বৃষ্টি, বন্যা ও উন্নয়নের বিকৃত রূপ

ফরিদা আখতার || Tuesday 04 August 2015

পাহাড়ি ঢলে ডুবে যাওয়া কঙ্বাজারের একটি গ্রাম

দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে জুন থেকে দফায় দফায় পাহাড়ি ঢলে বন্যা হয়েছে, বৃষ্টি থামার কোনো লক্ষণ নেই। একটু থামলেও রোদের দেখা সহজে মেলে না। দিনের পর দিন, রাতের পর রাত মানুষ ঘরের ভেতরে দুই থেকে তিন ফুট পানিতে বসে বসে কাটিয়েছে। সংযোগ থাকার পরও বিদ্যুৎবিহীন অবস্থায় কাটাতে হয়েছে। কক্সবাজার ও বান্দরবান এলাকার অবস্থা খুবই খারাপ। চকরিয়া উপজেলায় আমাদের সহকর্মীরা রয়েছেন বলে প্রতিদিন খবর পাচ্ছি। তাদের বর্ণনায় বোঝা যায়, এ বন্যা ভয়াবহ এবং অন্যবারের মতো নয়। একবার পানি নেমে গেলেও আবার কিছুদিন পর হচ্ছে। ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে গাছপালা, ঘরের আসবাবপত্র, মুরগি, এমনকি ১৩ দিনের এক নবজাতকও ভেসে গেছে। ঢাকার আকাশও খুব পরিষ্কার নয়। এ বেলা রোদ হলে অন্য বেলায় বৃষ্টি হচ্ছে। যারা নিচু জায়গায় থাকছে তাদের বাড়িতেও পানি উঠছে। বস্তিতে মানুষ কষ্ট করে আছে। দেশের অন্যান্য জায়গায়ও বন্যা হচ্ছে। একটু পত্রপত্রিকা খুঁটিয়ে পড়লে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশের অধিকাংশ এলাকাই কোনো না কোনোভাবে প্লাবিত হচ্ছে।

পত্রিকা থেকে সংগৃহীত কিছু তথ্য দিচ্ছি। জুন থেকে বৃষ্টি হচ্ছিল, এ সময় দেশের উপকূলীয় ও পাহাড়ি অঞ্চলে প্রবল বর্ষণ এবং পাহাড়ি ঢলে বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। রোজার মাসেও মানুষকে দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। ঈদের দিন অনেকে নামাজও পড়তে পারেননি। ঈদের পর থেকে চট্টগ্রাম ও বান্দরবান এলাকায় পাহাড়ি ঢলের কথা শোনা যায়। প্রথম পাহাড়ি ঢল শুরু হয় ২৩ জুন। চট্টগ্রাম শহরে পাহাড়ধসে একই পরিবারের কয়েকজন মারা যায়। নগরীতে মানুষ বন্দি হয়ে পড়ে। নগরীর এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাওয়াটাও সম্ভব হয় না। কক্সবাজারে কয়েকটি উপজেলা বিশেষ করে রামু, চকরিয়া, পেকুয়া ও মহেশখালীতে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা মারাত্মক ভেঙে পড়ে। চকরিয়া ও পেকুয়ার ২৫টি ইউনিয়নের তিন লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়ে। মাতামুহুরী ও বাঁকখাল নদীর পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে শত শত একর ফসলি জমি ও চিংড়ি ঘের পানির নিচে তলিয়ে যায়। বিশেষ করে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের পানি ঢুকে পড়ে বিভিন্ন ইউনিয়নের বিস্তীর্ণ এলাকায়। টানা বর্ষণের কারণে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হওয়ার পাশাপাশি কর্ণফুলী, হালদা ও শঙ্খ নদীর পানিও বৃদ্ধি পায়। আবহাওয়া অফিস সূত্রে জানা যায়, চট্টগ্রামে ২৪ থেকে ২৬ জুলাই, মাত্র তিন দিনে ৮০০ মিলিমিটার (৩২ ইঞ্চি) বৃষ্টি হয়েছে। কক্সবাজারে ২৪ জুলাইয়ের পর থেকে বৃষ্টি ৯২৪.৬ মিলিমিটার (৩৬.৪ ইঞ্চি) বা তিন ফুটের বেশি হয়েছে। আবহাওয়াবিদদের মতে, এবারের বৃষ্টিপাত অন্য সময়ের তুলনায় ২৪ শতাংশ বেশি।

