ফরিদা আখতার || Friday 03 April 2015
তিনটি সিটি কর্পোরেশানের নির্বাচনের তফসীল ঘোষনা করেছেন নির্বাচন কমিশন। এর মধ্যে দুটি ঢাকায় – উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন আর একটি হচ্ছে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন। কাজেই খবরে আলাপ-আলোচনায় নির্বাচন, প্রার্থী মনোনয়ন ইত্যাদি চলে এসেছে। জানুয়ারি মাস থেকে আন্দোলন শুরু হয়েছে, তা এখনো শেষ হয় নি। এই আন্দোলনের দাবী হচ্ছে একটি নির্দলীয় নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের জন্যে। সেটার জন্যে ২০১৯ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা নয়, এরই মধ্যে করতে হবে কারণ এখন সরকারের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নানা প্রশ্ন রয়েছে। সরকার নির্বাচন এক্ষুণি না দিলেও অন্তঃত একটি সংলাপ করার জন্যে শুধু বিশ দলীয় জোট নয়, দেশের মধ্যে নানা ভাবে সুশিল সমাজ, নাগরিক সমাজ, সাধারণ মানুষ, বুদ্ধিজীবী থেকে শুরু করে প্রায় সকলেই চেয়েছেন। বলা যায় এখনো সবারই তাই প্রত্যাশা। কুটনৈতিক পাড়া সক্রিয় হয়েছিল, এখনো ক্রমাগতভাবে বলেই যাচ্ছেন তাঁরা। জাতি সংঘ বলতে বলতে ক্লান্ত হয়ে গেছে বলেই মনে হয়। কিন্তু সরকার কিছুতেই শোনেনি, শুনবে বলে কোন আভাসও পাচ্ছি না। সবারই ধারণা জন্মেছে নির্বাচন যদি সত্যিকার অর্থে হয় তাহলে ক্ষমতাসীন দলের হারবার ভয় আছে। কাজেই পাঁচ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে যতো প্রশ্নই থাকুক না কেন সেটাকেই বৈধ হিশেবে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। এটাই সরকারের অঙ্গীকার। আর বিএনপি, যার নতুন নাম দেয়া হয়েছে ‘মাঠের বিরোধী দল’ তারা নির্বাচন না করে ভুল করেছেন এি কথাও বারে বারে বলতে হবে তাহলে পাঁচ জানুয়ারির নির্বাচন আরো বৈধতা পায়। এটা কেউ বলে না যে পাঁচ জানুয়ারি নির্বাচন তো আসলে শুধু প্রার্থীবিহীন ছিল না, সেটা ভোটার বিহীনও ছিল। কাজেই বিরোধী দল ট্রেন ফেল করেছে বলে তাদের খেসারৎ দেয়ার যে কথা বলা হয় তা হাস্যকর লাগে। খেসারত সরকারকেও দিতে হচ্ছে! আর পিষ্ট হচ্ছে জনগণ।
কিন্তু এর মধ্যে কী এমন হোল যে হঠাৎ সরকা্রের নির্বাচন ভীতি কেটে গেল? নির্বাচন কমিশন, স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত দিতে পারবেন কিনা জানি না, কিন্তু সরকারের ঘোষণার সাথেই সাথেই কাজ শুরু হয়ে গেছে ধুমধাম। একজন পুলিশ কর্মকর্তার কথায় নির্বাচনের তারিখও নির্ধারিত হয়ে গেছে এপ্রিলের শেষের দিকে।শিক্ষামন্ত্রী আগে ভাগেই ঘোষণাও দিয়েছেন যে সেই তারিখগুলোতে উচ্চ মধ্যমিক পরীক্ষা থাকবে না। এতো প্রস্তুতি? মনোনয়নপত্র জমা দেয়া শেষ হয়েছে ২৯ মার্চ। ঢাকা উত্তর, দক্ষিণ ও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্যে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দল সমর্থিত প্রার্থীরা। যদিও এটা দলীয় নির্বাচন হবার কথা নয়। মেয়র পদে ঢাকা উত্তরে ২১ জন, ঢাকা দক্ষিণে ২৬ জন ও চট্টগ্রাম সিটিতে ১৩ জন প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। মেয়র,কাউন্সিলর ও সংরক্ষিত কাউন্সিলর পদে সবমিলিয়ে ঢাকা উত্তরে ৬৫০, ঢাকা দক্ষিণে ৮১১ ও চট্টগ্রামে ৩৭২ জন প্রার্থী হয়েছেন [যুগান্তর, ৩০ মার্চ, ২০১৫] । যারা নির্বাচণ পর্যবেক্ষণ করেন আজকাল তাদেরই টক শোতে দেখা যায়। তারা দলীয় রং লুকিয়ে রেখে ‘নিরপেক্ষ’ বিশ্লেষণ দিয়ে চলেছেন। টক শো দেখার আগ্রহ আজকাল অনেকেরই আর নেই। আর বিএনপি যেন নির্বাচনে আসে এবং এসে যেন ভাল মতো হেরে যায় তার জন্যে মন্ত্রী ও আওয়ামি নেতাদেরদের যে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে তা তাঁরা নিষ্ঠার সাথেই পালন করে যাচ্ছেন। ধন্যবাদ।
এই নির্বাচন শেষ পর্যন্ত ঠিকমতো হতে পারবে কিনা, বিএনপির প্রার্থী সমর্থন দেয়া আদৌ ঠিক কিনা সে সব প্রশ্নে আজ আমি যাবো না। তিনটি সিটি কর্পোরেশানের মাধ্যে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ খুব গুরুত্বপুর্ণ। রাজধানী ঢাকা মেয়র বিহীন অবস্থায় দীর্ঘদিন রয়েছে, আমলা দিয়ে যে কাজ হয় না তা তাঁরা সফলভাবেই প্রমাণ করে ছেড়েছে। কাজেই একজন নির্বাচিত মেয়র অবশ্যই দরকার, তবে তা হতে হবে জনগণের স্বার্থ রক্ষা করতে পারে এমন মানুষ। আমি মেয়র পদ প্রার্থী কয়েকজন ধনী ও এলিট মানুষকে দেখে একটু চিন্তিত হচ্ছি কারণ নগরে তো শুধু ধনিরাই থাকেন না, থাকেন মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত এবং গরিব মানুষ। ট্যাক্সও সবাই দেন। কিন্তু নাগরিক সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার সাথে তুলনা করলে দেখা যায় মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত ও গরিবরা ট্যাক্স দেন কিন্তু সুযোগ সুবিধা ঠিকমতো পান না। এই অন্যায় আমরা অনেক দিন ধরে দেখে আসছি। ধনি প্রার্থীরা মেয়র হলে কি গরিব নাগরিকদের সেবার কথা মনে রাখবেন নাকি ধনিদের ড্রয়িং রুমে তাঁদের প্রশংসার ঝড় বয়ে যায় এমন ব্যবস্থা করে গরিব নাগরিক উৎখাত হয়ে যাবে? বস্তি বাসীরা নাগরিক কিনা সে প্রশ্ন ওঠে নাগরিক সেবা দেয়ার সময়। ওয়াসার লাইন পেতে হলে তাদের নাগরিক হিশেবে স্বীকৃতি মেলে না,এসব অভিজ্ঞতা অতীতে দেখেছি। তাই প্রথম কথা হচ্ছে নির্বাচন করুন ঠিক আছে, নাগরিক কিন্তু সবাই। কারো অধিবকার ক্ষুন্ন হলে তা মেনে নেয়া যাবে না।
আভিধানে ইংরেজিতে মেয়র শব্দের অর্থ নগরাদির প্রধান।একটু ব্যাখ্যা করে বলা হয় the head of a municipal corporation of a city, পৌরপ্রতিষ্ঠানের কর্তা ইত্যাদি। কিন্তু কেন জানি বাংলাদেশে মেয়রকে ‘নগরপিতা’ বলা হয় তা আমার কাছে অজানা। যে কারণই হোক আমার কাছে এটা অত্যন্ত পশ্চাদপদ ও বাজে পুরুষতান্ত্রিক চিন্তার প্রতিফলন মনে হয়। এখানে প্রথম সমস্যাই হচ্ছে, ধরে নেয়া হচ্ছে মেয়র একমাত্র পুরুষরাই হবেন। নারায়নগঞ্জের মেয়র আইভিকে নগরমাতা বলতে শুনিনি। তিনি নির্বাচিত হয়ে গেছেন,তাঁকে তাই বলে নগরমাতা বলা হয় না। যদি হয় এটাও হবে পুরুষতান্ত্রিককতা। নগরের সেবা দেয়ার কাজ করতে হলে মাতা-পিতা হবার দরকার পড়ে না। তিনি জনপ্রতিনিধি, জণগণের সেবা নিশ্চিত করাই তাঁর কাজ। এবার ঢাকায়ও একজন নারী মেয়র প্রার্থী হয়েছেন। তিনি যদি নির্বাচিত হন তাহলে তিনি নিশ্চয়ই নগরপিতা হবেন না। তাই আগে ভাগেই পুরুষ নারী সবাইকেই বলছি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে জিতে পুরুষতন্ত্র থেকে মুক্ত হয়ে নিজেকে নগরপিতা নয়, বা নগর শাসক নয়, নগর সেবক ঘোষনা করতে পারেন কিনা বিবেচনা করবেন। নিজের প্রার্থিতা প্রচারণায় যেন সেই কথা স্পষ্ট হয়।
ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের একজন করদাতা ও ভোটার হিশেবে আমি জানতে চাই যিনি মেয়র হবেন তিনি কি অঙ্গীকার করবেন যে তাঁর প্রথম কাজ হচ্ছে ঢাকা শহরের আবর্জনা সাফ করা? ঢাকা শহরকে বসবাসের অযোগ্য শহর হিশেবে ঘোষনা করা হয়ে গেছে আন্তর্জাতিক ভাবে। শুধু ট্রাফিক জ্যাম নয়, রাস্তার ধারে ওয়াসা, গ্যাস বিদ্যুৎ লাইনের কাটাকুটি নয়, ময়লার স্তুপের কারণে ভয়ানক ও অসহ্য দুর্গন্ধময় শহরে পরিণত হয়েছে এই ঢাকা শহর। যতো বিল্ডিং হচ্ছে, আবর্জনা তত বেশী। আবাসিক এলাকায় হেঁটে গেলে, রিক্সায় গেলে ময়লার গন্ধে নাক বন্ধ করলেও কাজ হয়না, গাড়ীতে গেলে জানালার কাঁচ তুলে দিলেও ভেদ করে চলে আসে। আর সবচেয়ে বিরম্বনা হয়, ট্রাফিক জ্যামে দিনে দুপুরে ঠিক সামনে একটি ময়লার ট্রাক থেমে থাকলে। এই সময় মনে হয় আসলেই আমলারা অফিস টাইমের বাইরে কাজের পরিকল্পনা করতে জানেন না। জ্যামে মনে হ্য় নিজেরা কখনো ময়লার ট্রাকের পেছেন পড়েন না। মন্ত্রীদের জন্যে রাস্তা সব সময় ক্লিয়ার করে দেয় ট্রাফিক পুলিশ। প্রধানমন্ত্রী জীবনেও এই গন্ধ কি দুর্বিসহ জানার সুযোগ পাবেন না। তাঁর নিরাপত্তার কারণে তাঁকে নগরবাসীর সুবিধা-অসুবিধা সম্পর্কে জানার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হয়। তাই তিনি যাদের ডেকে সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে বলেছেন তাঁরা আবর্জনার খবর রাখেন কিনা আমার ঘোরতর সন্দেহ কাজ করছে। এখনো সময় আছে এই ধরণের উচ্চ শ্রেণীর প্রার্থীরা যেন একটু ঢাকা শহরে আবর্জনার হিশাব নেন, সরাসরি গন্ধ শুঁকে নেন তাহলে ভাল মেয়র হতে পারবেন।
তাঁদের সুবিধার জন্যে দুই একটি গবেষণা থেকে ঢাকার আবর্জনার হিশাব দিচ্ছি।জাপান সরকারের সহযোগিতায় ২০০৫ সালে করা Clean Dhaka Master Plan এর জন্যে করা জরীপ অনুযায়ি দিনে ২,৭৬৭ টন প্লাস্টিক, কাগজ, গ্লাস, ধাতব পদার্থ, এবং বাসা বাড়ীর আবর্জনা (প্রায় ২,২১১ টন) সৃষ্টি হয়, যার মধ্যে প্লাস্টিক, কাগজ ও গ্লাস সামগ্রী রিসাইকেল হয় বেশীর ভাগ, কিন্তু বাসা বাড়ীর আবর্জনা যা মুলতঃ দুর্গন্ধ ছড়ায় তা রিসাইকেল হয় মাত্র ৬ টন। আর একটি গবেষণা জাপানী গবেষক ও বাংলাদেশের বুয়েটের গবেষকের (২০০৫ সালে প্রকাশিত) প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে বর্তমানে দিনে প্রায় ৩৫০০ টন আবর্জনা তৈরি হচ্ছে, ২০২০ সালে গিয়ে তা ৩০ হাজার টনে গিয়ে ঠেকবে। বিল্ডিংও বাড়বে, ময়লাও বাড়বে। ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের এতো ব্যাপক পরিমান আবর্জনা পরিস্কার করার ক্ষমতাও সীমাবদ্ধ। জনবলের ঘাটতি যেমন আছে তেমনি আছে তথ্যের ঘাটতি। ব্যাবস্থানার তো কোন চিন্তাই নাই। সিটি কর্পোরেশনের জানা দরকার যে সলিড ও ক্ষয় হয় এমন আবর্জনার প্রায় ৫০% বাসা বাড়ী থেকে আসে। তাঁদের এই কাজটি প্রথমে অবশ্যই করতে হবে। এই বাসা বাড়ীর মানুষেরাই কর দেয়। তাদের সেবা পাওয়ার অধিকার আছে। আর শিল্প কলকারখানা, হাসপাতালের আবর্জনা সাফ করাও খুব জরুরী। তারাও কর দেন কিন্তু তাঁরা নিজেরাও কিছু দায়িত্ব নিতে পারেন।
আর বেশী বলতে চাই না। শুধু বলবো, নির্বাচনের প্রচারে ঢাকা শহরকে বাতি দিয়ে ও বড় বড় রাস্তা ও ব্রিজ বানিয়ে সুন্দর করার ঘোষণা দিয়ে ভোটারদের মুগ্ধ করার আগে আবর্জনা পরিস্কারের অঙ্গীকার চাই।