সীমা দাস সীমু || Monday 17 August 2015
নয় বছরের স্মৃতি। ‘আমি যখন বড় হব, গাছও তখন বড় হবে’ আম গাছ লাগিয়ে এমনই তার ভাবনা।
গ্রামে কিশোরীদের বিয়ে হয় তাড়াতাড়ি। অল্প বয়সে। মেয়েদের বয়স ১২-১৩ হলেই মা-বাবা’রা বিয়ে দেবার জন্য চিন্তিত হয়। ফলে তারা লেখা-পড়া বেশী দূর করতে পারে না। এই বিয়ে দেবার যথেষ্ট কারণও আছে। গ্রামে কম বয়সে মেয়েদের বিয়ে হলে যৌতুক কম লাগে। মেয়ে বড় হয়ে গেলে যৌতুক বেশী লাগে। বাবা-মাদের পক্ষে সম্ভব হয় না বেশী যৌতুক দিয়ে মেয়ের বিয়ে দেবার। তাই নারীগ্রন্থ প্রবর্তনা বাল্যবিবাহ বা ১৮ বছরের পূর্বেই যাতে মেয়েদের বিয়ে না হয় তার জন্য কিশোরীদের মধ্যে গাছ লাগানোর কর্মসূচী হাতে নেয়। এখন গাছ লাগান হলে মেয়ে বড় হতে হতে গাছও বড় হবে। বাবা-মাকে মেয়ের বিয়ের খরচের জন্য চিন্তা করতে হবে না। এর মধ্যে মেয়ে তার পড়াশুনাও চালিয়ে নিতে পারবে। এই উদ্দেশ্যেই কিশোরীদের মাঝে গাছ বিতরণ করা হয়।
গ্রামে প্রতিটি পরিবারেই গাছ লাগাবার প্রবণতা দেখা যায়। হোক সে গরীর, ধনী বা মধ্যবিত্ত। যার গাছ লাগাবার মত তেমন জায়গা নাই শুধু ভিটে বাড়ি আছে এমন পরিবারও নিজ ভিটেতে একটা গাছ লাগাতে চায়। ভবিষ্যতের আশায়। গাছ অর্থের যোগান দেয়। গাছ লাগাবার এটাও একটা করণ তো বটেই। গ্রামের গরীব পরিবারগুলিতে গাছ বিপদের বন্ধু হিসাবেই তারা মনে করে।
গ্রামে সাধারণত বর্ষা মৌসুমেই গাছ লাগান হয়। এই বর্ষা মৌসুমের আগে আগে আরশিনগর বিদ্যাঘর থেকে হাজারীপাড়া, খয়েরবাড়ী, মিরাপাড়া গ্রামের মোট ৬০ জন কিশোরীদের মাঝে গাছ বিতরণ করা হয় ৩১ মে, ২০১৫। এই কিশোরীরা মৃধাপাড়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, মাড়মী সুলতানপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং চাঁদপুর লক্ষ্মীকুলা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় শ্রেণী থেকে ৫ম শ্রেণীর ছাত্রী। ৭ থেকে ১১ বছর বযসী কিশোরীদের মাঝে এই গাছ বিতরণ করা হয়।
কিশোরীদের পারিবারিক অবস্থা:
এই কিশোরীদের পারিবারিক অবস্থা তেমন ভাল না। বেশীরভাগই ( মোট ৬০ জনের মধ্যে ৪২ জন) কৃষি পরিবার। তাদের চাষের কোন জমি নাই। বর্গা চাষ করে। কারও কারও পরিবারে আছে (১০ জন) মুদির টোং দোকান। আবার কোন কোন পরিবারে বাবা মায়েরা (৭ জন) রাইস মিলে দিন মজুরের কাজ করে। ইট ভাটায় কাজ করে একজন। তবে সকল কিশোরীদের রয়েছে নিজেদের বসত ভিটা। শুধুমাত্র দুই রয়েছে নানা বাড়িতে।
যেসব গাছ বিতরণ করা হয়েছে:
চারা গাছ বিতরণ করা হয়েছে ৭ জাতের। চারা গাছ জাতের মধ্যে ছিল আম, জাম, মেহগনি, কাঠবাদাম, অর্জুন, কাঁঠাল এবং নিম।
১. আম গাছ: কলম করা আম গাছে তিন বছরেই ফল ধরে। আর কলম করা না হলে ফল ধরে দেরীতে। প্রায় ১০ বছর সময় লেগে যায়। তাই কলম করা আম গাছ বিতরণ করা হয়েছে। আম গাছের কাঠ দিয়ে দামী আসবাবপত্র হয় না। তবে কম খরচে চেয়ার-টেবিল তৈরী হয়। এই কাঠ বেশী কাজে লাগে ঘরের চালের বাটাম তৈরীর কাজে। কাঠ হওয়ার উপযুক্ত হতে সময় লাগে কমপক্ষে ১২ বছর।
২. জাম গাছ: জাম গাছে ফল ধরতে সময় লাগে। ১২ থেকে ১৪ বছরের আগে ফল ধরে না। জাম গাছের বয়স ১৫ বছরের উপরে হলে কাঠ হিসাবে ভাল দাম পাওয়া যায়। ঘরের ডাসা বা ধরণা হিসাবে কাজে লাগে। জাম গাছের ডাসা বা ধরণা’র অনেক দাম। সাধারণত এক সি.এফ.পটি কাঠের দাম ১৫০০.০০ (পনের শো) টাকা।
৩. মেহগনি গাছ: কাঠ জাতীয় গাছ। কম করে ১২ বছর লাগে কাঠ হতে। আসবাবপত্র তৈরী হয়। কাঠের ভাল দাম পাওয়া যায়।
৪. কাঠবাদাম: এই গাছে ফল ধরে ১০ বছরে। ফলের চাহিদা আছে এবং দাম বেশী।
৫. অর্জুন: কাঠ জাতীয় গাছ। কমপক্ষে ১২ বছর লাগে কাঠ হতে। দামী কাঠ। দাম বেশী। অনেকের ধারণা এই কাঠের তৈরী খাটে ঘুমালে রোগ-ব্যাধী কম হয়।
৬. কাঁঠাল: বাংলাদেশের জাতীয় ফল গাছ। ৬-৭ বছরের মধ্যেই ফল ধরে। কাঁঠাল গাছ ১২ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে ভাল কাঠে পরিণত হয়। কাঁঠাল কাঠ দিয়ে আসবাসপত্র তৈরী হয়।
৭. নিম: নিম গাছ ঔষুধী গাছ। ১৫ বছরের মধ্যে ভাল কাঠে পরিণত হয়। ভাল দামে গাছ বিক্রি হয়। এই কাঠ দিয়ে আসবাবপত্রও তৈরী হয়।
গাছ বিতরণের সময় সকলকে চারা গাছ রোপনের নিয়ম শিখিয়ে দেয়া হয়েছে।
গাছ নিয়ে ভাবনা:
কিশোরীদের মধ্যে গাছ নিয়ে নানান ভাবনা রয়েছে। তাদের কথা তুলে ধরা হলো-
১. আমি বৃষ্টি। হাজারিপাড়া গ্রামে আমার বাড়ি। ১১ বছর বয়স। ক্লাস V এ পড়ি। আম গাছ নিয়েছি আমি। গাছ বড় হলে আম খাওয়া যাবে। আমার লেখা পড়ার জন্য খাতা কলম কিনতে পারবো। আর গাছটা আমার হবে। আমার আব্বা’র দুইটা গাছ আছে। কাঠের গাছ। এই গাছটা আমার হবে।
২. স্মৃতি, বয়স ৯ বছর। ক্লাস V এ পড়ি। আমি আম গাছ নিয়েছি। আমি যখন বড় হব গাছও তখন বড় হবে। আম ধরবে। আমার আম্মা একটা করে আম বিক্রি করবে, আমার লেখাপড়ার খরচ দিবে। তারপর আমার বিয়ের সময় এই গাছ বিক্রি করে বিয়ে দিবে। আমার আব্বু ইটের ভাটায় কাজ করে। আব্বুর টাকা কম খরচ হবে।
৩. মিথিলা, ৭ বছর বয়স। ক্লাস II পড়ি। আমি অর্জুন গাছ নিয়েছি। আমার আব্বায় মাটি খুঁড়ে দিয়েছে। আমরা দুইজনাই ওই গাছ লাগিয়েছি। আমিতো জানি না এই গাছে আম হয় না। আমার আব্বায় বলছে এই গাছ নিতে। এরপরে আমি ফজলি আম গাছ নিব। লম্বা লম্বা আম হবে। আমরা খাব বিক্রিও করব। আমার বিয়ের সময় এই গাছ বিক্রি করা হবে। এর আগে বিক্রি করা যাবে না। উবিনীগের আপারা বলছে।
৪. মিতু, ৯ বছর। আমি ক্লাস IV এ পড়ি। নিম গাছ ভাল। আমি নিম গাছ নিয়েছি। নিম গাছের পাতা দিয়ে ওষুধ বানায়। খাইলে জ¦র ভাল হয়। আমার মায়ে মাটি খুঁড়ে দিছে। কলতলার (টিউবওয়েল) পাশে গাছ লাগাইছি। প্রতিদিন গাছে পানি দিছি। আমি বড় হব তখন গাছ বড় হয়ে কাঠ হবে। আমার আব্বায় অনেক দামে বিক্রি করতে পারবে। আমাকে কাঁঠাল গাছ নিতে বলেছিল। আমাদের বাড়িতে পানি আসে। আম্মা বলছে গাছের নিচে পানি থাকলে গাছ মরে যাবে। তাই আমিকাঁঠাল গাছ নেই নাই।
৫. সন্ধ্যা খাতুন, আমি ক্লাস IV এ পড়ি। আমার বয়স ৯ বছর। আমি কাঁঠাল গাছ নিয়েছি। আমাদের বাড়িতে পানি আসে না। কাঁঠাল খাইতে আমি ভালবাসি। কাঁঠাল বিক্রি করে পয়সা জমাইতে পারবো। আমি পড়াশুনার জন্য খাতা-কলম কিনতে পারবো। আমার বিয়ের সময় গাছ বড় হবে তখন আমার আব্বায় গাছ বিক্রি করে খরচ করবে।
এইভাবেই কিশোরীরা গাছ নিয়ে তাদের ভাবনার কথা বলে। ছোটকালে বিয়েকে “বাল্য বিবাহ বা বিয়ে” বলে এটা কিশোরীরা জানে। এ সর্ম্পকে আরও কি জানে প্রশ্ন করতেই মর্জিনা বলে, ‘১৮ বছরের আগে কোন মেয়েকে বিয়ে দিলে তাকে বাল্য বিয়ে বলে’।
অন্যান্যরা বলে, ‘আমরা গাছ নিয়েছি, আমরা যতদিন পড়াশুনা করবো ততোদিনে আমাদের এই গাছ বড় হতে থাকবে। ১৮ বছর পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত আমরা কেউ আগে বিয়ে করবো না। আমরা জানি ছোট কালে বিয়ে হলে অনেক অসুখ হয়। আমাদের গ্রামে দাইঘর আছে দাইমায়েরা এ কথা বলে। দাইমায়েরা এই ঘরে বসে, পরামর্শ দেয়। মায়েরা দাইঘরে আসে। শিশু বাচ্চারাও আসে। তাদের কোন অসুবিধা হলে দাইমায়েরা পরামর্শ দেয়। বেশী অসুবিধা হলে সরকারী হাসপাতালে ডাক্তারের কাছে পাঠায়। আমরাও দাইঘরে যাই। ওজন মাপি। মায়েদের সাথে ‘মায়েদের মিটি’ এ যাই। আমরা লেখাপড়া শিখবো। পড়াশুনা শিখবো। তারপর বিয়ে করবো।