তামাকের শৃংখল থেকে মুক্তিঃ

ফরিদা আখতার || Wednesday 06 May 2015

খাদ্য সংকট, পরিবেশ ও মানুষের স্বাস্থ্যের ক্ষতি রোধে তামাক চাষ নিয়ন্ত্রণ

তামাক কোন খাদ্য ফসল নয়, এমনকি কৃষি ফসলের পর্যায়েও পড়ে না। প্রয়োজনীয় কোন শিল্পের কাঁচামালও নয়। তামাক চাষ করা হয় পাতা উৎপাদন করার জন্যে যে পাতায় নিকোটিন থাকে বলে এই পাতা দিয়ে বিভিন্ন মানের ও ব্রান্ডের সিগারেট তৈরী করা হয়, বিড়ি ও জর্দা-গুল তৈরি করা হয়। বিশ্বব্যাপী এখন সচেতনতা বৃদ্ধ্বি এমন পর্যায়ে এসেছে যে ধূমপান ও ধোঁয়াবিহীন তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর এবং অনেক অসংক্রামক রোগ (NCD) যেমন হার্ট এটাক, হাই-ব্লাড প্রেসার, শ্বাস কষ্ট জনিত রোগ, ডায়াবেটিস ও অন্ত্রনালীর রোগের জন্যে দায়ী। সারা বিশ্বে প্রতিবছর লক্ষ কোটি মানুষ ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহারের কারণে মারা যাচ্ছে এবং পঙ্গুত্ববরণ করছে। বিগত শতাব্দিতে ১০ কোটি মানুষ মারা গেছে যা দুটি বিশ্ব যুদ্ধ্বের মৃত্যুর সংখ্যার চেয়াও বেশী। কিন্তু তামাক ব্যবহার এভাবে চলতে থাকলে এই শতাব্দিতে মৃত্যুর হার বেড়ে হবে ১০০ কোটি। তবুও তামাকজাতদ্রব্যের ব্যবহারে ক্ষতির দিকটি এখন অনেক বেশী জানা হয়ে আছে, কিন্তু এর সরবরাহের দিক বিশেষ করে মূল যে পাতার চাষ করে বিড়ি সিগারেট তৈরি হয়, তার কারণে কি ক্ষতি হয় সে সম্পর্কে খুব বেশী জানা নাই। তামাক চাষের ক্ষতি আরো অনেক বেশী ভয়াবহ এবং বিস্তৃত; এর সাথে জড়িত রয়েছে খাদ্য উৎপাদন, পরিবেশ এবং কৃষক, তার পরিবার এবং শ্রমিকদের স্বাস্থ্য।

বাংলাদেশ স্বাধীন হবার আগে থেকে এই দেশে ব্রিটিশ আমেরিকান টোবাকো কোম্পানি রংপুরে তামাক চাষ ১৯৬৪ সালে পরীক্ষামূলকভাবে শুরু করে। এরপর স্বাধীনতার পর তারা ব্যাপকভাবে চাষ শুরু করে এবং এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় সম্প্রসারণ করতে থাকে। মাত্র দু’তিনটি তামাক পাতার জাত যেমন মতিহারী, বার্লী ও ভার্জিনিয়া যাকে ফ্লু কিউর্ড ভার্জিনিয়া (FCV) বলা হয়, তার চাষ সবচেয়ে বেশী হয়। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রায় ১০৮,০০০ হেক্টর জমিতে সারাদেশে বিভিন্ন জেলায় তামাক চাষ হচ্ছে। ফ্লু কিউর্ড ভার্জিনিয়া আগে আমদানী করে সিগারেট বানাতো, এখন তারা দাবী করে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক মানের FCV পাতা উৎপাদন করতে সক্ষম এবং এখন বাংলাদেশ থেকে এই পাতা বিদেশে রপ্তানী হয়। এই কথা বেশী জোর দিয়ে বলার কারণ হচ্ছে বিশ্বের অনেক দেশেই, বিশেষ করে ধনী দেশে, এখন তামাক চাষ নিষিদ্ধ। বাংলাদেশ রপ্তানী উন্নয়ন ব্যুরোর মতে তামাক রপ্তানি করে আয় হয়েছে ৫ কোটি ডলার (২০০৯-১০), অথচ তার আগে থেকেই কৃষি পণ্য রপ্তানি করে আয় হয়েছে ৯ কোটি ডলার, শুধু সব্জি রপ্তানী করে আয় হয়েছে সাড়ে ৪ কোটি ডলার। রপ্তানী আয়ের যুক্তিতে তামাক চাষ মোটেও বাড়তি কোন আয়ের উৎস নয়। বরং এই জমিতে কৃষি পণ্য আবাদ করলে আরো বেশী বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব হোত।

তামাক চাষের এলাকা বাড়লে খাদ্য শস্য উৎপাদন কমে যায়

উবিনীগ তিনটি এলাকায় (কুষ্টিয়া, কক্সবাজার বিশেষ করে চকরিয়া এবং বান্দরবান) ২০০৬ সাল থেকে তামাক চাষের ক্ষতি এবং যারা এই চাষ বন্ধ করে খাদ্য উৎপাদন করতে চায় সে উপায় সম্পর্কে বিস্তারিত গবেষনা করেছে। গবেষণায় দেখা গেছে কুষ্টিয়ায় দীর্ঘদিন তামাক চাষের কারণে জমির উর্বরতা নষ্ট হবার পর কক্সবাজার ও বান্দরবানসহ নতুন নতুন এলাকায় তামাক চাষের এলাকা বাড়ানো হচ্ছে। কক্সবাজার-বান্দরবান এলাকায় ১৯৯৮ সালে তামাক চাষ ছিল মাত্র ৭৪০ একর জমিতে কিন্তু ২০০৫-২০০৬ সালে এসে তা বেড়ে যায় ৪৭৫০ একর জমিতে অর্থাৎ ৫৪০% বৃদ্ধি পেয়েছে। কুষ্টিয়াতে নতুন এলাকায় গেলেও তা বেড়েছে ৪১%, কারণ সেখানে জমির উর্বরতা নষ্ট হয়ে গেছে এবং জ্বালানী কাঠ আর নেই। গত (২০১৪-১৫) মৌসুমে চকরিয়াতে তামাক চাষ হয়েছে ৮৭৫০ একর জমিতে এবং বান্দরবানের আলীকদম ও লামায় ১০,২০০ একর জমিতে তামাক চাষ হয়। এতো পরিমান জমিতে তামাক চাষ হওয়ার অর্থ হচ্ছে এই জমিতে কোন খাদ্য উৎপাদন হচ্ছে না।



কুষ্টিয়াতে তামাক করলে মশুর ডাল, সরিষা, তেল, পেয়াজ, রসুন, গম, ভুট্টা ও শীতকালীন সব্জিসহ অনেক ফসল করা যায় না। ধানের মধ্যে বোরো ধান যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয় তেমনি আউস লাগাবার সময় ধরা যায় না। কক্সবাজার ও বান্দরবানে আলু, বেগুন, বাদাম, রঙ্গিমা সীম, ফেলন, মরিচ, টমেটো, সরিষা, তরমুজ, বাঙ্গি, ক্ষিরা, মিষ্টি কুমড়া, রসুন, বরবটি, কপি, ঢেড়শ, পেয়াজ, করলা, কচু, বোরো ধান, মিষ্টি আলু ভূট্টা চাষ করা যায় না। এসবই হচ্ছে খাদ্য শস্য যা তামাক এককভাবে মাত্র একটি ফসলে কেড়ে নিচ্ছে।

উবিনীগের গবেষণায় তিনটি এলাকার কৃষকরা নিজেরা হিশাব করে দেখিয়েছেন বান্দরবানের লামা উপজেলায় তামাক চাষের কারণে ১০, ০৯০ একরে প্রায় ২১ ধরণের খাদ্য শস্য উৎপাদন করা যাচ্ছে না, যার বাজার মূল্য ১১ কোটি টাকা, আলী কদমে ৫,১২০ একরে ২৩ ধরণের খাদ্য ফসল করা যেতো যার মূল্য প্রায় ৪ কোটি টাকা, চকরিয়াতে ৪,২৮৩ একর জমিতে তামাক চাষ না করলে ২৪ ধরণের খাদ্য শস্য উৎপাদন করে আয় হোত প্রায় ৩ কোটি টাকা এবং কুষ্টিয়ার দৌলতপুরে ২০,০০০ একর জমিতে ৭ ধরণের খাদ্য শস্য উৎপাদন করে আয় হোত ১৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ তামাক অর্থকরি ফসল বলে যে দাবী করে তা সঠিক নয়, বরং খাদ্য শস্য চাষ করে এর চেয়ে অনেক বেশী আয় করা সম্ভব। শুধু আয়ের প্রশ্ন নয়, তামাক চাষ করলে কোটি টাকার খাদ্য শস্য থেকে এই নির্দিষ্ট এলাকার মানুষ বঞ্চিত হচ্ছে।



দীর্ঘদিন তামাক চাষ করার কারণে কৃষক তামাক মৌসুমের পরেও কোন খাদ্য ফসল উৎপাদন করতে পারেন না। সে কারণে তামাকের গ্রামগুলোতে চাষীদের হাতে আউস, আমণ ধান এবং বর্ষা কালীন ও শীতকালীন ফসলের বীজ থাকে না। যারা তামাক চাষ করবে বলে ঠিক করে তাদের জন্যে কিছু ফসল লাগানোর সময় কিংবা কিছু ফসল কাটবার সময়ের সাথে সমস্যা তৈরি হয়। তাই তারা অন্য সময় জমি ফেলে রাখে কিংবা ধৈঞ্ছা বুনে রেখে দেন। অর্থাৎ তামাক চাষ করলে সারা বছরই খাদ্য ফসলের সাথে সংঘাত হয়।

তামাক আগ্রাসী ফসল

তামাক চাষ যেভাবে শুরু করা হয় তাতে সরাসরি আর্থিক লাভের সম্পর্ক দেখানো হয়। তামাক কোম্পানি সরাসরি জমির মালিকের সাথে চুক্তি করে নেয় এবং তাদের কোম্পানি কার্ড দিয়ে নানা সুযোগ সুবিধা দিয়ে এমনকি আগাম টাকা দিয়ে লোভ দেখায়, যা অন্যান্য ফসলের ক্ষেত্রে সরকারের পক্ষ থেকে পাওয়া যায় না। ফলে কৃষক কোম্পানির দেয়া শর্তে নির্দিষ্ট পরিমান পাতা কোম্পানি-নির্ধারিত দামে সরবরাহে বাধ্য হয়। তামাক পাতার দাম আগেভাগেই ঘোষনা দিয়ে লোভ দেখায়। নগদ অর্থে পাতা কিনবে বলে কৃষকরা আশাবাদী হয় নগদ আয় হবে বলে। যেমন ২০০৯-১০ সালে এসে প্রথম থেকেই তামাক কোম্পানী কৃষককে পাতার দাম বাড়িয়ে এবং নানা প্রোলভন দেখিয়ে পূর্বের এলাকায় আরও বেশী জমি এবং নতুন নতুন জেলা তামাক উৎপাদনের আওতায় নিয়ে আসতে সক্ষম হয়। অন্যদিকে কৃষি ফসলের বাজার নির্ধারিত থাকে না। দাম ওঠা নামা করলে কৃষকের আর্থিক ক্ষতি হয় কিংবা ফলণ ভাল হলেও খরচ ওঠে না। কৃষি বিভাগ থেকে কোন আগাম সুবিধাও পাওয়া যায় না। এসব সুবিধার অভাবের সুযোগ নিয়ে কোম্পানি কৃষককে তাদের শৃংখলে বেঁধে ফেলতে সক্ষম হয়। কোম্পানি চেষ্টা করে এক গ্রাম বা কয়েকটি গ্রাম একসাথে নিয়ে ব্যাপকভাবে চাষ করাতে। এর মাঝখানে কোন কৃষক তামাক চাষ না করলে তার ফসল করা কঠিন হয়ে পড়ে, ফলে এক পর্যায়ে সেও তামাক চাষ করতে বাধ্য হয়। কোম্পানির কাছে কৃষক গুরুত্বপুর্ণ নয়, তাদের দরকার জমির। তাই কৃষকের মাধ্যমে জমির ওপর দখল স্থাপন করে। এবং জমি যখন উর্বরতা হারায় তখন তাকে পেছেনে ফেলে অন্য জমির খোঁজে চলে যায়। তামাক চাষ এভাবে একের পর এক নতুন এলাকায় আগ্রাসন চালায়। এবং খুবই পরিকল্পিতভাবে কোম্পানী কার্ডের মাধ্যমে কৃষকদের দীর্ঘ বা স্বল্পমেয়াদী চুক্তিতে বেঁধে ফেলে।

ব্রিটিশ আমেরিকান টোবাকো কোম্পানি তামাক চাষ শুরু করলেও বর্তমানে দেশী অনেক কোম্পানি এর সাথে যুক্ত হয়েছে। এর মধ্যে আছে ঢাকা টবাকো,আবুল খায়ের লীফ টবাকো বিভিন্ন ধরণের পাতা যেমন (NC-95, K-326, SG-28, CSC-447), চাষ করায়। এরাও ব্রিটিশ আমেরিকান টবাকো কোম্পানির মতো কৃষককে বেঁধে ফেলে।

তামাক চাষ পরিবেশে জন্যে মারাত্মক হুমকি

তামাক চাষে প্রথম দিকে কিছু নগদ আয়ের আকর্ষণ সৃষ্টি হলেও ধীরে ধীরে কৃষক বুঝতে পারে তারা আসলে বাঁধা পড়ে গেছেন। এবং নানারকম ক্ষতির শিকার হচ্ছেন। খাদ্য শস্য উৎপাদন কমে গিয়ে খাদ্য ঘাটতি দেখা দেয়। কৃষককে তামাক চাষের ‘নগদ’ টাকায় বাজার থেকে চাল, শাক, সব্জি, ডাল ইত্যাদি কিনে খেতে হয়। এক পর্যায়ে দেখা যায় তামাকের বিক্রি থেকে পাওয়া নগদ টাকা সারা বছরের খাদ্য কেনার জন্যে যথেষ্ট নয়। দেনা শোধ করা এবং চিকিৎসা করতে গিয়েও অনেক টাকা খরচ হয়ে যায়। তাই পরবর্তী মোউসুমের আগে কোম্পানি আবার তাকে যখন আগাম টাকা দিতে আসে তখন সে টাকা নিয়ে সংসার চালায় আর পরের মৌসুমে তামাক চাষের জন্যে দায়বদ্ধ হয়ে পড়ে।

তামাক চাষের জন্যে একদিকে উর্বর জমির দরকার অন্যদিকে দরকার পাতা পোড়ানোর জন্যের লাকড়ির। এই লাকড়ীর জন্যে হাজার হাজার গাছ অবাধে কেটে ফেলা হচ্ছে। তাই তারা জমির উর্বরতা কমে গেলে এবং গাছ না থাকলে এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় চলে যায়। তামাক চাষে পরিবেশের ক্ষতির কয়েকটি দিক রয়েছে। যেমন, তামাক চাষের শুরু থেকে পাতা বড় হওয়া পর্যন্ত অনেকবার নানা ধরণের সার-কীটনাশক ব্যবহার করতে হয়। ইউরিয়া,ফসফেট থেকে শুরু করে পটাশিয়াম সালফেটসহ প্রায় ১০ রকমের সার ও ৫২টি ব্রান্ডের বিষ ব্যবহার করতে দেখা গেছে কুষ্টিয়াতে। চাষীরা বলেন খাদ্য উৎপাদনের চেয়ে তামাকের জমিতে ৮ গুন বেশী সার ও বিষ ব্যবহার করতে হয়।এর ফলে মাটি নষ্ট হয়এবং এই সার-বিষ গড়িয়ে আশে পাশের পানিতে গেলে মাছ ও জলজ প্রাণী ধ্বংস হয়ে যায়। তামাক ক্ষেতে বিষে আক্রান্ত কীটপতংগ অন্যান্য প্রাণী খায় বলে তামাক চাষ এলাকায় পশু-পাখীও বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া মৌমাছি, প্রজাপতি, কেন্ন, ঘাস ফড়িং, ব্যাং ও কেচোর মতো কৃষির জন্যে উপকারী প্রানসম্পদ আমরা হারাতে বসেছি। কৃষকের বাড়ীতে গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি পালন করা যায় না। তামাক চাষীর বাড়ীতে গরু-ছাগলের খাদ্য থাকে না। গরু-ছাগল মানুষের চেয়েও বুদ্ধ্বিমান, তারা তামাক পাতা খায় না।

তামাক এলাকা এবং তামাক চাষীর বড় পরিচয় হচ্ছে তার বাড়ীর সামনে কোন তন্দুর (বান্দরবান) কিংবা ভাটিঘর (কুষ্টিয়া)।


তন্দুরঃ ১৩ ফুট x ১৩ ফুট x ১৫ ফুট


প্রতি মৌসুমে ৫ কানি (২ একর) জমির পাতার জন্য ৮ লোড পাতা পোড়ানো হয়,প্রতি লোডে ৩৫ মণ খড়ি লাগে।প্রতি মৌসুমে প্রতি তন্দুরে ২৪০ মণ খড়ি লাগে,এই খড়ি পেতে হলে মাঝারি সাইজের ১০০০ থেকে ১২০০ গাছ কাটতে হয়।চকরিয়াতে ২০০০ চুল্লি আছে অতএব এখানে ৪৮০০ টন খড়ি প্রতি মৌসুমে ব্যবহার হয়। বান্দরবানের পাহাড়গুলোতে এখন কোন পুরোন গাছ নেই। বিশেষ করে বনজ, ফলাদি ও ওষূধি গাছ একেবারে ধ্বংস হয়ে গেছে। এর মধ্যে রয়েছে আম, জাম, কাঠাল, কড়ি, হারগুজা, গর্জণ, গুটগুইট্টা ইত্যাদি। বান্দরবনের পাহাড়ে এখন যে গাছ দেখা যায় তা হচ্ছে একাশিয়া, ইউকেলিপ্টাসের মতো পরিবেশের জন্যে অনুপযুক্ত গাছ। ব্রিটিশ আমেরিকান টোবাকো কোম্পানি পরিবেশ বান্ধব প্রমান করতে গিয়ে এই সব গাছ লাগিয়ে ভরে রেখেছে তাদেরই সুবিধার জন্য। উলটো পরিবেশের ক্ষতি করছে।

তামাক পাতা যেখানে পোড়ানো হয় তার কাছে গেলে টের পাওয়া যায় বাতাস কত দুষিত হয়ে আছে। সেখানে থাকেন তাদের তীব্র শ্বাস কষ্ট হয়, চোখ জ্বালা-পোড়া করে এবং চোখ দিয়ে পানি পড়ে। স্কুলের কাছে তামাকের তন্দুর থাকলে শিশুরা আক্রান্ত হয়। পরিবারে তামাক পোড়ানোর কাজ নারী ও শিশুদের জন্যে অত্যন্ত ক্ষতিকর।

তামাক চাষে স্বাস্থ্যের মারাত্মক ঝুঁকি

তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহারের কারণে স্বাস্থ্য ঝুঁকির কথা সবাই জানে। কিন্তু তামাক চাষের সাথে যারা যুক্ত থাকেন তারা নানাভাবে রোগের শিকার হন। এই রোগ বা স্বাস্থ্য সমস্যা হওয়ার তিনটি প্রধান কারণ দেখা যায়। এক – তামাক চাষে অতিরিক্ত শ্রম দিতে হয়। বীজতলা থেকে শুরু করে পাতা তোলা পর্যন্ত মাঠে এবং পাতা তুলে এনে তন্দুরে পোড়াবার আগে ও পরে এবং বাজারে বিক্রির আগ পর্যন্ত প্রচুর পরিশ্রম করতে হয়। এর ফলে নানা ধরণের রোগ বা স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা যায়। দুই- তামাক চাষে ব্যাপক পরিমান সার-কীটনাশক ব্যবহার করতে হয়, যা আধুনিক কৃষিতে যে পরিমান সার-কীটনাশক ব্যবহার করে তার চেয়ে অনেক বেশী। রাসায়নিক সার-কীটনাশকের ব্যবহারের সময় কোন প্রকার নিরাপত্তামুলক ব্যবস্থা থাকে না। সে কারণে নানা রোগ ও স্বাস্থ্য সমস্যা হয়। তিন- তামাক চাষে তামাক চারার পাতার যত্ন করতে গিয়ে এর মধ্যে যে নিকোটিন আছে তা ভেজা অবস্থায় হাত দিয়ে ধরলে কিংবা শরীরে এসে ছিটিয়ে পড়লে নিকোটিন চামড়ার মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করে। এর ফলে নানা রোগ ও স্বাস্থ্য সমস্যা হয়।

উবিনীগের গবেষণায় দেখা গেছে তামাক চাষের সময়ে প্রায় ৫০ দিনের পরিশ্রম লাগে। শতকরা ২০ ভাগের বেশী মানুষের কোমর ব্যাথা, আরও ২০% এর প্রশ্রাবের সমস্যা, অনেক ক্ষণ রোদে কাজ করতে গিয়ে শরীর শুকিয়ে যাওয়া, জ্বর হওয়া, পাতলা পায়খানা হওয়া ইত্যাদী নারী-পুরুষ সকলের মধ্যে দেখা গেছে। পাতা পোড়াতে গিয়ে মহিলাদের তন্দুরের সামনে বসে থাকতে হয় প্রায় ৬০ থেকে ৭২ ঘন্টা। একনাগারে চুলায় কাঠ দিতে হয়। এই সময় তারা ঘুমাতে পারে না এবং মানসিকভাবে অস্থির থাকে পাতার মান ঠিক থাকে কিনা এই চিন্তায়।

অসংক্রামক ব্যাধির মধ্যে উচ্চ রক্তচাপ তামাক গ্রামের মানুষের মধ্যে শতকর ১০- ১২% ভাগ পাওয়া গেছে। হৃদরোগ ২.৫% , দীর্ঘমেয়াদী শ্বাস কষ্ট ১২% এবং রোগ নির্ণয় যাদের হয়েছে তাদের মধ্যে ক্যান্সারও পাওয়া গেছে। ডায়াবেটিস রোগের সংখ্যা কিছুটা কম পাওয়া গেছে। এই সকল রোগ খাদ্য গ্রামেও পরীক্ষা করে দেখা হয়েছে, এবং তামাক গ্রামের তুলনায় সেখানে এই সব রোগের হার কম, যদিও আধুনিক কৃষি গ্রামে সার-কীটনাশকের ব্যবহার থাকার কারণে এই সব রোগ থাকলেও তুলনায় বেশ কম।

এ ছাড়া হাতের চামড়া কালো আঠালো হয়ে যাওয়া, নানা ধরণের চামড়ার রোগ, পেটের অসুখ এবং মানসিক সমস্যা দেখা গেছে। নারীদের মধ্যে বাচ্চা নষ্ট হওয়া, কিংবা সময়ের আগে বাচ্চা হয়ে যাওয়ার ঘটনা দেখা গেছে।

বিশ্ব ব্যাপী তামাক পাতা চাষের সাথে গ্রীণ টোবাকো সিকনেস (GTS)-এর সম্পর্ক পাওয়া গেছে। ব্রিটিশ আমেরিকান টোবাকো কোম্পানি নিজেও এই রোগ সম্পর্কে জানে। তামাক পাতায় নিকোটিন শরীরে যাওয়ার ফলে এই রোগ হয়। তবে রোগের লক্ষণগুলো এমন যে এর জন্যে রোগী ডাক্তারের কাছে ছুটে যায় না। কারণ ডাক্তারের কাছে যাওয়া মানে খরচ। গ্রীণ টোবাকো সিকনেসের উপসর্গ হচ্ছে দুর্বলতা, বমিভাব, মাথা ধরা, মাথা ঘুরা, তল পেটে ব্যাথা, শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া, শীত শীত ভাব লাগা, মুখ দিয়ে লালা ঝরা, এবং ঘেমে যাওয়া। আমরা দেখেছি তামাক গ্রামের কৃষকদের মধ্যে এই উপসর্গ গুলো আছে, কিন্তু অন্য গ্রামে সবগুলো একসাথে পাওয়া যায় নি।

তামাক চাষ নিয়ন্ত্রণে সরকারের উদ্যোগ

তামাক নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয় মূল কাজ করছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ৫৬তম সম্মেলনে ধুমপান ও তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবহার নিরুৎসাহিত করার জন্যে Framework Convention on Tobacco Control (FCTC) নামক কনভেনশনে বাংলাদেশ ১৬ জুন ২০০৩ তারিখে স্বাক্ষর এবং ১০ মে ২০০৪ তারিখে অনুস্বাক্ষর করে। বাংলাদেশ সরকার ২০০৫ সালের ১৫ মার্চ ধুমপান ও তামাকজাত দ্রব্য উৎপাদন, ব্যবহার, ক্রয়, বিক্রয় ও বিজ্ঞাপন বিয়ন্ত্রনের লক্ষে বিধান প্রণয়নকল্পে ‘ধুমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ আইন ২০০৫ প্রণয়ন করে রুল ও বিধি জারি করে। যদিও এই আইনে প্রধানত: তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার বন্ধ করার কথা রয়েছে তবুও ১২ নং ধারায় তামাকজাত দ্রব্যের বিকল্প ফসল উৎপাদনের জন্য ঋণ প্রদানের কথা উল্লেক করা হয়েছে। বলা হয়েছে:

১২. তামাকজাত দ্রব্যের বিকল্প ফসল উৎপাদনের জন্য ঋণ প্রদান—

১. তামাক চাষীকে তামাকজাত দ্রব্য উৎপাদনে নিরুৎসাহ এবং বিকল্প অর্থকরী ফসল উৎপাদনে উৎসাহ প্রদানের জন্য সরকার সহজ শর্তে ঋণ প্রদান করিবে, এইরুপ সুবিধা এই আইন কার্যকর হইবার পরবর্তী পাঁচ (৫) বৎসর পর্যন্ত অব্যাহত থাকিবে।

২. তামাক জাত দ্রব্যে উৎপাদন ও ব্যবহার ক্রমাগত নিরুৎসাহিত করিবার জন্য উদুদ্ধকরণ এবং তামাকজাত সামগ্রীর শিল্প স্থাপনে নিরুৎসাহিত করিবার লক্ষে সরকার প্রয়োজনীয় নীতিমালা প্রণয়ন করিবে।

কিন্তু ২০১৩ সালে আইন সংশোধনের সময় বলা হয়েছে তামাক চাষ নিরুৎসাহিত করার জন্যে তামাক চাষ নীতি তৈরী করা যেতে পারে। এই বিষয়ে সম্প্রতি সরকার কাজ শুরু করেছে।

তামাক চাষ নিয়ন্ত্রণ করার বিষয়টি এককভাবে কৃষি মন্ত্রণালয় বা বিভাগের নয়। এটি একটি আন্তমন্ত্রণালয় বিষয়। ইতিমধ্যে কয়েকটি উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। যেমন বাংলাদেশ ব্যাংক তামাক চাষ এবং উৎপাদনকে নিরুৎসাহিত করতে ১৮ এপ্রিল, ২০১০ তারিখে এক সার্কুলারের মাধ্যমে তামাক খাতে দেশের সব তফসিলি বাংককে ঋণ না দেয়ার নির্দেশ দিয়েছে। গণমানুষের স্বাস্থ্য,আর্থিক অবস্থা ও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর তামাক চাষকে নিরুৎসোহিত করা এবং দেশের খাদ্য নিরাপত্তা বাড়ানোর স্বার্থে বাংলাদেশ ব্যাংক এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যদিও তামাক কোম্পানি চাষীদের দিয়ে খাদ্য ফসলের নামে ঋণ নিয়ে তামাক চাষে তা ব্যবহার করে।

কৃষি মন্ত্রণালয় তামাক চাষের ক্ষতিকর দিক নিয়ে ২০০৯ ভর্তুকি দেয়া সার তামাক চাষে ব্যবহার না করার জন্যে নির্দেশ দিয়েছে। শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীনে উৎপাদিত বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশান (বিসিআইসি) থেকে সার নিয়ে তামাক চাষ করা হচ্ছে। কোম্পানি কৃষকদের সরাসরি সার-কীটনাশক সরবরাহ করে। যেহেতু খাদ্য উৎপাদনের জমিতে খাদ্য চাষ না করে অ–খাদ্য ফসল (তামাক) করা যাবে কিনা এমন কোন নীতিমালা নেই তাই কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ কোন বাধা দেন না।

দেশে খাদ্য সংকট হলে দেখার দায়িত্ব খাদ্য মন্ত্রণালয়ের। অথচ তামাক চাষের কারণে খাদ্য ঘাটতি হচ্ছে কিনা সেটা খাদ্য মন্ত্রণালয় দেখছে না।

বন বিভাগের চোখের সামনে তামাক এলাকায় বিশেষ করে পার্বত্য চট্টগ্রামে এতো গাছ কাটলেও তাদের যথেষ্ট ক্ষমতা নাই তামাক কোম্পানীকে নিষিদ্ধ করা। বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়কেও কখনোই এই বিষয় নিয়ে অনুসন্ধান করতে বা উদ্বেগ প্রকাশ করতে দেখা যায় না।

তামাক পাতা রপ্তানী করে বলে রপ্তানী উন্নয়ন ব্যুরো হিশাব রাখে, কিন্তু জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের দায়িত্ব হচ্ছে এমন পণ্যের ওপর অধিক হারে রপ্তানী শুল্ক বসানো, যেমন বিড়ি সিগারেটের ব্যবহারের ক্ষেত্রে কর বাড়ানো হচ্ছে। তামাক রপ্তানীতে আগে ১০% শুল্ক ছিল এখন তা কমিয়ে ৫% করে কোম্পানিকে উৎসাহিত করা হচ্ছে।

কৃষি জমি সুরক্ষা ও ভূমি ব্যবহার আইন খসড়া তৈরি হয়েছে এই ২০১৫ সালে, কিন্তু এর আওতায় তামাক চাষকে আনা হয় নি।

সুপারিশ

নিম্নলিখিত সুপারিশগুলো সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় আমলে নিলে তামাক চাষ নিয়ন্ত্রণ ও তামাক চাষের ক্ষতি কমিয়ে আনা সম্ভব হবে। নীতিমালা প্রণয়নে আমাদের সুপারিশ:

১. মাঠ পর্যায়ে তামাক চাষের ক্ষেত্রে তামাক কোম্পানি কর্তৃক কোন সুবিধা প্রদানের সুযোগ রাখা যাবে

না এবং তামাক চাষের জন্য একবারের বেশি জমি ব্যবহার না করা।

২. তামাক চাষের জন্য কোন তামাক কোম্পানি কৃষককে ঋণ, সার, কীটনাশক বা বীজ সরবরাহ করতে হলে তামাক নিয়ন্ত্রণ টাস্ক ফোর্সের অনুমোদন নিতে হবে।

৩. তামাক চাষ বনজসম্পদ ধ্বংস করে তাই পাহাড় ও বন সরকারি বনভূমি/রিজার্ভ বনভূমি এলাকায় তামাক চাষ নিষিদ্ধ মর্মে বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় যৌথ উদ্যোগে আইন বা নীতিমালা প্রণয়ন করতে পারে।

৪. তামাক চাষের জন্য পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে তার জন্য পরিবেশ অধিদপ্তরকে নীতিমালা গ্রহন করতে হবে।

৫. খাদ্য ফসলের জমিতে তামাক চাষ নিষিদ্ব করা এবং তামাক চাষের জন্য কৃষকের জমি লীজ না দেয়া।

৬. কক্সবাজার ও বান্দরবান জেলার মধ্যে প্রবাহিত সাংগু, মাতামুহুরী, বাঁকখালী নদীর তলদেশ পর্যন্ত তামাক চাষে মৎস্য ও জলজ সম্পদ বিপন্ন রোধে মৎস্য ও পানি সম্পদ মন্ত্রনালয় যৌথভাবে আইন তৈরী করতে পারে।

৭. উত্তরবঙ্গ, যশোর, কুষ্টিয়াসহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ খাদ্য উৎপাদন অঞ্চলসমূহকে ‘খাদ্য উৎপাদন জোন’ ঘোষণা করে ঐসব এলাকায় তামাক চাষ নিষিদ্ধ করা এবং পর্যায়μমে কমিয়ে আনার উদ্যোগ নিতে পারে কৃষি মন্ত্রণালয় ও খাদ্য মন্ত্রণালয়।

৮. কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের অর্থকরী ফসলের তালিকা থেকে তামাককে বাদ দেয়া।

৯. শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় তামাকচাষের জন্য সারের বিপণন নিষিদ্ধ করতে পারে। বিসিআইসি প্রতিটি সারের বস্তায় লিখে দিতে পারে ‘তামাকচাষের জন্য নহে’ ইত্যাদি। কেননা কৃষি মন্ত্রণালয় ইতিমধ্যে তামাক চাষে ভর্তুকিকৃত সার ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে।

১০. বিদ্যুৎচালিত সরকারি ও ব্যক্তি মালিকানাধীন সেচ প্রকল্পের আওতায় তামাক চাষ করা হলে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন / স্থগিত করা যেতে পারে। বিএডিসি পরিচালিত সেচ প্রকল্পের আওতায় তামাক চাষ নিষিদ্ধ করা যেতে পারে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *