বেগম রোকেয়া, সুফিয়া কামাল, নুরজাহান বেগম এবং আরও পথিকৃৎ – সালাম জানাই

ফরিদা আখতার || Sunday 06 December 2015

বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন (১৮৮০-১৯৩২) বাংলাদেশের শুধু নন, পুরো দক্ষীণ এশিয়ায় উল্লেখ করার মতো একজন নারী মুক্তি দার্শনিক ও পথ প্রদর্শক। প্রায় শত বছর আগে তিনি যা লিখেছেন এবং করেছেন আজকের দিনেও অনেকে সেভাবে ভবিষ্যত কল্পনা করে ভাবতে পারেন না, কাজ করতে পারেন না। এটা আমি হলপ করে বলতে পারি। বেগম রোকেয়াকে নারী শিক্ষায় অবদান রাখার জন্যে বেশী উল্লেখ করা হয়, কিন্তু রোকেয়া রচনাবলী পড়লে তার চিন্তার ব্যাপকতা বোঝা যায়। কি কি বিষয় নিয়ে না ভেবেছেন তিনি! আরও যেটা বোঝা দরকার সেটা হচ্ছে তাঁর চিন্তা ও কাজ একত্রে ছিল। তিনি শুধু লিখে বসে না থেকে যতোটুকু পেরেছেন স্কুল চালিয়েছেন, নারীদের কর্মসংস্থানের চিন্তা করেছেন। নিরাশ্রীতাদের আশ্রয় দিয়েছেন। আবার সম্ভাবনার দ্বার যেখানে খোলা ছিল সেগুলো সবই করেছেন। নারী সংগঠন করে দলীয় কোন রাজনীতির বাইরে গিয়ে কী করে নারীদের সংগঠন গড়ে তুলতে হয় তাও দেখিয়েছেন। আজ যখন দলীয় রাজনীতির মধ্যে নারীমুক্তির কথা শুনি তখন দুঃখ হয়। রাজনীতিতে এগিয়ে গিয়ে নারী আন্দোলনে পিছিয়ে গেছি। রোকেয়া পাঠ করলে আমাদের আর বিদেশ থেকে ধার করে নারীমুক্তি শিখতে হয় না। তবে হ্যাঁ, বেগম রোকেয়া এটাও দেখিয়েছেন যে অন্য দেশের নারীরা এবং অন্য দেশের লেখিকারা কী ভাবছেন তার সাথেও পরিচিত হতে হবে। শামুকের মতো গুটিয়ে থাকা যাবে না। যেমন সে যুগেই তিনি নারীর ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যে পাশ্চাত্যের অন্যতম প্রধান নারী-মুক্তির দার্শনিক মেরী ওলস্টোনক্রাফট (Mary Wollstonecraft, ১৭৫৯ – ১৭৯৯) এর লেখা A Vindication of the Rights of Woman গ্রন্থ পড়ে ছিলেন। শুধু মেরী ওলস্টোনক্রাফট নয়, রোকেয়া জন স্টুয়ার্ট মিল এর যুগান্তকারী গ্রন্থ The Subjection of Women (১৮৬৯) ও পড়েছিলেন এবং তাঁর নিজের চিন্তাকে প্রসারিত করতে ব্যবহার করেছিলেন। নিজের পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিবেচনা করে, অনুকরণ করে নয়। জন স্টুয়ার্ট মিলে গ্রন্থটি কিছু ঐতিহাসিক সাফল্যের দাবীদার, যেমন বৃটেনের নারীরা পুরুষের সমান ভিত্তিতে ভোটাধিকার লাভ করেছিলেন।