চট্টগ্রাম, বান্দরবান, কক্সবাজার ছাড়াও দেশের অনেক উপকূলীয় জেলায় অতিবৃষ্টি ও বন্যার কারণে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এলাকাগুলো হচ্ছে- নোয়াখালী, হাতিয়া, সন্দ্বীপ, ছাগলনাইয়া, ফুলগাজী, বরগুনা, ঝালকাঠি, সাতক্ষীরা, কলারোয়াসহ আরও অনেক এলাকা। পত্রিকায় খণ্ডিতভাবে প্রতিবেদন পড়ে সারা দেশের হিসাব দেয়া সম্ভব নয়। প্রথম আলো (৩ আগস্ট, ২০১৫)। একটি প্রতিবেদনে লিখেছে, দেশের পাঁচটি জেলায় ১০ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে আছে। এ জেলাগুলো হচ্ছে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, নোয়াখালী, ফেনী ও বান্দরবান। তারা এ তথ্য দিয়েছে জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে নিয়ে।

এর মধ্যে নিম্নচাপে সৃষ্টি হয়েছিল সাইক্লোন কোমেন। ভাগ্য ভালো, সেটা দুর্বল হয়ে অন্যদিকে চলে গেছে; বড় ধরনের আঘাত হানতে পারেনি।

মৌসুমি বৃষ্টি হোক, এটাই কাম্য। একটু কম বা বেশি হতেই পারে। বাংলাদেশ একটি কৃষিপ্রধান দেশ। মৌসুমের সঙ্গে মিলিয়ে এখানকার ফসল, মাছ চাষসহ নানা কৃষিকাজ পরিচালিত হয়। বিদেশে বন্যা নিয়ে চিন্তিত হলেও বাংলাদেশের মানুষ বন্যার বিরোধিতা করে না। কারণ বন্যা জমিতে পলি মাটি নিয়ে আসে, যা কৃষির জন্য খুব দরকার। কিন্তু বৃষ্টিপাত যখন অতিমাত্রায় হয় এবং পানি যাওয়ার পথ না পায় তখন এ আশীর্বাদ অভিশাপে পরিণত হয়। এবার বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অভিযোগ উঠেছে বৃষ্টির পানি বের হওয়ার কোনো জায়গা নেই। বিশেষ করে চট্টগ্রাম শহরে বিভিন্ন স্থান প্লাবিত হওয়ার প্রধান কারণ হচ্ছে শহরের ড্রেনেজ ব্যবস্থা ঠিক নেই। অথচ চট্টগ্রামে বিলাসবহুল আবাসিক এলাকা গড়ে তোলা হয়েছে পাহাড় কেটে। তারা ঘরের মধ্যে বিলাসিতা করছে কিন্তু ঘর থেকে প্রাইভেট কার (যা তুলনামূলকভাবে নিচু) নিয়ে বের হতে পারছে না। এখন থেকে ধনীদের বাড়িতে ট্রাক রাখার ব্যবস্থা করতে হবে, যা তারা বর্ষাকালে ব্যবহার করবে। তাহলে তাদের ঘর বানানোর স্বেচ্ছাচারিতায় কিছুটা ভাটা পড়তে পারে।

এবারের এ দুর্যোগ শুধু অতিবৃষ্টির কারণে হয়েছে এমন নয়; অতিবৃষ্টির কারণে যেসব ঝুঁকি বেশি থাকে তার মধ্যে পাহাড়ধস অন্যতম। এ কথা চট্টগ্রাম ও বান্দরবান এলাকার প্রশাসন এবং সংশ্লিষ্ট সবাই জানেন। বান্দরবান ও চট্টগ্রামে যে প্রাণহানি ঘটেছে তার মূল কারণ পাহাড়ধস। এ ঘটনা প্রতি বছর কিছু না কিছু ঘটে। সবচেয়ে বড় ঘটনাটি ঘটেছিল ২০০৭ সালের ১১ জুন। ওই সময়ে এক দিনে চট্টগ্রাম শহরের বাটালি হিলে ১৭ জন নিহত হয়েছিলেন। এর আগে ২০০৮ সালে মারা গেছেন ১৪ জন। এরপর থেকে প্রতি বছরই পাহাড়ধসে প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। ২০১২ সালে মারা গেছেন ২৮ জন। সেই থেকে ৯ বছরে এ পর্যন্ত ১৯৯ জন নিহত হয়েছেন পাহাড় ধসের কারণে। চট্টগ্রাম শহরে যেসব পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস রয়েছে তার বেশিরভাগ মালিকানা সরকারের। ব্যক্তিমালিকানাধীন পাহাড়ও রয়েছে। সরকারি পাহাড় দখল করে অথবা ইজারা নিয়ে ঘর তৈরি করে দেন প্রভাবশালী ব্যক্তিরা। ২০০৭-এ পাহাড়ধসের পর নিহতের ঘটনা ঠেকাতে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। এত দুর্ঘটনা এড়াতে ৩৬ দফা সুপারিশ দেয়া হয়েছিল। এসব সুপারিশ ৮ বছরে আলোর মুখ দেখেনি। প্রতি বছর বর্ষা এলে উচ্ছেদ চালানো হয়। ব্যস এতটুকুই কাজ। বর্ষা শেষ হলে পরবর্তী বর্ষা এবং দুর্ঘটনা না ঘটলে ভাবনার কিছু নেই। সরকার নাকে তেল দিয়ে ঘুমিয়ে থাকে।

দিন দিন সমস্যা আরও গভীর হচ্ছে। একদিকে অপরিকল্পিত নগরায়ণ চলছে, দেদার পাহাড় কাটা হচ্ছে, পাহাড় কেটে বিলাসবহুল বাড়িঘর বানানো হচ্ছে। এ বিষয়ে পরিবেশবিদরা অনেক দিন থেকে আপত্তি জানিয়েছেন এবং এ ধরনের দুর্যোগের আভাসও দিয়েছেন। কিন্তু কে শোনে কার কথা! যারা বাড়ি বানাতে চায় এবং যারা নিজের বিলাসিতা প্রকাশ করতে চায় তাদের বাড়িঘর শক্তভাবে বানানো থাকে। পাহাড়ের আরেক দিকে যেখানে কাঁচাবাড়ি রয়েছে, সেখানে থাকে গরিব মানুষ। পাহাড় ধসে তারাই মরে। তারা আমাদের কারও পরিচিত নয়। তাদের লাশ বের করার পর তাদের নাম ও বয়স জানা যায়। পত্রিকায় আসে। এ নাম ও বয়স দেখে শুধু এটুকু জানা যায় যে, তাদের মধ্যে কতজন নারী, কতজন শিশু এবং কতজন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ রয়েছেন। পরিবারের জীবিতদের কাঁদতে দেখা যায়। এ পর্যন্তই শেষ। এরপর তাদের জীবনে কী ঘটছে আমরা কেউই জানতে পারি না। আবার পরের বছর বর্ষা এলে আরও কিছু মানুষের মৃত্যু ঘটলে তাদের হয়তো মনে পড়ে যায়। মৃত্যুর সংখ্যা বাড়তেই থাকে। নতুন নাম যুক্ত হয়।

উপকূলীয় অঞ্চলে বিশেষ করে মাতামুহুরী নদীর পাড়ে যে প্যারাবন ছিল তা ধ্বংস করা হয়েছে চিংড়ি চাষের জন্য। প্যারাবন রক্ষার চেয়ে চিংড়ি চাষকেই গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। কারণ এর মাধ্যমে নাকি বৈদেশিক মুদ্রা আসবে। অথচ প্যারাবন প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করে। এখন প্যারাবন নেই, অতিবর্ষা ও বন্যার কারণে প্রাকৃতিকভাবে রক্ষার ব্যবস্থাও ভেঙে পড়েছে। এখন সেই চিংড়ি ঘের ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলে পত্রপত্রিকায় খবর আসছে। অথচ এ চিংড়িই যে এ দুর্যোগের ব্যাপকতা সৃষ্টির কারণ, তা বলা হচ্ছে না। কৃষকের ক্ষতি পুষিয়ে দেয়ার চেয়েও বড় প্রয়োজন হয়ে পড়ে চিংড়ি ঘের বা তথাকথিত উন্নয়নমূলক প্রকল্প রক্ষার কাজ।

উন্নয়নের কথা বলে রাস্তাঘাট তৈরি করা, ব্রিজ-কালভার্ট তৈরি করা- সবই হয়েছে। বার্ষিক উন্নয়ন বরাদ্দের মধ্যে যা দেয়া আছে তার থেকে যত কাটছাঁট করে একটি কিছু তৈরি করে দেয়া হয়। সেটা অতিবর্ষা বা পাহাড়ি ঢলের বন্যায় টিকবে কিনা, তা দেখার দরকার নেই। আমি আশ্চর্য হয়ে যাই, বর্ষা আসার আগে পানি উন্নয়ন বোর্ড ও সড়ক উন্নয়ন বোর্ড কেন রাস্তাঘাট, ব্রিজ, কালভার্ট ইত্যাদি পরীক্ষা করে দেখেন না, কোনো কারণে বেশি বৃষ্টি হলে এগুলো ঠিক থাকবে কিনা। কেন আমাদের শুনতে হয় যে, যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। উপদ্রুত এলাকার মানুষ বেরোতে পারছে না, আর কেউ রিলিফ দিতেও যেতে পারছে না। একমাত্র রেড ক্রিসেন্ট বা যারা দুর্যোগ নিয়ে কাজ করে তারাই যেতে পারে তাদের বিশেষ ব্যবস্থায়।

এবারে একদিকে দেশের দক্ষিণে যেমন অতিবৃষ্টি ও বন্যা হচ্ছে ঠিক একই সময়ে উত্তরের জেলা, যেমন- ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, দিনাজপুরে প্লাবণেও বৃষ্টির দেখা পাওয়া যায়নি। এখানে বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়ছে, দোয়া-প্রার্থনা করছে। পাটচাষিরা পাট জাগ দিতে পারছেন না; রোপা আমন লাগানোর সুযোগও পাচ্ছেন না কৃষক। তাহলে কি দেশে জলবায়ু পরিবর্তনের ভাব দেখা যাচ্ছে?

ইংরেজিতে একটি কথা আছে, man-made disaster বা মানবসৃষ্ট দুর্যোগ। অতিবৃষ্টি প্রকৃতির সৃষ্টি অবশ্যই, কিন্তু অতিবৃষ্টির কারণে সৃষ্ট সমস্যা তো মানুষের তৈরি। জমে থাকা পানি বের হতে না পারার জন্য দায়ী কে? আবার পাহাড়ি ঢলে যে বন্যা হচ্ছে এবং সব ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, তার জন্য দায়ী প্রধানত নির্বিচারে পাহাড় কাটা। উন্নয়ন বলতে অন্ধভাবে রাস্তাঘাট, বাড়িঘর বানানোর যে চিন্তা তা বিকৃত চিন্তার প্রতিফলন। যেসব দেশের প্রশাসন প্রকৃতির সঙ্গে বুঝেশুনে চলেন তারা ঘরবড়ি বানানোর জন্য নিয়মনীতি বেঁধে দেন। উচ্চ ও বিলাসবহুল বাড়ি বানানোর ক্ষেত্রে অনেক দেশে বাধ্যবাধকতা আছে এবং জনগণ তা মেনে চলেন। আমাদের এই দুর্ভাগা দেশে নিয়মও নেই, নিয়ম থাকলেও মেনে চলার বালাই নেই। আমরা স্বাধীন জাতি। আমরা যা খুশি তা করতে পারি। পয়সা ও ক্ষমতায় থাকলে আমাদের কেউ কিছু করতে পারে না। অনেকেই মনে করছেন, একই দেশের দুই দিকে অতিবৃষ্টি ও অনাবৃষ্টি জলবায়ু পরিবর্তনের লক্ষণ। তা যদি হয়, তাহলেও এটা মানুষ সৃষ্ট কর্মকা- ও বিকৃত উন্নয়নের ফল। উন্নয়ন মানুষের কল্যাণে না হয়ে যখন শুধু চাকচিক্যময় অর্থনৈতিক সূচকে গিয়ে দাঁড়ায়, ধনীদের বিলাসী জীবনকে উৎসাহিত করে, ধনী-গরিব ব্যবধান বাড়িয়ে দেয় এবং গরিবের জীবন-জীবিকার প্রতি অবজ্ঞা করে- তখন সেটা আর কল্যাণের উন্নয়ন থাকে না, হয়ে যায় বিকৃত উন্নয়ন।

এ বিকৃতির শিকার হচ্ছে সাধারণ মানুষ। তারা ভাসছে অতিবৃষ্টি ও বন্যায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *