রফিকুল হক টিটো || Saturday 01 August 2015
মাস না পেরোতেই আবার বন্যার শিকার হয়েছে কক্সবাজারের প্রায় ৫ লাখ মানুষ। গণমাধ্যমে এর মাত্রা এবং বন্যায় এলাকার মানুষের দুর্ভোগের খবর যথযোগ্য মনোযোগ পায় নি। সরকারের নীতি নির্ধারনী পর্যায় জনগণের দুর্ভোগ লাঘবের জন্যও সাড়াও অপ্রতুল। এই পরিপ্রেক্ষিতে এলাকার কিছু এলাকা সরেজমিন ঘরে এই প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে।
উত্তর বঙ্গোপসাগর ও তার আশপাশের বাংলাদেশের উপকুলীয় এলাকায় একটি লঘু চাপ তৈরি হয়েছিল। সেটা দ্রুত ঘনীভূত হয়ে মৌসুমী নিম্ন চাপে পরিণত হয়। মৌসুমী নিম্ন চাপের প্রভাবে গত ২৪ জুলাই ২০১৫ শুক্রবার থেকে টানা ৪ দিন প্রবল বৃষ্টি ও মাতামুহুরী ও বাকখালী নদীতে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ী ঢলের পানিতে জেলায় এই ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতি সুষ্টি হয়েছে। এই বন্যায় প্রায় ৩০০ টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। নিহত হয়েছে শিশু সহ ৯ জন। বাসস্থান, খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির মারাত্মক সংকট চলছে বন্যা কবলিত এলাকাগুলোতে। মনে রাখা দরকার সবে মাত্র এলাকার মানুষ এর আগে (২৪ জুন-২৭জুন ২০১৫) আরেকটি বন্যার ধকল সবে মাত্র কাটিয়ে উঠেছিল। তার জের শেষ হতে না হতেই এই নতুন বন্যা। এতে করে আবার চরম দুর্ভোগে পড়েছে মাত্র কিছুদিন আগে বন্যার ধকল কাটিয়ে না উঠা মানুষগুলো। ফের ভয়াবহ বন্যার শিকার হয়ে পড়ায় অবস্থা আরো কঠোর হয়ে উঠেছে। পানিবন্দী হয়ে পড়েছে গ্রাম ও জনপদ। দুর্যোগ প্রবণ এলাকায় চলছে হাহাকার। বৃষ্টির মাত্রা বাড়ায় পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ আকার ধারন করার আশষ্কা দেখা দিয়েছে।
স্থানীয় পর্যায়ে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, শুক্র, শনি রবিবার,ও সোমবারের টানা প্রবল বৃষ্টিতে জেলার চকরিয়া, রামু, পেকুয়ায় ভয়াবহ বন্যা সুষ্টি হয়েছে। চকরিয়ায় বন্যায় নিহত হয়েছে শিশু সহ ২ জন। রামুতে পানিতে ভেসে গেছে ১৩ দিনের এক নবজাতক। বিছিন্ন হয়ে পড়েছে কক্সবাজার- টেকনাফ চকরিয়া মহেশখালী-পেকুয়াসহ বিভিন্ন সড়ক যোগাযোগ। পানিতে তলিয়ে গেছে ঘরবাড়ি, বসতভিটা ও ফসলী জমি ও পুকুর গবাদি পশু পাখী।
এই লেখা যখন লিখছি পানির নীচে চকরিয়ার উপজেলার ১৪ ইউনিয়ন। পরিস্থিতি কতোটা ভয়াবহ তা নীচের ছবিই প্রমাণ
প্রবল বৃষ্টিতে মাতামুহুরী নদীর বাঁধ ভেঙ্গে ও উপচে চকরিয়ার অন্তত ১৪ টি ইউনিয়ন প্লাবিত হয়েছে। এতে করে এই উপজেলার ২ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। ভারী বর্ষণ ও পাহাড়ী ঢলের কারনে উপজেলার ২ শতাধিক গ্রামের বসতভিটা কয়েক ফুট পানির নিচে তলিয়ে গেছে। বেশির ভাগ এলাকার টিউবয়েলগুলো পানিতে ডুবে থাকায় বিশুদ্ধ পানির জন্য হাহাকার চলছে। বন্যার পানিতে ভেঙ্গে গেছে লক্ষাধিক কাচা ঘরবাড়ি, হাজার হাজার গাছপালা। পানিতে তলিয়ে গেছে বিপুল পরিমান ফসলি জমি ও আমন ধানের বীজতলা। পানিতে ভেসে গেছে হাঁস-মুরগী ও কয়েক হাজার পুকুরের মাছ। এবারের বন্যায় কয়েকশত কিলোমিটার রাস্তা ও কালভার্ট ভেঙ্গে গেছে।
মাতামুহুরী নদীতে প্রচণ্ড ভাবে পাহাড়ী ঢল নেমেছে। ঢলের পানি ভাঙন গুলো দিয়ে পেকুয়া সদর ইউনিয়নের ঢুকে পড়েছে। পেকুয়া সদর ইউনিয়নের নন্দীর পাড়া, বাজারপাড়া, বলিরপাড়া, মোরার পাড়া, সৈকতপাড়া, পূর্ব বাঘগুজারা, চৈরভাঙ্গা, উত্তর মেহেরনামা, তেইল্যাকাটা, মছন্যাকাটা, সরকারী ঘোনা, ছিরাদিয়া, বিলাহাছুরা, গোয়াখালী, বাইম্যাখালী, মইয়াদিয়া, জালিয়াখালী, মগকাটা, হরিণাফাঁড়ি, গোয়াখালী টেকপাড়ায়সহ আরও অনেক এলাকার গ্রামীণ অবকাঠামো বন্যার পানিতে ফের তলিয়ে গেছে। কৃষকের আমনের সব বীজতলা ঢলের পানিতে তলিয়ে গেছে। শিলখালী ইউনিয়নেও বেড়ীবাঁধ উপচে পানি ঢুকেছে। পেকুয়া উপজেলা আওয়ামীলীগ নেতা জহিরুল ইসলাম এ প্রতিবেদককে জানিয়েছেন বন্যার পানি ঘন্টায় ঘন্টায় বেড়ে যাওয়ায় এলাকার লোকজন গরু ছাগলসহ নিয়ে সড়কে, বেড়িবাঁধ ও আশ্রয় কেন্দ্র্রের দিকে চলে যাচ্ছে। নিচু এলাকার বেশীরভাগ ঘরবাড়িতে ঢলের পানি উঠে গেছে। এসব এলাকার প্রায় ৫০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। তিনি বলেন গত ৩০ জুনের বন্যায় ভেঙ্গে যাওয়া বেডিবাঁধ দ্রুত পুন:নির্মাণ করা হলে এ অবস্থার সৃষ্টি হতো না। তিনি এবারের বন্যার পানি উঠার জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকতাদের দায়ীত্বহীনতা ও অবহেলাকে দায়ী করেছেন। পেকুয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ মারুফুর রশিদ খান বলেছেন; আশ্রয় কেন্দ্র গুলো খোলা রয়েছে। এলাকার লোকজনকে আশ্রয় কেন্দ্রে চলে যাওয়ার পরামর্শ দেয়া হয়েছে।
বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ রাস্তায় এসে ঘর বাঁধতে বাধ্য হয়েছে। পুরা এলাকায় অবিলম্বে সহায়তা দরকার। পানি নামার সঙ্গে সঙ্গে স্বাস্থ্যের সমস্যা দেখা দেবার প্রবল আশংকা রয়েছে। প্রতিরোধের জন্য এখনই উদ্যাগ নেওয়া দরকার।
এক মাসের ব্যবধানে পরপর ২ বার বন্যায় উবিনীগ কেন্দ্রের ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়েছে। উবিনীগ কেন্দ্রের বীজ ঘরে সংরক্ষিত বীজের মধ্যে ৫২ জাতের ধান, ৩০ প্রজাতির প্রায় ১২০ জাতের শাক-সবজির বীজ নষ্ট হয়েছে। কেন্দ্রের নার্সারীর প্রায় ৩০০০ চারা নষ্ট হয়েছে। পানির প্রবল স্রোতে প্রতিটি ঘরের বেড়ার নিচের ৩ ফুট ভেঙ্গে গেছে এবং অধিকাংশ বাঁশের বেড়া পচে গেছে। কেন্দ্রের সবগুলো ঘর, বারান্দার ও ভিটার মাটি পানির সাথে চলে গেছে। কেন্দ্রের আসবাবপত্র যেমন: কাঠের আলমারি, চেয়ার, টেবিল, টুল, চকির গোড়া পচে গেছে। চেয়ার, টেবিল একেবারে ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। তাছাড়া ফাইল, খাতাপত্র, বই ও প্রতিবেদন পানি এবং কাদায় নষ্ট হয়ে গেছে। রান্নাঘর ও হাসেঁর ঘর একপাশে হেলে গিয়েছে। উল্লেখ্য যে গত মাসের বন্যায় মুরগী, হাঁস সব ভেসে গিয়েছিল এবং পুকুরের সব মাছ ভেসে গিয়েছিল।
চকরিয়া পদ্মাবতি কেন্দ্র দুর্লভ গাছ ও বীজ সম্পদ সংরহের জন্য সুপরিচিত। বারবার বন্যার কারণে পদ্মাবতী বিদ্যাঘর মারাত্মক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যা অপূরণীয়। বাংলাদেশে কৃষকদের নেতৃত্বে প্রাণবৈচিত্র সংরক্ষণ কাজ এই এলাকায় এর ফলে হুমকির মুখে পড়তে পারে।
নয়াকৃষি ও প্রাণ বৈচিত্র সংরক্ষণে অগ্রসর গ্রামগুলোর মধ্যে ২ টি গ্রাম এবং কম্পক্ষে ৫ শতাধিক কৃষক পরিবার এই ভয়াবহ বন্যায় আক্রন্ত। নয়াকৃষি গ্রামের কৃষকদের বীজতলা, বর্ষাকালীন শাক-সবজি, হাঁস-মুরগী, গবাদী পশু, পুকুরের মাছ, রবি মৌসুমের বীজের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।