মেরীর চিন্তা রোকেয়াকে অদ্ভুতভাবে প্রভাবিত করেছিল তাই সেই সময় তিনি নারীর তথাকথিত প্রাকৃতিক দুর্বলতা, ‘কমনীয়তা’ রূপচর্চা ইত্যাদী থেকে বেরিয়ে বুঝিয়েছিলেন পুরুষের মতো যোগ্যতা অর্জন না করলে শুধু নারীর সমান অধিকার দাবী করলেই নারী মুক্তি আসবে না। আমার কাছে বেগম রোকেয়ার এই দিকটি অত্যন্ত মূল্যবান অবদান মনে হয়। শুধু নারীর অধিকার দাবী করলে করুণা পাওয়া যাবে, পিঠ চাপড়ানিও কম হবে না, কিন্তু নারী তার প্রাকৃতিক গন্ডি পার হয়ে সামাজিকভাবে মানুষ বা ব্যাক্তি হয়ে উঠতে পারবে না। তাই এখনও যখন খবরে বলা হয় যে সড়ক দুর্ঘটানায় ২ জন নারী সহ ৫ জন নিহত’ তখন বুঝতে পারি এই ২ নারী ও ৩ পুরুষ এক নয়। তিন ‘জন’ পুরুষ সমাজের মধ্যে আছেন, আর নারী ‘আলাদা কিছু। মনে হয়ে এই বাসে বা গাড়িতে তার থাকার কথা ছিল না। এরা বাড়তি কেউ। অথচ এখন দূর পাল্লার হোক বা শহরের ভেতরের বাস হোক এমন কোন বাস দেখানো যাবে না যেখানে নারী যাত্রী নেই। তাহলে তারা যাত্রী নয় কেন? বেগম রোকেয়া যে কাজ করে গেছেন তাতে নারী যাত্রী হয়ে একা বাসে উঠতে পেরেছেন আর দশজন পুরুষের মতো, কিন্তু বর্তমান নারী আন্দোলন তাদের ব্যাক্তি বানাতে ব্যর্থ হচ্ছে। এই ব্যর্থতার দায় আমরা বেগম রোকেয়ার ওপর চাপাতে পারিনা। এর দায় আমাদেরই নিতে হবে।

বেগম রোকেয়ার সময় থেকে আমরা এগিয়েছি, আধুনিক যুগে এসেছি, কৃৎকৌশলে দক্ষ হয়েছি, কিন্তু ব্যাক্তি হতে পারি নি। আমরা পুরুষতান্ত্রিক ও পুঁজিতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় পড়ে গিয়ে নারীর সকল অর্জন এখন কোম্পানির হাতে তুলে দিয়েছি। তাই প্রথম বেতন পেয়ে প্রচন্ড ব্যক্তিত্ব নিয়ে সাদা ঝকঝকে কাপড় পড়ে পাঁচ তারা হোটেলে এসে যখন কর্মজীবী মেয়ে মাকে সাথে হোটেলে ঢুকতে গিয়ে কর্মকর্তাদের বলেন ‘প্রথম এসেছি কিন্তু শেষ বার নয়’ তখন পুরো ক্রেডিট হয়ে যায় একটি সাবান বা ডিটার্জেন্ট কোম্পানির। কারণ এতে বোঝানো হয় সেই মেয়ে যতোই যোগ্য হোক না কেন, তার পক্ষে এমন হাই ফাই হোটেলে ঢোকা সম্ভব একমাত্র ঝকঝকে কাপড় পড়লেই। নাহলে তাদের প্রতি কটাক্ষ করা হবে। শুধু তাই নয়, কোম্পানিই নারীকে কর্মজীবী নারী হয়েও তার সন্তানদের খাবারের যোগার করার ব্যবস্থা করতে পারে। সেটা করতে পারে বিশেষ নুডলস কোম্পানি। গায়ের রং সাদা বা গোলাপী না হলে কর্মক্ষেত্রেও কোন উন্নতি করা সম্ভব হয় না। তখন খুব দুঃখ হয়, আমরা কত সহজে নিজেদের বিলিয়ে দিয়েছি কোম্পানির হাতে। আর ঘুরে ফিরে ‘নারী’ হয়ে থেকেছি। প্রযুক্তি ও পুঁজির দাস হয়ে।

