ফরিদা আখতার || Tuesday 09 June 2015
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বাংলাদেশে দুই-দিনের বা ৩৬ ঘন্টার সফরে এসে ব্যস্ত সময় কাটিয়ে গেছেন। জুন মাসের ৬ ও ৭ তারিখ তাঁর সফর নিয়ে সরকারের ব্যস্ততা ছিল লক্ষ্য করার মতো। ভাল করে পরিবেশ দিবস ও পালিত হয় নি। মাঝখানে আবার একটু খানি মমতা ব্যানার্জীও এসে ঘুরে গেছেন। তাঁকে স্বাগত জানাতে গিয়ে বাংলাদেশের নিজস্ব কায়দায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আর একদিন থেকে যাবার অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু তিনি তাঁর কাজ সেরে চলে গেছেন। অনুরোধ রক্ষা করেন নি। মোদীর সফরের সাথে তাঁর আসাটা বাংলাদেশের সফর সুচিতে কতটুকু খাপ খেয়েছে তা অনেকেই ভেবে পাচ্ছেন না, আমিও না।
দিত্বীয় দিনে সারাদিনের কাজ শেষে যাবার আগে, মোদী দীর্ঘ বক্তৃতা দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে, ঢাকা বিশবিদ্যালয়ের আয়োজিত অনুষ্ঠানে। তার বক্তৃতা না শুনে পারি নি। ভাল লেগেছে শোনা হিশেবে, হতাশ হয়েছি মর্ম বস্তুতে। কন্ঠের ওঠা-নামা, মুখের ভঙ্গী, সব কিছুই ভাল বক্তার লক্ষণ। তবে মনে হয়েছে ভারতের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে ৬৫% তরুনের ভাষায় কথা বলেছেন, তাদের উৎসাহ দিয়েছেন। এমনিতেই আসার আগে থেকে তরুণদের মতোই তিনি টুইটে ব্যস্ত ছিলেন নিজের মনের ভাব প্রকাশ করতে। কিন্তু আমরা ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিশেবে নরেন্দ্র মোদীর কাছে যা শোনার জন্যে বেশির ভাগ মানুষ কানটি খাড়া করে রেখেছিল তা তিনি বলেন নাই। তাই কথায় চিড়ে ভেজেনি, জল-পানি না পড়ার কারনে। তিস্তার পানির কোন আশ্বাস পাইনি, কিন্তু বিদ্যুতের ঝল্কানিতে ভরে গেছে তাঁর কথা। তিস্তার পানির জন্যে একদিকে হাহাকার অন্যদিকে বিদ্যুতের জন্যে সুন্দর বন বিপন্ন হবার আশংকায় ‘ভাল’ কথাগুলো কানে গিয়ে কষ্ট পেয়ে আছাড় খাচ্ছিল। অন্যদিকে নারীর ক্ষমতায়নের কথা এমন করে বলছিলেন, তা খুবই পুরুষতান্ত্রিক মনোভাবের প্রকাশ পেয়েছে। এতো পিঠ চাপড়ানি ভাল লাগে নি। বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রশংসা করতে গিয়ে তিনি বলে বসলেন, ‘নারী হওয়া সত্ত্বেও তিনি সন্ত্রাসের বিরুদ্ধ্বে………”। তাঁর এই মন্তব্য ভারতের নারীদেরও ক্ষুব্ধ করেছে।
তবে এসব কিছুই আমার এখন লেখার কারণ নয়। আমি চোখ রেখেছিলাম সংবাদ পত্রে নিরামিষ ভোজী বাংলাদেশে আমন্ত্রিত মোদীর জন্যে বাংলাদেশ সরকার খাবারের কি ব্যবস্থা করেছেন। বাংলাদেশের আতিথেয়তার সুনাম পৃথিবীজুড়ে রয়েছে, তবে সেটা মাছ-মাংস শাক-সব্জি, কোরমা পোলাও হলে টেবিল ভরে দেয়া কোন ব্যাপার নয়। কিন্তু শুধু নিরামিষ খাবারের বৈচিত্র্য আনা কঠিন কাজ। পত্রিকার শিরোনামেও ছিল মোদীর টেবিলে ১৯ পদের খাবার (যুগান্তর, ৭ জুন, ২০১৫)। আবার ভারতের প্রচার মাধ্যমেও বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। মোদী্র খাবার নিয়ে শিরোনাম করেছে ভারতের প্রচার মাধ্যম। The Hindustan Times ৭ জুন, ২০১৫ তারিখে শিরোনাম করেছে “100 veg dishes for Modi” এবং তালিকার মধ্যে রেখেছে বিশেষ ডাল, ধোকলা, এবং বাংলাদেশের বিশেষ মিষ্টান্ন খাবার।NDTV news আরও একটু বিস্তারিত করে লিখেছে শুরুতে গুজরাটি বিশেষ খাবার কামন ধোকলা, তার সাথে দই ও ধনিয়ার চাটনি; মূল খাবার থাকবে উত্তর ভারতীয় পনির-মাখন মাসালা, সব্জি শামি কাবাব, ডাল টাডকা, খিছিডি ইত্যাদী।
জানা গেছে মোদির খাবারের মেন্যু তৈরীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই খোঁজ-খবর নিয়েছেন। যুগান্তর লিখেছে “নিরামিষভোজী মোদি মাছ ছোঁবেন না, এমনকি ছোঁবেন না ঢাকার বিখ্যাত কাচ্চি বিরিয়ানি, কিংবা মাংসের নানা কিসিমের পদ। তাতে কি! প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারি বাসভবন গণভবনে চলছে এলাহি বন্দোবস্ত। ১৯ রকমের নিরামিষ পদের ব্যবস্থা করা হয় অতিথি প্রধানমন্ত্রীর জন্য। তালিকার মূল পদে থাকছে ভাঘারেলি খিচুরি। উপকরণ মসুর ডাল ও নানা ধরনের সবজি। সঙ্গে থাকবে নানা ধরনের এবং নানা স্বাদের ডালনা, সরষে দিয়ে সজনে ডাটা, আমের চাটনি। থাকবে মোদির নিজস্ব পছন্দ ভেণ্ডি কড়ি, অর্থাৎ ঢেঁড়স আর দুধ দিয়ে তৈরি। মোদির পছন্দের গুজরাটি খাবার সাদা খাট্টা ধোকলাও থাকবে এসবের সঙ্গে থাকবে তাজা ফল, আর অবশ্যই বাংলাদেশের বিখ্যাত পিঠেপুলি, পায়েস, ক্ষীর ও সন্দেশ।”
যুগান্তরের প্রতিবেদনে আরও জানা যায়, খাদ্য তালিকা ঠিক করার জন্যে প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে মোদির পছন্দের খাদ্যতালিকা জানতে চাওয়া হয়। তিনি কী কী খান না, সেটাও জেনে নেয়া হয়। দিল্লি এবং ঢাকার মধ্যে দূতাবাসের মাধ্যমে এ নিয়ে বিস্তারিত তথ্য বিনিময় হয় বলে খবর প্রকাশ করে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলো। অর্থাৎ মাছে-ভাতের বাংলাদেশে গুজরাটি নিরামিষভোজী মোদী ঠিক মতো খেতে পারবেন কিনা তা নিয়ে সংশয় ছিল ভারতীয় গণমাধ্যমের। জানি না, রান্নার জন্যে বাবুর্চি ভারত থেকে আনা হয়েছিল কিনা।
বাংলাদেশের রান্নার বিশেষ স্বাদ আছে। এখানে মসলার ব্যবহার ভারতের চেয়ে ভিন্ন। এমন কি, পশ্চিম বঙ্গের সাথেও সব কিছুতে মেলে না। বাংলাদেশের মানুষ সব্জিও খায় প্রচুর। কিন্তু শুধু সব্জির রান্না করে না। অল্প করে চিংড়ি মাছ হলেও দিয়ে দেয় লাউয়ের সাথে, কিংবা পুঁই শাকে। এটাই সব্জি। তবে নিরামিষ নয়। আবার সজনা দিয়ে সর্ষে বাটা খেতেও খুব মজা। সেটা নিরামিষ। বাংলাদেশের খাবারের তুলনা নেই। দুঃখের বিষয় যে ভারতের প্রধানমন্ত্রিকে ইলিশ মাছ খাওয়ানোর কোন উপায় নেই।
তবুও ভারতের প্রধান মন্ত্রীর খাবার তো ঠিক হতেই হবে, এবং নিরামিষভোজীর রান্না নিয়মেই হতে হবে। কৌতুহল মেটাতে শেষ পর্যন্ত নৈশ ভোজ সভার (বেঙ্কোয়েট) ছাপানো মেন্যু পেয়ে গেলাম। অন-লাইনেই তা পাওয়া যাচ্ছে। রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে জুনের ৬ তারিখ নৈশ ভোজের আয়োজন করা হয়েছিল। এখানে সেদিন রাতে অন্তত কি খাবার দেয়া হয়েছে তার সুনির্দিষ্ট তালিকা পাওয়া গেল। এতে অন্যান্য খাবারের পাশাপাশি মূল খাবার হিশেবে যা ছিল তা হচ্ছে, সব্জি শামি কাবাব, পনির-মাখন মাসালা, পটল দোলমা, ভাগারী বেগুন, ডাল টাডকা। সাথে ছিল হায়দ্রাবাদী সব্জি বিরিয়ানী, খিছিডি, চাপাতি-নান রুটি ইত্যাদী।
বোঝা গেল ভারতের প্রধান মন্ত্রীর পাতে বেগুনের একটি পদ ছিল, যার নাম ভাগাড়ি বেগুন। মেন্যুতে এর বর্ণনা দেয়া হয়েছে, “মিষ্টি ও টক তেঁতুলের সাথে বেগুন সেদ্ধ ও বাদামের ঝোল’। এটাই ভাগারী বেগুন। নিশ্চয়ই খেতে খুব স্বাদ হবে। বাংলাদেশেও টক দিয়ে বেগুন রান্না করা হয়। এর জন্যে বিশেষ জাতের বেগুনও আছে। যেমন ঝুমকা, খুদে বা তিত বেগুন। কৃষকরা এই বিষয়টি জেনেই চাষ করেন।
প্রশ্ন হচ্ছে, নৈশ ভোজে বেগুনের পদ তৈরি হয়েছে, তার জন্যে বেগুন কোথা থেকে কেনা হয়েছে? ঢাকার কাওরান বাজার থেকে? ভারত থেকে নিশ্চয়ই আনা হয় নি। এটা কি বাংলাদেশের কোন স্থানীয় জাতের বেগুন ছিল নাকি বিটিবেগুন ছিল? ঢাকা থেকে কেনা হলে কৃষি মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরির একটি ভাল সুযোগ ছিল নয়টি জাতের বিটি বেগুন যা বর্তমানে ১০৮ জন কৃষকের মাধ্যমে চাষ করা হচ্ছে এবং তাঁর ভাষায় খুব ‘সফল’ হচ্ছে, তার মধ্যে একটি জাত সরবরাহ করে নৈশ ভোজের ভাগারি বেগুন রান্না করে ভারতের প্রধানমন্ত্রীসহ সকল অতিথিকে খাওয়ানোর। কৃষি মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতা ছাড়া অবশ্য নৈশ ভোজের আয়োজকদের বাজার থেকে কেনার উপায় নেই কারণ বিটি বেগুনে লেবেল লাগিয়ে বিক্রি করা হচ্ছে না। এটা বিটিবেগুন চাষের অনুমোদনের শর্তের লংঘন। কৃষি মন্ত্রী উদ্যোগ নিয়ে সরাসরি বিটি বেগুন চাষীর কাছ থেকেই সংগ্রহ করে দিতে পারতেন। তিনি দাবী করতে পারতেন এই বেগুন ‘নিরাপদ’ কারণ এতে কোন কীটনাশক ব্যবহার করা হয় না। যদিও, মাঠ পর্যায়ের তথ্য থেকে জানা যায় বিটি বেগুন চাষ করতে গিয়ে কৃষি কর্মকর্তাদের পরামর্শেই পাতায় লাগা পোকা, অন্যান্য পোকার আক্রমনের হাত থেকে বাঁচতে কীটনাশক ব্যবহার করতে হয়, কেবল ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকার জন্যে কীটনাশক ব্যবহার করা হয় না। মাঠ পর্যায় থেকে এটাও দেখা গেছে বিটি বেগুনের ফলেও পোকা লেগেছে।
ভারতের নিরামিষভোজী প্রধানমন্ত্রীকে বিটি বেগুনের তরকারি কেন খাওয়ানো হোল না তার কারণ কি এই যে বিটি বেগুন আসলে ট্রান্সজেনিক; অর্থাৎ এর মধ্যে জেনেটিক ইঞ্জিনীয়ারিংয়ের মাধ্যমে ব্যাক্টেরিয়ার জিন প্রবেশ করানো হয়েছেন? কাজেই এটা আর নিরামিষের পর্যায়ে নেই, এর মধ্যে অন্য প্রাণীর জিন ঢোকানো আছে। তাই যদি হয় তাহলে বিটি বেগুন বাজারে বিক্রির ক্ষেত্রে লেবেল লাগানো আরো জরুরী কারণ কোন নিরামিষভোজী এই বেগুন খেতে পারবেন না। অথচ লেবেল না থাকলে তিনি না বুঝে ভুল করে ফেলতে পারেন। আর যদি বিটিবেগুন অন্য বেগুনের মতোই হয় তাহলে ভারতের কোম্পানি মাহিকোর সহায়তায় মন্সান্তোর দেয়া বেগুনের এই প্রযুক্তি বাংলাদেশের মাটিতে বসে ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে আপ্যায়ন করতে পারলে বাংলাদেশের জন্যে কত বড় সার্টিফিকেট হতে পারতো! নরেন্দ্র মোদী ভারতে বিটি বেগুন চাষের ওপর অনির্দিষ্টকালের নিষেধাজ্ঞা থাকার কারনে সেখানে বসে খাবেন এমন সুযোগ নেই। অথচ বাংলাদেশে পরিবেশবাদী, কৃষক সংগঠনসহ অনেকের আপত্তি জানানো সত্ত্বেও জিএম খাদ্য ফসল প্রবর্তনের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক নিয়ম উপেক্ষা করে মাঠ পর্যায়ে চাষের অনুমোদন দেয়া হয়েছে এবং যারা আপত্তি জানাচ্ছেন তাদের ‘মুর্খ্য’ বলে আখ্যায়িত করা হচ্ছে। সেই দেশে বেড়াতে এসে তিনি এই বেগুন খেয়ে গেলে যারা প্রবর্তন করেছেন তাদের কথা বলার সুযোগ আরও বাড়তো।
গত মে মাসের ২০ তারিখে যুক্তরাষ্ট্রের কর্ণেল বিশ্ব বিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে কৃষির উন্নতি ও খাদ্য নিরাপত্তার জন্যে বিশেষ সম্মাননা দেয়া হয়েছে। মনসান্তোর পক্ষে গবেষণাকারী এই প্রতিষ্ঠানকে প্রধানমন্ত্রী বিটি বেগুন উদ্ভাবনের জন্যে ধন্যবাদ দিয়েছেন। কিন্তু মোদীর এই সফরে বিটি বেগুন রাষ্ট্রীয় অতিথিকে না খাওয়ানোর অর্থ হতে পারে এর স্বাস্থ্য ঝুঁকি সম্পর্কে এখনো নিশ্চিত হওয়া যায় নি, তাই নরেন্দ্র মোদী্র কোন ধরণের কোন স্বাস্থ্য ঝুঁকি সৃষ্টি না করা বুদ্ধিমানের কাজ হয়েছে। ভাগাড়ি বেগুন তাই বিটি বেগুন দিয়ে রান্না হয় নি।
তবে এর মাধ্যমে এটাও প্রমান হয় পরিবেশ বাদীরা স্বাস্থ্য, পরুবেশ দুষণ ও বেগুনের জাত নষ্ট হবার ক্ষেত্রে যে সব আশংকা করছেন তা অমুলক নয়। যে খাদ্য মেহমানকে খাওয়ানো যাবে না, তা নিশ্চয়ই নিরাপদ ও ভাল খাদ্যের তালিকায় পড়বে না। যাক, বিটি বেগুনের বিরোধিতাকারীরা যথেষ্ট অবহিত হয়েই দেশের মানুষের জন্যে উদ্বেগ প্রকাশ করছেন।