থিক ও প্রাকৃতিক সম্পদ উভয় ক্ষেত্রে সম্পদশালী করা নয়াকৃষির নীতি।
প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষায় সামাজিক ব্যবস্থাপনা
প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষায় সামাজিক ব্যবস্থাপনা প্রকল্পের মূল লক্ষ্য বীজ ও প্রাণসম্পদ রক্ষা, বিকাশ ও ব্যবস্থাপনাকে তরান্বিত ও সমৃদ্ব করা। নয়াকৃষি আন্দোলনের কৃষকরা নয়াকৃষি বীজ সংঘ (NSN), বীজ সম্পদ কেন্দ্র (CSW) এবং বীজ আখড়ার (SH) মাধ্যমে বীজ সম্পদ রক্ষা ও ব্যবস্থাপনার কাজ করেন। বীজ রক্ষা ও ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি গবাদি পশু-পাখি, হাঁস-মুরগী ও মাছসহ জলজ সম্পদ ব্যবস্থাপনা নিয়েও এ প্রকল্প কাজ করছে। বাংলাদেশের জাতীয় অর্থনীতি কৃষি ও প্রাকৃতিক সম্পদ নির্ভর। জলবায়ু পরিবর্তনের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বীজ ও প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবস্থাপনার বিষয়টি খুবই সংবেদনশীল।
প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষায় সামাজিক ব্যবস্থাপনা (CBM) প্রকল্প এই বিষয়গুলোকে গুরুত্বের সংগে বিবেচনা করে প্রকল্পের সার্বিক কার্যক্রমের রূপরেখা ও পরিকল্পনা গ্রহণ করে।
প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষায় সামাজিক ব্যবস্থাপনা (CBM) প্রকল্প নয়াকৃষি অনুশীলনে সুষম খাদ্যের সমৃদ্ধির লক্ষ্যে শর্করা, আমিষ, খনিজ লবণ, তৈল ও পানির সরবরাহ নিশ্চিত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। এ সকল উপাদানের সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য দানাদার শস্য, ডাল, তৈল, শাকসবজি, ফলমূল, মসল্লা ও ওষুধী গাছপালার আবাদ করা হয়। বৈচিত্র্যপূর্ণ এ সকল ফসল আবাদ করতে শস্যাবর্তন ও মিশ্রফসলের অনুশীলন করা হয়।
নয়াকৃষি শস্য পরিকল্পনায় বাড়ির আংগীনায় ও মাঠে চাষাবাদের বিন্যাস এমনভাবে করা হয় যাতে বছরের সবসময় কোন না কোন ফসল কৃষক ঘরে তুলতে পারে। এর মাধ্যমে একদিকে যেমন খাদ্য স্বার্বভৌমত্ব নিশ্চিত হয় অন্যদিকে উদ্বৃত্ত ফসল বিক্রি করে কৃষক বাড়তি আয় লাভ করতে পারে। পাশাপাশি মাটির উৎপাদিকা শক্তি সংরক্ষিত হয় এবং ফসলের ফলন বৃদ্ধি পায়।
নয়াকৃষি পরিবর্তিত প্রাকৃতিক পরিবেশে খাপ খাওয়ানোর জন্য সময় উপযোগী ফসল নির্বাচন করে। তাপমাত্রার হেরফের, বৃষ্টিপাত, খরা, জলাবদ্ধতা, কুয়াশা ইত্যাদি প্রতিকূলতার মধ্যেও টিকে থাকতে পারে এমন ফসলের চাষ করে।
নয়াকৃষিতে কৃষকরা প্রাণবৈচিত্র্য ব্যবস্থাপনায় বিশেষ করে বীজ সংগ্রহ, সংরক্ষণ, পুনরুৎপাদন ও ব্যবহারের ক্ষেত্রে তাদের অভিজ্ঞতা বিভিন্ন উপলক্ষ্যে অংশীদারিত্ব করে এবং নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে নয়াকৃষির বক্তব্য ও অভিজ্ঞতা তুলে ধরার ক্ষেত্র সৃষ্টি করে।
নয়াকৃষি বীজ সংঘ
নয়কৃষি বীজ সংঘ এর সুনির্দিষ্ট কাজ হচ্ছে প্রাণবৈচিত্র্য নির্ভর কৃষি উৎপাদন চর্চা এবং নয়াকৃষি আন্দোলনের সাংগঠনিক কার্যক্রম যেমন-বীজ ও প্রাণসম্পদ সংগ্রহ, সংরক্ষণ এবং নয়াকৃষি কৃষকদের মাঝে বীজ বিতরণ, বীজসম্পদের বিকাশ ও বৃদ্ধি করা। নয়াকৃষি বীজ সংঘ হচ্ছে নয়াকৃষি আন্দোলনের সক্রিয় ও উদ্যোমী কৃষকদের নিয়ে গঠিত একটি নেটওয়ার্ক। নয়াকৃষির কৃষকদের উদ্যোগে, কৃষকদের নিয়ে গঠিত ‘নয়াকৃষি বীজ সংঘের সদস্যগণ সামাজিক পর্যায়ে কৃষকের ক্ষেতে (in-situ) এবং ঘরে (ex-situ) বীজ ও প্রাণসম্পদ সংরক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজে প্রধানশক্তি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। নয়াকৃষির কৃষকরা ক্ষেতে যেমন প্রাণসম্পদ সংরক্ষণ করে ঠিক তেমনি ঘরেও বীজ সংরক্ষণ করেন। নয়াকৃষি বীজ সংঘের কাজ তিনটি ধাপে যেমন-কৃষকের বীজ ঘর, বীজ আখড়া এবং সামাজিক বীজ সম্পদ কেন্দ্রের মধ্যে বিন্যস্ত। নয়াকৃষি বীজ সংঘের নেতৃত্বে নয়াকৃষি আন্দোলনের বীজ ব্যবস্থাপনা কৃষক পর্যায়ে গ্রামে গড়ে উঠেছে। নয়াকৃষি বীজ সংঘের কাজে নয়াকৃষির নারীকৃষক সদস্য মুখ্য ভূমিকা পালন করেন এবং তারা নেতৃত্ব দিয়ে থাকেন। ইংরেজিতে নয়াকৃষি বীজ সংঘকে Nayakrishi Seed Network (NSN) বলা হয়।
নয়াকৃষি বীজ সংঘের কার্যক্রম তিনটি ধাপে পরিচালিত হয়ে থাকে যেমন-
১. কৃষকের বীজ ঘর
নয়াকৃষি বীজ সংঘের কার্যক্রমের প্রথম ধাপে কৃষকের বীজ সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও পুনরুৎপাদন। নয়াকৃষির কৃষকরা প্রধানত নিজ নিজ ক্ষেতে চাষাবাদের মাধ্যমে নিজেদের বীজ সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করেন। আবার তাদের উৎপাদিত বীজ পরবর্তী মৌসুমে চাষাদের জন্য ঘরে সংরক্ষণ করে রাখেন। কৃষকদের সংগৃহীত নিজেদের বীজের একটি অংশ বীজ নিরাপত্তার স্বার্থে বীজ আখড়ায় সংরক্ষণ করেন।
২. বীজ আখড়া
নয়াকৃষি বীজ সংঘের কার্যক্রমের দ্বিতীয় ধাপ বীজ আখড়া। নয়াকৃষির কয়েকটি পাশাপাশি গ্রামের কৃষকরা সম্মিলিত ভাবে বীজ আখড়া গড়ে তুলেছেন। বীজ সার্বভৌমত্ব রক্ষার স্বার্থে এক একটি বীজ আখড়ার এলাকার সকল নয়াকৃষির কৃষকরা তাদের নিজস্ব সংগৃহীত ও সংরক্ষিত বীজের একটি অংশ বীজ আখড়ায় সংরক্ষণ করে রাখেন। এখান থেকে কৃষকদের মধ্যে বীজ বিনিময়ের মাধ্যমেও বিভিন্ন বীজসম্পদ সৃংগ্রহ, সংরক্ষণ ও বিতরণের কাজ করা হয়ে থাকে। এছাড়া কৃষকদের নিয়মিত সভা আয়োজন করা হয়ে থাকে। বীজ সম্পদের ওপর অধিকার নিশ্চিত করা এবং দুর্যোগকালীন সময়ে চাষাবাদ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কৃষকরা নয়াকৃষি বীজ আখড়ায় বীজ সংরক্ষণ করে রাখেন।
৩. সামাজিক বীজ সম্পদ কেন্দ্র
নয়াকৃষির কৃষকদের নিজেদের এবং বীজ আখড়ায় সংরক্ষিত বীজের একটি অংশ সামাজিক বীজ সম্পদ কেন্দ্রে সংরক্ষণ করা হয়ে থাকে। এখানে প্রধানত স্থানীয় জাতের বীজের গবেষণা, বিকাশ, বীজসম্পদের জাত সংরক্ষণ ও পুনরুৎপাদনের কাজ করা হয়। এখানে কৃষকদের মাঝে বীজ বিনিময়ের কার্যক্রমও পরিচালিত হয়। সামাজিক বীজ সম্পদ কেন্দ্র প্রধানত নয়াকৃষি কৃষকদের নিরাপদ ভান্ডার হিসাবে কাজ করে।
নয়াকৃষি আন্দোলনের কৃষকদের বীজ সম্পদ সংরক্ষণ কেন্দ্রের নাম সামাজিক বীজ সম্পদ কেন্দ্র। ইংরেজিতে বলা হয় Community Seed Walth Center (CSW)। ১৯৯৮ সালে দেশব্যাপী বন্যার ফলে কৃষকরা মারাত্মকভাবে বীজ সমস্যায় পড়লে নয়াকৃষি আন্দোলনের কৃষকরা সামাজিক বীজসম্পদশালা বা বীজসম্পদ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন। উদ্দেশ্য অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক গুরুত্বের দিক বিবেচনায় রেখে স্থানীয় জাতের বীজ সংগ্রহ, সংরক্ষণ, পুনরুৎপাদন, অধিক ফলনশীল জাত বাছাই এবং স্থানীয় জাতের বীজের বিস্তার ঘটানো এবং একই সাথে বীজের সঙ্গে জড়িত লোকায়ত সামাজিক জ্ঞান ও সংস্কৃতির তথ্য সংগ্রহ ও চর্চা। এই চর্চার মধ্য দিয়ে কৃষির বিকাশ ঘটানোই উদ্দেশ্য। নয়াকৃষি আন্দোলনের অধীনে কৃষি ব্যবস্থা ও প্রাকৃতিক পরিবেশ অঞ্চল অনুসারে তিনটি সামাজিক বীজ সম্পদ কেন্দ্র রয়েছে। বন্যাপ্রবণ বা বন্যাবিধৌত সমতল এলাকার সামাজিক বীজ সম্পদ কেন্দ্রটি রয়েছে রিদয়পুর বিদ্যাঘর, টাঙ্গাইলে। খরা প্রবণ এলাকার জন্য সামাজিক বীজ সম্পদ কেন্দ্র রয়েছে আরশিনগর বিদ্যাঘর, ঈশ্বরদী, পাবনায় এবং উপকূলীয় ও পাহাড়ী এলাকার জন্য সামাজিক বীজ সম্পদ কেন্দ্র রয়েছে পদ্মাবতী বিদ্যাঘর, চকরিয়া, কক্সবাজারে। প্রতিটি সামাজিক বীজ সম্পদ কেন্দ্রের আওতায় রয়েছে কয়েকটি বীজ আখড়া। বীজ আখড়া ইংরেজিতে ঝববফ ঐঁঃ নামে পরিচিত। বর্তমানে রিদয়পুর বিদ্যাঘরের আওতায় ৭টি বীজ আখড়া, আরশীনগর বিদ্যাঘরের আওতায় ৩টি বীজ আখড়া এবং পদ্মাবতী বিদ্যাঘরের আওতায় ৩টি বীজ আখড়া এবং আখড়াবাড়ি কুষ্টিয়া কেন্দ্রের আওতায় ৩টি বীজ আখড়া সক্রিয় রয়েছে।
দ্বিতীয় অধ্যায়: শস্য বৈচিত্র্য ও বীজ বৈচিত্র্য সংরক্ষণ
ক্ষেত ও মুক্তাঞ্চলে শস্য বৈচিত্র্য সংরক্ষণ
যে দিন থেকে মানুষ কৃষি কাজ শুরু করলো সেই আদিকাল থেকে কৃষক তথা পুরো সমাজই সকল ধরণের শস্যবৈচিত্র্য তথা বীজবৈচিত্র্য সংরক্ষণ করছে। কৃষক তাদের নিজেদের প্রয়োজনে বীজ সংগ্রহ, বীজ পরীক্ষা, সংরক্ষণ, বীজ উৎপাদন, পুনরুৎউৎপাদন এবং বীজ বিকশিত করার কাজ করে আসছে এবং যা বর্তমানে অব্যাহত আছে। কিন্তু দু:খের বিষয় কয়েক দশক পূর্ব থেকে কৃষিতে আধুনিক পদ্ধতি প্রবর্তন করার কারণে যে শস্য এবং বীজবৈচিত্র্য নিয়ে বিভিন্ন রকম লোকায়ত জ্ঞান চর্চা করা হচ্ছিল সেই সব জ্ঞানকে প্রতিটি ক্ষেত্রে হেয় করা শুরু হলো। তার ফলে গোটা পৃথিবী থেকে প্রাণবৈচিত্র্যের সম্পদগুলো (Genetic Resources) দিন দিন ধ্বংস হওয়া শুরু হলো। বর্তমানে গাছ-গাছালির বৈচিত্র্য ধ্বংসের পরিমাণ বেড়েই চলেছে।
কৃষক নিজে তার শস্যকে বিকশিত করার লক্ষ্যে শস্যবীজ শস্য প্রজননের মাধ্যমে পুনরুৎপাদন (Regeneration) কাজ করে থাকেন। বীজ পুনরুৎপাদনের জন্য কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ কাজ রয়েছে।
শস্যকে বিকশিত করতে হলে পরিবর্তন করা প্রয়োজন। এ পরিবর্তনের কাজ অত্যন্ত ধীর গতিসম্পন্ন হয়ে থাকে। কৃষক শস্যকে বিকশিত (উন্নত) করার জন্য আবহাওয়া, জলবায়ু সহিষ্ণু এবং রোগবালাই প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পন্ন করার জন্য প্রকৃতির সহায়তা গ্রহণ করে থাকে। তারা শস্য জাতকে ধাপে ধাপে উন্নত করার জন্য মাটির গুণগতমান উন্নত করেন এবং চাষাবাদ পদ্ধতি পরিবর্তন করেন। কৃষকের ক্ষেতে বা মুক্তাঞ্চলে বীজ/শস্যবৈচিত্র্য ও প্রাণবৈচিত্র সংরক্ষণ করার সুনির্দিষ্ট কারণ হচ্ছে সমন্বিত চাষাবাদ পদ্ধতির মাধ্যমে শস্যকে রোগবালাই থেকে মুক্ত রাখা। একজন কৃষক দীর্ঘকাল যাবৎ পর্যবেক্ষণ ও পরিদর্শন কর্মকান্ডের মাধ্যমে চাষাবাদ পদ্ধতির (Farming system) সহায়তায় জাত উন্নয়ন ও চাষাবাদ পদ্ধতি আবিস্কার করে থাকেন যা কোন কালেই আধুনিক পদ্ধতিতে সম্ভব হবে না।
কৃষকের ক্ষেত বা মুক্ত এলাকায় সরাসরি পরিদর্শন, পর্যবেক্ষণ অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধির মাধ্যমে প্রকৃত জ্ঞান অর্জন করা যায়। এই সব কারণেই ক্ষেত পর্যায়ে প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণ করা একান্ত প্রয়োজন।
কৃষক পর্যায়ে বীজ বৈচিত্র্য সংরক্ষণ
বর্তমানে পৃথিবীতে দুই ভাবে বীজ বৈচিত্র্য সংরক্ষণ করা হয়ে থাকে। যেমন
ক. আধুনিক জীন বা বীজ ব্যাংকের মাধ্যমে বীজসম্পদ সংরক্ষণ
খ. কৃষক পর্যায়ে অর্থাৎ কৃষকের ক্ষেত খামারে বীজসম্পদ সংরক্ষণ
এই দুই ধরণের বীজসম্পদ সংরক্ষণের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য সম্পূর্ণভাবে আলাদা।
আধুনিক পদ্ধতিতে বীজ বৈচিত্র্য সংরক্ষণ | কৃষক পর্যায়ে সমন্বিতভাবে বীজ বৈচিত্র্য সংরক্ষণ |
১. বীজ ঠান্ডা ঘরে সংরক্ষণ করা হয়। | ১. শস্য পর্যায়ের প্রয়োজন অনুযায়ী স্বাভাবিক তাপমাত্রায় বীজ সংরক্ষণ করা হয়। |
২. সকল বীজ সম্পদ বিজ্ঞানীদের প্রাধান্য সৃষ্টির জন্য বীজ ব্যবহার করা হয়। | ২. সকল বীজ সম্পদ কৃষকদের প্রয়োজনে ব্যবহার করা হয়। |
৩. বীজ সম্পদ কৃষক ও বিজ্ঞানীদের যৌথভাবে মুল্যায়নের কোন সুযোগ থাকে না। | ৩. কৃষক ও বিজ্ঞানী উভয়ের যৌথ বীজ সম্পদ মূল্যায়নের সুযোগ থাকে। |
৪. এক জাতীয় অথবা অল্প কিছু জাতের ব্যবহারের সুযোগ রাখা হয়। | ৪. সমজাতীয় একাধিক জাতের সুনির্দিষ্ট এবং কৃষকের প্রয়োজনে ব্যবহারের সুযোগ রাখে। |
৫. আধুনিক বীজ সংরক্ষণাগারে বীজকোষ কেবল মাত্র বিজ্ঞানীদের কাজে লাগে। | ৫. সামাজিক বীজ বিনিময়ের প্রতি জোর দেয়া হয় এবং বৈচিত্রময় কৃষির প্রতিশ্র“তির প্রতি গুরুত্ব দেয়া হয়। |
৬. আধুনিক পদ্ধতিতে বীজ সম্পদ সংরক্ষণের উদ্দেশ্যই থাকে উফশী/হাইব্রিড বীজ সম্প্রসারণের দিকে। | ৬. সামাজিক পর্যায়ে বীজ সম্পদ সংরক্ষণের লক্ষ্যই থাকে বহু কৃষকের সঙ্গে বীজ বিনিময় এবং কৃষকদের বীজের ওপর নিজেদের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা। |
৭. আধুনিক বীজ ব্যাংক ব্যবসায়িক স্বার্থ রক্ষা করে। | ৭. সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত বীজ সম্পদ কেন্দ্র কোন ব্যবসায়িক স্বার্থ রক্ষা করে না। লক্ষ্য থাকে খাদ্যের নিশ্চয়তা এবং বীজ সার্বোভৌমত্ব বিধান। |
৮. আধিুনিক পদ্ধতিতে বীজ সংরক্ষণ করার ভিত্তিই হচ্ছে কেন্দ্রীভুত করা যা অত্যন্ত ব্যয় বহুল। | ৮. সামাজিক পর্যায়ের বীজ সংরক্ষণের ভিত্তিই হচ্ছে অল্প খরচে বিকেন্দ্রীকরণ অর্থাৎ কৃষক পর্যায়ে সামাজিক মালিকানা সংরক্ষণ করা। |
বীজ সম্পদ ক্ষয় হবার নানা কারণ
আধুনিক কৃষি প্রবর্তনের পর থেকে শস্যসহ বীজবৈচিত্র্য সম্পদ খুবই দ্রুত হারে হারিয়ে যেতে শুরু করেছে। তা ছাড়াও বীজবৈচিত্র্য সম্পদ হারিয়ে যাবার বহু কারণ রয়েছে। যে সব কারণে বীজবৈচিত্র্য সম্পদ দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে বা প্রায় ধ্বংসের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে সে সব হচ্ছে:খরা, বন্যা ইত্যাদি দুর্যোগ, যেমন-
ক. খরা, বন্যা ইত্যাদি দুর্যোগ, যেমন- খরা: বাংলাদেশের একটি উল্লেখযোগ্য প্রাকৃতিক দূর্যোগ। দেশের উত্তর পশ্চিম অঞ্চল খরা প্রবণ এলাকা। ১৯৭২ এবং ১৯৭৯ সালে চৈত্র-জৈষ্ঠ্য মাসে প্রচন্ড খরা দেখা দেয়। খরার ফলে মুশুরী, ছোলা, তিল, কাউন, আউশ ধানের ব্যাপক ফসলহানী ঘটে। খরার কারণে অনেক ফসলের জাত বিলুপ্ত হয়েছে।
বন্যা: ১৯৮৭, ১৯৮৮, ১৯৯৮, ২০০৪ এবং ২০০৭ সালে বাংলাদেশের ব্যাপক এলাকায় বন্যা হয়। আষাঢ় থেকে আশ্বিন পর্যন্ত বিভিন্ন অঞ্চল বন্যায় ডুবে যায়। আউশ ধান, আমন ধান, পাটসহ অনেক ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়। অনেক অনাবাদি শাক সবজির জাত বিলুপ্ত হয়।
খ. আধুনিক কৃষির সম্প্রসারণ যেমন – বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে বাংলাদেশে ১৫ হাজার জাতের ধানের আবাদ ছিল। ১৯৭৬ সালে এক সমীক্ষায় ৬০০০ জাতের ধানের উল্লেখ দেখা যায়। ১৯৬৬ সালে বাংলাদেশে ইরি ধান প্রবর্তন করা হয়। পরবর্তীতে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনষ্টিটিউট থেকে ৫৫টি আধুনিক জাত এবং তিনটি হাইব্রিড ধান ছাড় করা হয়। বীজ কোম্পানীর মাধ্যমে চীন, ভারত ও থাইল্যান্ড থেকে আরো ৭৫টি হাইব্রিড ধান প্রবর্তন করা হয়। সীমিত সংখ্যক আধুনিক জাত ও হাইব্রিড ছাড় করার ফলে হাজার হাজার স্থানীয় জাতের ধান সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়েছে। একইভাবে আধুনিকজাত প্রবর্তনের ফলে অন্যান্য ফসলের বহু স্থানীয় জাত বিলুপ্ত হয়েছে।
গ. প্রকৃত শস্যের জায়গায় অন্য শস্য চাষাবাদ করা অর্থাৎ যে জমিতে পেঁয়াজ, রসুন ভাল হয় সেখানে তা না করে মনে করুন তুলা বা তামাক চাষ করা। আবার যে জমিতে রবিশস্য ভাল হয় সেখানে তা না করে ধানের চাষ করা ইত্যাদি।
ঘ. শস্যের রোগ-বালাই নিয়ন্ত্রণের নামে অহেতুক বিষ ব্যবহার, যেমন- আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি প্রবর্তনের পর থেকেই বাংলাদেশে বালাইনাশক ব্যবহার শুরু হয়েছে। দিনে দিনে বালইনাশকের ব্যবহার বাড়ছে। ১৯৯২ সালে ৭৩৫০ মেট্রিকটন বালাইনাশক ব্যবহার হয়। ২০০১ সালে ১৬,২০০ টন ব্যবহার করা হয়। ২০০৮ সালে ৪৮,৬৯০ টন ব্যবহার করা হয়েছে। কৃষি আধুনিকরণের সাথে সাথে আগাছানাশকের ব্যবহার ও বাড়ছে। এ সবের ফলে পরিবেশ বিষাক্ত হয়েছে এবং প্রাণবৈচিত্র্য বিলুপ্ত হয়েছে।
ঙ. প্রকৃতির বন ধ্বংস করা, যেমন- কৃষি সম্প্রসারণ, ঘর বাড়ী নির্মাণ, শিল্পস্থাপন, লবণ চাষ, চিংড়ী চাষসহ নানাবিধ উন্নয়নমূলক কাজ এবং বন সংরক্ষণের আইন প্রয়োগের দূর্বলতার ফলে বাংলাদেশের বন সম্পদ ধ্বংশ হচ্ছে। ১৯৪৭ সালে এদেশে ২০% এলাকায় বনাঞ্চল ছিল। বর্তমানে তা কমে ৬% হয়েছে। বন সম্পদ ধ্বংশের সাথে সাথে মহামূল্যবান প্রাণসম্পদ বিলুপ্ত হয়েছে।
হাজার হাজার প্রাণকোষ ধংস হয়ে যাচ্ছে। পৃথিবীতে গত ৩০ থেকে ৪০ বছর ধরে শস্যবৈচিত্র্য, বীজবৈচিত্র্য এবং মুক্ত স্থানের হাজার রকমের প্রাণকোষ (Germplasm) দ্রুত ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। মারাত্মক ভাবে এই সব প্রাণকোষ ধ্বংস হবার প্রধান কারণ হচ্ছে উফশী, হাইব্রিড ও জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং পদ্ধতি জাত তৈরির কাজে ব্যবহার করা। এই জাত তৈরির কাজ করার জন্য হাজার হাজার বর্গ মাইল চাষযোগ্য জমির শস্যবৈচিত্র্য মারাত্মক রকম ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। এর ফলাফল দাঁড়িয়েছে পৃথিবীর হাজার হাজার বর্গ মাইল একাট্টা (Monoculture) শস্য দখল করে নিয়েছে। যেমন-ধান, গম, ভুট্টা ইত্যাদি শস্য উৎপাদন বৃদ্ধির নামে একাট্টা শস্যের চাষাবাদের পরিমাণ বৃদ্ধির ফলে শস্যে রোগ-বালাইয়ের পরিমাণও বেড়ে গেছে। একজাতীয় শস্যের চাষাবাদ বীজবৈচিত্র্যকে একেবারে সংকীর্ণ করে দেয় যার ফলাফল প্রাকৃতিক পরিবেশকে একেবারে ক্ষতবিক্ষত করে দেয়। বর্তমানে আবার হাইব্রিড, খরা সহিষ্ণু জাত তৈরি, রোগা-বালাই সহিষ্ণু জাত তৈরি এবং জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং পদ্ধতিতে তৈরি বীজ হাজার হাজার লোকায়ত বীজবৈচিত্র্যের স্থান দখল করে নেয়ার জন্যও বীজবৈচিত্র্য ধ্বংসের জন্য দায়ী। এই বীজগুলো বিনা পরীক্ষায় প্রবর্তন করা এখন-ই বন্ধ করা উচিত। এর পাশাপাশি আর যেন লোকায়ত বীজবৈচিত্র ধ্বংস না হয় তার জন্য আশু পদক্ষেপ নেয়া জরুরী।
বীজ কি ?
বীজ এমন একটি প্রাণসত্তা যা অবিকশিত ঘুমন্ত গাছ-গাছালি। এই প্রাণসত্তা সৃষ্টির মূলই বীজ। বীজেই প্রকৃতি, বীজেই সৃষ্টি। বীজ একদিকে প্রকৃতির পুনরুৎপাদনের উপায়, বীজ ছাড়া চাষাবাদ চলেনা। অন্য দিকে বীজ নিজেই নিজের প্রক্রিয়ার ফল, অর্থাৎ বীজেই আবার ফসল। বীজের আবরনের ভেতরে আপনা থেকেই খাদ্য পেয়ে থাকে। এই জীবনসত্তা বীজের খোসার ভেতরে খুবই ক্ষুদ্র গাছ-গাছালি আকারে বীজের ভেতরে আবদ্ধ অবস্থায় থাকে। এটাই হচ্ছে বীজ। কিন্তু এ সবের বাহিরেও এমন গাছগাছালি রয়েছে সে সব গাছগাছালি বীজ থেকে তাদের বংশবিস্তার করে না। সে সব গাছগাছালি যেমন-কান্ড, পাতা, কন্দ ইত্যাদির মাধ্যমে তাদের বংশবিস্তার করে থাকে। এসব গাছগাছালির বীজ বা প্রাণকোষ, কান্ড, পাতা, কন্দ, গেড় ইত্যাদি। অতিসংক্ষেপে গাছ-গাছালির যে অংশ থেকে একটি নতুন গাছ-গাছালির জন্ম হয়ে থাকে তাহাই বীজ বা প্রাণকোষ।
বীজ উৎপাদনের জন্য যা দরকার
যেহেতু বর্তমানে বিভিন্ন রকম বহিরাগত বীজ যেমন উফশী ও হাইব্রিড বীজ হাজির হয়েছে সে কারণে হাজার বছরের পুরানো আদি বীজবৈচিত্র্য রক্ষা করার জন্য যা করতে হবে তা হলো-
ক. কম খরচে সহজে খুব ভাল বীজ উৎপাদন করা।
খ. নিজের প্রাকৃতিক পরিবেশে বীজ যাতে ভাল থাকে এমন প্রাকৃতিক পরিবেশে বীজ উৎপাদন করতে হবে।
গ. নিজেদেরকে, নিজের এলাকার প্রাকৃতিক পরিবেশ সম্মত খাঁটি, সুস্থ এবং রোগ-বালাই মুক্ত বীজ উৎপাদন করতে হবে।
ঘ. এমন কিছু বীজ আছে যা বাজারে কিনতেও পাওয়া যায় না আবার কোন কোম্পানীও তৈরি করে না। কিন্তু কিছু সংখ্যক কৃষকের নিকট অথবা কারো বাগানে আছে। আগামী প্রজন্মের জন্য সেসব বীজ সংগ্রহ করে রাখা দরকার।
ঙ. এছাড়া যে বীজ বা প্রাণসম্পদ হুমকি সম্মুখিন বা হারিয়ে যাচ্ছে সেসব বীজ বা প্রাণসম্পদ সংগ্রহ করে তা ভালভাবে সংরক্ষণ করা দরকার।
আদি প্রচলিত বীজের গুণ
এখানে প্রশ্ন আদি প্রচলিত বীজ হলেই কি সে বীজ সংগ্রহ করবো ? আবার এসব বীজ কি যেখানে ইচ্ছা সেখানে থেকে সংগ্রহ করবো ? উত্তর না। তাহলে আদি প্রচলিত বীজ, হুমকির সম্মুখিন বীজ বা বিলুপ্ত প্রায় গাছ-গাছালি বা শস্যের বীজ সংগ্রহ করার পূর্বে কতকগুলো বিষয় লক্ষ্য রাখতে হবে। যেমন-
১. প্রাকৃতিক পরিবেশ যে স্থানে লোকায়ত বীজ বেশী পরিমাণে জন্মে সেখান থেকে বীজ বা প্রাণসম্পদ সংগ্রহ করতে হবে।
২. যেসব শস্য গাছ-গাছালির বহুবিধ ব্যবহার রয়েছে যেমন-খাদ্য, ওষুধ, জ্বালানী, আঁশ, জমির খাদ্য, পশু খাদ্য, হস্তশিল্প, ধর্মীয় এবং সামাজিক আচার অনুষ্ঠানসহ বিভিন্ন ব্যবহার আছে সে সব বীজ সংগ্রহ করতে হবে। এখানে মনে রাখতে হবে সকল উদ্ভিদে/গাছ-গাছালিতে একই রকম গুণ পাওয়া যাবে না। সে কারণে বীজ সংগ্রহের সময় বিষয়টা অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে।
৩. যে বীজসম্পদ সংগ্রহ করা হবে তার কীটপতঙ্গ রোগবালাই রোধ সম্পন্ন এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা করে টিকে থাকতে পারে কি না।
৪. যে সব বীজসম্পদ সংগ্রহ করা হবে সে সব খাদ্যের দিক থেকে পুষ্টিমান সম্পন্ন কি না।
ভাল বীজের বৈশিষ্ট্য
ভাল বীজ বলতে কোন বীজকে বুঝব ? বীজ দেখতে সুন্দর এবং পুষ্ট হলেই কি আমরা ভাল বীজ বলবো ? বর্তমানে বাজারজাত করা দেখতে সুন্দর, পুষ্ট ও চারা গজালেই ভাল বীজ বলা হয়ে থাকে। কিন্তু আসলেই কি তাই! প্রকৃতপক্ষে ভাল বীজ সংগ্রহ করতে হলে সেই বীজের কতকগুলো চারিত্রক বৈশিষ্ট্য অবশ্যই থাকতে হবে। বীজের সেই সব চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য না থাকলে তাকে ভাল বীজ বলা যাবে না। যেমন-
ক. আদি বীজর বংশগতির সঙ্গে নতুন ভাবে উৎপাদিত বীজের বংশগতির কোন রূপ পরিবর্তন হবে না।
খ. স্থানীয় প্রাকৃতিক পরিবেশে বীজ থেকে সহজেই চারা গজাবে।
গ. শস্যে বা গাছ-গাছালিতে ফুলধরা ও বীজ জন্মনো থেকে শুরু করে বীজ পরিপক্ক হওয়া পর্যন্ত সম্পূর্ণ রূপে রোগবালাই মুক্ত থাকবে।
ঘ. বীজ অবশ্যই পরিপুষ্ঠ ও স্বাস্থ্যবান হবে। বীজ থেকে উৎপাদিত চারা দ্রুত বিকশিত হবে। উল্লিখিত বৈশিষ্ট্যপূর্ণ বীজই স্বাস্থ্যসম্মত ও ভাল বীজ।
তৃতীয় অধ্যায়:কৃষকের ক্ষেতে শস্য বৈচিত্র্য সংরক্ষণ
কৃষকের ক্ষেতে শস্য বৈচিত্র্য সংরক্ষণ
প্রতিটি বীজ বা প্রাণকোষ তার বৈশিষ্ট্যের ধারাবাহিকতা বহন করে চলে। উদাহরণ হিশাবে আমের বীজ থেকে আম গাছই হয়। অন্য কোন গাছ হয় না। অথবা গোলাপ ফুল গাছ থেকে গোলাপ ফুলই হয়। আমের বীজ বা প্রাণসম্পদ আমের বৈশিষ্ট্যের ধারাবাহিকতা রক্ষা করে চলেছে। অনুরূপভাবে গোলাপ গাছও তাই। আমের বীজ যে আমের বৈশিষ্ট্যতা ধরে রাখে তার প্রমাণ হলো আম গাছ থেকে আম ফলই পাওয়া যায়। অনুরূপভাবে গোলাপ গাছ থেকে গোলাপ ফুলই পেয়ে থাকি। গাছ-গাছালি বা প্রাণীর এ ধারাকেই বলে বংশগতির বৈশিষ্ট্য।
আদিকাল থেকেই সমাজের সুনির্দিষ্ট প্রয়োজনে প্রয়োজনীয় শস্য বা গাছ-গাছালি সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা হয়ে থাকে। উদাহরণ হিশাবে গাছ-গাছালিটির ওষুধিগুণ আছে কিনা, খরা সহিষ্ণু কিনা, রোগ-বালাই রোধ সম্পন্ন কিনা ইত্যাদি তথ্য সংগ্রহ করা হয়ে থাকে। বীজ বা প্রাণসম্পদ সংগ্রহের পুর্বে গাছ-গাছালি সম্পর্কে বিস্তারিত জানার জন্য গাছ-গাছালির বীজ/প্রাণকোষ সংগ্রহ, সংরক্ষণ, ব্যবহার, উৎপাদন, পুনরুৎপাদনসহ বিভিন্ন তথ্যাদি জানা দরকার। সে ক্ষেত্রে বীজ বা প্রাণকোষ সংরক্ষণ করার জন্য মাঠ পর্যায়ে অর্থাৎ কৃষকের ক্ষেত পর্যায়ে সংরক্ষণ করে রাখা সবচেয়ে সহজ। অপরদিকে খরচ পত্র খুবই কম এবং নিরাপদে রাখা সম্ভব হয়। এ সব কারণে মাঠ পর্যায়ে বা কৃষকের ক্ষেতে বীজ বা প্রাণসম্পদ সংরক্ষণ করে রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। উল্লিখিত বিষয়গুলো বর্তমানে আধুনিক পদ্ধতিতে যে বীজসম্পদ সংরক্ষণ করা হয় সেখানে এ ব্যবস্থা নাই। যে ব্যবস্থা আছে সেটা সম্পূর্ণ প্রযুক্তি নির্ভরশীল।
কৃষকের ক্ষেত বা মাঠ পর্যায়ে বীজ বা প্রাণসম্পদ সংরক্ষণ করে রাখা তখনই অর্থবহ বা কার্যকরী হবে যখন বীজ বা প্রাণসম্পদ সংরক্ষণের সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য এবং সুপরিকল্পনা থাকবে। অবশ্যই মনে রাখতে হবে কেন বীজ বা প্রাণসম্পদ বৈচিত্র্যসম্পদ সংরক্ষণ করা হচ্ছে। কৃষকের ক্ষেতে বীজ বা প্রাণসম্পদ বৈচিত্র্য সংরক্ষণ করে রাখার জন্য কতগুলো বিষয়ের প্রতি অবশ্যই লক্ষ্য রাখা দরকার। যেমন-
১.সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য লক্ষ্যের পরিকল্পনা
২.বীজ বা প্রাণকোষ সংরক্ষণের যথাযথ নথিপত্র রাখা (Documentation)
৩.বীজ বা প্রাণকোষকে প্রয়োজনে শোধন করতে হবে
৪.বীজ বা প্রাণকোষ থেকে চারা গজানো এবং বাঁচিয়ে রাখার পরীক্ষা করতে হবে।
৫.বীজ বা প্রাণকোষের মূল্যায়ন ও বৈশিষ্ট্যকরণ
৬.বীজ বা প্রাণকোষের সম্প্রসারণ ঘটানো
৭.শস্য এবং গাছ-গাছালির ব্যবহার সম্পর্কে জানা
একজন প্রকৃত কৃষকের ক্ষেত খামারে বীজসম্পদ বা প্রাণকোষ সম্পদ সংরক্ষণের ক্ষেত্রে কোন কোন কর্মকান্ডের পুনরাবৃত্তি হবার সম্ভাবনা থাকে। সে দিকে নজর রাখা দরকার। যেমন-
- যেখানে কোন গাছ-গাছালির বেশীর ভাগ লুপ্ত বা ধ্বংস হয়ে গেছে।
- উফশীজাত অথবা এককাট্টা জাতীয় (monoculture) শস্য চাষাবাদের কারণে কোন বীজবৈচিত্র্য সম্পদের আংশিক অথবা পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যাওয়া।
যে সব ক্ষেত খামারে প্রাণবৈচিত্র্য সম্পদ রয়েছে, সেই সব ক্ষেত খামারের হিশাব নিকাশ করতে হবে জৈবপরিমাণ (Biomass) দিয়ে। কোন অবস্থাতেই অর্থনৈতিক হিশাব নিকাশ দ্বারা নয়। কেননা প্রাণবৈচিত্র্য সম্পদ কখনই টাকা পয়সা দিয়ে তুলনা করা সম্ভব নয়। এটা অর্জন করতে হয়। সামাজিক বীজসম্পদ কেন্দ্র সমাজ তথা কৃষকদের প্রয়োজনে কৃষকের তত্ত্বাবধানে গড়ে ওঠে। এখানে বীজসম্পদ বিনিময়ের কাজ থাকে। কোন আর্থিক দেনা পাওনা বা হিশাব নিকাশ থাকে না। সে কারণে সামাজিক বীজসম্পদ কেন্দ্র গড়ে তোলার পরিকল্পনা করার সময় সতর্ক থাকতে হয়। বীজসম্পদ কেন্দ্র যেন আর্থিক সুবিধা পাবার জন্য যেন গড়ে না ওঠে। সামজিক বীজসম্পদ কেন্দ্র সব সময় স্থানীয় জনগণের প্রয়োজনের প্রতি বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকে। অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে সামাজিক বীজসম্পদ কেন্দ্র গড়ে তোলার প্রধান লক্ষ্যই হচ্ছে জনগণ তথা সমাজ। বীজসম্পদ সংগ্রহ, সংরক্ষণ এবং ডকুমেন্টেশান করা হয় জনগণের বিভিন্ন প্রায়োজনের প্রতি দৃষ্টি রেখে।
ক. পরিকল্পনা
অন্যান্য বৃহৎ ও দীর্ঘ মেয়াদী কাজ করার পুর্বে যেমন পরিকল্পনা করা হয়, ঠিক তেমনি সামাজিক বীজসম্পদ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করার পুর্বে পরিকল্পনা করতে হবে। যেমন বীজসম্পদ কেন্দ্র কেন প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে। তার আগে দেখতে হবে সামাজিক বীজসম্পদ কেন্দ্র গড়ে তোলা হলে সমাজের কি কি উপকার হবে। এ রকম ভাবে পর্যালোচনা করা প্রয়োজন। যা হউক একটা সামজিক বীজসম্পদ কেন্দ্রের পরিকল্পনা বেশ ভাল ভাবে করা দরকার। যাতে করে নিশ্চিত হওয়া যায় যে মৌসুমে, সঠিক বীজসম্পদ এবং সঠিক ব্যক্তি বীজসম্পদ সংরক্ষণ কাজে নিয়োজিত আছেন। এখানে মনে রাখা দরকার যে, বীজ সম্পর্কে দক্ষ এবং অভিজ্ঞ ব্যক্তি যেন বীজসম্পদ কেন্দ্রের দায়িত্বে থাকেন।
বীজসম্পদ সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজন এমন একজন ব্যক্তি যিনি এলাকার শস্য ও গাছ-গাছালির বৈচিত্র্যতার সঙ্গে প্রাকৃতিক পরিবেশ সম্মত কৃষি সম্পর্কে ভাল মত জানেন। এটাও অতি গুরুত্বপূর্ণ যে বীজসম্পদ সংরক্ষণকারী যেন এলাকার সারা বছরের শস্য পঞ্জিকা ও চাষাবাদ পদ্ধতি সম্পর্কে ভালভাবে অবহিত থাকেন। এটা বুঝার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে ঐ এলাকার সংস্কৃতি এমন যে স্বাভাবিকভাবে বীজসম্পদ বা প্রাণসম্পদের সংগ্রহ সংরক্ষণসহ যাবতীয় কাজ করা হয়ে থাকে। সেক্ষেত্রে আলাদাভাবে বীজসম্পদ বা প্রাণসম্পদ সংগ্রহ, সংরক্ষণসহ বীজসম্পদের অন্যান্য কাজ করার প্রয়োজন পরে না।
১. জরিপ
বীজসম্পদ কেন্দ্রের আওতায় সমগ্র এলাকার কোথায় কি ধরণের বীজসম্পদ প্রাণবৈচিত্র্য রয়েছে তা জানা দরকার। সে জন্য বীজসম্পদ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে বীজসম্পদ কেন্দ্রের আওতায় সমগ্র এলাকাতে জরিপ কাজ পরিচালনা করা দরকার। সমগ্র এলাকায় বীজসম্পদ বা প্রাণসম্পদ জরিপ কাজে নিয়োজিত হবার প্রথমে সে সব প্রাণসম্পদ চিহ্নিত করা প্রয়োজন, যে সব গাছ-গাছালির জাত স্বাভাবিকভাবে জন্মাতো কিন্তু অতিসম্প্রতি হারিয়ে গেছে অথবা প্রাকৃতিক নিয়মেই হারিয়ে যাচ্ছে। অবশ্যই মনে রাখতে হবে এলাকার প্রাকৃতিক পরিবেশ চক্র সম্পর্কে তথ্য আগে থেকেই সংগ্রহ করে রাখতে হবে। কোন কোন ক্ষেত্রে কোন এলাকার প্রকৃতি চক্র ক্ষুদ্র বা বেশ ছোট। কোন ঢাল, যেখানে রোদের প্রখরতা বেশী, বালি প্রধান এলাকা, পানির নিকটে, নদীর ধারে যার সীমানা ১৫ বর্গ কিলোমিটর। এই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পরিবেশ চক্রের ভেতরে হয়তো একই জাতের গাছ-গাছালি জন্ম লাভ করেছে। কিন্তু এই সব জাতের বীজসম্পদ সংরক্ষণের সময় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পরিবেশের দিক খেয়াল করে আলাদা আলাদাভাবে বীজসম্পদ সংরক্ষণ করতে হবে। যে সব গাছ-গাছালির জাত হুমকির সম্মুখীন এবং বিপদগ্রস্থ, যে সব গাছ-গাছালির জাত পারিবারিক বাগানে, ক্ষেতে সংরক্ষণ করা হচ্ছে সেগুলোর প্রতি বিশেষ যত্ননেয়ার প্রয়োজন।
বীজ সম্পদকে কেন্দ্রের আওতায় সমগ্র এলাকার যে সব স্থানে উফশী এবং হাইব্রীড শস্য চাষাবাদের বিস্তার লাভ করার ফলে চাষাবাদ পদ্ধতির পরিবর্তন হয়েছে এবং শস্য বৈচিত্র্যতাও অনেক কমে গেছে। এসব ক্ষেত্রে দুরবর্তী গ্রাম যেখানে উফশী শস্য বা হাইব্রিড শস্যের চাষাবাদর প্রচলন নাই এমন গ্রাম খুঁজে বের করতে হবে। একই ভাবে এমন সব কৃষক চিহ্নিত করতে হবে যারা স্থানীয় জাত দিয়েই সব সময় চাষাবাদ করেন। মনে রাখা দরকার জরিপ কাজ, একজন পরিকল্পনাকারীকে খোদ কৃষকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। যে কৃষক প্রকৃত অর্থেই প্রচলিত তথা স্থানীয় শস্য জাত দিয়ে নিজস্ব পদ্ধতিতে চাষাবাদ করে শস্য ফলান। জরিপ কাজের জন্য এলাকার কোথায় স্থানীয় বীজসম্পদ বা প্রাণসম্পদ পাওয়া যাবে তারও খোঁজ খবর পাওয়া সহজ হয়। সে কারণে বীজসম্পদ বা প্রাণসম্পদ সংগ্রহ ও সংরক্ষণ কাজ করার জন্য জরিপ কাজ যথাযথ সুসম্পন্ন করার জন্য এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
২. কৃষকের জ্ঞানকে নথিপত্রের মাধ্যমে শক্তিশালী করা
কৃষকদের বংশ পরস্পরে পাওয়া তাদের প্রচলিত জ্ঞান মহামূল্য সম্পদ। এই জ্ঞানকে আধুনিক প্রযুক্তির সংখ্যা ভিত্তিক গুরুত্বের দিক থেকে ভুল প্রমাণিত করা হয়ে থাকে। যে কোন গ্রামে অথবা সমাজে কৃষকদের মধ্যে বা গ্রামের জনগণের মধ্যে বীজ বা প্রাণসম্পদ বিনিময়ের রেওয়াজ চালু আছে এর মধ্যে অফুরন্ত জ্ঞান নিহিত আছে। যেভাবে একজন কৃষক তার জ্ঞানকে উপস্থাপন করে থাকেন তা অতিগুরুত্বপূর্ণ। এই জ্ঞানকে ডকুমেন্টেশানের মাধ্যমে শক্তিশালি করা দরকার।
আধুনিক জীনব্যাংক অর্থাৎ বীজ ব্যাংকে বীজ চাইলে বীজ সামগ্রী দিয়ে থাকে কিন্তু গ্রামে সামাজিকভাবে বীজ বিতরনের রেওয়াজ শুধু কৃষকদের মধ্যে বীজসম্পদ আদান প্রদানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না। এর বৃহৎ উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য আছে। যেমন এক একটা বীজসম্পদ তারা একেক ভাবে সংরক্ষণ করেন। আবার চারা গজানোর সময় একেক বীজসম্পদ একেক ভাবে এবং সময় নির্ধারণ করে থাকেন। বিভিন্ন নিয়মকানুন আচার মেনে বীজ তলায় বীজ বোনা হয়। কিন্তু আধুনিক বীজ ব্যাংকে যান্ত্রিক পদ্ধতি এবং প্রেসক্রিপসন মাফিক কাজ করা হয়।
বাহিরের অর্থাৎ বাজারে বীজ কেনা বেচার নিয়ম সমাজের তথা কৃষকদের বীজে বিতরনের অর্থাৎ বীজ আদান প্রদানের রেওয়াজকে শুধু ধ্বংস করে না, বীজসম্পদের ওপর যে সামাজিক মালিকানা ও অফুরন্ত লোকজ-জ্ঞানকে ধ্বংস করে। একই সাথে কৃষকদের নিজেদের জ্ঞানের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলেন। যদি বাজারের বীজ বেচাকেনার নিয়ম চালু না হতো তাহলে কৃষক বা জনগণ বীজ বিনিময়ের প্রথা নিজেদের প্রয়োজনেই চালু রাখতেন এবং আরও বিকশিত করা হতো। সেখানে প্রচুর তথ্যেরও আদান প্রদান হতো। কৃষক বীজ আদান প্রদানের সময় একে অপরের মধ্যে তথ্য বিনিময়ের মাধ্যমে নিজেদের জ্ঞানকে যে বিকশিত করে থাকে সে পথও আজ ধ্বংসের পথে। কৃষকদের বীজ বিনিময় সম্পর্কিত যাবতীয় তথ্য যথাযথ ভাবে নথিভূক্ত করা খুবই প্রয়োজন। কেননা কৃষকেরা বীজসম্পদ বিষয়ে নথিপত্র বীজের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে সহায়তা করে অপর দিকে নথিপত্রগুলো রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে।
যে কোন কর্মসূচীতেই ডকুমেন্টেশান বা নথিপত্রের প্রয়োজন পরে। বীজ সংরক্ষণের ক্ষেত্রে বীজের ব্যবহারিক বিষয়ে পর্যাপ্ত এবং বিস্তারিত তথ্য যদি না থাকে তাহলে তার গুরুত্ব কমে যায়। সুতরাং জরীপের প্রাথমিক পর্যায়ে এবং জরিপ কাজ চলাকালে বীজ চিহ্নিত করণের নিয়ম, সংগ্রহ পদ্ধতি, বীজ বিস্তারের জন্য বীজ উৎপাদন (Multiplication), গুদামজাত করণ, মূল্যায়ণসহ যাবতীয় বিষয় প্রচুর তথ্যসহ খোলাশা ভাবে নথিভুক্ত করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। খেয়াল রাখতে হবে নথিপত্র যেন মানসম্পন্ন হয়।
বীজ সম্পদের নথিপত্র তৈরি করার সময় অবশ্যই কৃষকের জ্ঞানকে প্রধান্য দিতে হবে। উদহারণ স্বরূপ ধরুন কোন ধানের মূলতন্ত্র (Root System) এর তথ্য নথিভুক্ত করা খুবই প্রয়োজনা। এসব তথ্য বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই সংগ্রহ করা যায় না। কৃষকের জন্য এ তথ্য জরুরী দরকার নাও পরতে পারে। কেননা কৃষক ধানের মূলতন্ত্র সম্পর্কে জানেন। কিন্তু ধান চাষাবাদের সময় ধানের জাত বাছাই বা পছন্দ করার জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় ধানের জাতের মূলতন্ত্র সম্পর্কে জানা জরুরী। এ তথ্যের ওপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত নেবেন কৃষক কোন জাতের ধানের চাষাবাদ করবেন।
বীজ বা প্রাণসম্পদ সংরক্ষণের লক্ষ্যে জরিপ কাজ চলাকালে সুনির্দিষ্ট গাছ-গাছালি বা শস্যের যে সব তথ্য নিতে হবে যেমন শস্য ভাল খাদ্য কিনা, পুষ্টিমান, রান্না করার পদ্ধতি অন্যান্য বিস্তারিত তথ্য নথিভুক্ত করতে হবে। শস্য গুদামজাত করার সময় কৃষিতাত্ত্বিক তথ্য যেমন শস্যের আকার আকৃতি অর্থাৎ দেখতে কেমন। শস্য ক্ষেত অর্থাৎ গাছ-গাছালির জন্মস্থান সম্পর্কে তথ্যাদি নথিভুক্ত থাকতে হবে। আরো যে সব তথ্য রাখতে হবে যেমন উৎপাদনের পরিমাণ, শস্যের গুণগত মান, রোগবালাই এবং কীটপতঙ্গ রোধসম্পন্ন বীজসম্পদ কি না, প্রাকৃতিক পরিবেশ এবং শস্য বা গাছ-গাছালি সম্পর্কে লোকজ সংস্কৃতিসহ যাবতীয় তথ্যাদি বিস্তারিতভাবে নথিভুক্ত থাকতে হবে।
আরো যে তথ্য যেমন, পাতার প্রস্থ, ফুলের ধরণ, রং ইত্যাদি অন্যান্য তথ্য শস্য মাড়াইয়ের পর কৃষকদের জানানো সম্ভব নাও হতে পারে। তা ছাড়া কৃষকও প্রয়োজনীয় সময় দিতে পারেনা। আবার খারাপ আবহাওয়ার কারণেও তথ্য সংগ্রহ করা নাও যেতে পারে। এ সব ক্ষেত্রে জরিপ কাজ চলাকালে যতটুকু তথ্য সংগ্রহ করা যায় সেটুকু তথ্য সংগ্রহ করে অবশিষ্ট তথ্যাদি বীজসম্পদ সংরক্ষণের লক্ষ্যে পুনরুৎপাদনের সময় অবশ্যই করতে হবে।
খ. বীজ সম্পদ সংগ্রহ
যে কোন বীজসম্পদ কেন্দ্রের বীজসম্পদ বা প্রাণসম্পদ সংরক্ষণের সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য থাকে। সে লক্ষ্যকে সামনে রেখে বীজসম্পদ সংরক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। সুনির্দিষ্ট কোন গাছ-গাছালি বা শস্যের জাতের ভৌগলিক অথবা অবস্থানগত কারণে যেমন- খরা সহিষ্ণু, কীটনাশক সহিষ্ণু, বিপদগ্রস্থ গাছ-গাছালি, ওষুধিগুণ সম্পন্ন, পশুখাদ্য, নতুনজাত উদ্ভাবন ইত্যাদি। এ সব হচ্ছে গাছ-গাছালির সুনির্দিষ্টগুণ। আর সাধারণ লক্ষ্য হচ্ছে এলাকা ভেদে একই গাছ-গাছালি বিভিন্ন রকমের প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়। একই সময়ে পরিপক্ক হয়ে থাকে। এখন কথা হচ্ছে যে সামাজিকভাবে বীজসম্পদ সংরক্ষণ কর্মসূচী গাছ-গাছালির ভৌগলিক অবস্থানের বিষয় বিশ্বাস করে কিন্তু বিভিন্ন ভৌগলিক এলাকার সকল বিপদগ্রস্থ গাছ-গাছালির বীজসম্পদ বা প্রাণসম্পদ সংগ্রহ এবং সংরক্ষণ করা সম্ভব নয়। সামাজিকভাবে বীজসম্পদ বা প্রাণসম্পদ সংরক্ষণ করার ক্ষেত্রে কড়াকড়ি নিয়ম নাই যে, কোথায় কি পরিমাণ কত জাতের কেমন করে বীজ বা প্রাণসম্পদ সংগ্রহ বা সংরক্ষণ করা হবে। একটা ছোট গ্রামে বা সমাজে সামাজিকভাবে সকল ধরণের বীজ বা প্রাণসম্পদ সংগ্রহ করে রাখা সম্ভব নয়। সামাজিকভাবে স্থাপিত বীজসম্পদ কেন্দ্রে বীজসম্পদ বা প্রাণসম্পদ সংরক্ষণের দৃষ্টিই থাকে যে সব স্থানীয় জাতের বীজসম্পদ বা প্রাণসম্পদ বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে সেই সব গাছ-গাছালির প্রাণসম্পদ প্রথমে সংগ্রহ এবং সংরক্ষণ করা প্রয়োজন। পরবর্তীতে অন্যান্য প্রাণ সম্পদ।
১. কোথা থেকে বীজসম্পদ সংগ্রহ করবেন
এখানে কোথা থেকে বীজসম্পদ সংগ্রহ বলতে বীজসম্পদ প্রাপ্তি এবং জন্মানোর স্থানকে বোঝানো হয়েছে। প্রকৃতিতে গাছ-গাছালির জন্মানোর স্থান ভেদে বীজবৈচিত্র্যের কর্মক্ষমতা ও গুণগত মান নির্ভর করে। প্রাকৃতিক নিয়মে বীজবৈচিত্র্য বা শস্যবৈচিত্র্য জন্মানো বা সৃষ্টি নির্ভর করে প্রাকৃতিক অবস্থান। যেমন ভূÑপ্রকৃতির প্রতিটি স্থানের উচ্চতা, দূরত্ব, দিবা-রাত্রির সময় কাল, খাল বিল হাওর বাওর আবহাওয়া জলবায়ু নদী হ্রদ মাটির প্রকৃতি ইত্যাদি দ্বারা প্রাণসম্পদের ভিন্নতা দেখতে পাওয়া যায়। প্রকৃতিতে প্রাণসম্পদের জন্মানোর স্থানের ভিন্নতার কারণে গাছ-গাছালি বা প্রাণসম্পদের প্রকৃতি এবং গুণগত মানের পার্থক্য হয়ে থাকে। বাস্তবে তা দেখাও যায়। এই প্রকৃিতক কারণ গুণগত মানসম্পন্ন গাছ-গাছালির বৈচিত্র্যসহ প্রাণসম্পদ জন্মানোর স্থান পরিবর্তন করে সুনির্দিষ্ট গাছ-গাছালি কৃষকের পক্ষে পুনরায় জন্মানো সম্ভব হয় না। যে গাছ-গাছালি বা প্রাণসম্পদ যেরকম প্রাকৃতিক পরিবেশ জন্মায় সে সব গাছগাছালি বা প্রাণসম্পদকে ঠিক সেই প্রাকৃতিক পরিবেশ সংরক্ষণে করা দরকার। নচেৎ তার গুণগত মান ঠিক থাকে না। এটাই হচ্ছে কৃষিসংস্কৃতির জীবন্তরূপ। বিভিন্ন বীজসম্পদ অথবা প্রাণসম্পদ সমাজের বিভিন্ন মানুষ তাদের এক সমাজ থেকে অন্য সমাজের মধ্যে নৈতিক ও সাংস্কৃতিক পার্থক্য হয়ে থাকে। বাস্তবে দেখা গেছে একই সমাজের মধ্যে বিভিন্ন মানুষের জীবন চর্চা এবং জ্ঞানের ব্যবহারের বৈচিত্র্যতা রয়েছে।
সে জন্য বীজ সম্পদ তথা প্রাণসম্পদ সংরক্ষণের জন্য এটাই হচ্ছে প্রকৃত স্থান। সত্যিকারার্থে যদি বীজসম্পদ বা প্রাণসম্পদ সংরক্ষণের লক্ষ্যে বীজসম্পদ বা প্রাণসম্পদ সংগ্রহের কাজ কৃষকদের সঙ্গে নিয়ে করাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কেননা এলাকার কৃষক তথা জনগণই জানেন কোথা থেকে কোন বীজসম্পদ বা প্রাণসম্পদ সংগ্রহ করতে হবে। তারাই প্রাণসম্পদ বৈচিত্র্যতা সম্পর্কে ভাল জানেন। বীজ তথা প্রাণসম্পদ অবশ্যই এলাকার কৃষকদের নিকট থেকেই সংগ্রহ করতে হবে। যেখানে লোকায়ত চাষাবাদ পদ্ধতির চর্চা হয়ে থাকে এবং লোকায়ত জ্ঞান বেশী শক্তিশালী। প্রাণসম্পদ এবং শস্যবৈচিত্র্যতা সবুজ বিপ্লবের বা আধুনিক কৃষির প্রদর্শীত পথে কোন অবস্থায় ধরে রাখা সম্ভব নয়। এছাড়া শস্যবৈচিত্র্য ধরে রাখার কাজ করাও হয় না। সবাই জানেন যে এলাকায় একাট্টা (monoculture) পদ্ধতি চাষাবাদের বিস্তার লাভ করে নাই, সেখানেই বীজসম্পদ বা প্রাণসম্পদের বৈচিত্র্যতা বেশী। ঠিক এ রকম এলাকাতে বিভিন্ন প্রাণসম্পদের তথা গাছ-গাছালির বৈচিত্র্য সম্পদের নমুনা সংগ্রহ করা বেশ সহজ হবে। একাট্টা (monoculture) চাষাবাদ চর্চার এলাকাতে প্রাণসম্পদের বৈচিত্র্যতার নমূনা সংগ্রহ করা বেশ কঠিন।
সামাজিক ভাবে বীজসম্পদ প্রাণসম্পদ সংগ্রহের পদ্ধতি সম্পূণরূপে নির্ভর করে সমাজের বীজ বিনিময় পদ্ধতির ওপর। সমাজে এ প্রচলন বজায় থাকার গুরুত্বপূর্ণ কারণ হচ্ছে কৃষক বীজসম্পদ তথা গাছ-গাছালি জন্মানোর মৌসুমে বীজসম্পদ সংগ্রহ করা সম্ভব হয় না। কেননা কৃষক ঐ সময় নিজ নিজ কাজ নিয়ে ভীষণ রকম ব্যাস্ত থাকেন। এসব কারণে বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে সরাসরি কৃষকের জমাকৃত বীজসম্পদের ভান্ডার থেকে সংগ্রহ করা হয়ে থাকে। সমাজের বাস্তব অবস্থা বিবেচনা করে, কোথা থেকে বীজসম্পদ সংগ্রহ করা হবে তা নির্ধারণ করা হবে। নিজেকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে কোথায় থেকে বীজ সংগ্রহ করবেন।
২. কোন ধরণের শস্যের/ গাছ-গাছালির জাত অবশ্যই সংগ্রহ করতে হবে
কোন ধরণের কোন শস্য জাতের বীজসম্পদ সংগ্রহ করবেন। যেহেতু বীজসম্পদ কৃষকের ক্ষেতে সংরক্ষণ করা হবে, যে কারণে বীজসম্পদ সংগ্রহ করা কাজটা সম্পূর্ণরূপে নির্ভর করছে কৃষকদের প্রয়োজনের ওপর। কৃষকদের দরকার বিভিন্ন শস্যের। তারা বাহির থেকে অর্থাৎ বাজার থেকে বীজ সংগ্রহ করতে পছন্দ করেন না। বাহির থেকে বীজ সংগ্রহ করা পছন্দ না করার প্রধান কারণ হচ্ছে এতে বীজের বিশুদ্ধতা রক্ষা হয় না। বীজের মিশ্রণ অথবা সংখ্যা ভিত্তিক বীজ বা প্রাণসম্পদ সংগ্রহ করা কৃষকদের লক্ষ্য নয়। তাদের প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে বীজ বিনিময়কে আরো শক্তিশালী করা, শস্যবৈচিত্র্যতাকে সমৃদ্ধ করা। সামাজিক বীজ বিনিময়ের লক্ষ্যই হচ্ছে কৃষকের প্রয়োজনে কত প্রজাতির কত জাতের কি পরিমাণ বীজসম্পদ সংগ্রহ করা হবে। কৃষকরা নিজেদের সুনির্দিষ্ট প্রয়োজনে, সুনির্দিষ্ট শস্য জাত, নির্দিষ্ট গুণাবলী সম্পন্ন বীজসম্পদ সংগ্রহ করে থাকেন। একটা সামাজিক বীজসম্পদ সংগ্রহ কর্মকান্ড বীজ বিনিময় করার সময় কতকগুলো সাধারণ নিয়ম মেনে চলেন।
যেমন-
- শস্যের ফলনের পরিমাণ
শস্যের গুণগত মান। যেমন-রং আকারে আকৃতি সুগন্ধ ইত্যাদি - রান্নার সময় সীমা এবং গুদামজাতকরণ পদ্ধতি
- উচ্চ পুষ্টিমান সম্পন্ন কিনা
- মাটি ও আবহাওয়া উপযোগী কিনা
- রোগবালাই প্রতিরোধ সম্পন্ন কিনা
- কীটপতঙ্গ প্রতিরোধ সম্পন্ন কি না
- কোন ওষুধি গুণ আছে কিনা
- পশু খাদ্য হিশাবে ব্যবহার করা যায় কিনা
- মাটির (ক্ষেত) উন্নতিতে অবদান রাখে কিনা
- ক্ষেতে চাষ উপযোগী এবং প্রকৃতিক পরিবেশ উপযোগী কিনা
এখানে একটা বিষয় মনে রাখা দরকার সেটা হচ্ছে সামাজিক বীজ বিনিময় রীতি বীজসম্পদ সংরক্ষণের লক্ষ্য নিয়ে বীজসম্পদ তথা প্রাণসম্পদ সংরক্ষণ করা হয় না। বীজসম্পদ সংরক্ষণ করা হয় কৃষকের তথা সমাজের প্রয়োজনে।
কৃষকদের মধ্যে বীজ বিনিময়ের যে রীতি প্রচলন রয়েছে সেটা বীজসম্পদ সংরক্ষণের ক্ষেত্রে খুবই শক্তিশালী মাধ্যম। তাদের প্রয়োজনে তারা একই শস্যের বিভিন্ন বৈচিত্র্যময় জাত সংগ্রহ করেন। কৃষক শুধু এককাট্টা (monoculture) চাষাবাদ প্রতিহত নয়, তারা ভাষার আধিপত্ত্বের (Language Monoculture) প্রতিও বেশ বিরক্ত। তারা প্রতিটি শস্যের স্থানীয় ভাষায় নাম লিখে রাখেন। শুধু তাই নয় তারা স্থানীয় ভাষায় প্রতিটি শস্যের বিভিন্ন তথ্য, গুণাগুণ এবং ব্যবহার লিখে রাখেন। যেমন উদাহরণ হিশাবে ধানের কথা বলা যায়। ধানের বৈজ্ঞিানিক নাম ওরাইজা স্যাটিভা Oryza sativa। ধানের এই নাম ল্যাটিন ভাষা থেকে নেয়া হয়েছে। ল্যাটিন ভাষায় ধানের নাম থেকে কোন কিছু বুঝার তেমন কোন সুযোগ নাই। বাংলাদেশের কৃষকের পক্ষে কোন অর্থ বের করা সম্ভব নয়। কিন্তু বাংলাদেশের কৃষক ধানের প্রতিটি তথ্য বৈশিষ্ট্য গুণাগুণের ওপর ভিত্তি করে স্থানীয় ভাষায় ধানের বিভিন্ন নাম রাখেন। যেমন কটকতারা, বাদশা ভোগ, লাহাইয়া, বিন্নি, ইন্দুশাইল ইত্যাদি। কৃষক এরকম ভাবে শস্যকে স্থানীয় ভাবে চিহ্নিত করে থাকেন। কৃষক যে স্থানীয় রীতিতে শাস্যকে চিহ্নিত করে থাকেন, তার পেছনে বহু কারণ রয়েছে। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
ভাষার মনোকালচার বড় ধরণের বর্ণবাদ। ভাষার মনোকালচার বীজসম্পদ সংরক্ষণের ক্ষেত্রে বড় ধরণের বাধা। এখানে লক্ষ্য করার বিষয় হচ্ছে আধুনিক পদ্ধতিতে কৃষির ক্ষেত্রে ভাষার মনোকালচার ব্যবহার করার প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে শস্যের নতুন জাত বের করা এবং তার বাজার সৃষ্টি করা। সে কারণে তাদের বীজসম্পদ সংগ্রহ ও সংরক্ষণের লক্ষ্য আলাদা। তারা বীজসম্পদ সংগ্রহের ক্ষেত্রে কতিপয় নিয়ম মেনে চলেন যেমন-
- কোথায় বা কোন স্থান থেকে শস্যের জাত বেশী মাত্রায় ধ্বংস হয়ে গেছে।
- সুনির্দিষ্ট শস্য জাতের বাজারে চাহিদা পার্থক্য রয়েছে।
- প্রকৃতিক চক্র ধ্বংসাত্মক পর্যায়ে চলে গেছে।
- যে এলাকার জনগণের সংস্কৃতির পার্থক্য রয়েছে।
- বীজ সম্পদ সংগ্রহের সময় প্রধান লক্ষ্য থাকে সংগৃহিত শস্য বীজ যেমন সকল প্রকৃতিক পরিবেশে উৎপাদন করা যায়।
৩. কখন বীজসম্পদ বা প্রাণসম্পদ সংগ্রহ করবেন
বীজসম্পদ সংগ্রহের প্রথম ধাপই হচ্ছে এলাকা ঘুরে দেখে দেখে নিশ্চিত হতে হবে বীজ বা প্রাণসম্পদ সংগ্রহের উপযোগী হয়েছে কিনা। সাধারণত গ্রীস্মকালের তিন চার মাস পূর্বে থেকে বীজসম্পদ বা প্রাণসম্পদ সংগ্রহ করা হয়ে থাকে। তবে বীজ বা প্রাণসম্পদ সংগ্রহের সবচেয়ে ভাল সময় হচ্ছে শস্য মাড়াই এর সময়। এছাড়া গ্রামে যে দিন হাট বসে, এই হাট বীজসম্পদ সংগ্রহের একটা ভাল স্থান। কেননা গ্রামের হাটে ক্ষুদ্র কৃষক অল্প পরিমাণে বীজ বিক্রি করার জন্য নিয়ে আসেন। এছাড়া খোদ কৃষকদের মেলাও বীজসম্পদ সংগ্রহের ভাল স্থান। এই সব বিষয়গুলোর খোঁজ খবর নিয়ে বীজসম্পদ সংগ্রহে নামতে হয়।
সরাসরি ক্ষেত থেকে বীজ সংগ্রহ করার ক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হবে দিনের কোন সময় বীজ সংগ্রহ করবেন। দিনের সবচেয়ে ভাল সময় হচ্ছে সকাল দশটার পর থেকে দুপুর পর্যন্ত। এটা একটা সাধারণ নিয়ম। তবে এখানে খেয়াল রাখতে হবে সকল বীজের বেলায় এ নিয়ম প্রযোজ্য নয়। বীজসম্পদ সংগ্রহের ক্ষেত্রে এক একটি বীজ একেক নিয়মে সংগ্রহ করতে হয়। সে কারণে কৃষকদের নিকট থেকে বীজ সংগ্রহের প্রকৃত তথ্য জেনে নিয়ে বীজসম্পদ সংগ্রহ করা দরকার। আপনি কখন বীজসম্পদ সংগ্রহ করবেন সে সম্পর্কে সাধারণ কিছু দিক নির্দেশনা দেয়া হলো যেমন-
ক. ফল জাতীয় সবজি উদাহরণ হিশাবে টমেটো বা বেগুনই ধরুণ। টমেটো বা বেগুনের বীজ সংগ্রহ যদি করতে চান তাহলে দেখতে হবে টমেটো বা বেগুনের ফলের ভেতরের শাঁস সর্বোচ্চ পর্যায়ে পরিপক্ক হয়েছে কিনা। টমেটো বা বেগুনের ভেতরের শাঁস সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছানোর পর রসালো ভাবটা কমতে শুরু করবে, তার সাত আট দিন পর থেকে বীজ সংগ্রহ করতে হবে।
খ. অন্যান্য শস্যের বীজ সংগ্রহ করার ক্ষেত্রে দেখতে হবে শস্যটি পরিপুষ্ট হয়েছে কিনা। এ ক্ষেত্রে পরিপুষ্ট খুঁতবিহীন এবং ক্ষেতের মধ্যে সবচেয়ে ভাল শস্য নির্ধারণ করবেন এবং সেই নির্ধারিত শস্য থেকে বীজ সংগ্রহ করবেন।
গ. প্রকৃতিতে এমন গাছ-গাছালি বা শস্য আছে যে সব শস্যের বীজ পরিপূর্র্ণতা লাভ করার সাথে সাথে গাছ-গাছালি বা শস্যটি পুরোপুরি মরে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। গাছ-গাছালি বা শস্যটি পুরোপরি মরে যাবার পর নিখুঁত পরিপুষ্ট বীজ দেখে বীজ সংগ্রহ করবেন। যেমন ধান, গম, ছোলা, মুগ, কাউন, মশুর, রাই, সরিষা, তিসি ইত্যাদি।
ঘ. আবার এমন সব শস্য আছে যে সব শস্যের বীজ রাখা কষ্টকর। যেমন- আলু, হলুদ, আদা, ইত্যাদি। এসব শস্যের বীজ হয় না। তবে শস্য পরিপূর্ণতা লাভ করলে গাছ-গাছালিটি আপনা আপনি মরে যায়। এ রকম শস্যের গাছটি পুরোপুরি মরে যাবার পর প্রাণকোষ সংগ্রহ করতে হবে। এক্ষেত্রে একটা বিষয় খেয়াল রাখতে হবে-সেটা হচ্ছে, বীজ হিশাবে যে শস্যটি সংগ্রহ করবেন সে শস্যে সরাসরি সূর্যের আলো না লাগে।
ঙ. প্রকৃতিতে এমন অনেক শস্য আছে, যাদের ফল হয় কিন্তু ফল থেকে ভাল বীজ হয় না। অর্থাৎ সে সব গাছ-গাছালি বা শস্যের সংগৃহিত ফলের বীজ থেকে গাছ, লতা গাছ-গাছালি ভাল হয় না, যেমন পটল, কাকরোল, কলা, আনারস ইত্যাদি। প্রাণসম্পদ সংগ্রহ করার ক্ষেত্রে খোয়াল রাখতে এই সব শস্যের গাছ-গাছালির শিকড়ের মাঝে মাঝে স্ফীত শিকড় সৃষ্টি হয়। এই স্ফীত শিকড়কে স্থানীয় ভাষায় গেড় বলে এবং ইংরেজীতে সাকার (suker) বলে। কলার ক্ষেত্রে কান্দমূল বলে। পটল, কাকরোল এরকম শস্যের জন্য গেড় সংগ্রহ করার জন্য গাছ-গাছালিটি চিহ্নত করে রাখতে হবে, আপনি কোন গাছ-গাছালি থেকে গেড় সংগ্রহ করবেন। একদিন বিকেল বেলায় নিখুঁত দেখে গেড় সংযুক্ত অর্থাৎ গেড় ওয়ালা গাছ-গাছালি সংগ্রহ করবেন। এ ক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হবে সংগৃহীত গেড় ওয়ালা গাছ-গাছালি যেন সরাসরি সূর্যের আলো না পায়।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে যিনি বীজসম্পদ সংগ্রহের কাজ করবেন তাকে অবশ্যই বীজ বিষয়ে ভাল জ্ঞান থাকতে হবে। নচেৎ প্রকৃত উদ্দেশ্য অর্জন হবে না।
৪. কেমন করে বীজ বা প্রাণসম্পদ সংগ্রহ করবেন
বীজসম্পদ বা প্রাণসম্পদই বলেন, সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করা বেশ কঠিন এবং ধৈর্য্যরে কাজ। প্রকৃত শস্যবৈচিত্র্য ও গাছ-গাছালির বৈচিত্র্য একমাত্র কৃষক পর্যায়েই সংরক্ষণ করা সহজতর। তাহলে কি বীজসম্পদ সংগ্রহ করা যাবে না ? হ্যাঁ যাবে। এলাকায় যেখানে সামাজিক বীজসম্পদ কেন্দ্র গড়ে তোলা হয়েছে সেই সব সামাজিক বীজসম্পদ কেন্দ্রের মাধ্যমে বীজ বিনিময় কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। সামাজিক বীজসম্পদ কেন্দ্রের সঙ্গে সরাসরি খোদ কৃষক যুক্ত থাকেন। এখানে নির্ধারন করা থাকে, কোন কোন কৃষক সামাজিক বীজসম্পদ কেন্দ্রের বীজের কাজগুলো করবেন। বীজ বিষয়ে নির্ধারিত কৃষকদের নিয়ে একটা বীজ নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে হবে। এই বীজ নেটওয়ার্কের তারাই সদস্য হতে পারবেন যারা স্থানীয় শস্য বীজ দিয়ে চাষাবাদ করে থাকেন। কোথায় গেলে স্থানীয় জাতের বীজ পাওয়া যাবে। এ তথ্য তিনি জানেন।
বীজ অবশ্যই খোদ কৃষকের ক্ষেত থেকে সংগ্রহ করতে হবে। যখন শস্য পরিপূর্ণ ভাবে পেকে যাবে সে সময় অথবা কৃষক যখন শস্য মাড়াই করবার জন্য শস্য বাড়ী নিয়ে আসেন, সেই সময় বীজসম্পদ বা প্রাণসম্পদ সংগ্রহ করা দরকার। বীজসম্পদ সংগ্রহের সময় অবশ্যই কৃষকের পছন্দের প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে।
কৃষকের দৃষ্টিকোন থেকে বীজসম্পদ বা প্রাণ সম্পদ সংগ্রহ করার কতগুলো ধাপ এখানে দেয়া হলো-
ক. প্রথমে ক্ষেতে গিয়ে দেখতে হবে, সেখানে কত প্রকারের শস্য এবং তাদের জাত রয়েছে। এরপর যে কৃষকের ক্ষেত থেকে বীজসম্পদ সংগ্রহ করা হবে তার ক্ষেতে কত রকম শস্য এবং শস্যের জাত রয়েছে তা দেখে নিশ্চিত হতে হবে।
খ. বীজ সম্পদ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে ক্ষেতে গিয়ে একের পর এক বীজের নমূনা সংগ্রহ করতে হবে। এক একটা জাতের জন্য ক্ষেতের নির্দিষ্ট অল্প স্থান থেকে বীজসম্পদ সংগ্রহ করতে হবে।
গ. বীজ সম্পদ সংগ্রহের সময় অবশ্যই খোয়াল রাখতে হবে। স্যাত স্যাতে, ভিজা যেখানে সূর্যের আলো পড়ে না অথবা শস্যগুলো ভাল নয়, এমন স্থান থেকে বীজসম্পদ সংগ্রহ করা বাদ দিতে হবে। একটি জাতের জন্য অল্প পরিমাণ বীজ সংগ্রহ করলেই চলবে। সব সময় জাতের প্রতি দৃষ্টি রাখতে হবে।
ঘ. শুধুমাত্র শস্যের বীজ সংগ্রহ করলেই চলবে না। ছোট ছোট গাছ-গাছালি হলে গাছ-গাছালিসহ বীজ সংগ্রহ করতে হবে। বড় গাছের বেলায় কমপক্ষে ফল বা বীজসহ আঠারো থেকে বিশ ইঞ্চি পরিমাণ কান্ডসহ সংগ্রহ করতে হবে। আরেকটি বিষয় খেয়াল রাখতে হবে। সেটা আমরা সবাই কমবেশী করে থাকি। সুন্দর ফুল ফল বা কোন গাছ-গাছালি দেখলেই আমরা বীজ সংগ্রহ করে থাকি। এটা ভাল তবে একই শস্যের বা গাছ-গাছালির অন্য রকম জাতের বীজসম্পদ বা প্রাণসম্পদ সংগ্রহ করার প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে।
যদি দেখা যায় বীজসম্পদ বা প্রাণসম্পদের কোন নমূনা রোগবালাই বা কীটপতঙ্গে আক্রান্ত হয়ে থাকে সে ক্ষেত্রে ঐ বীজ বা প্রাণসম্পদের নমূনাকে সম্পূর্ণ ভাবে আলাদা করতে হবে। অন্যথায় রোগবালাই বা কীটপতঙ্গ আক্রান্ত বীজ বা প্রাণসম্পদ অন্য প্রাণসম্পদকে ধ্বংস করে ফেলবে। সাধারণত শস্যের রোগবালাই কীটপতঙ্গ আক্রান্ত হওয়া বিষয়টি প্রাকৃতিক ভাবেই নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে। বীজ বা প্রাণসম্পদ সংরক্ষণের ক্ষেত্রে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য।
৫. বীজ মেলা বীজ বৈচিত্র্য সংগ্রহের একটা পথ
অতীত কাল থেকেই গ্রামে বছরের একটা সময়ে খোদ কৃষকদের বীজমেলা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। খোদ কৃষকদের বীজ মেলার অর্থই হচ্ছে গাছ-গাছালির বৈচিত্র্য সংরক্ষণের লক্ষ্যে বীজসম্পদ সংগ্রহের ভাল পথ। বীজ মেলায় বিভিন্ন এলাকার কৃষক নিজস্ব ক্ষেতের বিভিন্ন রকম শস্যের বীজ নিয়ে হাজির হন। সেখানে উপরি পাওনা হিশাবে বিভিন্ন বীজবৈচিত্র্য সম্পর্কে কৃষকের জ্ঞানের আদান প্রদানের পাশাপাশি বীজবৈচিত্র্য সম্পর্কে বিরল তথ্য জানা যায়। সেটা কোন ওষুধি গুণাগুণ বা জৈব-কীটনাশক গুণাগুণ বা অন্য কোন বিরল তথ্য হতে পারে। কৃষক বীজমেলায় যে মতামত বিনিময় করে থাকেন সেটা তার নিজেদের স্বার্থেই করেন। বীজ মেলাতেই বুঝা যায় কৃষকদের জ্ঞানের শক্তি। গাছ-গাছালির বিজ্ঞান ভিত্তিক প্রজনন সম্পর্কে কৃষকদের জ্ঞানের অবদান। শুধু তাই নয় কৃষকদের বীজ মেলা কৃষকদের জন্য পাটাতনের (Platform) ভূমিকা পালন করে। বিভিন্ন এলাকার কৃষক সেখানে এক সঙ্গে মিলিত হন। এবং বিভিন্ন শস্যের জাত নিয়ে জ্ঞানের আদান প্রদান করেন। এছাড়া বিশেষ ধরনের নতুন বা পুরাতন যাই হোক শস্য বৈচিত্র্য নিয়ে জ্ঞানের আদান প্রদান করে থাকেন। বীজ মেলার মতো যে কোন ধরণের মেলা একটি সমাজের সঙ্গে অন্যান্য সমাজের মিলন ঘটায়। এখানে এক সমাজের কৃষক আরেক সমাজের কৃষকের সম্পর্কের উন্নতি হয়।
৬. কি পরিমাণ বীজ সংগ্রহ করবেন
এখন প্রশ্ন হচ্ছে কি পরিমাণ বীজসম্পদ সংগ্রহ করতে হবে ? এছাড়া সংগৃহীত বীজসম্পদ দিয়ে কতগুলো কৃষকের প্রয়োজন মেটনো যাবে। এখানে সিদ্ধান্ত নিতে হবে বিভিন্ন এলাকা থেকে যতগুলো জাতের বীজসম্পদ যে পরিমাণ সংগ্রহ করতে পারেন তাই করবেন। সামর্থ অনুযায়ী বেশী পরিমাণে বীজ সংগ্রহ করবেন। কি পরিমাণ বীজ সংগ্রহ করবেন এটা সম্পূর্ণরূপে নির্ভর করছে সামর্থের ওপর। বিশেষ ধরণের বীজ অর্থাৎ যে সব বীজ হুমকির সম্মুখিন অথবা হারিয়ে যাচ্ছে সে ক্ষেত্রে বীজ সংগ্রহের প্রতি খেয়াল রাখতে হবে। যেখানে বীজসম্পদ বেশী পাওয়া যায় সেখান থেকে এবং যেখানে বীজ বেশী জন্মে না সেখান থেকেও বীজ সংগ্রহ করবেন। দু’রকম জায়গা থেকে বীজসম্পদ সংগ্রহ করার প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে বিশেষ ধরণের গাছগাছালি জন্মানোর প্রকৃতি চক্র বুঝা। পর-পরাগায়িত এবং ওষুধি গাছ-গাছালির প্রাণসম্পদ বেশী পরিমাণে সংগহ্র করতে হবে। যদি বড় গাছ হয় সে ক্ষেত্রে এক একটি জাতের কম পক্ষে দুই তিনটি করে কাটিং সংগ্রহ করতে হবে। বীজসম্পদ সংগ্রহের সময় কোন রূপ বাচ-বিচার না করে যা পাওয়া যায় সবই সংগ্রহ করতে হবে।
৭. বীজ সম্পদ সংগ্রহের সময় কি কি জিনিস সঙ্গে নেবেন
বীজ সম্পদ সংগ্রহের কি কি জিনিস সংগে নিতে হবে কৃষক ভাল মতই জানেন। কোন কৃষক যখন বীজসম্পদ সংগ্রহের জন্য প্রস্তুত হন, তখন সে তার নিজের যে সব জিনিস রয়েছে, সেখান থেকেই তার প্রয়োজন অনুযায়ী জিনিস সঙ্গে করে নেন। তারা বীজ বা প্রাণসম্পদ সংগ্রহ করে রাখার জন্য এলাকা থেকেই পাত্র সংগ্রহ করে নেন। কৃষকদের স্মরণ শক্তি খুবই প্রখর ফলে তাদের কাগজ পত্রের প্রয়োজন পরে না। বীজসম্পদ সংগ্রহের জন্য উপস্থিত নথিপত্র Documentation) কৃষকদের প্রয়োজন পরে না। সামাজিক বীজসম্পদ কেন্দ্র, বীজসম্পদের জ্ঞানকে বিকিশিত করা এবং অন্য কৃষক ভাই বোনদের জানানোর জন্য নথিপত্রের প্রয়োজন। কৃষক বীজসম্পদ নিয়ে জানাজানির কাজটা করে থাকেন, কৃষকদের সভায়, একে অপরে জানাজানির মাধ্যমে কৃষক এবং অন্য কোন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান যৌথভাবে কোন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে জানাজানি করে থাকেন।
৮. বীজ বা প্রাণসম্পদের নথিপত্র সংগ্রহ
বীজসম্পদ শুধু সংগ্রহ করলেই চলবেনা বীজের তথ্যও সংগ্রহ করতে হবে। কেননা সংগৃহিত বীজ সম্পর্কে কোন তথ্য না থাকলে সে বীজ কোন কাজে লাগানো যাবে না। বীজ সংগ্রহের পর কি করতে হবে সে সম্পর্কে ধারণা দেয়া হলো।
- বীজ বা প্রাণসম্পদ সংগ্রহ করে তাতে লেবেল লাগাতে হবে। যদি লেবেল না থাকে সে ক্ষেত্রে ছোট্ট কাগজে বীজের নাম লিখে রাখতে হবে। কেননা এক সঙ্গে বিভিন্ন শস্যের বিভিন্ন জাতের শস্য বীজ সংগ্রহ করা হবে। যখন একই থলে থেকে বিভিন্ন সংগৃহিত বীজ বের করা হবে তখন চেনা যাবে না কোনটা কোন বীজ। সে কারণে বীজ সংগ্রহের পর লেবেল লাগানো দরকার।
- যে পাত্রের ভেতরে অথবা থলেতে বীজ রাখা হোক না কেন বীজের থলে, কৌটা বা বাক্সের গায়ে এবং ভেতরে আলাদা আলাদা ভাবে বীজের তথ্য লিখে রাখতে হবে।
ক. বীজের তথ্য সংক্ষেপে রাখবেন
বীজসম্পদ সংগ্রহের সময় বীজের তথ্য সিটে প্রচুর তথ্য সংগৃহিত হয়ে থাকে। কিন্তু বীজ সংগ্রহের পর প্রতিটি বীজের জন্য যে লেবেল লাগাবেন তাতে বিস্তারিত তথ্যের প্রয়োজন নাই। লেবেলের তথ্য হবে সংক্ষিপ্ত। বীজ সংগ্রহের পর বীজের জন্য লেবেল সাধারণত যে সব তথ্য তাকে তা এখানে দেয়া হলো-
- বীজ বা প্রাণসম্পদের সাধারণ নাম, আঞ্চলিক নাম
- যে স্থান বা এলাকা থেকে বীজ সংগ্রহ করা হয়েছে তার নাম ও পরিচিতি
- বীজ সংগ্রহের তারিখ
- সংগ্রহ সংখ্যা
- বীজ সংগ্রহকারীর নাম
- বীজ দাতার নাম ও ঠিকানা
খ. বীজের অতিরিক্ত তথ্য
বীজ সংগ্রহের সময় সাধারণ তথ্য অবশ্যই সংগ্রহ করতে হবে। তবে বীজ সংগ্রহ করতে গিয়ে যদি অতিরিক্ত তথ্য পাওয়া যায় তাহলে অবশ্যই সংগ্রহ করতে হবে। বীজ সংগ্রহের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত তথ্য হচ্ছে গাছগাছালির বৈজ্ঞানিক নাম। যে স্থান থেকে বীজ সম্পদ সংগ্রহ করা হচ্ছে সে স্থান সমূদ্র পৃষ্ঠ থেকে কত উচ্চতায় অবস্থিত, খরা না স্যাতস্যাতে স্থানে ভালো হয়, পুষ্টিমান, পশুখাদ্য, ওষুধি গুণাগুণ ইত্যাদি। এ রকম অল্প বিস্তর তথ্য যা পাওয়া যায়, সংগ্রহ করতে হবে এবং বীজ সংগ্রহের সময় তথ্য পাওয়া গেলে ভালো।
গ. বীজের লেবেলে কি তথ্য রাখবেন
বীজ সংগ্রহের পর বীজ লেবেলে কি তথ্য রাখবেন সে সম্পর্কে ধারণা দেয়া হলো-
- শস্য/ গাছগাছালির নাম
- স্থানীয় নাম
- জাতের নাম
- কৃষকের নাম ও ঠিকানা
- বীজ সংগ্রহের স্থান এবং দূরত্ব
- বীজ সংগ্রহের তারিখ
- পুনরায় নথিভুক্ত করার স্থান ও লোকেশন
ঘ. ফাইলে কি কি তথ্য রাখবেন
বীজ সংগ্রহের সময় যে সব তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে আবার সে তথ্য ফাইল করতে হবে কেন ? এটা একটা স্বাভাবিক প্রশ্ন। একজন কৃষকের জন্য কোন নথিপত্রের দরকার নাই তবে একটা সামাজিক বীজসম্পদ কেন্দ্রের জন্য এবং অন্যান্য কৃষকেদের জানাজানি এবং বীজসম্পদকে উন্নতর করার জন্য বীজের তথ্য প্রয়োজন। এছাড়া বীজ সংগ্রহের সময় যে সব তথ্য সংগ্রহ করে লেবেল দেয়া হয়েছিল সেই লেবেল কোন কারণ বশত: হারিয়ে গেলে বীজ শনাক্ত করা বেশ কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। ফলে সংগৃহিত বীজ কোন কাজেই লাগানো যায় না। এই সব কারণে সংগৃহিত বীজসহ সকল বীজের তথ্য ফাইলে নথিভুক্ত করতে হবে। বীজ সম্পর্কে যে সব তথ্য রাখতে হবে সে সব হচ্ছে-
- বীজ সংগ্রহের সময় লেবেলে যে সব তথ্য দেয়া হয়েছিল সে সকল তথ্য
- বীজ বা প্রাণকোষ এর বিস্তারিত বিবরণ
- বীজ সংগ্রহ করে কোথায় রাখা হয়েছে তার ঠিকানা এবং বীজ কি অবস্থায় আছে তা উল্লেখ করতে হবে
- বীজের অঙ্কুরোদগম এবং চারা গজানো সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য
- বীজ/প্রাণসম্পদ এবং কৃষক (বীজদাতা) সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য
- বীজের সাধারণ তথ্য এবং গাছগাছালি সম্পর্কে তথ্য থাকতে হবে
- এছাড়া কোন গাছগাছালি / শস্যের বিশেষ কোন গুণ বা বৈশিষ্ট থাকলে তা উল্লেখ করতে হবে
চতুর্থ অধ্যায়: বীজ সংরক্ষণের নানা কাজ
বীজের সংরক্ষণ
বীজ পরিস্কার করা
বীজ সংগ্রহ করার পর কতকগুলি নিয়ম মাফিক কাজ করা হয়। কেননা বীজ সংরক্ষণ করার জন্য বীজ পরিস্কারসহ কিছু পরীক্ষা করা দরকার পরে। তবে বীজ পরীক্ষা করার পূর্বে বীজ সংগ্রহ করে সামাজিক বীজসম্পদ কেন্দ্রের রেজিষ্টার বই প্রথমে তালিকা ভুক্ত করতে হবে। তারপর সংগৃহীত বীজের কিছু পরীক্ষা করার প্রয়োজন পরে যেমন-
১. বীজের আকার আকৃতি ঠিক আছে কিনা
২. বীজ/প্রাণসম্পদ কোন সংক্রামক রোগ বালাই কর্তৃক আক্রান্ত কি না
৩. এক বীজের সঙ্গে অন্য বীজের মিশ্রণ হয়েছে কি না দেখতে হবে। যদি এসব কারণের কোন একটি কারণ পাওয়া যায় তাহলে বীজ অবশ্যই পরিস্কার করতে হবে
এমনও দেখা যায় সংগৃহিত বীজে আদ্রতার পরিমাণ বেড়ে গেছে। তখন বুঝতে হবে বীজ নষ্ট হয়ে যাবার উপক্রম হয়েছে। এক্ষেত্রে সঙ্গে সঙ্গে প্রাকৃতিক ভাবে অর্থাৎ রোদে বীজ শুকানোর ব্যবস্থা করতে হবে। আবার পাকাফল থেকে বীজ সংগ্রহের জন্য ফলের ভেতরের শাঁস থেকে বীজ আলাদা করে পরিস্কার পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলতে হবে। যদি বীজে জাবরা থাকে তাহলে সে বীজকে জাবরা মুক্ত করতে হবে। আর ভিজা বীজে যদি জাবরা থাকে সে ক্ষেত্রে পানি দিয়ে ধুয়ে ফেললে বীজ জাবরা মুক্ত হবে না। এ ক্ষেত্রে চিকন বালি দিয়ে আলতোভাবে ঘষে বীজের জাবরা পরিস্কার করে স্বাভাবিক তাপমাত্রার বীজ শুকাতে হবে। বীজ পরিস্কার করার জন্য কোন অবস্থায় রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করা যাবে না। কৃষকদের সংরক্ষিত বীজ থেকে সংগ্রহ করা বীজ সরাসরি বীজসম্পদ কেন্দ্রে সংরক্ষণ করা যাবে। কিন্তু যখন কৃষক অতিসত্তর শস্য মাড়াই করার জন্য ক্ষেত থেকে বাড়ি নিয়ে এসেছে কেবল মাত্র সে ক্ষেত্রে সংগৃহীত বীজ পরিস্কার করার প্রয়োজন দেখা দিতে পারে। এ ছাড়া সব সময়েই কৃষকের বীজ মৌসুম অনুযায়ী বপন করার উপযোগী থাকে।
বীজের জাবরা পরিস্কার করা
বাতাসের সাহায্যে বীজের জাবরা পরিস্কার করা কৃষকদের একটা আদি পদ্ধতি। বাতাসের সাহায্যে বীজ থেকে জাবরা এবং অপ্রয়োজনীয় ময়লা পরিস্কার করার জন্য তারা নিজস্ব জিনিসপত্র ব্যবহার করে থাকেন। যেমন, বাঁশের তৈরী কুলা, টুকরী ইত্যাদি। বাতাসের সাহায্যে বীজ পরিস্কার করার পদ্ধতি আজও গ্রামাঞ্চলে প্রচলন রয়েছে। যদি অল্প পরিমাণ (আনুমানিক পাঁচ থেকে দশ কেজি) বীজ হয়ে থাকে সেক্ষেত্রে কুলা দিয়ে ঝেড়ে বীজ পরিস্কার করে থাকেন। বীজ পরিস্কারের এ কাজ কৃষক পরিবারের মেয়েরা করে থাকেন।
বীজ শুকানো
বীজ শুকানো মানে হচ্ছে বীজের ভেতরের পানির পরিমাণ কমানো। বীজের ভেতর যদি পানির পরিমাণ বেশী থাকে তাহলে সেখানে তাপ ও চাপের সৃষ্টি হয় যা বীজের জন্য ক্ষতিকর। বীজের ভেতরের অতিরিক্ত পানি বীজের ভেতরে তাপের সৃষ্টি হয় আর এই তাপের কারণে চাপের সৃষ্টি করে বীজের আয়ুষ্কাল কমিয়ে দেয়। শুধু তাই নয় বীজ নানা রকম রোগ-বালাই দ্বারা আক্রান্ত হয়। এ সব কারণে বীজ ঠিক মতো শুকিয়ে সংরক্ষণ করা হয়। বাংলাদেশে আবহাওয়ার বৈচিত্র্যতার কারণেও আপনা থেকেই বীজে পানির পরিমাণ বেড়ে যায়। বীজ সংরক্ষণ করার জন্য ঠিক মতো বীজ শুকিয়ে রাখলে বীজের ভেতরে পানির পরিমাণ কমার সাথে সাথে বীজের ভেতরের তাপ ও চাপ কমে যায়, সাথে সাথে বীজ রোগ বালাই ও কীটপতঙ্গ দ্বারা আক্রান্ত হওয়া থেকে রক্ষা পাবে। একটা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। মনে রাখতে হবে, শতকরা এক ভাগ যদি বীজের আদ্রতা কমানো যায়, তাহলে সে বীজের আয়ুষ্কাল দ্বিগুণ হয়।
বীজ শুকানোর পদ্ধতি
বীজ শুকানোর প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে বীজকে রোগমুক্ত এবং জীবন্ত রাখা। বিভিন্ন পদ্ধতিতে বীজ শুকানো হয়ে থাকে। এখানে কয়েকটি বীজ শুকানোর পদ্ধতি সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো-
১. প্রাকৃতিক ভাবে বীজ শুকানো
কৃষক সাধারণত প্রাকৃতিকভাবে বীজ শুকিয়ে থাকেন। এই পদ্ধতি হচ্ছে শস্যের বীজ বা ফল গাছগাছালির সঙ্গে লেগে থাকে অর্থাৎ ফল বা বীজ গাছগাছালির সঙ্গে লেগে থাকা অবস্থায় গাছে পাকে এবং শুকায় এরকম ভাবে বীজ শুকানোকে প্রাকৃতিকভাবে বীজ শুকানো বলে।
ক. সূর্যের আলোতে বীজ শুকানো
বীজ সরাসরি সূর্যের আলোতে রেখে বীজ শুকানোর পদ্ধতিকে বলে সূর্যের আলোতে বীজ শুকানো।
খ. শীতল ও গরম বাতাসে বীজ শুকানো
এমন অনেক বীজ আছে যে সব বীজকে শীতল বাতাসে শুকানো দরকার পড়ে। আবার এমনও বীজ আছে যে সব বীজকে গরম বাতাসে শুকানোর প্রয়োজন পড়ে এই দু’রকম বাতাসে বীজ শুকানোর পদ্ধতিকে বাতাসে শুকানো বা এয়ার ড্রাইং (Air drying) বলে।
গ. বায়ু শূন্য এবং হিমাঙ্কে বীজ শুকানো
যে সব বীজ বায়ু শূন্য অবস্থায় রেখে শুকানো হয় তাকে বায়ু শূন্য বীজ শুকানো পদ্ধতি বলে। যে সব বীজ শূন্য ডিগ্রী তাপমাত্রার নীচে বীজ শুকানোর পদ্ধতিকে হিমাঙ্কে বীজ শুকানো বলে। এ পদ্ধতি আধুনিক বীজ ব্যাংকে ব্যবহৃত হয়।
২. বীজ শুকানো সম্পর্কে সতর্কতা
বীজ শুকানো আপাত দৃষ্টিতে মনে হয় বেশ সহজ কাজ। আসলে ততোসহজ কাজ নয়। সামান্য সতর্কতা অবলম্বন না করায় বীজের প্রাণ নষ্ট হয়ে যেতে পারে। সে কারণে বীজ শুকানোর বিষয়ে কতিপয় সতর্কতা এখানে দেয়া হলো-
ক. বীজ কখনই সরাসরি মাটিতে রেখে শুকানো যাবে না। কেননা মাটিতে অনেক রকম জীব-অণুজীব থাকে যা বীজের ভেতর প্রবেশ করে বীজের গুণগত মান কমিয়ে দেয়। সে জন্য বীজ শুকানোর জন্য পাটি, মাদুর ইত্যাদি ব্যবহার করতে হবে। কৃষক সহজে পায় অথবা কৃষকের আছে এমন জিনিসের উপর ভিত্তি করে বীজ শুকানোর ব্যবস্থা করা উচিৎ। ঠিক একই ভাবে কোন ধাতব পাত্রের উপর বীজ রেখে বীজশুকানো যাবে না। কোন ধাতব পাত্রে বীজ শুাকানোর সময় ধাতব পাত্র অতিরিক্ত গরম হয়ে বীজের খোসা জ্বলে যাবার সম্ভাবনা থাকে। বীজ শুকানোর ক্ষেত্রে এদিকটা অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে।
খ. খুব কড়া রোদে অথবা তাপে বীজ শুকানো যাবে না। কেননা খুব কড়া রোদে অথবা তাপে বীজ শুকানো হলে বীজের অঙ্কুর গজানোর ক্ষমতা কমে যায়। এবং বীজের খোসা শক্ত হয়ে থাকে। অনেক ক্ষেত্রে বীজের ভ্রƒণ মারাও যেতে পারে। যদি গ্রীষ্মকালে বীজ শুকানোর দরকার পরে তখন বেলা এগারটা থেকে বেলা দুটার মধ্যে বীজ শুকানো ঠিক নয়। এই সময়ে সূর্যের তাপ ভীষণ রকম বেশী থাকে।
গ. বর্ষা মৌসুমে বীজ শুকানো এড়ানো উচিৎ। এ সময় বাতাসে আর্দ্রতার পরিমাণ বেশী থাকে। যা বীজের জন্য ক্ষতিকর। তবে খুবই প্রয়োজন হলে সতর্কতার সঙ্গে বীজ শুকানো যেতে পারে।
৩. কেমন করে নিশ্চিত হবেন যে ভাল করে বীজ শুকানো হয়েছে
বীজ শুকানোর পর বীজ ঠিকমত শুকানো হয়েছে কি না সে সম্পর্কে নিশ্চিত হবার প্রয়োজন রয়েছে। সে কারণে বীজ শুকানোর পর বীজ পরীক্ষা করে দেখা দরকার। বীজ ঠিক মতো শুকানো হয়েছে কি না তা পরীক্ষা করার জন্য কৃষক যে সব পদ্ধতি ব্যবহার করে থাকেন সে সব পদ্ধতি এখানে দেয়া হলো-
- বড় এবং হালকা পাতলা বীজ হলে সে ক্ষেত্রে দুটো বীজ একে অপরে আঙ্গুল দিয়ে আঘাত করলে কট্ কট্ শব্দ হবে। আঙ্গুল দিয়ে আঘাতের ফলে যদি কট্ কট্ শব্দ হয় তাহলে বুঝতে হবে বীজ শুকানো হয়েছে।
- শুকানো বীজ দাঁত দিয়ে চাপ দিলে কট্টাস করে শব্দ হবে। তখন বুঝতে হবে বীজ শুকানো হয়েছে।
- শুকানো ছোট আকারে বীজকে দুই হাতের শাহাদাত আঙ্গুলের কাঠ নখ একত্র করে তার মাঝখানে রেখে চাপ দিলে বীজের আকৃতির কোন পরিবর্তন না হলে বুঝতে হবে বীজ শুকানো হয়েছে। এছাড়া দাঁতে দিয়েও পরীক্ষা করে দেখা যেতে পারে। এক্ষেত্রে বীজ যদি চেপ্টা হয়ে না যায় বা যদি ভেঙ্গে যায় এবং কট্টাস করে শব্দ হয় তখন বুঝতে হবে বীজ যথাযথ শুকিয়েছে।
বীজ শোধন
১.লোকায়ত পদ্ধতিতে কৃষক কিভাবে বীজ কীটপতঙ্গ ও রোগবালাই মুক্ত রাখেন
কৃষক কেন বীজ শোধন করেন? কৃষক এ কারণে বীজ শোধন করেন, যাতে বীজ থেকে সহজে চারা গজানো যায় এবং সে চারা যেন রোগবালাই মুক্ত থাকে। সে কারণে সতর্কতা স্বরূপ বীজ শোধন করা হয়ে থাকে। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে অনেক রকম রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার এবং বিভিন্ন প্রযুক্তির সহায়তায় বীজ শোধন (treatment) করা হয়ে থাকে। এখানে কৃষক লোকায়ত পদ্ধতিতে যেভাবে বীজ শোধন করে থাকেন সে সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো।
ক. প্রথম দানাদার শস্য বীজ যেমন-ধান, গম, ভুট্টা, লালশাক, পাট, পিঁয়াজ ইত্যাদির বীজ ভালোমতো সুর্যের তাপে শুকিয়ে তারপর স্বাভাবিক পরিবেশে ঠান্ডা করার মাধ্যমে বীজ শোধন করে থাকেন।
খ. কৃষক বীজ সংগ্রহ করে ভাল মতো পরিস্কার করেন এবং শুকিয়ে ঘরে রাখেন। ফলে সেই বীজকে আর শোধন করার প্রয়োজন পড়ে না।
গ. যদি কখনও বীজ শোধন করার প্রয়োজন পরে, সে ক্ষেত্রে কৃষক দানা শস্য বীজ শোধন করার জন্য স্থানীয়ভাবে পাওয়া যায় এমন সব গাছ-গাছালি ব্যবহার করে থাকেন। এছাড়া কৃষকদের জানা গাছ-গাছালির পাতা শুকিয়ে গুড়া করে দানা শস্যের সঙ্গে মিশিয়ে বীজ সংরক্ষণ করে থাকেন। কখন কখন কোন গাছের ছাল অথবা মরিচের গুড়া শস্য বীজ শোধনের কাজে ব্যবহার করে থাকেন।
ঘ. অনেক সময় দানা শস্যের সঙ্গে কৃষক ছাই মিশিয়ে রাখেন। বীজের সঙ্গে ছাই মিশিয়ে রাখার প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে বীজে পোকা মাকর আক্রমণের গতিপথ বন্ধ করা। আবার অনেক সময় কৃষক দুই তিনটি দানা শস্য এক সঙ্গে মিশিয়ে বীজ সংরক্ষণ করে থাকেন। যেমন – কাউন, ভুট্টা ইত্যাদি শস্য এক সঙ্গে মিশ্রণ করে রাখেন।
ঙ. কৃষক অনেক সময় বীজ শস্যের সঙ্গে বিশেষ ধরণের কাদা মিশিয়ে তারপর তা শুকিয়ে বীজ ঘরে সংরক্ষণ করেন। আবার এমনও দেখা গেছে ঘুটার ছাই এর সঙ্গে বালি মিশিয়ে শস্য বীজ সংরক্ষণের জন্য ঘরে তুলে রাখেন, কোন কোন সময় কৃষক শস্য বীজের সঙ্গে গাছ-গাছালি শিকর মিশিয়ে রাখেন।
চ. কৃষক বীজ সংগ্রহ করে ভাল মতো শুকিয়ে, বীজ সংরক্ষণ করে রাখার পূর্বে বীজে ধোঁয়া দেয়। কৃষক বীজে এ কারণে ধোঁয়া লাগান যে, বীজে যদি কোন পোকামাকড় আক্রমণের লক্ষণ দেখা দেয় তখন বীজ পোকামাকড়ের হাত থেকে একদিকে রক্ষা পায় অন্য দিকে বীজে আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রিত হয়।
ছ. কৃষক যে কোন পাত্র, ঝুড়ি বা ডোলে বীজ সংরক্ষণ করে রাখুন না কেন সেই বীজপাত্র অবশ্যই আলো- বাতাস মুক্ত হয়ে থাকে। কৃষক যে বাঁশের অথবা বেতের ঝুড়ি বা ডোলে বীজ সংরক্ষণ করেন – সেই ঝুড়ি বা ডোলের গায়ে আঁঠালো কাদার সঙ্গে ধানের তুষ মিশিয়ে ঝুড়ির গায়ে লেপে দেন। তারপর তা ভাল করে রোদে শুকান। এই আঁঠালো কাদার সঙ্গে ধানের তুষ মিশিয়ে বাঁশের বা বেতের ঝুড়ির গায়ে লেপে দেয়ার প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে বীজপাত্রকে আলো এবং বাতাস রোধক করা। কৃষক ঝুড়ির ভেতরে বীজ সংরক্ষণের জন্য বীজ রাখার পূর্বে বীজপাত্র ঝুড়ি বা ডোলের ভেতর বাতি/কুপি/চেরাগ কিছুক্ষণ জ্বেলে রাখেন। বীজ পাত্রের ভেতর বাতি জেলে রাখার প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে বীজ পাত্র ঝুড়ি বা ডোলের ভেতর যদি কোন পোকামাকর থাকে তা আলো দেখে বের হয়ে আসে। তখন সে সব পোকা-মাকরকে সহজেই মারা যায়। এরপর ঐ ঝুড়ি বা ডোলের ভেতর থেকে বাতি (চেরাগ) সরিয়ে বীজ রেখে ঝুড়ির বা ডোলের মুখে শক্ত করে আটকিয়ে রেখে দেন।
জ. কৃষক ভালভাবে এবং ভবিষ্যতে প্রাকৃতিক কোন দুর্যোগের হাত থেকে বীজসম্পদ রক্ষা করার জন্য পোড়া মাটির পাত্রের ভেতর বীজ রাখে। বীজ পাত্রের মুখ ভাল করে আটকিয়ে ঘরের ভেতর গর্ত করে, তারপর বীজপাত্র রেখে আবার সে গর্ত মাটি দিয়ে বন্ধ করে দেন। আবার মৌসুমের সময় সেখান থেকে বীজ বের করে চাষাবাদ করেন। এ পদ্ধতিতে বীজ সংরক্ষণ করলে বীজ দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করা যায় এবং বীজ সুস্থ থাকে।
২. বীজে রোগবালাই আক্রান্ত হলে কৃষক কিভাবে পরীক্ষা করেন
বীজ যেন কোন অবস্থায় রোগবালাই কর্তৃক আক্রান্ত না হয়, সে দিকে অবশ্যই সর্তক দৃষ্টি রাখতে হবে। যে কোন বীজ বিভিন্ন রোগবালাই বা কীটপতঙ্গ দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে। যেমন ছত্রাক/কীটপতঙ্গ দ্বারা বীজ ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে। এমন কি বীজের রং পরিবর্তন হয়ে যাওয়াও বীজ রোগাক্রান্ত হবার লক্ষণ। সে কারণে বীজ শোধন করা প্রয়োজন। যদি বীজ শোধন করা না হয় তাহলে যে কোন রোগবালাই এর কারণে বীজ একেবারে নষ্ট হয়ে যেতে পারে। কোন অবস্থায় রাসায়নিক দ্রব্য দিয়ে বীজ শোধন করা যুক্তিসংগত হবে না। কৃষক অনেক রকম পদ্ধতিতে বীজ শোধন করে থাকেন। এখানে দুটি সহজ পদ্ধতিতে বীজ শোধন সম্পর্কে আলোচিত হলো।
গাঁজানো পদ্ধতি
এমন কিছু শস্যের বীজ আছে যেমন টমেটো এবং কুমড়া জাতীয় শস্যের বীজ শাঁসের সঙ্গে লেগে থাকে ফলে বীজ ব্যাকটেরিয়া এবং ইষ্ট কর্তৃক দ্রুত আক্রান্ত হয়ে থাকে। এ সব শস্যের বীজ নিরাপদ করার ক্ষেত্রে গাঁজানো পদ্ধতি বেশ সহজ এবং ভাল।
পদ্ধতি: প্রথমে একটি পাত্রে পরিস্কার পানি নিয়ে আবার শস্য থেকে শাঁসসহ বীজ পানিতে ভিজিয়ে রাখবেন। তারপর পাত্রের মুখ ঢেকে অন্ধকার ও ঠান্ডা স্থানে কয়েক দিন রেখে দেবেন। কয়েক দিন পর পাত্রের মুখ খুললে দেখা যাবে প্রচুর ফেনার সৃষ্টি হয়েছে। এই ফেনার সঙ্গে কিছু বীজ ভেসে আছে। অবশিষ্ট বীজ, পাত্রের তলায় শাঁস বিহীন অবস্থায় জমা হয়েছে। এখন ফেনাসহ ভাসমান বীজ ফেলে দেবেন। কেননা ভাসমান বীজগুলো রোগাক্রান্ত ও অপুষ্ট। পাত্রে তলায় যে সব বীজ জমা হয়েছে এ সব বীজ সংগ্রহ করে পরিস্কার পানি দিয়ে ধুয়ে সূর্যের আলোর মধ্যম তাপমাত্রায় ভাল করে শুকিয়ে নেবেন। এসব বীজ ভাল বীজ।
বীজ রাখা
সব সময় মনে রাখা দরকার বীজ কোন জড় পদার্থ নয়। বীজের ভেতর গাছ-গাছালির প্রাণসত্তা ঘুমন্ত অবস্থায় থাকে। বীজ একটি গাছ-গাছালির জীবন্ত সত্তা। সে কারণে বীজ যেখানেই রাখা হোক না কেন তাকে যতœ সহকারে রাখতে হবে। যে ঘরে বীজ রাখা হবে সে ঘর তৈরির নক্শা এমন ভাবে করা দরকার সেখানে যেন কোনরূপ পোকা-মাকড় ইঁদুর, কোন রোগবালাই এর জীবাণু, ছত্রাক এবং অণুজীব (বিভিন্ন ধরণের ব্যাকটেরিয়া) দ্বারা আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা না থাকে। সব দিক খেয়াল রেখে বীজ ঘর তৈরি করা দরকার।
আমরা একটা বিষয় প্রায় ভুলে যাই সেটা হচ্ছে কৃষক সমাজের জীবন ব্যবস্থার মধ্যেই বীজ ব্যাংক থাকে। অর্থাৎ প্রতিটি কৃষকের বাড়িই হচ্ছে একটা করে বীজ ব্যাংক। বীজ ব্যতীত লোকায়ত কোন কৃষকের বাড়ী চিন্তা করা যায় না। বিভিন্ন সমাজ বিভিন্ন রকম প্রাকৃতিক পরিবেশ ও অবস্থার মধ্যে বিরাজ করে। তাদের জীবন ধারণ পদ্ধতি আচার-অনুষ্ঠান, সাংস্কৃতি চর্চাও আলাদা হয় থাকে। এমন কি চাষাবাদ পদ্ধতিও আলাদা। উদাহরণ হিশাবে খুব পুরাতন গ্রামের কৃষকের বাড়ীর কৃষক যে ঘরে থাকে ঠিক তার পাশের ঘরেই বীজ ঘর। বীজ ঘরের পাশেই রান্না ঘর। বীজ ঘরটি এমনভাবে তৈরি করা হয়, যাতে বীজ ঘরে রান্না ঘরের ধোঁয়া প্রবেশ করে। একই সাথে রান্না ঘরের ধোঁয়া যেন বীজের গায়ে লাগে। কৃষক খুব চিন্তা ভাবনা করেই বীজ ঘরটি এরকম স্থানে তৈরি করেন। কৃষকের বীজ ঘরের অবস্থান দেখেই তার উদ্দেশ্য সহজে বুঝা যায়। কৃষক খুব ভাল করেই জানেন যে, ধোঁয়া যদি বীজে লাগে তাহলে ঐ বীজ পোকামাকড় বা রোগ বলাই দ্বারা আক্রান্ত হবে না। আবার কোন কারণবশত যদি বীজের আদ্রর্তা বেড়ে যায়, তাহলে তা কমে যাবে। ফলে বীজ থাকবে সম্পূর্ণ নিরাপদ। বীজ নিরাপদে রাখার জন্যই কৃষক তার বীজঘর রান্নাঘরের পাশেই তৈরি করে থাকেন। কৃষক তার বীজ রাখার জন্য যে ব্যবস্থা করেন আমরা তা করি না। কৃষকের এ জ্ঞানের যে বৈজ্ঞানিক ভিত্তি রয়েছে তার মূল্য কখনই দেয়া হয় না। একটা সামাজিক বীজসম্পদ কেন্দ্রের বীজ, সব সময় বীজ বিষয়ে অভিজ্ঞ কৃষকগণই মূল্যায়ণ করে থাকেন। বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে কৃষক নিজের প্রয়োজনীয় বীজ নিজের কাছেই রাখেন। সারা বছরে কৃষকের যে বীজ দরকার তার চেয়ে বেশী বীজ তিনি নিজে সংগ্রহ করে রাখেন।
ক. বীজ সংরক্ষণের বিষয়ে কি কি স্মরণ রাখতে হবে
শস্য বীজ আমরা সংরক্ষণ করি, শস্য বীজ যাতে জীবন্ত এবং কর্মক্ষম থাকে। সে কারণে বীজ সংরক্ষণের ক্ষেত্রে কতিপয় বিষয় অবশ্যই মনে রাখতে হবে। যেমন-
- সংরক্ষণের জন্য বীজসম্পদকে অবশ্যই আর্দ্রতা শূন্য পাত্রে রাখতে হবে। কেননা বীজে আর্দ্রতার পরিমাণ বেড়ে গেলে শস্য বীজের গুণাগুণের ক্ষতি হয়।
- বীজ যে পাত্রে রাখা হবে সে পাত্র যেন অবশ্যই বায়ু শূন্য হয়। যদি বীজ পাত্রে বায়ু থাকে তাহলে ঐ বায়ুর সঙ্গে জলীয় কণা থাকবে যা বীজকে সুস্থ রাখতে বাঁধা দিবে।
- যে পাত্রে বীজ রাখা হবে সে পাত্রকে অবশ্যই রোগবালাই কীটপতঙ্গ এবং ইঁদুর জাতীয় প্রাণী যাতে পাত্রের ক্ষতিসাধন করতে না পারে সে দিকে অবশ্যই দৃষ্টি রাখতে হবে।
- বীজসম্পদ অবশ্যই অল্প তাপমাত্রায় রাখতে হবে। কেননা বেশী তাপমাত্রায় বীজ সংরক্ষণ করলে বীজের প্রাণসত্তার ক্ষতি হয়।
- যে ঘরে বীজ সংরক্ষণ করা হবে সে ঘরে বীজ আনা নেয়ার সুব্যবস্থা রাখতে হবে। কেননা একই বীজঘরে বিভিন্ন রকম, বিভিন্ন জাতের বীজ রাখা হয়। সে কারণে মৌসুম অনুযায়ী কৃষক একই বীজঘর থেকে বীজ আনা নেয়া করবেন।
- বীজ সংরক্ষণের বিষয়ে অযথা খরচ অবশ্যই কমাতে হবে। সে দিকটা যেন খেয়াল থাকে।
গ্রামীণ সমাজ ব্যবস্থায় সামাজিকভাবে শস্যবীজ সংরক্ষণের জন্য কৃষক লোকায়ত যে সব পদ্ধতি এবং ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকেন, সবগুলোই বিজ্ঞান সম্মত। কেননা সামাজিক বীজসম্পদ কেন্দ্র থেকে বীজসম্পদ আনা নেয়ার ব্যবস্থা, আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা মান-সম্পন্ন কৃষকদের পদ্ধতিতে বীজসম্পদ সংরক্ষণ করলে বীজসম্পদ রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় কোন অবস্থায় বেশী হবে না। অন্য দিকে যে সব বীজ পাত্র ব্যবহার করা হয় যা রোগবালাই, কীটপতঙ্গ এবং ইঁদুর জাতীয় প্রাণী কোন ক্ষতি করতে পারে না।
খ. বীজ ঘরের পরিবেশের ওপর বীজের আয়ুস্কাল নির্ভর করে
যে ঘরে বীজ সংরক্ষণ করা হয় সে ঘরের পরিবেশ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কেননা বীজ ঘরের পরিবেশের ওপর নির্ভর করে বীজের আয়ুষ্কাল। বীজ ঘর নির্মাণ এবং বীজ ব্যবস্থাপনা করার সময় মনে রাখা দরকার সেটা হচ্ছে, কোন বীজের আর্দ্রতার পরিমাণ যদি এক শতাংশ কমানো যায় তাহলে বীজের আয়ুষ্কাল দ্বিগুণ হয়। আবার যেখানে বীজ রাখা হয় সেই বীজ ঘরের তাপমাত্রা যদি পাঁচ ডিগ্রী কমানো যায় তাহলে সে ঘরের বীজের আয়ুষ্কাল দ্বিগুণ হয়। এই সব কারণে যেখানে অর্থাৎ যে ঘরে বীজ রাখা হবে সে ঘরের পরিবেশের কথা অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে। এখানে বুঝার সুবিধার্থে বীজের আর্দ্রতার কারণে বীজের ওপর কি প্রভাব পরে তার একটি ছক দেয়া হলো।
বীজের আর্দ্রতার পরিমাণ | বীজের ভেতরে প্রতিক্রিয়া |
৩০ – ৬০% | বীজে পানির পরিমাণ বেশী থাকায় বীজের ভেতরে পাতা গজানো চেষ্টা শুরু হয় |
১৮ – ২০% | বীজের ভেতরে শ্বাসক্রিয়ার পরিমাণ বেড়ে যায়। এই অবস্থায় বীজ থেকে অঙ্কুর গজানোর অবস্থা সৃষ্টি হয়। |
১৩ – ১৭% | এই অবস্থায়ও বীজের শ্বাসক্রিয়ার পরিমাণ অধিক থাকে তবে বীজ থেকে চারা গজানোর মতো অবস্থা থাকে না। |
১০ – ১২% | এ অবস্থায় বীজের অবস্থা ভাল থাকে। এই আর্দ্রতায় খোলা অবস্থায় বীজ ৬ থেকে ৮ মাস রাখা যাবে। বীজের কোন ক্ষতি হবে না। তবে আবহাওয়াগত কারণে বীজ রোগবালাই বা কীটপতঙ্গ দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে। |
৮ – ১০% | এই রকম অবস্থায় বীজ বেশ ভাল থাকে। এই পরিমাণ আর্দ্রতায় বীজ এক থেকে তিন বছর পর্যন্ত সুস্থ থাকে তবে খুবই সুক্ষ্ম পোকার আক্রমণ হতে পারে। |
৪ – ৮% | এই আর্দ্রতায় বীজ সম্পূর্ণরূপে আর্দ্রতা রোধক পাত্রে সিল করে রাখা দরকার। |
০ – ৪% | এই আর্দ্রতার বীজ বেশ ভাল থাকে। বীজকে অবশ্যই আর্দ্রতা রোধক পাত্রে রাখতে হবে। এখানে খেয়াল রাখতে হবে যে, এই বীজ শুকানো হলে, বীজের ক্ষতি হবে। এমনও হতে পারে যে বীজ মারা যাবে। |
গ.আর্দ্রতার ওপর বীজের আয়ুষ্কাল
আমরা একটা বিষয় কখনই খেয়াল রাখি না, বীজে আর্দ্রতার পরিমাণ বেড়ে গেলে যে বীজের জীবনকালের ওপর এর প্রচন্ড প্রভাব ফেলে। সে কারণে বীজ সংরক্ষণ করে রাখার পূর্বে প্রতিটি বীজের আর্দ্রতার পরিমাণ জেনে রাখা দরকার। এখানে বীজ সংরক্ষণ করে রাখার ক্ষেত্রে বীজের আর্দ্রতার পরিমাণের ওপর নির্ভর করে কতদিন বীজ সংরক্ষণ করে রাখা যাবে সে সম্পর্কে ধারণ দেয়া হলো:
বীজের আর্দ্রতার পরিমাণ | বীজ সুস্থ অবস্থায় থাকার সময়কাল |
বীজের আর্দ্রতা ১১ – ১৩% | ছয় মাস/অর্ধ বছর সুস্থ থাকে। |
বীজের আর্দ্রতা ১০ – ১২% | এক বছর বীজ সুস্থ থাকে। |
বীজের আর্দ্রতা ৯ – ১১% | দুই বছর বীজ সুস্থ থাকে। |
বীজের আর্দ্রতা ৮ – ১০% | চার বছর বীজ সুস্থ থাকে। |
সমাজে বীজসম্পদ যৌথভাবে সংরক্ষণ করা হয়। এটা নির্ভর করে কৃষকের বীজ উৎপাদন এবং সরবরাহের ওপর। কৃষক পর্যায়ে অল্প জাতের হলেও বেশী পরিমাণে বীজ দরকার। প্রতিটি শস্যের, প্রতিটি জাতের বেশী পরিমাণে ভাল বীজ সংরক্ষণ করে রাখার জন্য প্রচুর জায়গার প্রয়োজন। একটা সামাজিক বীজসম্পদ কেন্দ্রের বীজ সংরক্ষণ করার জন্য বেশী পরিমাণে স্থানের ব্যবস্থা করা সম্ভব নয়। সামাজিকভাবে কৃষক তার বীজসম্পদ কেন্দ্র যৌথভাবে বীজ সংরক্ষণ করে থাকেন।
ঘ. বীজ সম্পদের বাগান
কৃষক তাদের উৎপাদিত শস্য বীজের একটা অংশ সামাজিক বীজসম্পদ কেন্দ্রে সংরক্ষণ করেন ঠিকই কিন্তু এমন সব শস্য আছে যাদের বীজ, বীজসম্পদ কেন্দ্রে সংরক্ষণ করে রাখা সম্ভব হয় না। যেমন আম, কাঁঠাল, লিচু, জাম, জাম্বুরা, নিম, কলা, কাকরোল, পটল, পান ইত্যাদি। এই ধরণের প্রাণসম্পদ বীজসম্পদ কেন্দ্রের নিকটে একটা বাগান (নার্সারী) স্থাপন করে রাখা হয়। প্রাণসম্পদ সংরক্ষণের এ রকম স্থানকে বলা হয় প্রাণসম্পদের বাগান আর ইংরেজিতে জীন পার্ক বা জীন গার্ডেন বলা হয়ে থাকে। এই প্রাণসম্পদের বাগানের সঙ্গেই একটা ছোট জলাশয়ও রাখা হয়। এই জলাশয় রাখার প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে জলজ প্রাণসম্পদ সংরক্ষণ করা। এই প্রাণসম্পদের বাগানে প্রয়োজনের ভিত্তিতে বিভিন্ন রকম গাছগাছালি সংরক্ষণ করা হয়। যেমন ওষুধি গাছগাছালি, ভেষজ রং এর গাছগাছালি, ফল জাতীয় গাছগাছালি, বিভিন্ন রকম ফল জাতীয় গাছগাছালি, হুমকির সম্মুখীন এমন জাতীয় গাছগাছালি বিলুপ্ত প্রায় গাছগাছালি ইত্যাদি শস্যের বিভিন্ন জাত সংরক্ষণ করা হয়ে থাকে। এই সব প্রাণসম্পদের বাগানে শুধু প্রাণসম্পদ সংরক্ষণ করাই হয় না, সে সব প্রাণসম্পদের বিস্তারিত তথ্যও সংরক্ষণ করা হয়ে থাকে। এটাও এক ধরণের প্রতিষ্ঠানিক প্রাণসম্পদের বাগান। যেমন বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বোটানিক্যাল গার্ডেন, বলদা গার্ডেন ইত্যাদি। কিন্তু একটা গ্রামীণ সমাজে প্রাণসম্পদের বাগান এরকম ভাবে থাকে না। প্রতিটি কৃষকের বাড়িই এক একটা কৃষকের প্রাণসম্পদের বাগান। তারা আলাদা ভাবে কোন জীন পার্ক বা প্রাণসম্পদের বাগান তৈরি করেন না। কেননা কৃষক তার প্রয়োজন অনুসারে তার বাড়ি, সীমানার মধ্যেই গাছগাছালির লতা, গুল্ম, গাছ লাগিয়ে থাকেন।
ঙ. জলীয় বাতাসের সঙ্গে বীজের আর্দ্রতার সম্পর্ক
মুক্ত বাতাসে যে পরিমাণ জলীয় কণা থাকে সেই জলীয় কণার সঙ্গে বীজের আর্দ্রতা সম্পর্ক কি রূপ সে সম্পর্কে ধারণা দেয়া হলো। মুক্ত বাতাসের জলীয় কণার কারণে বীজের ওপর বাষ্পীয় চাপের সৃষ্টি হয় ফলে মুক্ত বাতাসে যে পরিমাণ জলীয় কণা থাকে ঠিক সে পরিমাণ আর্দ্রতা বীজে থাকে না। বীজের বিপাকক্রিয়া অনবরত চলতে থাকায় মুক্ত বাতাসে যে পরিমাণ আর্দ্রতা থাকে ঠিক সে পরিমাণ আর্দ্রতা বীজে থাকে না। এ ছাড়া প্রাকৃতিক পরিবেশের ওপরও নির্ভর করে বীজের আর্দ্রতা। এখানে মুক্ত বাতাসের সঙ্গে বীজের আর্দ্রতার সম্পর্ক দেখানো হলো –
মুক্ত বাতাসের আর্দ্রতা | ৭০% | ৬০% | ৪৫% | ৩৫% |
বীজের আর্দ্রতা | ১৪% | ১২% | ১০% | ৯% |
এখানে মুক্ত বাতাসের আর্দ্রতার পরিমাণের সঙ্গে বীজের আর্দ্রতার যে সম্পর্ক তাতে করে প্রাকৃতিক পরিবেশ ভিত্তিক এলাকা অনুসারে বীজ সংরক্ষণ করার জন্য আলাদা আলাদা ঘরের দরকার। যা বাস্তবে করা সম্ভব নয়। যেমন ধরা যাক কোন এলাকায় মুক্ত বাতাসে আর্দ্রতার পরিমাণ বেশী। ফলে ঐ সব এলাকায় বীজেও আর্দ্রতার পরিমাণ বেড়ে যাবে। কিন্তু বাস্তবে বীজ ঘরের স্বাভাবিক মাত্রায় বীজ রাখা হয়। বীজ ভালই থাকে। কৃষক অভিজ্ঞতা দিয়েই বুঝতে পারেন বীজের আর্দ্রতা ঠিক আছে কি না। বীজে আর্দ্রতা পরিমাপ করার জন্য তাদের কোন যান্ত্রিক সহায়তার দরকার পরে না। এছাড়া কৃষকের বীজ সংগ্রহের উদ্দেশ্য এক নয়। বীজের বিষয়টি অবশ্যই কৃষকের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে হবে। কৃষকের দৃষ্টিকোণ থেকে মুক্ত বাতাসে ৪৫% থেকে ৬০% আর্দ্রতায় বীজে আর্দ্রতার পরিমাণ ১০ থেকে ১২%। কৃষকের শস্য মাড়াই থেকে শুরু করে পরবর্তী মৌসুমে বীজ বপন বা রোপন করার ক্ষেত্রে ১০ থেকে ১২% বীজের আর্দ্রতায় বীজ বেশ ভাল থাকে। ১০ থেকে ১২% আর্দ্রতায় বীজ কমপক্ষে এক বছর সুস্থ রাখা যায়। এ পরিমাণ সময় কৃষকের জন্য যথেষ্ঠ সময়।
পঞ্চম অধ্যায়: বীজ থেকে চারা গজানো
বীজ থেকে চারা গজানো
বীজ হলেই যে সে বীজ থেকে চারা গজাবে, এমন কোন নিশ্চয়তা নাই। সে কারণে বীজে সুস্থতা যাচাই, পরীক্ষা করা দরকার। যখন দেখা যাবে কোন কারণ বশতঃ বীজের চারা গজানোর পরিমাণ কমে গেছে তখন সে বীজকে আলাদা করে নিরাপদ স্থানে চারা গজানোর ব্যবস্থা করতে হবে। এখন প্রশ্ন বীজের কি পরীক্ষা করবেন ? বীজ যাচাই বা পর্যবেক্ষণ করার জন্য বীজের পরীক্ষা করা সম্পর্কে কিছু ধারণা দেয়া হলো।
বীজের গুণগত মান পরীক্ষা
বীজের গুণগত মান পরীক্ষা বা যাচাই করার দরকার পড়ে দুটো পর্যায়ে। প্রথমটি হচ্ছে সামাজিক বীজসম্পদ কেন্দ্রে রক্ষিত বীজ ভাল অর্থাৎ সুস্থ আছে কি না তা যাচাই করে দেখার জন্য বছরে একবার অথবা দুই বার পরীক্ষা করে দেখা যেতে পারে। আর দ্বিতীয় ধাপ হচ্ছে যখন কৃষক নিজেদের বীজ বিনিময় করেন সে সময় চারা গজানোর হার ঠিক আছে কি না তা দেখা এবং গ্রামের হাট অথবা বাজার থেকে কৃষকের বীজ সংগ্রহ করা হয়। সে বীজ, বীজসম্পদ কেন্দ্রে সংরক্ষণ করে রাখার পূর্বে বীজ যাচাই পরীক্ষা করার দরকার।
১.বীজের পুষ্টতা যাচাই
সমাজের বীজসম্পদ কেন্দ্রের বীজের পুষ্টতা ঠিক মতো আছে কি না সে সম্পর্কে সব সময় নিশ্চিত থাকার প্রয়োজন পরে। কেননা দূর্বল বীজ যদি অনুর্বর জমি বা ক্ষেতে বপন বা রোপন করা হয় তাহলে ঐ বীজ থেকে চারা গজালেও রোগ বালাই দ্ধারা আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা থাকে। এছাড়া চারা নাও গজাতে পারে। দূর্বল বীজ থেকে যদি চারা গজায় তাহলে তাদের বাড়ন্ত সমান হয় না এবং ফলনও ভাল হয় না। বীজের পুষ্টতা পরিমাপ করার হয় শতকরা হার হিশাবে। সাধারণত বীজের পুষ্টতা পরীক্ষা করা হয় পানিতে দিয়ে।
যদি বীজ ভালো থাকে তাহলে সে বীজ পানিতে ডুবে যাবে আর খারাপ বীজ পানির ওপর ভেসে ওঠে। এছাড়া কৃষক তাদের নিজস্ব পদ্ধতিতে বীজের পুষ্টতা পরীক্ষা করে থাকেন।
২. বীজের স্বাস্থ্য পরীক্ষা
সুস্থ বীজ বলতে ঐ বীজকে বুঝানো হয়ে থাকে যে বীজ রোগবালাই মুক্ত। স্বাস্থ্যসম্মত বীজ নিজে রোগ বালাই কর্তৃক আক্রান্ত হয় না। ফলে সে বীজ থেকে রোগবালাই ছড়ায়ও না। যেহেতু সামাজিক বীজসম্পদ কেন্দ্রে কোন অনুবীক্ষণ যন্ত্র থাকে না সে কারণে বীজের স্বাস্থ্য পরীক্ষা বেশ সতর্কতার সঙ্গে করা দরকার। শস্য থেকে যখন ফুলের কুড়ি বের হয়ে ফলের সৃষ্টি হয়, সে সময় সতর্কতার সঙ্গে পরীক্ষা করে দেখা দরকার। এ সময় পরীক্ষা করার প্রয়োজন এজন্য যে, ঐ ছোট্ট ফলের গায়ে পতঙ্গ ডিম পারে অথবা সুক্ষ্ম ছিদ্র করে। যেটা পরবর্তীতে বীজে গভীর রোগের সৃষ্টি করে। এই রোগবালাই যুক্ত বীজ পরবর্তী মৌসুমে চাষাবাদের যোগ্যতা হারিয়ে ফেলে। সে জন্য বীজের স্বাস্থ্য ভাল রাখার লক্ষ্যে বীজকে অবশ্যই রোগ বালাই মুক্ত বীজ সংরক্ষণ করা এবং রোগে আক্রান্ত বীজ বাতিল করা দরকার।
অনেক সময় দেখা যায় বীজ বপনের পর বীজে রোগ বালাই ধরা পরে। আবার চারা গজানোর লক্ষ্যে বীজ পরীক্ষার সময় অনেক ক্ষেত্রে বীজে ফাংগাস, ব্যাকটেরিয়া দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে অথবা বীজ নরম হয়ে গেছে বা খারাপ গন্ধ বের হচ্ছে। এই সব বিভিন্ন কারণে বীজের স্বাস্থ্যের প্রতি খেয়াল রাখা দরকার। স্বাস্থ্য সম্মত পুষ্ট বীজ নিশ্চিত হবার জন্য কৃষকদের দেয়া তথ্যগুলো বেশ সাহায্য করে। বাস্তব অবস্থার প্রেক্ষিতে অনেক সময় বীজ শোধন করার প্রয়োজন হতে পারে। যেমন অনেক ছত্রাক এবং ব্যাকটেরিয়া আছে যা ৫০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রার গরম পানিতে শোধন করা যায়। যদি এমন অবস্থা দেখা যায় কোন না কোন কারণে বীজ, রোগে আক্রান্ত হয় সে ক্ষেত্রে ঐ বীজের ব্যাপারে অবশ্যই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কেননা ঐ সকল রোগাক্রান্ত বীজের কারণে অন্য সকল বীজ নষ্ট হয়ে যাবার যথেষ্ট সম্ভাবনা থেকে যায়।
৩. প্রকৃত বা খাঁটি বীজ
বীজ হলেই কি সেটা খাঁটি বীজ ? বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই গাছ-গাছালি বা গাছের সব বীজ থেকে চারা গজায় না। কিন্তু বীজ থেকে দ্রুত চারা গজায় এমন খাঁটি বীজ কৃষকের বেশী দরকার। এমন অনেক বীজ আছে যে সব পাখিদের দ্বারা বিস্তার লাভ করে যেমন নিম, বট, অশ্বথ, ডুমুর, জাম ইত্যাদি। কৃষক সব সময় প্রকৃত উৎস থেকে বীজ সংগ্রহ করেন। শুধু তাই নয় তারা বীজ সম্পর্কে প্রকৃত তথ্য সংগ্রহ করে রাখেন। কৃষক সব সময় খাঁটি বীজ সংগ্রহ করেন। আর কৃষকদেরও দরকার খাঁটি বীজ।
৪. বীজে আর্দ্রতা
বীজে যদি আর্দ্রতার পরিমাণ বেশী থাকে তাহলে চারা গজানোর ক্ষমতা কমে যায়। অনেক সময় চারা গজায় না। পাশাপাশি এ ধরণের বীজ কৃষক সংরক্ষণ করে ক্ষতিগ্রস্থ হন। সে কারণে যতটা সম্ভব বীজের আর্দ্রতা কম এমন বীজ সংগ্রহ করতে হবে। সাধারণভাবে কৃষক পর্যায়ে বীজ সংগ্রহের বেলায় ১৪% আর্দ্রতা গ্রহণযোগ্য। তবে এমন বীজও আছে যে সব বীজের আর্দ্রতা ১২% এর বেশী গ্রহণ যোগ্য নয়। এসব কারণে বীজের আর্দ্রতার দিকটি অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে। একটা তথ্য মনে রাখা দরকার সেটা হচ্ছে বীজের আর্দ্রতা যদি ১% কমানো যায় তাহলে ঐ বীজের সুস্থ থাকার পরিমাণ দ্বিগুণ হয়।
৫.লোকায়ত পদ্ধতিতে বীজ পরীক্ষা
কৃষক পর্যায়ে বীজের পরীক্ষা যেমন বীজের আর্দ্রতা, চারা গজানোর ক্ষমতা, বীজের পুষ্টতা ইত্যাদি পরীক্ষাগুলো কৃষক পরিবারের মহিলারা করে থাকেন। মূলত পরিবারের মহিলারাই বীজের যাবতীয় কাজ করে থাকেন। গ্রামে মা বোনেরা পানিতে বীজ দিয়ে দেখেন বীজ ভাল আছে কি না। যে সব বীজ পানির ওপর ভেসে ওঠে সেসব বীজ খারাপ বলে বিবেচিত হওয়ায় বাতিল করেন। তারা বীজের চারা গজানোর পরীক্ষা করেন- কাদা মাটিতে বীজ দিয়ে ৯ দিন অপেক্ষা করেন। নয় দিন পর দেখেন বীজ থেকে কি পরিমাণ চারা গজিয়েছে। যদি দেখেন যে চারা গজানোর পরিমাণ কম, তাহলে সে বীজ চাষাবাদ করার জন্য আর দেবেন না। এছাড়া বাংলাদেশের কোন কোন অঞ্চলের কৃষক কলাপাতার ডগা এবং মানকচুর ডগার ভেতর বীজ রেখে বীজ থেকে চারা গজানোর পরিমাণ নির্ধারণ করেন। তারা বিভিন্ন লোকায়ত পদ্ধতিতে বীজ পরীক্ষা করে নিশ্চিত হন বীজ ভাল কি না। এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে সামাজিক বীজসম্পদ কেন্দ্রে মাঝে মাঝে বীজ পরীক্ষা করে নিশ্চিত হতে হবে বীজ ভাল আছে কি না। যদি বীজ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া না যায় তাহলে কৃষক ভীষণ রকম ক্ষতি গ্রস্থ হবেন।
৬. যে সব প্রাকৃতিক বিষয় বীজ অঙ্কুরোদগমকে প্রভাবিত করে
প্রাকৃতিক যে সকল বিষয় বীজের অঙ্কুরোদগমকে প্রভাবিত করে সে সব হচ্ছে পরিমাণ মতো পানি, বায়ু (অক্সিজেন), তাপ ও আলো। এগুলোর মধ্যে পানি, অক্সিজেন ও তাপ বীজ অঙ্কুরোদগমের ওপর বেশী প্রভাব ফেলে। অঙ্কুরোদগমের ক্ষেত্রে বীজ পানি কি পরিমাণ গ্রহণ করবে বা শুষে নিবে এটা নির্ভর করে কয়েকটি বিষয়ের ওপর যেমন – পানির রাসায়নিক উপাদান এর মধ্যে একটি।
আমরা জানি, পানিতে দুই মলিকুল হাইড্রোজেন এবং এক মলিকুল অক্সিজেন উপাদান থাকে। অর্থাৎ দুই মলিকুল হাইড্রোজেন এবং একটি মলিকুল অক্সিজেন মিলে পানির সৃষ্টি হয়ে থাকে। এটা আমরা জানি, কিন্তু প্রাকৃতিকভাবে যে পানি পেয়ে থাকি, তাতে হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন ছাড়াও আরো অনেক উপাদন যেমন আইরন বা কোরিন ও অন্যান্য থাকে যা বীজ থেকে চারা গজানোর ক্ষেত্রে বীজকে প্রভাবিত করে থাকে। শুধু পানির এই রাসায়নিক উপাদানগুলোর ওপরই নির্ভর করে, বীজ, কি পরিমাণ পানি গ্রহণ করবে।
ক. বীজের খোসার পানি শোষণের ক্ষমতা
চারা গজানোর পূর্বে কোন বীজ একদিন, কোন বীজ দুইদিন এরকম ভাবে একটা নির্দিষ্ট সময়কাল ভিজিয়ে রেখে তারপর চারা গজানোর জন্য বীজ তলায় বীজ দেয়া হয়। এক একটা শস্যের এক এক রকম সময় কৃষক কেন মেনে চলেন ? এর প্রধান কারণ হচ্ছে কৃষক ভাল করেই জানেন, কোন শস্য বীজের খোসার পানি শোষণ করার ক্ষমতা কতটুকু। সে অনুসারেই তারা বীজ, বীজতলায় বীজ বপনের পূর্বে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ভিজিয়ে রেখেই বীজ তলায় বীজ দেন।
খ. প্রাকৃতিক পরিবেশে পানির উপস্থিতি
যে কোন শস্য বীজ কি পরিমাণ পানি গ্রহণ করবে তা সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করে প্রাকৃতিক আবহাওয়ার ওপর। বাংলাদেশে যেহেতু প্রধানত কৃষি ঋতু হচ্ছে তিনটি। গ্রীষ্ম, বর্ষা ও শীত। এক এক ঋতুতে আবহাওয়ায় জলীয় কণার পরিমাণের তারতম্য হয়ে থাকে। আবহাওয়ার জলীয় কনার তারতম্য বীজের পানি শোষণের ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলে। সে কারণে বীজ থেকে চারা গজানোর সময় অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে।
এখানে একটা বিষয় মনে রাখতে হবে সেটা হচ্ছে, বীজে যদি পানি কম হয় তাহলে বীজ থেকে চারা গজানোর ক্ষেত্রে সমস্যা সৃষ্টি হবে। বীজে পানি বেশী বা কম উভয় অবস্থায়ই বীজে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে যায়। ফলে বীজের ভেতরে বিপাকক্রিয়া ঠিক মতো হয় না। তার বাস্তব ফল স্বরূপ দেখতে পাই অস্বাভাবিক চারা গজানো অথবা কোন কোন ক্ষেত্রে একেবারেই চারা গজায় না। বীজ ক্ষেতে আবাদ করার পূর্বে ১০টি থেকে ১০০টি বীজ পরীক্ষা করলেই বীজের প্রকৃত অবস্থা জানা যাবে।
গ. অক্সিজেন
বীজ থেকে চারা গজানোর ক্ষেত্রে অক্সিজেনের প্রয়োজনীয়তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কেননা বীজে যখন চারা গজানোর প্রক্রিয়া শুরু হয় তখন বীজের ভেতরে প্রচুর শক্তি ব্যবহৃত হয়। বীজ এই শক্তি পায় অক্সিজেনের মাধ্যমে। বীজে যখন অঙ্কুর গজানোর প্রক্রিয়া শুরু হয় তখন বাতাস থেকে শ্বাস ক্রিয়ায় মাধ্যমে অক্সিজেন গ্রহণ করে।
ঘ. তাপমাত্রা
চারা গজানোর ক্ষেত্রে বিভিন্ন বীজের জন্য বিভিন্ন তাপমাত্রার প্রয়োজন পরে। বীজ থেকে চারা গজানোর ক্ষেত্রে তাপমাত্রা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এ ক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে যে খুব কম বা খুব বেশী কোনটাই বীজের জন্য ভাল নয়। চারা গজানোর সময়কালের নিজস্ব প্রয়োজন অনুসারেই বীজ তাপ গ্রহণ করে থাকে।
বীজ উৎপাদন ও সংগ্রহ
আমরা জানি যে কোন সপুষ্পক গাছ-গাছালি থেকে প্রাকৃতিক নিয়মে ফুলে পরাগ যুক্ত হয়ে বা পরাগ নিষিক্ত (Pollinated) হয়ে ফল ও বীজ তৈরি হয়ে থাকে। ফুলের পুরুষ কেশর এন্থার থেকে পরাগ এসে ফুলের স্ত্রী কেশর স্টিগমা ও পিষ্টিলের সহায়তায় পরাগ রেনু মিলিত হয়ে ফল ও বীজের সৃষ্টি হয়ে থাকে।
বীজ উৎপাদনের ক্ষেত্রে চিন্তা করতে হবে, প্রকৃতিতে স্বপরাগায়ন (Self pollination) এবং পর-পরাগায়ন (cross pollination) গাছ-গাছালি রয়েছে।
আমরা যদি প্রতিটি শস্যজাত বা গাছ-গাছালির খাঁটি (Pure) বীজ উৎপাদন ও সংরক্ষণ করতে চাই তাহলে এ বিষয় অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে। এখানে স্বপরাগায়ন কয়েকটি গাছ-গাছালির নাম দেয়া হলো। যেমন টমেটো, সীম, সয়াবীন, ফরাসী সীম, বরবটি ইত্যাদি। যেখানে স্বপরাগায়ন গাছ-গাছালি/শস্যের চাষাবাদ করা হবে সেখানে স্বপরাগাযন গাছ-গাছালি থেকেই পরাগ রেনু মিলিত হতে হবে নচেৎ সেখানে গাছ-গাছালি থেকে কোন ফল বা বীজ হবে না। স্বপরাগায়ন গাছ-গাছালি নিজস্ব পরাগ রেনু ছাড়া বীজ উৎপাদন করতে পারে না।
আবার পর-পরাগায়ন গাছ-গাছালির পরাগায়ন নিষিক্তকরণ পদ্ধতি আলাদা। পর-পরাগায়ন গাছ-গাছালির পরাগায়ন করার ক্ষেত্রে অন্য গাছ-গাছালির সহায়তা ছাড়া ফুল ফল বীজ উৎপাদন করতে পারে না। এখানে কয়েকটি পর-পরাগায়ন গাছ-গাছালির নাম দেয়া হলো। ভুট্টা, তরমুজ, কুমড়া, লাউ, সরিষা, মূলা, পিঁয়াজ গাজর করল্লা ইত্যাদি। তবে হ্যাঁ কিছু পর-পরাগায়ন গাছ-গাছালি রয়েছে – যেমন ভুট্টা, মিষ্টিকুমড়া, লাউ ইত্যাদি নিজ হাতের সাহায্যে পরাগায়ন ঘটিয়ে স্বপরাগায়ন গাছ করা যায়। এই সব দিক চিন্তা করে শস্য থেকে খাঁটি বীজ পাবার ক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয় অবশ্যই বিবেচনা করতে হবে। যেমন –
ক. প্রতিটি শস্যের ক্ষেত্রে সঠিক মৌসুম নির্ধারণ করা
খ. সঠিক এলাকা এবং স্থান চিহ্নিত করা। অর্থাৎ মাটি ও কৃষি প্রাকৃতিক পরিবেশ শস্যের জাত সংগ্রহের বেলায় কৃষি পরিবেশ অঞ্চল এর প্রতি খেয়াল রাখতে হবে –
ক. প্রতিটি শস্যের জন্য সঠিক মৌসুম
খ. কীটপতঙ্গ এবং রোগ বালাই রোধ সম্পন্ন কি না
গ. বীজের ক্ষরা সহিষ্ণুতা গুণ আছে কি না
ঘ. পানি সহনশীলতা গুণ আছে কি না
ঙ. বীজ লবণাক্ততা সহনশীল কি না
চাষাবাদের ক্ষেত্রে প্রতিটি শস্যের নিজস্ব সীমানা
আমরা সবাই চাষাবাদ করি কিন্তু কখনই শস্যের আবাদ করার সময় পরবর্তী মৌসুমের জন্য বীজের কথা খেয়াল রাখি না। ফলে অনেক সময় আমরা পরিশ্রম করা সত্ত্বেও পরিমাণগত দিক থেকে ভাল শস্যও পাই না। এর প্রধান কারণ হচ্ছে শস্য চাষাবাদের লক্ষ্যে বীজ বপন বা রোপনের সময় শস্যের চরিত্রের কথা মনে রাখি না। গাছ-গাছালির মধ্যেও প্রাকৃতিক ভাবে চারিত্রিক ভিন্নতা রয়েছে। যেমন- অনেক শস্য আছে স্বপরাগায়নের মাধ্যমে ফুল ফল ও বীজের সৃষ্টি করে থাকে। আবার অনেক শস্য আছে তারা পর-পরাগায়ন এর মাধ্যমে ফুল ও বীজ উৎপাদন করে থাকে। শস্য থেকে খাঁটি বীজ পাবার লক্ষ্যে প্রতিটি শস্যের মধ্যে অনায়াসে পরাগায়ন ঘটতে পারে সেদিক বিবেচনা করে শস্যের পরাগায়নের নিয়মের প্রতি খেয়াল রেখে চাষাবাদ করা দরকার। সে জন্য চাষাবাদের সময় প্রতিটি শস্যের একক দূরত্ব বজায় রেখে আবাদ করতে হবে। শস্যের এই একক দূরত্ব বজায় রেখে চাষাবাদ করলে যে লাভটা হবে, সেটা হচ্ছে শস্যের পরাগায়নের মৌসুমে অনায়াসে পরাগায়ন ঘটবে এবং পরিমাণের দিক থেকে শস্য উৎপাদন বেশী হবে। যত বেশী পরিমাণে সহজে গাছ-গাছালিতে সফল পরাগায়ন হবে তোতবেশী পরিমাণে শস্য বীজ উৎপাদন হবে। গাছ-গাছালির পরাগায়ন ঘটাবার মাধ্যমে হচ্ছে বাতাস, প্রজাপতি, মৌমাছি, ভ্রমর এবং প্রাকৃতিক অন্যান্য প্রাণীদের মাধ্যমে। প্রাকৃতিক উৎস গাছ-গাছালির পরাগায়নের প্রতি লক্ষ্য রেখে কাজ করে না। তারা প্রাকৃতিক নিয়ম অনুযায়ী নিজ নিজ লক্ষ্যে কাজ করে চলেছে। চাষাবাদের সময় আমাদের এমন ভাবে শস্যবীজ রোপন বা বপন করতে হবে; যখন শস্য গাছ-গাছালি বড় হয়ে ফুল ফুটবে তখন যেন পরাগায়ন ঘটকদের অনায়াসে পরাগায়নে অংশগ্রহণ করানো যায়। সে কারণে একটি শস্য থেকে অন্য আরেকটি শস্যের মধ্যে নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। খাঁটি এবং ভাল বীজের শস্য পরিমাণগত দিক থেকে বেশী পাবার জন্য সাধারণত স্বপরাগায়ন গাছ-গাছালি বা শস্যের তুলনায় পর-পরাগায়ন গাছ-গাছালি বা শস্যের একটি শস্য থেকে অন্য শস্যের একক দূরত্ব রাখা জরুরী। এটা এজন্য বেশী দরকার যে, পর-পরাগায়ন শস্য যাতে অন্য শস্যের সঙ্গে পরাগায়ন ঘটাতে না পারে। পর-পরাগায়ন গাছ-গাছালির নিবিড় পরাগায়নের জন্য এই চরিত্রের শস্যের একটি থেকে অন্যটির মধ্যে অবশ্যই একক দূরত্ব বজায় রেখে চাষাবাদ করতে হবে।
বীজের বাড়ন্ত
ক. আমরা বহু পরিশ্রম করে শস্য আবাদ করে থাকি কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই দেখি, যে ফল আশা করি তা পাই না। আমরা মনে করি বীজ বপন বা রোপন করলেই বুঝি ভাল ফলন পাওয়া যাবে। কিন্তু এ চিন্তা করাটা ঠিক নয়। কেননা প্রতিটি শস্যের আলাদা নিজস্বতা আছে। যেমন যে কোন শস্যের প্রকৃতির আবহাওয়া এবং মৌসুমে পছন্দ অপছন্দ আছে। আমরা যদি শস্য উৎপাদনের দিকে একটু নজর করি তাহলে স্পষ্ট দেখতে পাই, যেমন কোন শস্যই এক মৌসুম হয় না। বাংলাদেশেও ফসল উৎপাদনের দিক মৌসুমকে বড় দাগে তিনটি ভাগ রয়েছে। যথা গ্রীষ্মকালীন শস্য, শীতকালীন শস্য এবং বর্ষাকালীন শস্য। এখানেই দেখা যাচ্ছে, সকল ফসল এক মৌসুম পছন্দ করছে না। বুঝার সুবিধাতে আরো একটু স্পষ্ট করে উদাহরণ হিশাবে যদি ধানের কথায় ধরি তাহলে দেখতে পাই ধান তিন মৌসুমেই জন্মে। ধানের জাতের চরিত্রের গুণাগুণ আলাদা হবার কারণে কোন ধান আউশ মৌসুমে (খরা) কোন ধান আমন মৌসুমে (বর্ষা) এবং কোন ধান বোর মৌসুমে (শীত) ভাল হয়। এখানে লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে ধান একই শস্য হওয়া সত্ত্বেও জাতের ভিন্নতার কারণে এক মৌসুম পছন্দ করছে না। একই ভাবে অন্যান্য শস্যও একই মৌসুমে ভাল জন্মে না। এখানে দেখার বিষয় হচ্ছে শস্য থেকে ভাল বীজ ও শস্য পেতে হলে যে শস্য যে মৌসুম এবং আবহাওয়া বেশী পছন্দ করে সেই শস্যকে তার পছন্দের মৌসুমেই চাষাবাদ করতে হবে। নচেৎ সেই শস্য থেকে ভাল বীজ বা শস্য পাওয়া যাবে না। কেননা শস্যের আবহাওয়া ও জলবায়ু সহনীয় না হলে শস্যের বীজ ও শস্য ভাল হবে না। ভাল বীজ ও শস্য ভাল পাবার ক্ষেত্রে ক্ষেতের মাটিরও যথেষ্ট ভূমিকা রয়েছে যা আবহাওয়া এবং জলবায়ুর তুলনায় কোন অংশেই কম নয়। মাটির বেলাও সকল গাছ-গাছালি বা শস্য এক জাতীয় গুণাগুণ সম্পন্ন মাটি পছন্দ করে না। মাটি যতই সারবান হোক এক জাতীয় মাটিতে সকল শস্য ভাল হবে না। ফলে সে শস্য থেকে ভাল বীজেরও আশা করা যায় না। সেজন্য যে শস্য যে মাটিতে (ক্ষেতে) ভাল জন্মে তাকে সেই ধরণের মাটিতেই বপন ও রোপন করতে হবে। বীজের পরিপূর্ণতার ক্ষেত্রে শস্য অনুযায়ী মাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শস্য এবং বীজ পরিপূর্ণভাবে যাতে বিকশিত হয় সে দিক থেকে শস্যের পছন্দ অনুযায়ী মাটি আবহাওয়া এবং প্রাকৃতিক পরিবেশের প্রতি অবশ্য নজর দিতে হবে, অন্যথায় উদ্দেশ্যই পন্ড হবে।
খ. পর-পরাগায়ন শস্যের নিজ চারিত্রিক গুণাগুণ যথাযথ রাখার জন্য অবশ্যই আলাদা করে বপন বা রোপন করতে হবে। পর-পরাগায়ন শস্য প্রয়োজনীয় দূরত্ব বজায় রেখে আলাদা করে চাষাবাদ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কেননা যদি আলাদা করে চাষাবাদ না করা হয়, তাহলে পর-পরাগায়ন শস্যের নিজস্ব চারিত্রিক গুণাগুণ ঠিক থাকে না। উদাহরণ হিশাবে ধরা যাক পাঁচ জাতের মরিচ। প্রতিটি জাতের মরিচের নিজস্ব গুণাগুণ যাতে ঠিক থাকে সেদিক লক্ষ্য রেখে আলাদা আলাদাভাবে পাঁচটি প্লটে পাঁচ জাতের মরিচ গাছ রোপন করা হলো। কিন্তু পাঁচটি প্লটের প্রতিটির মাঝে যদি পর্যাপ্ত পরিমাণে স্থান ফাঁকা রাখা না হয়, তাহলে পাঁচ জাতের মরিচ গাছে একই সময়ে ফল এবং বীজ সৃষ্টি হবে। এর মানে এই, যে পাঁচটি আলাদা আলাদা গুণাগুণ সম্পন্ন জাতের মরিচ থেকে নিজ নিজ গুণাগুণ সম্পন্ন মরিচ উৎপাদন করার লক্ষ্যে আলাদা আলাদা প্লটে রোপন করা হয়েছিল সে উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য পূরণ হলো না। কারণ পাঁচ জাতের মরিচের পাঁচ রকম গুণাগুণ পরিবর্তন হয়ে মিশ্র জাতের মরিচ তৈরি হয়েছে। সে কারণে শস্য বা গাছ-গাছালির পর-পরাগায়নের প্রতি খেয়াল রাখতে হবে। অর্থাৎ একটি জাত থেকে অন্য জাতের প্লটের মাঝে পর্যাপ্ত ফাঁকা রাখতে হবে।
গ. ভাল বীজ তৈরি করার ক্ষেত্রে শস্য/ গাছ-গাছালি এর ব্রিডিং সম্পর্কে ধারণা থাকা দরকার। এছাড়া বেশী পরিমাণে ভাল বীজ উৎপাদনের ক্ষেত্রে বেশী সংখ্যক জাতের বীজ সংগ্রহ এবং রক্ষণাবেক্ষণের ব্যাপারে অবশ্যই যতœবান হতে হবে। ভাল অর্থাৎ গুণ সম্পন্ন বীজ পাবার ক্ষেত্রে বেশী সংখ্যক বীজ বা প্রাণসম্পদের বিষয় অবশ্যই বিবেচনায় আনতে হবে। বীজ বা প্রাণসম্পদের (Genetic Variation) বৈচিত্র্যতা না বাড়ালে গুণগত মান সম্পন্ন বীজ বা শস্য পাওয়া যাবে না। বীজে বৈচিত্র্যতা বাড়াবার সবচেয়ে ভাল পথ হচ্ছে বীজ সংগ্রহ করা। বীজের জাত সংগ্রহের সময় বীজ দেখতে কেমন, রং এর বৈচিত্র্যতা এবং বীজের আকারসহ যত বৈচিত্রপূর্ণ বীজ পাওয়া যায় সংগ্রহ করতে হবে। এখানে প্রশ্ন হচ্ছে, কেন বেশী সংখ্যক বৈচিত্র্যপূর্ণ বীজ বা প্রাণসম্পদ সংগ্রহ করতে হবে বিষয়টা উদাহরণ দিলে বুঝা সহজ হবে। ধরা যাক খাঁটি মিশ্র আট (৮) রংয়ের সীম বীজ পেতে চাই তাহলে প্রথম কমপক্ষে চৌষট্টিটি বিভিন্ন রং এর বাছবিচারবিহীন সীম বীজ নির্বাচন করতে হবে। এই বাছবিচার ছাড়া (randomly) নির্বাচিত চৌষট্টিটি সীম বীজ থেকে খাঁটি মিশ্র আট রং এর সীম বীজ পাওয়ার সম্ভাবনা নিরানব্বই ভাগ নিশ্চিত। এখন নিশ্চয় বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না কেন বেশী সংখ্যক বীজ সংগ্রহ করতে হবে। একটা সামাজিক বীজসম্পদ কেন্দ্র থেকে ভাল বীজ পেতে হলে কমপক্ষে দুই শত পঞ্চাশটি স্বপরাগায়ন গাছ-গাছালির জাত সংগ্রহে থাকতে হবে। তাহলে সেখান থেকে পরিচয় দেবার মত স্বপরাগায়ন গাছ-গাছালির খাঁটি বীজ পাবার যথেষ্ট সম্ভাবনা থাকে। স্বপরাগায়ন গাছ-গাছালি যেমন সীম। পর-পরাগায়ন গাছ-গাছালির বীজ কমপক্ষে পাঁচশতটি বীজ, বীজসম্পদ কেন্দ্রে সংগৃহীত থাকতে হবে। পর-পরাগায়ন গাছ-গাছালি, যেমন ভুট্টা। বীজ সংগ্রহের সময় অবশ্যই মনে রাখতে হবে বেছে বেছে যেন বীজ সংগ্রহ না করি। কেননা এতে করে শস্য বীজের অনেক মূলবান জেনেটিক গুণাগুণ পাওয়া যাবে না, যা প্রয়োজনের সময় পাওয়া খুবই কষ্টকর হবে। সে কারণে মাঠ থেকে শস্য/ গাছ-গাছালির বীজ সংগ্রহের সময় সতর্কভাবে বীজ সংগ্রহ করতে হবে।
কখনোই কেবল মাত্র খুব ভাল বীজ সংগ্রহ করা ঠিক নয়
বীজ সংগ্রহ করার সময় যেন কেবলমাত্র আকর্ষণীয় বীজ সংগ্রহ করা না হয়। মনে রাখাতে শস্য বা বীজের বৈচিত্র্যতা খুবই জরুরী এবং খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ সতর্কতার সাথে পরিচয় দেবার মতো বীজ বৈচিত্র্যসম্পদ সংগ্রহ করি। এখানে পরিচয়দানকারী বীজ বলতে কোন বীজ কোন কোন গুণাগুণের জন্য সংগ্রহ করা হলো, সে সম্পর্কে বীজসম্পদ সংগ্রহকারীকে অবশ্যই পরিস্কার ও দৃঢ় থাকতে হবে। তা না হলে নিজেই একদিকে বীজ নির্বাচনের ক্ষেত্রে অপরাধী হবেন। অন্যদিকে অতিমূল্যবান গুণাগুণ সম্পন্ন বীজ নমুনা সংগ্রহ করা থেকে বঞ্চিত হবেন। মনে রাখতে হবে বীজ নমুনা সংগ্রহ করতে হবে বলেই করা নয়। দায়িত্বের সাথে শস্যের বীজ নমুনা সংগ্রহ করতে হবে।
কন্দ এবং গাছের কাটিং এর বেলায়
শুধুমাত্র কতিপয় গাছ-গাছালির প্রাণসম্পদ কেন্দ্রের আওতায় সংগ্রহ এবং সংরক্ষণ করা হয় না। প্রকৃতিতে এমন অনেক গাছ-গাছালি রয়েছে, তাদের বীজ সংগ্রহ করে রাখা যায় না। যদিও বা সেসব শস্য বা গাছের ফল এবং বীজ হয় কিন্তু বীজের সুপ্ততার সময়কাল অল্প মেয়াদী হবার কারণে বেশী দিন সংগ্রহ করে রাখা যায় না। এ সব বীজকে স্বল্প আয়ুর বীজ বলা হয়ে থাকে। যেমন – আম, জাম, লিচু, কাঁঠাল, বট, পাকুড়, নিম ইত্যাদি। আবার এমন জাতীয় শস্য আছে তাদের বীজ হয় না। যদিও বা বীজ হয়, সে বীজ থেকে ভাল চারা বা শস্য হয় না, সেটা হয় অতি নিম্নমানের। যেমন পান, আলু, কলা, আদা, হলুদ, পটল, কাকরোল, আনারস ইত্যাদি। কৃষি বিজ্ঞানের ভাষায় এসব শস্যকে কন্দ বা টিউমার শস্য বলে। তবে এই সব শস্যের মধ্যে পটল, কাকরোল, আনারস কন্দ ফসল নয়। কিন্তু এই সব শস্যের বীজ থেকে চারা বা শস্য কোনটাই ভাল হয় না। এগুলোও প্রাণসম্পদ। এ সব শস্যেরও বৈচিত্র্যতা সংগ্রহ এবং সংরক্ষণ করা অত্যন্ত জরুরী। এ জাতীয় শস্যের প্রাণসম্পদ সংগ্রহের ক্ষেত্রে বিশেষ করে আদা, হলুদের কান্ড, কলা এবং আনারসের জন্য সাকার (saker) এবং পান, পটল, কাকরোল জাতীয় শস্যের গেড় সংগ্রহ করতে হবে। পটল বা কাকরোলের গেড় হচ্ছে পান, পটল এবং কাকরোল জাতীয় গাছ-গাছালির শিকড়ের স্ফীত অংশ থাকে। এই স্ফীত মূল সংগ্রহ করতে হবে। এরকম গাছ-গাছালির প্রাণসম্পদ এর বৈচিত্র্যতা সংগ্রহ করার প্রথমে পর্যাপ্ত পরিমাণ জায়গা আছে কি না সে বিষয়ে নিশ্চিত হতে হবে। কেননা এ জাতীয় শস্যের বৈচিত্র্যতা সংগ্রহ এবং সংরক্ষণ করে রাখার জন্য বেশী পরিমাণ জায়গার প্রয়োজন হয়। সামাজিক বীজসম্পদ কেন্দ্রের জায়গার সীমাবদ্ধতা রয়েছে। সে দিক লক্ষ্য রেখে প্রতিটি শস্য জাতের কমপক্ষে দুই থেকে তিনটি করে গেড় এবং কাটিং সংগ্রহ করা যেতে পারে। মনে রাখতে হবে প্রতিটি প্রাণসম্পদ আলাদা আলাদা গাছ-গাছালি। এই জাতীয় প্রাণসম্পদ সংগ্রহ এবং সংরক্ষণের সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও যতটা সম্ভব বৈচিত্রপূর্ণ প্রাণসম্পদ সংগ্রহ করা যায় তাই করতে হবে। এ জাতীয় শস্যের বেলায়ও মনে রাখতে হবে শস্য বৈচিত্র্যতা খুবই জরুরী এবং গুরুত্বপূর্ণ।
২. বীজের খাঁটিত্ব রক্ষণাবেক্ষণ
বীজ সংগ্রহ এবং সংরক্ষণ করা হলো চাষাবাদও করা হলো। কিন্তু প্রশ্ন হলো প্রতিটি শস্যের নিজস্ব গুণাগুণ কি তাতে বজায় রয়েছে? যদি প্রতিটি শস্য জাতের নিজস্ব গুণাগুণ বজায় না রাখা যায় তাহলে একদিকে প্রতিটি শস্যের নিজস্ব মূল্যবান গুণাগুণ হারিয়ে যাবে। অন্যদিকে বীজসম্পদ সংগ্রহ ও সংরক্ষণের উদ্দেশ্য লক্ষ্য বাস্তবায়ন হবে না। শুধু তাই নয় অর্থ এবং সময়ের দিক থেকে ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে। এ সব কারণে বীজসম্পদ শুধু সংগ্রহ, সংরক্ষণ এবং চাষাবাদ করেই ক্ষান্ত দিলে চলবে না। একই সংগে প্রতিটি শস্যজাতের বৈশিষ্ট্য রক্ষা রক্ষণাবেক্ষণের প্রতি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করতে হবে। এখানে প্রশ্ন শস্যজাত কখন এবং কিভাবে তার খাঁটিত্ব হারায়। শস্যবীজ যখন বীজসম্পদ কেন্দ্রে সংরক্ষিত অবস্থায় থাকে তখন সে তার খাঁটিত্ব হারায় না। নিয়ম শৃংখলা না মেনে যখন ক্ষেতে শস্য বীজ চাষাবাদ করা হয় তখন সে তার নিজস্বতা হারায়। এখানে একটা কথা মনে রাখতে হবে একটা শস্যের নতুন জাত বের করতে সক্রিয়ভাবে বহুসময় ব্যয় করতে হয়। তাহলে প্রশ্ন কিভাবে শস্য জাতের খাঁটিত্ব রক্ষা করা যাবে। শস্য জাতের চাষাবাদের সময় কয়েকটি পদক্ষেপের দিকে নজর রেখে চাষাবাদ করলে শস্য জাতের খাঁটিত্ব রক্ষার ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যাবে। সেই পদক্ষেপ হচ্ছে –
শস্য জাত বপন/রোপন দূরত্ব
শস্যজাত বপন/রোপন করার সময় একই পরিবারের শস্যজাতের একটি জাতের মধ্য থেকে আরেকটি জাতের ক্ষেতের মাঝখানে অবশ্যই দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। এখানে মনে রাখতে হবে যে স্বপরাগায়ন শস্য এক জাত থেকে অন্যজাতের মধ্যে যে দূরত্ব বজায় রাখা হবে তার তুলনায় পর-পরাগায়ন শস্যজাতের একটি জাত থেকে অন্যজাতের মধ্যে বেশী পরিমাণে দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। পর-পরাগায়ন শস্যজাত একটি জাত থেকে আরেকটি জাতের মধ্যে কমপক্ষে একশত মিটার দূরত্ব বজায় রাখতে হবে।
শস্য বপন/রোপন সময়কাল
একই মৌসুমের সকল শস্য কি এক সময়ে বপন বা রোপন করবেন? তা করা যায় কিন্তু ভাল মানের গুণগত মান সম্পন্ন শস্য এবং তার থেকে বীজ পেতে হলে শস্য বীজ বপন বা রোপনের সময়ের ক্ষেত্রে হেরফের করা উচিত।
অর্থাৎ একই গাছ-গাছালির বিভিন্ন জাতের শস্য একই সময়ে বপন বা রোপন করা থেকে বিরত থাকতে হবে। এমন কি একই প্রজাতির বিভিন্ন জাতের শস্যও একই সময়ে বপন বা রোপন করা থেকে বিরত থাকতে হবে। একই সময়ে অর্থাৎ কয়েকদিন পর পর শস্যজাত বপন/রোপন না করার জন্য সকল শস্য জাতে এক সময়ে ফুল ধরবে না। ফলে এক শস্যজাত অন্য শস্যজাতের মধ্যে মিলন ঘটাবার সুযোগ থাকবে না। ফলে প্রতি শস্যজাতে ফল ও বীজ এক সময়ে হবে না ফলে শস্যজাতের খাঁটিত্ব রক্ষা পাবে।
বাতাসের বাধ
ক্ষেতের মধ্যে যে প্লটে এক জাতের শস্য বপন বা রোপন করা হবে সেখানে স্বাভাবিকভাবে সারি হবে। এক জাতের শস্য প্লটের একটা নির্দিষ্ট সীমানা নিয়ম মাফিক হবে। ফলে এক শস্যজাত থেকে অন্য শস্যজাতের মধ্যে একটা দূরত্ব বজায় থাকবে। আমরা জানি বাতাসের মাধ্যমে পরাগায়ন হয়ে থাকে। বাতাসের মাধ্যমে যদি অন্য কোন শস্যের পরাগরেণু ভেসেও আসে তাহলে তা শস্য প্লটের কিনারা বরাবর বাঁধা প্রাপ্ত হবে। ফলে শস্য প্লটের কিনারা বরাবর শস্যগুলি অন্য শস্যের পরাগরেণুর দ্বারা প্রভাবিত হবার যথেষ্ট সম্বাবনা থাকে। যদি পর-পরাগায়ন গাছ-গাছালি হয়ে থাকে তাহলে তো বাতাসের অন্য পরাগরেণু দ্বারা প্রভাবিত হবেই। এই সব কারণে শস্য প্লটের কিনারার শস্যগুলো থেকে পরবর্তী মৌসুমের জন্য বীজ সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করা যাবে না। যদি শস্য প্লটের কিনারা শস্য থেকে বীজ সংগ্রহ এবং সংরক্ষণ করলে খাঁটিত্ব নিয়ে প্রশ্ন থাকবে।
শস্য ক্ষেতের সীমানার সারি
শস্য ক্ষেতের সীমানা বরাবর যে সব শস্য থাকবে সে সব শস্য থেকে পরবর্তী মৌসুমে বপন বা রোপনের জন্য কোন বীজ সংগ্রহ এবং সংরক্ষণ করা যাবে না। এক্ষেত্রে শস্য ক্ষেতের সীমানা বরাবর সারিগুলো থেকে বীজ সংগ্রহ বা সংরক্ষণ না করে ভেতরের অংশ থেকে বীজ সংগ্রহ এবং সংরক্ষণ করতে হবে। এখানে মনে রাখতে হবে শস্য ক্ষেতের সীমানা বরাবর শস্যগুলি যে কোন ভাবে অন্য শস্যের পরাগরেণুর দ্বারা পরাগায়ন ঘটতে পারে।
ক্ষেতে থেকে অপ্রয়োজনীয় গাছ-গাছালি সরিয়ে ফেলা
প্রকৃতিতে সকল গাছ-গাছালি কোন না কোন গুণ রয়েছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের প্রতি খেয়াল রেখে শস্য ক্ষেতে প্রাকৃতিক নিয়মে জন্মানো অন্যান্য গাছ-গাছালি সরিয়ে ফেলতে হবে। কেননা শস্য যেন অন্য গাছ-গাছালির সঙ্গে পরাগায়ন ঘটাতে না পারে। এখানে লক্ষ্য হচ্ছে শস্য জাতের খাঁটিত্ব রক্ষা করা। শস্যজাতের খাঁটিত্ব রক্ষার জন্য শস্য ক্ষেতের অপ্রয়োজনীয় গাছ-গাছালি সরিয়ে ফেলতে হবে। যেমন- ১. বিভিন্ন রং এর আকারের অপ্রয়োজনীয় গাছ-গাছালি ক্ষেত থেকে তুলে ফেলতে হবে। ২. রোগবালাই বা কীটপতঙ্গ দ্বারা আক্রান্ত শস্য ক্ষেত থেকে তুলে ফেলতে হবে। শস্যজাতের ক্ষতিগ্রস্থ এবং দূর্বলগুলোকে ক্ষেত থেকে তুলে ফেলতে হবে। ক্ষেত থেকে অপ্রয়োজনীয় গাছ-গাছালি/শস্য তুলে ফেলা দরকার বিশেষ করে পর-পরাগায়ন শস্য/ গাছ-গাছালির জন্য।
ঢেকে রাখা
শস্যজাতের খাঁটিত্ব রক্ষার লক্ষ্যে খাঁটি বীজ তৈরীর জন্য শস্যে ফুল ধরার সঙ্গে সঙ্গে সুক্ষ্ম কাপড়ের থলে তৈরি করে অথবা সুক্ষ্ম কাপড় দিয়ে ঢেকে দেয়ার প্রয়োজন হয়। খেয়াল রাখতে হবে, যে আবরণ দিয়ে ঢেকে/আবৃত করা হবে তা যেন বায়ু রোধক না হয় অর্থাৎ বায়ু যেন চলাচল করতে পারে। থলে ব্যবহার এবং আবৃত করার পদ্ধতি ব্যবহারের প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে অন্য প্রজাতি বা জাতের শস্য বা গাছ-গাছালির সঙ্গে পরাগায়ন ঘটাতে না পারে। এ পদ্ধতিতে কীটপতঙ্গ দ্বারা পরাগায়ন রোধ করা হয়। এ পদ্ধতি বেশী ব্যবহৃত পর-পরাগায়ন গাছ-গাছালি বা শস্যে। স্বপরাগায়ন গাছ-গাছালি নিজেই পরাগায়ন ঘটাতে পারে। স্বপরাগায়ন গাছ-গাছালি অন্য গাছ-গাছালি সঙ্গে পরাগায়ন ঘটায় না।
পরাগায়ন পদ্ধতির মাধ্যমে বীজ উৎপাদন
আমরা জানি স্বাভাবিকভাবে প্রজনন পদ্ধতি অর্থাৎ পরাগায়নের মাধ্যমে গাছ-গাছালি বা শস্যের জাত সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করা হয়। পরাগায়ন পদ্ধতি ছাড়াও শস্য জাত সংরক্ষণ করা যায়। তাকে অপরাগায়ন বা অযৌন পদ্ধতিতে শস্যের জাত সংরক্ষণ করা হয়, সে রকম একটা পদ্ধতির নাম হচ্ছে ‘ক্লোনিং’ (Clones)। অযৌন পদ্ধতিতে গাছ-গাছালির বংশবিস্তারের জন্য কোনো প্রজনন অঙ্গ ব্যবহার করে না।
নার্সারী সাহায্যে চারা উৎপাদন
সরাসরি ক্ষেতে বীজ বপন করে সবজি বপন করা সাধারণ পদ্ধতি। সবজি বা অন্য কোন শস্য, গাছ-গাছালি আলাদাভাবে কোন পাত্রে বীজ থেকে চারা তৈরী করে নির্ধারিত স্থানে রোপন করলে ভাল ফল পাওয়া যায়। সে কারণে এখানে নার্সারী মাধ্যমে চারা গজানোর পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
ক. চারা গজানোর জন্য গ্রহণযোগ্য পাত্র নির্ধারণ
সরাসরি বীজ তলায় বীজ বপন করে চারা গজানো রক্ষণাবেক্ষণ এবং খরচের তুলনায় কোন বীজ পাত্রে চারা গজানো রক্ষণাবেক্ষণ খরচ কম। তবে বীজ থেকে চারা গজানোর জন্য পাত্র নির্ধারণ করার সময় খেয়াল রাখতে হবে চারার শিকড় ঠিকমতো যেন বিস্তার করতে পারে, পরবর্তীতে স্বাভাবিক ভাবে যেন বড় হয়।
খ. চারা গজানোর পাত্র প্রস্তুতকরণ
চারা গজানোর জন্য পাত্র প্রস্তুতকরণ বলতে যে পত্রে বীজ থেকে চারা গজানো হবে, সে পাত্র ব্যাকটেরিয়ার বা ছত্রাক কর্তৃক আক্রান্ত কি না। এছাড়া অন্যান্য রোগবালাই কর্তৃক আক্রান্ত কি না নিশ্চিত হতে হবে। অর্থাৎ বীজ থেকে চারা গজানোর পাত্রকে অবশ্যই রোগমুক্ত হতে হবে। বিশেষ করে মাটির পাত্র।
গ. বীজ পাত্রে ব্যবহারের জন্য মাটি তৈরি
চারা গজানোর জন্য বীজ পাত্রে যে মাটির ব্যবহার করা হবে, তা অবশ্যই রোগবালাই মুক্তহতে হবে। এমন কি নার্সারী বা বাগানের রোগবালাই দ্বারা যেন আক্রান্ত না হয়। চারা গজানোর মাটিতে ইট পাথর বা অন্য কোন কণা যেন না থাকে সেদিকে যতœ হতে হবে। কেননা ইট, পাথর বা অন্য কোন শক্ত কণা শিকরের বৃদ্ধিকে বাধা দেয়। মাটির মিশ্রণ এমনভাবে তৈরী করতে হবে, যাতে অনায়াসে আর্দ্রতা এবং বাতাস প্রবেশ করতে পারে। এরপর সমপরিমাণ মাটি বালি এবং কম্পোষ্ট ভাল মতো মিশ্রণ করে বীজ পাত্রে মাটি দিয়ে নিয়ম মতো পূর্ণ করতে হবে।
ঘ. বীজ বপন
আকার আকৃতির দিক থেকে তিন আকারেও বীজ রয়েছে যেমনÑ১. সূক্ষ্ম বীজ ২. মধ্যম আকারের বীজ ৩. বড় আকারের বীজ। এখন প্রশ্ন কোন বীজ কি ভাবে বপন করবেন। যদি বীজ সূক্ষ্ম হয় তাহলে চিকন বালির সঙ্গে মিশিয়ে লাগাতে হবে। মাধ্যম আকৃতির বীজ হলে ছোট ছোট গর্ত করে বপন করতে হবে। বড় আকারের বীজ হলে আঙ্গুলের সাহায্যে বড় গর্ত করে বীজ বপন করতে হবে।
ঙ. বীজ ঢেকে দেয়া
বীজ বপনের পরে কাজ হচ্ছে, বপন করা বীজ ঢেকে দেয়া। মধ্যম আকারের বীজ যে ছোট ছোট গর্ত করে লাগানো হয়েছে সেই গর্তের পাশ্বের মাটি দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। বড় আকারের ক্ষেত্রে বীজের আকারের দ্বিগুণ গর্ত করে বীজ বপন করে পাশ্বের মাটি দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। আর সূক্ষ্ম বীজগুলো যেহেতু চিকন বালির সঙ্গে মিশিয়ে বপন করা হয়েছে সে কারণে আলাদা মাটি দিয়ে ঢেকে না দিয়ে উপরিভাগ সমান করে দিতে হবে।
চ. বপন করা বীজের পরিচর্যা
বীজ বপন করেই কাজ শেষ নয়। বীজ বপন করার পর বপন করা ঠিকমত পরিচর্যা না করলে বীজ থেকে ঠিক মতো চারা গজাবে না। সে কারণে বপন করা বীজ থেকে চারা গজানোর জন্য পরিচর্যা হিশাবে বপন করা বীজকে তাপমাত্রা উঠা নামার থেকে রক্ষা করতে হবে। অধিক তাপমাত্রা যেমন বপন করা বীজের ক্ষতি করে ঠিক তেমনি অল্প তাপমাত্রাও ক্ষতি করে। তাপমাত্রা বায়ুর আর্দ্রতা এবং বায়ুর অক্সিজেনকে প্রভাবিত করে। শুষ্ক মাটি যেমন চারা গজানো প্রক্রিয়াকে বন্ধ করে দেয় ঠিক তেমনি অধিক পানিতে বীজ পঁচে যায়। যদি মাটি শুষ্ক হয়ে যায় তাহলে পরিমিত পরিমাণে পানি দিতে হবে। সেক্ষেত্রে যে বীজ বপন করা হয়েছে তা ঢেকে দেয়া যেতে পারে। তবে বীজ থেকে প্রথম পাতা বের হওয়া পর্যন্ত প্রতিদিন দেখতে হবে এবং প্রয়োজন মতো পরিচর্যা করতে হবে। দ্বিতীয় পর্যায়ে পাতা বের হবার পর যখন পূর্ণতা লাভ করবে বুঝতে হবে চারা নির্ধারিত স্থানে লাগাবার সময় হয়েছে।
ছ. চারা স্থানান্তর
এটা এক স্থান থেকে চারা নিয়ে অন্য বা নির্ধারিত স্থানে লাগানোর পদ্ধতি। এটা একটি চারার পাতা এবং শিকড়ের বাড়ন্তের ক্ষেত্রে প্রথম পদক্ষেপ। চারা অন্য স্থানে স্থানান্তর করার লক্ষ্যে চারা উঠানোর সময় ভাল কৃষিযন্ত্র (নিড়ানী) ব্যবহার করতে হবে। এটাও খেয়াল রাখতে হবে চারার শিকড় যেন ক্ষতিগ্রস্থ না হয় । চারা উঠানোর পূর্বে চারার গোড়া ভাল ভাবে পানি দিয়ে ভিজিয়ে নিলে চারা উঠানো বেশ সহজ হয়। চারা যদি খুবই নরম হয় তাহলে কমপক্ষে চার/পাঁচ সপ্তাহ পর চারা স্থানান্তরের জন্য উঠানো উচিত। আর অন্যস্থান অথবা নির্ধারিত স্থানে লাগানোর সঙ্গে সঙ্গে সরাসরি সূর্যের আলোর সংস্পর্শে না আসে। সে দিক খেয়াল রেখে কমপক্ষে এক সপ্তাহ অপেক্ষা করার পর সূর্যের আলোর সরাসরি সংস্পর্শে আনা যেতে পারে।
চ. চারা লাগানোর পদ্ধতি
যেহেতু একটা শস্য তিন থেকে চার মাস ক্ষেতে থাকে, বীজ বপনের পর থেকে চারা গজানো এবং স্থানান্তর করার সময় পর্যন্ত কমপক্ষে তিন থেকে চার সপ্তাহের প্রয়োজন হয়। চারা স্থানান্তরের জন্য চারার পাতার সংখ্যা এবং আবহাওয়ার প্রতি খেয়াল রাখা দরকার। বীজতলায় চারা গজানো এবং স্থানান্তর খরচ বেশী। সে কারণে খুবই অল্প মেয়াদী শস্যের চারা গজিয়ে স্থানান্তর করা ঠিক হবে না। ভেন্ডি, মূলা, করল্লা জাতীয় শস্য সরাসরি ক্ষেতে বীজ বপন করা দরকার। টমেটো, বেগুন, কপি ইত্যাদি বীজ তলায় চারা তৈরি করে স্থানান্তর করা যেতে পারে। মনে রাখতে হবে সরাসরি বীজ থেকে উৎপাদিত শস্যের তুলনায় স্থনান্তরিত চারা থেকে উৎপাদিত শস্যের গুণগতমান এবং পরিমাণের দিক থেকে বেশী হয়।
শস্য মাড়াই এবং বাছাই করণ
ক. শস্য মাড়াই
উন্নত মানের শস্য ও বীজ নিশ্চিত করার জন্য অবশ্যই সতর্কতার সঙ্গে শস্য মাড়াই করতে হবে। কেননা বীজই উন্নত মানের শস্য জাতের নিশ্চিয়তা দিতে পারে যা মৌসুমে রোপন করা হয়েছিল। যেমন- ধরাযাক লম্বা কালো রংয়ের বেগুন রোপন করা হয়েছিল। এখন সেই বেগুনের ফল থেকে আগামি মৌসুমের জন্য সতর্কতার সঙ্গে উন্নত মানের বীজ সংগ্রহ করতে হবে। পর-পরাগায়ন গাছ-গাছালি থেকে সংখ্যা এবং পরিমাণের দিক থেকে বেশী পরিমাণে বীজ সংগ্রহ করতে হবে। বীজ যখন পূর্ণমাত্রায় পরিপক্ক হবে; কেবল তখনই বীজ সংগ্রহের জন্য শস্য মাড়াই করতে হবে। বীজ অধিক মাত্রায় পরিপক্ক হলে সে বীজ পরবর্তী মৌসুমের জন্য সংগ্রহে রাখা যাবে না। কারণ সে বীজ গাছে থাকা অবস্থায় রোগবালাই দ্বারা আক্রান্ত হয়ে থাকে। সে জন্য বীজ সুপরিপক্ক হওয়া মাত্র মাড়াই এর জন্য ক্ষেত থেকে সরিয়ে ফেলা দরকার। যদি বীজ অতিরিক্ত পেকে যায় তখন স্বাভাবিক ভাবেই বয়স বেরে যায়। বীজের বয়স বেড়ে যাবার কারণে বীজ দূর্বল হয়ে যায়। ফলে সে বীজ থেকে চারা গজাবে না আর গজালেও চারা দূর্বল হবে।
ঠিক একই অবস্থা ঘটবে যদি অপরিপক্ক বীজ সংগ্রহ করা হয়। এই অপরিপক্ক বীজ থেকে চারা গজাবে না। সে কারণে ফসল পাকার মৌসুমে শস্য ক্ষেত দেখে দেখে সিদ্ধান্ত নিতে হবে কখন কোন শস্য মাড়াই করবেন। সাধারণত ফল জাতীয় সবজির প্রচুর বীজ হয় যেমন লাউ, ধন্দল, করল্লা, বেগুন ইত্যাদি। এদের বীজ পরবর্তী মৌসুমে ব্যবহার করার জন্য ফলের মধ্যের অংশ থেকে বীজ সংগ্রহ করতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে এক বয়সের বীজ যেন সংগ্রহ করা হয়। অধিক পরিপক্ক অথবা কমপরিপক্ক পরবর্তী মৌসুমে ব্যবহারের জন্য এ রকম বীজ সংগ্রহ করা যাবে না।
বীজ সংগ্রহের সময় যে পরিমাণ বীজ সংগ্রহ কারা হবে তার চেয়ে ৫০% বেশী বীজ সংগ্রহ করতে হবে। কেননা বীজ সংগ্রহের সময় ঘাটতি হবে, অঙ্কুর গজানো সময় ঘাটতি এবং কোন প্রাকৃতিক কারণে শস্য ক্ষেতে নষ্ট হয়ে যেতে পারে। যেন বীজ ঘাটতি সমস্যায় পরতে না হয়। শস্য মাড়াই সম্পন্ন হওয়া মাত্র প্রতিটি শস্য জাতে লেবেল লাগাতে হবে। লেবেল এ কারণে লাগাতে হবে, যাতে শস্য মিশ্রণ হয়ে না যায়।
কেমন করে নিশ্চিত হবেন বীজ পরিপক্ক হয়েছে
শস্যের বীজ এর পূর্ণ পরিপক্কতা বুঝাতে হলে ক্ষেত পর্যবেক্ষণ করে অভিজ্ঞতা বাড়াতে হবে। কেননা সকল শস্য এক সঙ্গে পাকে না। আবার একই শস্যের অন্যান্য জাতের চারিত্রিক গুণাগুণও ভিন্ন। একই শস্যের বিভিন্ন জাত রয়েছে। জাতের ভিন্নতার কারণে এক সঙ্গে পাকে না। যেমন ধান। ধানের বিভিন্ন জাত রয়েছে কিন্তু ধানের সকল জাত এক সঙ্গে পাকে না। তবে এখানে শস্য কখন পরিপক্ক হয় সে সম্পর্কে কিছু লক্ষণ সম্পর্কে বলার চেষ্টা করা হয়েছে। যেমন-
১. এমন কিছু দানা শস্য আছে সে শস্য পরিপক্ক হবার সময়ে এক রকম কালো দাগ দেখা যায়। শস্য যখন পরিপূর্ণ ভাবে পরিপক্ক হবে তখন কালো দাগ আরো স্পষ্ট হয়ে উঠবে।
২. এমন কিছু শস্য আছে যে সব শস্য পরিপক্ক হলে তাতে টোকা দিলে ফাঁপা শব্দ শোনা যাবে এই ফাপা শব্দ শুনে বুঝতে হবে শস্য পরিপক্ক হয়েছে কি না। যেমন তরমুজ, স্কোয়াশ ইত্যাদি।
৩. এমন কিছু শস্য আছে সেসব পরিপক্ক হবার সঙ্গে সঙ্গে রং আকারে আকৃতি পরিবর্তন হয়ে যায়। যেমন টমেটো, মরিচ, লাল রং ধারণ করে। সীম জাতীয় শস্যের খোসার রং হলুদ অথবা বাদামী রং ধারণ করে। বেগুনের রং হলুদ রং ধারণ করে।
৪. এমন কিছু জাতীয় শস্য আছে তাদের ফল পরিপক্ক হবার সঙ্গে সঙ্গে খোসা ভেঙ্গে যায়।
৫. আবার এমন কিছু শস্য আছে সে সব পরিপক্ক হওয়া মাত্র বোটা থেকে ফল খসে পরে যায়।
৬. এমন কিছু শস্য আছে ফল পরিপক্ক হবার পর গাছ থেকে নেমে পেরে হয়েছে কিন্তু ভাল বীজ পাবার জন্য ফল গাছ থেকে পেরে নেয়ার পরও কয়েক সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হয়। এসব শস্যের উপরের অংশ পরিপক্ক হবার সবচিহ্ন থাকলেও ভেতরের অংশ সম্পূর্ণ মাত্রায় পরিপক্ক নয়, সে জন্য ঘরে রেখে কয়েক সপ্তহ অপেক্ষা করতে হয়। যেমন-লাউ, স্কোয়াস, ধুন্দল ইত্যাদি।
খ. শস্য থেকে বীজ বের করে পরিস্কার করা
ফল থেকে বীজ সংগ্রহ করার সময় দেখা যায়, ফল এবং বীজ ভেজা অবস্থায় থাকে। ফলের ভেতরে বীজ শাঁসের সঙ্গে লেগে থাকে। ফলের ভেতর থেকে বীজ হাত দিয়ে নতুবা চাকু দিয়ে বের করতে হয়ে। অনেক সময় গাঁজানো পদ্ধতিতে (Fermentation) ভেজা বীজ শাঁস থেকে আলাদা করা যায়। পদ্ধতিটা হচ্ছে ফল থেকে বীজ বের করে পরিমাণ মতো পানি মিশিয়ে ঝাঁকুনি দিয়ে এক থেকে দুই দিন ভাল করে ঢেকে রাখলে শাঁস এবং বীজ আপনা থেকে আলাদা হয়ে যায়। তখন দেখা যাবে বীজ পানির ওপরে ভেসে উঠবে। তখন বীজকে আলাদা করে ভালভাবে পানি দিয়ে পরিস্কার করে শুকিয়ে নিতে হবে। যেমন- বেগুন, কুমড়া, টমেটো, করল্লা লাউ ইত্যাদি।
শুষ্ক বীজ
ফল জাতীয় শস্যের শুকনা বীজ থেকে বীজ সংগ্রহ করতে হলে হাত দিয়ে বীজ এবং বীজের খোসা আলাদা করতে হবে অথবা থলের ভেতরে বীজ রেখে ঝাঁকুনি দিয়ে বীজ আলাদা করতে হবে। তবে থলেতে ঝাঁকুনি বা কোন লাঠি দিয়ে আঘাত করার সময় বীজের যেন কোন রকম ক্ষতি না হয় সে দিকে নজর রাখতে হবে। যেমনÑবাঁধা কপি, ফুল কপি, সরিষা, মটরশুটি ইত্যাদি।
এখানে কিছু কিছু বিষয়ে শস্য মাড়াই কালে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। যেমন মেঘলা আকাশ, বৃষ্টির দিন, সকাল বেলা, যখন শিশির পড়ে বা কুয়াশা থাকে এবং ভর দুপুরে শস্য মাড়াই করা ঠিক নয়। খেয়াল রাখতে হবে মাটির সংস্পর্শে বীজ যেন না আসে। কেননা এতে বীজে অণুজীব দ্বারা আক্রান্ত হবার সম্ভবনা থাকে।
ফল শস্য থেকে শুষ্ক বীজ
পাকা শস্য শুকানোর পর সেখানে থেকে বীজ সংগ্রহ করতে হবে। যেমন মরিচ ও ভেন্ডি। তবে এ ধরণের বীজ বাতাসের সহায়তায় শুকানোর সময় বিভিন্ন ভাবে সংক্রামণ হবার সম্ভাবনা থাকে। যদি অন্য কোন শস্য মিশ্রিত বা অপ্রয়োজনীয় কিছু মিশ্রিত হওয়াকেও সংক্রামণ বলে ধরে নেয়া হবে। এ বিষয়ে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে। এ ছাড়া মনে রাখতে হবে ভাল বীজ যেন তৈরি করা হয়।
বীজ মূল্যায়ন বৈশিষ্ট্যকরণ এবং উৎপাদন
বীজের বা শস্যের জাত বৈশিষ্টকরণ মূল্যায়ন করতে হবে অবশ্যই কৃষকের প্রয়োজনের দিক থেকে। সে জন্য বীজের বা শস্যের জাত বৈশিষ্ট্যকরণ এবং মূল্যায়ণের যে মানদণ্ড ঠিক করা হবে সেটা যেন কৃষকের প্রয়োজনের প্রতিফলন দেখা যায়। সাধারণত বীজের বা শস্যের জাত বৈশিষ্টকরণ এবং মূল্যায়ণের মানদন্ড ব্যবহার হয়ে থাকে সে সব হচ্ছে-
১. উত্তম খাদ্য নির্বাচনের মানদণ্ড (Gastronomic Criteria)
ক. স্বাদ (Taste)
খ. রান্নার সময়কাল (Cooking Time)
২. খাদ্য প্রস্তুতি এবং প্রক্রিয়াজাত করার সুবিধা থাকতে হবে (Preparation and Processing Opportunities)
৩. শস্য ভান্ডারে প্রয়োজনীয় সময়কাল পর্যন্ত রাখা যায় (Storage Quality)
৪. কৃষিতান্ত্রিক মানদন্ড (Agronomic Criteria)
ক. আগাছার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বড় হবার ক্ষমতা (Ability to Compete with Weeds)
ক. শস্যজাতের বৈশিষ্ঠাবলীর নথিকরণ
শস্যজাতের বৈশিষ্ট্য বা গুণাগুণ নথিকরণ কাজ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ কাজের ওপর নির্ভর করে আগামি কাজের সফলতা। শস্য বা বীজের জাত নথিকরণ এমন ভাবে করতে হবে যাতে সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়ক হয়। এছাড়া শস্যজাতের বংশের যাবতীয় গুণাগুণ যেন খালি চোখে দেখা যায়। যেমন গাছ-গাছালির বাড়ন্ত (Growth) কেমন, পাতার আকার, আকৃতি রং কেমন, দানাদার শস্যের বেলায় দানার উপরের আবরণের রং কেমন, শস্য দানার আকার, আকৃতি কেমন, শস্যবীজের উপর কোন লোম বা ক্ষুদ্র শুং আছে না কি না। শুং যদি থাকে তাহলে তা দেখতে কেমন, গাছ-গাছালি/শস্যের রং (ফুল, পাতা, কা- ফুল, বীজ) কেমন, গাছ-গাছালি/শস্য লতা/গুল্ম/বৃক্ষ/কন্দ/তৃণ। বীজের খোসার আকার আকৃতি রং এবং শিম জাতীয় শস্যবীজ পেকে যাবার পর খোসা ফেটে যায় কিনা এবং কেমন হয়, ইত্যাদি নথিকরণ করতে হবে। এই সব তথ্যগুলো থেকে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে জাত উন্নত করা হবে না নতুন জাত তৈরি করা হবে অথবা অন্য কোন বিশেষ কাজে ব্যবহার করা হবে।
খ. নিবন্ধণকৃত তথ্য
নতুন কোন শস্যের বীজ বা প্রাণসম্পদ সংগ্রহের সঙ্গে সঙ্গে তথ্যগুলো নির্দিষ্ট নিবন্ধন পত্রে নথিভুক্ত করতে হবে। বীজ বা প্রাণসম্পদের মৌলিক সবগুলো তথ্য বীজ বা প্রাণসম্পদ সংগ্রহকারীকে নথিভুক্ত করতে হবে। যেমন নতুন সংগ্রহ করা বীজের তথ্যে (Accession data) বৈজ্ঞানিক, সাধারণ এবং এলাকার নাম থাকতে হবে। শস্যের জাতের ক্ষেত্রেও শস্যটি কি কৃষকের জাত, বন্যজাত না অন্য কোথাও থেকে সংগ্রহ করা জাত সে সব থাকতে হবে। এখানে নিবন্ধন পত্রের একটা নমুনা দেয়া হলো-
প্রবেশ/গ্রহণ সংখ্যা (Accession No) | ০০০১ |
বৈজ্ঞানিক নাম (Scientific Name) | Setaria italica |
সাধারণ নাম (Common Name) | বড় কাউন |
শস্যের এলাকার নাম (Vernacular Name) | জোয়ার |
শস্য জাত (Crop Variety) | কৃষকের জাত |
গ. শস্য জাতের তথ্য সংগ্রহ
বীজ বা শস্যের তথ্য সংগ্রহ করা হবে তখন বীজ বা শস্যের যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ করতে হবে। তথ্য সগ্রহের ফরমে তথ্য সংগ্রকারীর নাম, যে এলাকা থেকে বীজ বা শস্য সংগ্রহ করা হয়েছে সে এলাকার নাম, বীজ বা প্রাণসম্পদ দাতার নাম ঠিকানা অবশ্যই উল্লেখ থাকতে হবে।
ঘ. শস্য/বীজের প্রাথমিক মূল্যায়ন
প্রাথমিকভাবে শস্য/বীজ মূল্যায়ন করার সময় স্বাভাবিক তথ্য নথিকরণের পাশাপাশি নির্দিষ্ট শস্য প্রজাতির অতিরিক্ত গুণাবলি যা কৃষকের দিক থেকে শস্য প্রজাতির কাঙ্খিত চারিত্রিক গুণাবলী বেশী করে দেখতে হবে। যেমন নির্দিষ্ট শস্য প্রজাতির/জাতের অঙ্কুরোদগমের হার বপন/রোপন সময়কাল, ফুল ধরা থেকে শুরু করে পূর্ণতাপ্রাপ্ত হবার সময়কাল, গাছ-গাছালির উচ্চতা ইত্যাদি।
শস্য/শস্য বীজের চারিত্রিক গুণাগুণ অবশ্যই ক্ষেত পর্যবেক্ষণ করেই করতে হবে। শস্য গাছ-গাছালি জন্মনো থেকে শুরু করে সকল সময় অর্থাৎ শস্য ক্ষেতের প্রাকৃতিক অবস্থান অনুসারে শস্য গাছ-গাছালি বড় হওয়া থেকে শুরু করে পুরো ক্ষেতের শস্যে পরিপূর্ণভাবে ফুল ধরা, পরিপূর্ণতা প্রাপ্ত হওয়া পর্যন্ত প্রতিটি সময়কালের পর্যবেক্ষণের তথ্য নোট বুকে নথিভুক্ত করতে হবে। এ কাজটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কেননা শস্য ক্ষেত থেকে ঘরে আসার পর সঠিক মূল্যায়নের মাধ্যমে শস্যজাত ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া অনেক সহজ হয়।
শস্যজাতের বৈশিষ্ট্যকরণ করার সময় প্রতিটি শস্যজাত আলাদা আলাদা দৈবচয়নে (random) নির্বাচন করে পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে শস্য/জাতের চারিত্রিক গুণাগুণ লিপিবদ্ধ করতে হবে। কি পরিমাণ শস্য গাছ-গাছালির চারিত্রিক গুণাগুণ গ্রহণযোগ্য মানদন্ডের ভিত হিশাবে গ্রহণ করা হলো তা নিবন্ধনভুক্ত করতে হবে। অর্থাৎ কি পরিমাণ স্বপরাগায়ন এবং পর-পরাগায়ন শস্য গাছ-গাছালির চারিত্রিক গুণাগুণ লিপিবদ্ধ করা হলো তা নিবন্ধনভুক্ত করতে হবে। পর-পরাগায়ন (Cross Polinated) শস্য গাছ-গাছালির চারিত্রিক গুণাগুণ নিবন্ধন করার সময় পর্যবেক্ষণ করতে হবে শস্যের শীষ, ফুল/ফুলের গুচ্ছ এবং বীজের খোসা। প্রতিটি পর-পরাগায়ন শস্য প্রজাতি কমপক্ষে ৩০-৩৫ টি এবং স্বপরাগায়ন গাছ-গাছালি/শস্য কমপক্ষে ৫-১০ টি।
কৃষকের জন্য নির্বাচিত জাতের মানদন্ড
বিভিন্ন প্রয়োজনের দিক দৃষ্টি রেখে শস্যজাতের মানদন্ড নির্ধারণ করা হয়ে থাকে। কৃষকদের জন্য শস্যজাত নির্বাচনের মানদন্ড আলাদাভাবে নির্ধারণ করা হয়ে থাকে। যে মনদন্ড কৃষকের প্রয়োজনের প্রতি খোয়াল রেখে শস্যজাত নির্বাচন করা হয় সে শস্য কৃষকের।
কৃষকের জন্য নির্বাচিত শস্যজাত উৎপাদন এবং পুনরুৎপাদন করার পূর্বে কিছু সাবধানতা অবলম্বন করা দরকার।
কৃষকদের জন্য নির্বাচিত শস্যজাত নির্বাচন করার সময় কতিপয় সাবধানতা অবলম্বন করা প্রয়োজন হয়। যেমন-
- শস্য উৎপাদনের জন্য এমন জমি/ক্ষেত নির্বাচন করতে হবে, প্রকৃত ধরণের মাটি জমি/ক্ষেত থেকে শস্য জাত সংগ্রহ করা হয়েছে ঠিক অনুরূপ মাটি না পেলেও তার খুব কাছাকাছি গুণাবলীর মাটি যেন হয়।
- বীজ বপন/রোপনের অনুকূল সময় ও দিন নির্বাচন করতে হবে। নির্দিষ্ট শস্যের বীজ উৎপাদনের এবং সংগ্রহের হার, এক শস্যের জমির প্লট থেকে অন্য শস্য প্লটের মধ্যে প্রয়োজনীয় দূরত্ব যেন বজায় রাখা হয়।
- শস্যের সঙ্গে প্রকৃত সংস্কৃতি চর্চা অনুসরণ করা।
- শস্য পরিপূর্ণতা প্রাপ্ত হবার সঙ্গে সঙ্গে সঠিক সময়ে মাড়াই করা। অযথা দেরি অথবা তাড়াতাড়ি না করা। এখানে খোসাবিহীন বীজের তুলনায় খোসাআবৃত বীজ বেশী পরিমাণে সংগ্রহ করতে হবে।
- সবচেয়ে বেশী সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে এক বীজের সঙ্গে অন্য বীজের সংক্রামণ যেন না হয়।
কিভাবে বীজ থেকে অন্য বীজ সংক্রামন ঘটে
যখন ক্ষেতে শস্য বড় হতে থাকে এবং শস্যে ফুল এলে তখন পাশের ক্ষেতের অন্য শস্যের পরাগ এসে শস্যবীজকে সংক্রামিত করে। জেনে রাখা ভাল যে, এটা শস্য/গাছ-গাছালির প্রজনন প্রকৃতির ওপর নির্ভর করে।
অনেক সময় দেখা যায় মূল ক্ষেতে শস্য বীজ বপন/রোপন করার সময় ঠিক মতো বীজ/চারা বাছাই না করেই চাষাবাদ করা হয়ে থাকে। শস্য যখন বড় হয় তখন দেখা যায় শস্য মিশ্র হয়ে গেছে। এছাড়া শস্য মাড়াই এবং পরিস্কার করার সময়ও এক বীজ অন্য বীজের সঙ্গে সংক্রামিত হয়ে যায়।
পর-পরাগায়ন শস্য জাত পৃথকভাবে চিহ্নত করার জন্য নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। এছাড়া পর-পরাগায়ন প্রজনন প্রকৃতির শস্যজাতের বিশুদ্ধতা রক্ষা করা কষ্টকর। মনে রাখতে হবে গাছ-গাছালির পর-পরাগায়ন ঘটায় প্রধানত বাতাস, কীট-পতঙ্গ ইত্যাদি।