বেগম রোকেয়ার সময় থেকে যারা তাঁকে সরাসরি ‘একদম ছোট বয়সে’ দেখেছেন তাঁদের মধ্যে আমাদের মাঝে নুরজাহান বেগম আছেন। তিনি অসুস্থ, আমি তাঁর দীর্ঘায়ু কামনা করি। তিনি উপমহাদেশের নারী সাংবাদিকতার অগ্রদূত এবং সাহিত্যিক হিশেবে সুপরিচিত। তিনি সওগাত পত্রিকার সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরুদ্দিনের কন্যা। তিনি ১৯২৫ সালের ৪ জুন জন্মগ্রহণ করেন। বাবা তাঁকে আদর করে ডাকতেন নূরী। তাঁকে এক নামে সবাই চেনে বেগম পত্রিকার সম্পাদক হিশেবে। প্রায় ছয় দশক ধরে বেগম পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন নূরজাহান। বেগম পত্রিকাটি বাংলার প্রথম সচিত্র মহিলা সাপ্তাহিক। ১৯৪৭ সালে এটি কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয়। পরে ১৯৫০ সালে ‘বেগম’ঢাকা থেকেই প্রকাশিত হতো। এই প্রযুক্তির যুগেও তিনি মহিলাদের জন্যে প্রকাশ করে যাচ্ছেন পত্রিকাটি, বিশেষ করে যাদের আমরা গৃহিণী বলে জানয়ে, তাদের মধ্যে পাঠক সৃষ্টি করেছেন। তিনি হাজার হাজার নারী সাংবাদিক সৃষ্টি করেছেন। বর্তমানে নারী সাংবাদিকরা যদি বলেন তাঁরা ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের গণসংযোগ বিভাগে পড়ে সাংবাদিকতা শিখেছেন, তারা ভুল করবেন। নুরজাহান বেগম তার চেয়ে অনেক বেশী গভীরে নারীদের জন্যে সাংবাদিকতা কেমন হওয়া দরকার তাই শিখিয়েছেন। বেগম রোকেয়া নাসিরুদ্দিন সম্পাদিত সওগাত পত্রিকার নিয়মিত লিখতেন। আর নাসিরুদ্দিনের মেয়ে নুরজাহান বেগম বাংলাদেশের হাজার হাজার গৃহবধুদের মধ্যে লেখক, কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী তৈরী করেছেন। সাহস যুগিয়েছেন, আত্মবিশ্বাস বাড়িয়েছেন।

গত ২০ নভেম্বর, বেগম সুফিয়া কামালে ১৬ তম মৃত্যু দিবস পালিত হোল। তিনি ১৯৯৯ সালে ২০ নভেম্বর মৃত্যুবরণ করেন। তিনি সত্যিকার অর্থে নারী আন্দোলনের পথিকৃৎ ছিলেন। কথার কথা নয়, তার মৃত্যুতে নারী আন্দোলনের নেত্রীর স্থানটি একেবারে শূন্য হয়ে গেছে। তাঁকে আমরা কবি, সাহিত্যক হিশেবে চিনলেও নারী আন্দোলনে তার ভুমিকা অসাধারণ। আমরা এ অভাব আজও দূর করতে পারিনি। তিনি তাঁর সময়ের প্রয়োজনে যা কিছু করার তার সাথেই যুক্ত হয়েছেন। যেমন ভাষা আন্দোলনে তিনি নিজে সক্রিয়ভাবে অংশ নেয়ার পাশাপাশি এতে অংশ নেয়ার জন্য অন্য নারীদেরও উদ্বুদ্ধ করেন। ১৯৫৬ সালে শিশুদের সংগঠন কচিকাঁচার মেলা প্রতিষ্ঠা করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মহিলা হোস্টেলকে রোকেয়া হল নামকরণের দাবি জানান। ১৯৭০ সালে তিনি মহিলা পরিষদ প্রতিষ্ঠা করেন।বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর তিনি নারী আন্দোলন সংগ্রামকে বেগবান করার চেষ্টা করেছেন। ধার্মিক ছিলেন কিন্তু সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। কোণ আপোষ করেন নাই। দুঃখের বিষয় হচ্ছে ১৯৯০ এর দশক এবং বিশেষ করে একবিংশ শতাব্দির শুরু থেকে যখন নারী অধিকারের প্রশ্নগুলো আন্তর্জাতিক হয়ে উঠলো এবং এজেন্ডা নির্ধারিত হোল বিদেশ থেকেই। আমাদের দেশের নিজস্বতা একটু হারাতে শুরু করলো। নারী আন্দোলনে পরবর্তী প্রজন্মের নেত্রীরা এখন বড় বড় এনজিও’র কর্মকর্তা, সিইও, আর নারী হয়ে গেল জেন্ডার। সুফিয়া কামালের উত্তরসুরি আমরা হতে পারলাম না।

এছাড়াও সাখাওয়াত মেমোরিয়াল স্কুলে যারা পড়াশোনা করেছেন তাঁদের মধ্যে কয়েকজন বেঁচে আছেন, যদিও খুব একটু বাইরে সক্রিয় নেই। যেমন বিশিষ্ট মণবিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. সুলাতানা জামান। সমাজে এঁদেন অবদান অসাধারণ। প্রতিবন্ধীদের শিশুদের নিয়ে ভেবেছেন বিস্তর। এ কাজ ক’জনে করে। নিজ উদ্যোগে কাজ করে গেছেন, চিন্তা করেছেন, নতুন দিক নির্দেশনা দিয়েছেন। সাখাওয়াত মেমোঋয়ালের আর এক ছাত্রী গত বছর আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন, অধ্যাপক লতিফা আকন্দ। তাঁর অদ্ভুত কাজের গতি। যখন রাস্তায় সংগ্রামের প্রয়োজন হয়েছে তখন তিনি রাস্তায় মিছিল করেছেন, আর যখন গ্রামে যেতে হয়েছে চলে গেছেন গ্রামে। হাসপাতালে কেউ নবজাতক কন্যা ফেলে গেছেন খবঢ় পেয়ে তিনি নিয়ে এসেছেন পরম মমতায়, তুলে দিয়ে অন্য এক মায়ের কোলে। শেষ দিন পর্যন্ত কন্যা শিশুদের কর্মসুচিতে তিনি অংশগ্রহণ করে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন, তারপর মারা গেছেন। তিনি রোকেয়া পদকও পেয়েছিলেন। এঁদের হারানো কত বড় ক্ষতি তা বলে বোঝানো যাবে না।

হারিয়েছি আরো অনেক নারী আন্দোলনের নেত্রীদের, যারা বেগম রোকেয়ার ছায়ায় নিজেদের জীবন গড়েছিলেন, কখনো রোকেয়াকে কাছে পেয়ে, কখনো তাঁর অনুপ্রেরনা নিয়ে।

এই যুগে এসে প্রতিষ্ঠান হিশেবে নারীগ্রন্থ প্রবর্তনা প্রথম ও এক মাত্র নারীদের দ্বারা এবং নারীদের জন্যে প্রকাশিত বইয়ের কেন্দ্র হিশেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে ৯ ডিসেম্বর, ১৯৮৯ সালে। রোকেয়া দিবসে যাত্রা শুরু করে অনুসরণের পথ বের করার জন্যে। এই প্রতিষ্ঠান বেগম রচনাবলী থেকে ছোট ছোট চটি বই আকারে রোকেয়ার লেখাগুলো প্রকাশ করে একুশে বই মেলায় ছড়িয়ে দিল। আজও একুশে বই মেলায় নারীগ্রন্থ প্রবর্তনার সর্বোচ্চ বিক্রির বই হচ্ছে রোকেয়ার চটি বই। ভাবতেই ভাল লাগে যে নতুন প্রজন্ম হাতের কাছে বইগুলো পেয়ে অন্তত তাঁর চিন্তার সাথে পরিচিত হতে পেরেছে।

নয় ডিসেম্বর, রোকেয়া দিবস। নারী আন্দোলন শক্তিশালী হোক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *