আব্দুল জব্বার || Tuesday 07 April 2015
সরোজমিন পর্যবেক্ষণ
ভারতের মাহিকো বীজ কোম্পানি থেকে গত ২০০৫ সালে বাংলাদেশে বিটি বেগুন প্রবর্তন করা হয়। কয়েক বৎসর ধরে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) জেনেটিক্যালি মোডিফাইড অরগানিজম (জিএমও) বিটি বেগুনের উপর বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পরীক্ষা নিরীক্ষা চালাচ্ছে। ইতোমধ্যে বারি’র কেন্দ্রীয গবেষণা খামার গাজীপুর ছাড়াও আঞ্চলিক গবেষণা কেন্দ্র যেমন- গাজিপুর, রংপুর, ঈশ্বরদী (পাবনা),বরিশাল, চট্টগ্রাম এবং জামালপুর এর মাধ্যমে পরীক্ষা পরিচালনা করা হয়। ইতিমধ্যে বাংলাদেশের উল্লেখিত গাজিপুর, রংপুর, ঈশ্বরদী (পাবনা), বরিশাল, চট্টগ্রাম এবং জামালপুর এলাকার কৃষকদের মধ্যে বারি বিটি বেগুনের চারা বিতরণের মাধ্যমে চারা বিতরণের মাধ্যমে বিটি বেগুন পরীক্ষামূলক চাষাবাদ করাহয়। বিটি বেগুন চাষে ২ জন কুষক ব্যতিত অবশিষ্ট সকল কৃষক আর্থিকভাবে ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখিন হলেও পরবর্তী মৌসুমে নতুন করে ১০০ জন কৃষকের মধ্যে বিটি বেগুন চাষের জন্য চারা বিতরণ করা হয়।
বিটি বেগুন প্রবর্তণের গোড়াতে বলা হয়েছিল প্রতিবছর পোকায় ব্যাপক বেগুন ফসলের ক্ষতি করে। ফলে বেগুনচাষীরা বেগুনে ব্যাপক বিষ প্রয়োগ করে। এতকরে মানুষের ব্যাপক স্বাস্থ্য ক্ষতি হচ্ছে বলে সরকারের পক্ষ থেকে দাবী করা হয়েছিল। এর প্রেক্ষিতে বিটি-বেগুন প্রবর্তন করার প্রতি সরকারের পক্ষ থেকে উঠেপরে লাগা হয়। সরকার জনগণ, কৃষক, বিজ্ঞানী এবং পরিবেশবাদীসহ দেশের সচেতন জনগণের মতামতকে অগ্রাহ্য করে বিটি বেগুন সম্পসারণে সকল শক্তি ও ক্ষমতা ব্যবহার করে যাচ্ছে। বলা হয়েছিল-বিটি বেগুন এমন এক বেগুন, তার ফল ও ডগা ছিদ্রকারী পোকা কোন ক্ষতি করতে পারবে না ফলে রাসায়নিক বিষ প্রয়োগ করার দরকার হবে না। ফলে মানুষ নিরাপদ বেগুন খেতে পারবে। বিটি বেগুন নিয়ে হাজারো প্রশ্ন রয়েছে। সকল প্রশ্ন বাদ রেখে শুধু একটি প্রশ্ন সত্যিই কী বিটি বেগুন রাসায়নিক বিষমুক্ত বেগুন? এই একটি মাত্র সামনে রেখে সরেজমিনে দেখা-জানার জন্য আমি বিটি বেগুন চাষীর ক্ষেত দেখতে গিয়েছি।
আমার বাড়ি যশোর। চাকুরি করি কুষ্টিয়ায় এক বেসরকারী অফিসে। ২৯ মার্চ ২০১৫ সকালে বিটি বেগুনের খোঁজ খবর নেয়ার জন্য কুষ্টিয়া জেলার, গ্রামঃ মধুপুর, ইউনিয়নঃ পশ্চিম আবদালপুর, থানাঃ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় বিটি বেগুন চাষীর খোঁজে বের হই।
এলাকায় গিয়ে খোঁজ করতেই বিটি বেগুন চাষী মোঃ আলমগীর হোসেনের সঙ্গে দেখা হয়। তার সঙ্গে আমরা পরিচিত হই। আমরা আমাদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে তাকে বলা হলে তিনি আগ্রহ করে সরাসরি তার বিটি বেগুনের ক্ষেতে নিয়ে যান।
বিটি বেগুন চাষী মোঃ আলমগীর হোসেনের সঙ্গে কথা প্রসঙ্গে তিনি জানান, আমি আলমগীর হোসেনসহ মধুপুর গ্রামে মোট ৫ জন বিটি বেগুন চাষী রয়েছেন। এ গ্রামের ৫ জন বিটি বেগুন চাষীই দু’টি বিটি বেগুনের জাত চাষ করেছি। বিটি বেগুনের জাত দুটির নাম হচ্ছে- (১) বারি বিটি-২ (কাজলা) এবং (২) বারি বিটি-৪। এক এক জনের বিটি বেগুন চাষের জমির পরিমাণ হচ্ছে- (ক) আলমগীর হোসেন-২৫ শতক, (২) এনামূল হক-২৯ শতক, (৩) আমীর হোসেন-৩৪ শতক, (৪) তিজারত হোসেন-১৬ শতক এবং (৫) আব্দুর রশিদ-২০ শতক ।
বিটি বেগুন আবাদের জন্য জমি তৈরি ও সার-বিষ প্রয়োগ: বেগুন চাষের জন্য প্রথমে জমি তৈরী করা হয়েছে। জমি চাষ দেয়ার সময় জমিতে সার প্রয়োগ করা হয়েছে – গোবর-১১০০ কেজি, রাসায়নিক ইউরিয়া সার-১০ কেজি, টিএসপি সার-২১ কেজি, জিপসাম সার- ১১ কেজি, দস্তা সার- ২ কেজি, বোরন সার- ১ কেজি আর দানাদার বিষ- ফুরাডান ৪ কেজি। এছাড়া প্রতি শতাংশ জমিতে ৮৫ গ্রাম ব্লিচিং পাউডার প্রয়োগ করা হয়েছে।
জমি তৈরি করার পদ্ধতি ছিল- জমি চাষ দেওয়ার পূর্বেই ব্লিচিং পাউডার প্রয়োগ করা হয়। ব্লিচিং পাউডার প্রয়োগের পর গোবরসার দিয়ে একটি চাষ দিয়ে, দানাদার ফুরাডান বিষ প্রদান করা হয়। এরপর দ্বিতীয় চাষের সঙ্গে রাসায়নিক সার এবং ফুরাডান বিষ দিয়ে মাটি সমান করে জমি ৭ দিন ফেলে রাখা হয়। সাতদিন পর ঐ জমিতে ১১ নভেম্বর, ২০১৪ বিটি বেগুনের চারা রোপন করা হয়। বেগুনের চারার বয়স ১৫ দিন হলে ইউরিয়া, পটাশ ও এমওপি সার প্রয়োগ করা হয়। বিটি বেগুনের চারা গাছগুলো নিয়মিত পরিচর্যা করা হতো। ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথমে দু’টি জাতের বেগুন গাছেই ফুল আসে এবং বেগুণ ধরে। ১২ ফেব্রুয়ারি থেকে বেগুন তোলা শুরু হয়। বিটি বেগুন কাজলা জাতের বেগুন দেখতে কালচে এবং ওজনে ভারী হয় বারি বিটি -৪ জাতের বেগুন দেখতে সবুজ তেলতেলে। বিটি বেগুনে কোন প্রকার ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকার আক্রমণ হয় না বলে জানালেন কৃষক মোঃ আলমগীর হোসেন। তবে প্রতি সপ্তাহে কীটনাশক ছিটাতে হয় বলেও জানালেন তিনি। তার কারণ হিসাবে জানালেন যে ফল ছিদ্রকারী পোকার আক্রমণ না হলেও মাছি ও অন্যান্য পোকার আক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য কীটনাশক প্রয়োগ করতে হয়। স্থানীয় কৃষি অফিসের কর্মকর্তাদের গাইডলাইন অনুযায়ী কীটনাশক ব্যবহার করা হয়েছে। ফল ও ডগা ছিদ্রকারী পোকার আক্রমণ না হলেও পিঁপড়ার আক্রমণ হয় তার জন্য কীটনাশক স্প্রে করতে হয় বেগুনের গোড়া পচন রোগ রোধের জন্য কীটনাশক স্প্রে করতে হয় নিয়মিত তাছাড়া সাদা মাছি তাড়ানোর জন্য কীটনাশক প্রতি সপ্তাহে একবার স্প্রে করতে হয়। এক কিস্তি বেগুন তোলার পর পরই বেগুন জমিতে সার দিয়ে সেচ দেওয়া হয়। তিনি জানালে যে গত সপ্তাহে তিনি ২৫ শতক জমি থেকে তিনি ১৫ মন (৬০০ কেজি) বেগুন তুলেছেন। বর্তমানে প্রতি মন ৩০০ (প্রতি কেজি ৭.৫০টাকা) টাকা দরে বিক্রি করছেন। কৃষক এনামুল হক জানালেন যে গত ফেব্রুয়ারী মাস থেকে মার্চের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত ২৫ শতক জমি থেকে তিনি ২৭ মন প্রায় বেগুন তুলেছেন। কথা প্রসঙ্গে তারা জানালেন, বেগুনে ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকার আক্রমন হয় না বলে তারা এই বেগুনের চাষ করছেন পাশাপাশি সরকারী কৃষিবিভাগ আর্থিক ও অন্যান্য সহযোগীতা প্রদানের কারণেই বিটি বেগুনের চাষ করছেন।
তারা জানতেন না যে এই ধরনের বেগুনের বীজ পাওয়া যায় এবং কৃষি বিভাগের কর্মকর্তার বলছিলেন যে এই বেগুনের বীজ রাখা যাবে না প্রতিবারই তারা বেগুনের চারা দিবেন এবং নভেম্বর ২০১৪ জমি তৈরী শুরু থেকে অদ্যাবধি পর্যন্ত কৃষি বিভাগের কর্মকর্তাবৃন্দ ৫ জন কৃষককেই নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করে আসছে। কোন প্রকার তথ্য দিতেও নিষেধ করা আছে। কৃষি বিভাগের নিষেধ সত্বেও কৃষক এনমুল হক তার জমিতে বেগুনের বীজ রাখার জন্য বেগুন রেখে দিয়েছেন। বেগুনের বীজ রাখার বিষয়ে জানতে চাইলে কৃষক এনামুল হক জানালেন যে কৃষি বিভাগের কর্মকর্তাবৃন্দ বীজ রখার জন্য আমাকে নিষেধ করেছেন তবে আমি দেখতে চাই যে বীজ রাখলে পরবর্তী মৌসুমে এই বীজ দিয়ে চারা এবং ফল হয় কি-না। যদি বীজ থেকে চারা গজায় এবং চারা থেকে ফসল হয় তা হলে আমি কৃষি বিভাগের দিকে তাকিয়ে থাকতে চাই না। এনামুল হক আরো জানালেন যে এবছর কৃষিবিভাগ যে পরিমাণ খরচ বাবদ টাকা দিয়ে আমাকে বিটি বেগুনের চাষ করাচ্ছেন আগামী বছর তো আমাকে সেই পরিমাণ খরচ নাও পেতে পারি। সে কারণেই আমি আমার মত করে চেষ্টা করে দেখছি। এ বছর বিটি বেগুন ভাল ফলন দেখা যাচ্ছে। আগামী বছর কি হবে তা জানি না। তবে ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকার আক্রমণ না হলেও বিভিন্ন প্রকার বিষ ব্যবহার করতেই হয়েছে।
বিটি বেগুনে যে সব বিষ প্রদান করা হয়েছে-পিঁপড়ার জন্য (১) ডার্সবান, বিটি বেগুন গাছের গোড়া পচা রোগের আক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য বেভিষ্টন ও এভিক্স ছত্রাক নাশক একসঙ্গে মিশ্রণ করে প্রতিটি বিটি বেগুন গাছে স্প্রে করা হয়েছে। এছাড়া প্রতি সপ্তাহে এডমারার ও তন্দ্রা নামে দু’টি কীটনাশক বিটি বেগুন গাছে স্প্রে করা হয়েছে।
বিটি বেগুন প্রবর্তনকারীদের নিকট প্রশ্নঃ পরিবেশ ও স্বাস্থ্যের জন্য ভয়াবহ ঝুঁকিপূর্ণ বিটিবেগুন (বিকৃত বেগুন) প্রবর্তন করার সময় বলা হয়েছিল-বিটি বেগুনে ফল ও ডগা ছিদ্রকারী পোকার আক্রমণকারীর পোকার আক্রমণ হবে না, ফলে বিটি বেগুন চাষ করলে কোন রাসায়নিক বিষ প্রদান করতে হবে না। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে- ফল ও ডগা ছিদ্রকারী পোকার আক্রমণ রোধের জন্য মারাত্মক মারাত্মক রাসায়নিক বিষ ব্যবহার করা হচ্ছে। যারা মধ্যে (রাসায়নিক বিষ-ডার্সবান) অর্গানোফেসফেট শ্রেণীর বিষও প্রদান করা হচ্ছে। যা মানুষের স্বাস্থ্যোর জন্য দীর্ঘ মেয়াদী ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। এই বিটি বেগুন খেলে মানুষ সঙ্গে সঙ্গে বিষের প্রতিক্রিয়া হয়তো বুঝতে পারবেন না তবে ক্যান্সারসহ মারাত্মক জীবন ধ্বংসকারী রোগের আক্রমণের শিকার হবেন নিশ্চিত। আমাদের প্রশ্ন সরকার জনগণের সার্থে না কোম্পনির স্বার্থে বিটি বেগুন সম্প্রসারণ করার জন্য উঠে পরে লেগেছেন। বিটি বেগুনের চাষ সম্পসারণের মাধ্যমে এদেশের ১৪৭ স্থানীয় জাতের বেগুনকে ধ্বংস তো করবেই একই সাথে মানুষের ধ্বংসাত্মক মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এ ব্যাপারে জবাব কী।