চৈত্র সংক্রান্তি পালন ও প্রকৃতির হিশাব নিকাশ

ফরিদা আখতার || Monday 13 April 2015

চৈত্র মাস কেটে গেল গরম ছাড়াই। শীতের পর ফাল্গুন পার হয়ে চৈত্র মাস; চৈত্র মাসে আবহাওয়া গরম হয়ে ওঠার সুযোগ থাকে এবং বেশ গরম লাগার কথা। কিন্তু এবারের চৈত্র ছিল একটু ব্যতিক্রম। বেশ কয়েক বার বৃষ্টি হয়েছে এবং বৈশাখ আসার আগেই বৈশাখী ঝড় আমরা দেখেছি। হয়তো একে জলবায়ু পরিবর্তন বলা যেতে পারে। যদি তাই হয় তাহলে আমাদের প্রকৃতিতে মৌসুম অনুযায়ী তাপমাত্রা ও আদ্রতা নিয়ে যেসব ফসল ও গাছ-পালা জন্মাবার কথা তারও পরিবর্তন হচ্ছে।

চৈত্র মাস শেষ হচ্ছে, ৩০ দিনে। চৈত্রের শেষ দিনের  মধ্য দিয়ে ১৪২১ বাংলা বছরের সমাপ্তি ঘটবে। কিন্তু চৈত্র সংক্রান্তি পালনের বিষয়টি বছর শেষ ঘোষণার জন্যে নয়, দিনটি পালন হবে মানুষের শরীর ও প্রকৃতির মধ্যে একটি যোগ সুত্র ঘটাবার জন্য। প্রকৃতি থেকে কুড়িয়ে এনে শাক এবং চৈতালি মৌসুমের সবজি, পাতা, মুড়া ইত্যাদি খেয়ে চৈত্র সংক্রান্তি পালন করতে হবে। এই রেওয়াজ ঢাকা শহরে খুব বেশী নেই, কিছু কিছু জায়গায় কথার কথা হিসাবে চৈত্র সংক্রান্তি পালিত হলেও আসল প্রস্তুতি চলছে বৈশাখ বরণের। নতুন বছর ১৪২২। তবু, নতুন বছর শুভ হোক।

চৈত্র সংক্রান্তি পালন করার মধ্য দিয়ে গ্রামের মানুষের জ্ঞানের পরিচয় পাওয়া যায়। গ্রামীণ জনগোষ্ঠির কাছে চৈত্র সংক্রান্তির সাংস্কৃতিক ও ভাবগত তাৎপর্য অনেক গভীর। একটি বছর যখন পার হয়ে যায়, আবার বছর ঘুরে আরেকটি বছর ফিরে আসে তখন সবকিছুই একই রকম থেকে যাবার কথা না। হবার কথাও নয়। যেহেতু আমাদের গ্রামীণ পরিবেশ মূলত কৃষির সাথে যুক্ত, তাহলে কৃষির পরিবর্তনের সাথে আমাদের চাষাবাদে ও খাদ্যব্যবস্থায় কিছু না কিছু পরিবর্তন হবার কথা। প্রকৃতির সঙ্গে সারা বছর কী আচরণ করলাম তার বিচারের দিন চৈত্র সংক্রান্তি। প্রতিবছর কৃষির অবস্থা এক থাকছে না। আমাদের দেশের সরকারের কৃষি নীতিতে পরিবর্তন হচ্ছে, আসছে প্রযুক্তি নির্ভর কৃষি। তাহলে চৈত্র সংক্রান্তিতে কৃষক যখন তার আলানে পালানের মাঠে ময়দানে কি আছে আর কি নাই তার হিসাব নিতে বেরোয় তখন  আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় খাদ্য উৎপাদন করার কথা বলে কিভাবে প্রকৃতিকে আমরা ধ্বংস করছি। আমাদের খাদ্য ব্যবস্থার ওপর বড় ধরনের আঘাত আসতে পারে কিনা। হ্যাঁ সেটাই হচ্ছে।

চৈত্র সংক্রন্তির সৌন্দর্য হচ্ছে  গ্রামের কৃষকের স্মৃতি ও জ্ঞানচর্চার দিবস হিশেবে সবারই প্রায় অলক্ষ্যে দিনটি পালিত হয়ে যায়। গ্রামের মানুষ তাই তার জ্ঞানের মধ্যে যা যা পাবার কথা ছিল তা খুঁজে না পেলে আফসোস করেন, আমাদের বাপ-দাদার সময়ের, বা মায়েরা যে সব শাক সব্জি দিয়ে চৈত্র সংক্রান্তি করতেন, — তা এখন নেই। রাস্তাঘাট হয়েছে, বড় বড় দালান কোঠা হয়েছে, তাই অনাবাদী শাক সব্জি আর খুঁজে পাওয়া যায় না। এসব আছে কি নেই সেটা জেনে আমাদের কেমন সতর্ক হতে হবে সেটা নির্ধারণের জন্যে হলেও চৈত্র সংক্রান্তি পালন খুব গুরুত্বপূর্ণ।

বাংলা নতুন বছরের প্রথম দিনকে উৎসব হিসাবে পালনের যে রেওয়াজ এখন গড়ে উঠেছে, তা হোক। এখন তো পয়লা বৈশাখ পালন বাণিজ্যিকভাবে বিকৃত হয়ে যাচ্ছে। পয়লা বৈশাখ যে বৈশাখ মাসের ১ তারিখ তা ভুলে গিয়ে বলা হয় এপ্রিলে চৌদ্দ তারিখ। অর্থাৎ পয়লা বৈশাখ নামের দিনটি উৎসব হবে সেটা কি বাংলা মাস নাকি ইংরেজী মাস তা জানার দরকার মনে করেন না। কেলেন্ডারে তারিখ দিয়ে দেখাচ্ছে ১৪ এপ্রিল। ছুটির দিন, সাদা লাল মিলে ডিজাইন করা শাড়ী, জামা, পাঞ্জাবী পড়ে ইংরেজীর মতো করে বাংলা বলে ইলিশ ধ্বংস করে দিবসটি পালিত হয়। পরের দিন থেকে বৈশাখ মাস ভুলে গিয়ে আবার এপ্রিলের নিয়ম মেনে যার যার কাজে জড়িয়ে পড়া। আসলে পয়লা বৈশাখের শুরু মধ্যেই এই গলদ রয়ে গেছে। ঔপনিবেশিক আমলে জমিদার মহাজনরা বছর শেষে পাওনা আদায় ও নতুন হিসাবের খাতা বা লালসালুতে মোড়ানো হালখাতা খুলবার প্রয়োজনে ইংরেজি নববর্ষের অনুকরণে যে রঙ্গরসের আয়োজন করত সেই ধারণার ধারাবাহিকতায় শহরের মধ্যবিত্তের মধ্যে বাংলা নববর্ষের ধারণা পুষ্টি লাভ করেছে।

এসব হোক। তাতে ক্ষতি আছে কি নেই মন্তব্য করতে চাই না। আমরা এখনো বিদেশীদের পাওনা আদায়ের নিষ্ঠুর উৎসব পালন করণেই আনন্দ পাচ্ছি, এটাই আমাদের দুর্ভাগ্য। কিন্তু চৈত্রের মহাবিষুব সংক্রান্তি পালনের পেছনে যে জ্ঞানকলা, বিজ্ঞানবুদ্ধি, প্রজ্ঞা ও দূরদৃষ্টি – বিশেষত কৃষিকাজের মধ্য দিয়ে প্রাণ ও প্রকৃতির পুনরুৎপাদন ও বিকাশের অতি আবশ্যিক কর্তব্য পালনের রীতি – কোন অবস্থাতেই আমরা যেন তা ভুলে না যাই।

ঋতুর ধারণা আমাদের সংস্কৃতিতে প্রবল; ঋতুর যে ভাব বা ধারণা কৃষি সংস্কৃতিতে প্রবল সেখানে সময় কখনই শেষ হয়ে যায় না, কিম্বা আবার নতুন শুরুও হয় না, একই ঋতু বারবার ফিরে আসে। চিত্রা নক্ষত্রের রাশি চক্র অতিক্রম করে যাবার সময়টা চৈত্রের সংক্রান্তি, কিন্তু সেই একই চিত্রা নভোমণ্ডলে নিজের কক্ষ পরিভ্রমণ শেষে ফিরে আসবে আবার আগামি চৈত্রে। নতুন নক্ষত্র নয়, পুরানা নক্ষত্রই ফিরবে। চক্রাবর্তে প্রত্যাবর্তনের এই ধারণা সংক্রান্তিতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ, এর সম্পর্ক গ্রহ নক্ষত্রের সঙ্গে। বিপরীতে নতুন বছরের ধারণা ঘড়ি ও ক্যালেন্ডার থেকে উৎপন্ন। আমরা ঘড়ির দিকে তাকাতে তাকাতে গ্রহ নক্ষত্রের কথা ভুলে গিয়েছি। চাঁদ-সুর্য দেখে দিন-রাত বোঝার চর্চাও হারিয়ে যাচ্ছে।

চৈত্র সংক্রান্তিতে বিশেষ খাবার ছাতু, চিড়া, দই, মুড়ি, খই, তিল ও নারিকেলের নাড়ু ইত্যাদি খেতে হবে। তার সাথে দুপুর বেলার খাবারে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ‘চৌদ্দ’ রকমের শাক খাওয়া। এর মধ্যে অন্তত একটি তিতা স্বাদের হতে হবে। যেমন গিমা শাক। চৈত্র মাসে গিমা শাক খেতেই হবে। গিমা শাক পাওয়া না গেলে বুঝতে হবে এখানে প্রকৃতি থেকে জরুরী কিছু হারিয়ে গেছে। একটু টক কিছু থাকাও দরকার। কাঁচা আম তো আছে। অসুবিধা নেই। মাছ মাংস খাওয়া চলবে না।



বাংলার কৃষক নারী চৈত্র সংক্রান্তিতে ঘরের পাশে আলান পালান মাঠের আনাচে কানাচে শাক কুড়াতে বেরোয়। নিয়ম আছে তাকে চৌদ্দ রকম শাক কুড়াতে হবে। আবাদী নয় কিন্তু অনাবাদী, অর্থাৎ রাস্তার ধারে, ক্ষেতের আইলে, চকে আপনজালা শাক তুলতে হবে। অর্থাৎ যে শাক লতাপাতা কেউ আবাদ করেনি, আপনা থেকেই গজিয়েছে — নিজে থেকে হয়ে ওঠা শাক। এই মৌসুমে যা টিকে থাকে। এই শাক তোলার অধিকার কৃষক নারীর থাকে। তার দেখার বিষয় হচ্ছে যেই শাক তাঁরা খুঁজছেন সে শাক আছে কিনা। ধনি পরিবারের নারীরা নিজে শাক তুলতে বের না হলেও তার আশে পাশে যারা গরিব নারী আছে্ন তাঁদের মাধ্যমে শাক তুলিয়ে আনেন। মনে রাখতে হবে বলা হয় ‘শাক তোলা’ শাক কাটা নয়। কখনোই তারা পুরো গাছটি উপড়ে ফেলে শাক আনবেন না। অতি যত্ন করে পাতাটি তুলে আনবেন। গাছ যেমন আছে তেমনই থাকবে।

কৃষক নারী খবর নিতে চায় প্রকৃতির যে অংশ অনাবাদী – যে অংশ কৃষি সংস্কৃতির সংরক্ষণ করে রাখার কথা, নইলে প্রাণের সংরক্ষণ ও বিকাশ অসম্ভব – সেই অনাবাদী প্রকৃতি ঠিক আছে কিনা। যেসব গাছপালা, প্রাণ ও প্রাণী আবাদ করতে গিয়ে আবাদী জায়গায় কৃষক তাদের দমন করেছে, উঠতে দেয় নি, থাকতে দেয় নি, কিষাণি মেয়ে এই দিনে খবর নেয় তারা সব কি ঠিকঠাক আছে তো? চৈত্র সংক্রান্তিতে চৌদ্দ রকম শাক খাওয়া তো আসলে সব রকম গাছপালা প্রাণ ও প্রাণীর হালহকিকতের খোঁজ নেওয়া। এটা নারীর সুক্ষ জ্ঞান। যা নারীদের মধ্যে মা থেকে মেয়ে, পাড়া প্রতিবেশীরা ভাগাভাগি করে শেখে। ‘চৌদ্দ’ সংখ্যাটা প্রতীকী। আসলে বেশী পাওয়া গেলে আরও ভাল। তবে চৌদ্দ রকম শাক পাওয়াই এখন কঠিন হয়ে গেছে। কৃষক মেয়েকে খবর নিতে হবে পুরুষ সারাবছর যে ‘চাষ’ করল তাতে অনাবাদি জাতি বা প্রজাতির হাল হকিকতের কি অবস্থা দাঁড়াল। ‘চাষ’ করার অর্থ আবা্দি ফসলের দিকে মনোযোগ দেওয়া, কিন্তু অনাবাদি ফসলের বিশাল ক্ষেত্র যেন তাতে নষ্ট বা কৃষি ব্যবস্থায় গৌণ না হয়ে পড়ে তার জন্যই চৌদ্দ রকম শাক তোলা ও খাওয়ার রীতি চালু হয়েছে। যদি প্রকৃতি ঠিক থাকে তবে এই শাক অবশ্যই পাওয়া যাবে। চৌদ্দ রকম শাক কুড়িয়ে পেলে তার কৃষি আবাদের সাথে প্রকৃতির ভারসাম্যের পরীক্ষা পাশ করা হবে।

চৈত্র সংক্রান্তি ও বৈশাখের শুভেচ্ছা রইলো।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *