ফরিদা আখতার || Tuesday 24 March 2015 ||
চলছে তামাক পাতার চাষ
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আয়োজিত আবুধাবিতে ১৭ থেকে ২১ মার্চ অনুষ্ঠিত হলো ১৬তম ‘তামাক নাকি স্বাস্থ্য’ সম্মেলন। অসংক্রামক ব্যাধি (Non-Communicable Disease, NCD) এর আলোকে এ সম্মেলনে ব্যাপক আলোচনা হয়েছে। অনেক বড় সম্মেলন, প্রায় ১০০ দেশ থেকে ২ হাজার ১৮৪ জন অংশগ্রহণ করেছেন; কিন্তু আগে যারা অন্যান্য সম্মেলনে গেছেন তাদের এখানে অংশগ্রহণ আশানুরূপ ছিল না, বরং ছিল হতাশাব্যাঞ্জক। এ সম্মেলন আবুধাবিতে হওয়ার কারণে ভিসার সমস্যা ছিল বাংলাদেশসহ অনেক দেশের। বাংলাদেশ থেকে মাত্র আটজন যেতে পেরেছেন, যেখানে অন্তত ৩০ জন টিকিট কেটে হোটেল বুকিং দিয়ে এবং তাদের নিজ নিজ কাজ সম্পর্কে প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলেন। আমি যেতে পেরে উপকৃত হয়েছি; কিন্তু আনন্দিত হতে পারিনি। কারণ এ সম্মেলনে যাদের যাওয়ার প্রয়োজন ছিল তাদের সবার উপস্থিতি নিশ্চিত করতে পারেননি উদ্যোক্তারা। সম্মেলনে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকেও কেউ থাকতে পারেননি, এমনকি বাংলাদেশে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় যারা তামাক নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করছেন তারাও ভিসা জটিলতার কারণে যেতে পারেননি। বাংলাদেশের মানুষ ভিসা পেতে পারে না, অথচ অনেক দেশের অংশগ্রহণকারীদের ভিসাই করতে হয়নি। বাংলাদেশ এমনই এক হতভাগা দেশ।
নিঃসন্দেহে সম্মেলনটি বিশ্বের মানুষকে তামাকের মতো একটি ক্ষতিকর দ্রব্যের ব্যবহার থেকে বিরত রাখার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তামাকজাত দ্রব্যের সেবনে (বিড়ি, সিগারেট, জর্দা, গুল, সিসা, ই-সিগারেটসহ সব ধরনের) বছরে কোটি কোটি মানুষ অসুস্থ হচ্ছে এবং মারা যাচ্ছে। এ সম্মেলনে The Tobacco Atlas গ্রন্থটি দেয়া হয়েছে, যার মধ্যে সারা বিশ্বের তামাক সেবনের কারণে যে ক্ষতি হয় তার আদ্যোপান্ত পাওয়া যাবে। যদিও বাংলাদেশের তথ্য ঘাটতি আছে। আগামীতে নিশ্চয়ই তা পূরণ করা যাবে। বিশ্বে বছরে ১০ কোটি মানুষ মারা যাচ্ছে শুধু তামাক সেবনে সৃষ্ট রোগের কারণে। এত মৃত্যু দুইটি বিশ্বযুদ্ধেও ঘটেনি। এটি নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে আগামী শতাব্দীতে এ মৃত্যুর সংখ্যা ১ বিলিয়ন হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এর মধ্যে বেশিরভাগ মারা যাবে নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশে। আমরা যতই মধ্য আয়ের দেশে উন্নীত হব বলে দাবি করি না কেন তামাক নিয়ন্ত্রণ ঠিকমতো না করতে পারলে, দেশ উন্নত হবে ঠিকই; কিন্তু মানুষ অসুস্থ হয়ে থাকবে কিংবা মরে যাবে। এর মধ্যে নারীদের সংখ্যাও ক্রমাগতভাবে বাড়ছে। কারণ তামাক কোম্পানিগুলো এখন নারীদের দিকেই বেশি ঝুঁঁকছে। নতুন ভোক্তা হচ্ছে নারী এবং তরুণরা, তাহলে কোম্পানির বাজার সম্প্রসারিত ও দীর্ঘমেয়াদি হবে।
সবচেয়ে দুঃখজনক হচ্ছে, এ অসুস্থতা এমন যা প্রতিরোধযোগ্য এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অসংক্রামক; যেমন হৃদরোগ, স্ট্রোক, ডায়াবেটিস, ক্যান্সার, বিশেষ করে ফুসফুসের ও মুখের ক্যান্সার। যাদের এসব রোগ এমনিতেই আছে তাদের মৃত্যু আরও একটু নিশ্চিত করে দেয় তামাক সেবন অব্যাহত থাকলে। যারা প্রতিদিন ১০টি সিগারেট সেবন করে তাদের জীবন থেকে অন্তত পাঁচ বছর আয়ু কমে যাবে এবং ফুসফুসের ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা ২০ গুণ বেশি হবে। এটলাসে দেখানো হয়েছে মস্তিষ্ক, গলা ও ঘাড়ের ক্যান্সারের ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ তামাকের কারণে ঘটে, যা সহজেই প্রতিরোধ করা যায়। এটা শুধুই অভ্যাস পরিবর্তনের ব্যাপার। কেউ যদি সিদ্ধান্ত নেয়, তিনি আর ধূমপান বা ধোঁয়াবিহীন তামাক সেবন করবেন না, তাহলে তিনি নিজে এবং তার কাছের মানুষ যেমন স্ত্রী, সন্তান, মা-বাবা এবং কর্মস্থলে নিজেরসহ কর্মীদের রক্ষা করতে পারেন। কিন্তু এ অভ্যাস দূর করার জন্য যে উদ্যোগ নেয়া হোক না কেন তামাক কোম্পানির নতুন নতুন কৌশলে কম বয়সী ছেলেমেয়েদের উদ্বুুদ্ধ করে তা বন্ধ করতে দেয় না।
আমি এ স্বল্প পরিসরে সম্মেলনে আলোচিত সব বিষয় নিয়ে বিস্তারিত লিখতে পারব না। কিন্তু যেগুলো খুব জরুরি তার কিছু ইঙ্গিত দিচ্ছি। একটি হচ্ছে, অধূমপায়ী হয়েও আশপাশে ধূমপায়ী থাকলে কেউ রেহাই পাবে না। ২০১০ সালে ৬০ লাখ মানুষ মারা গেছে শুধু অন্যের ধূমপানের কারণে। এরা কারা? শিশু, নারী এবং অধূমপায়ী পুরুষ। চীনে জনসংখ্যা বেশি, ধূমপায়ীও বেশি। ২০১০ সালে শুধু চীনে ৭৪ লাখ নারী পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হয়েছেন।
নারীদের দিকে কোম্পানি বেশ আগ্রহী হয়ে উঠেছে। স্মার্ট, স্লিম ও ফ্যাশনের প্রতীক হিসেবে নারীদের ধূমাপানে আগ্রহী করে তোলা হচ্ছে। তবুও এটলাস অনুযায়ী এখনও বিশ্বের মাত্র দুইটি দেশে পুরুষের তুলনায় নারী ধূমাপায়ীর সংখ্যা বেশি এবং ২৪টি দেশে ছেলেদের চেয়ে মেয়েরা বেশি ধূমপান করছে। এটা নাকি সমতা। মৃত্যুর সমতা। ধনীরা ফ্যাশন হিসেবে তামাক সেবন করেন, আর গরিব মনে করে তামাক খেলে ক্ষুধা মিটে যাবে। কাজেই খাদ্য না কিনে একটা বিড়ি টান দিলে হবে কিংবা জর্দা দিয়ে এক খিলি পান মুখে গুঁজে দিলে দিন পার। দারিদ্র্যদূরীকরণ বটে!
ধূমপানের বিরুদ্ধে আন্দোলন যখন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তখন তামাক কোম্পানিগুলো বসে নেই। তারা ই-সিগারেট, ওয়াটার পাইপ বা সিসা নামক হুঁকার মাধ্যমে তামাক সেবনের প্রচলন শুরু করেছে, যা ধূমপানের চেয়েও বেশি বিপজ্জনক। সিসার এক টান (৪৫০ মিলিলিটার), যা একটি পুরো সিগারেটের (৫০০ মিলিলিটার) চেয়ে বেশি। কেউ নিশ্চয়ই একটা টান দিয়ে বসে থাকে না। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় কয়েক টান সিসা সেবন হচ্ছে, অর্থাৎ বিষ খাচ্ছে। ঢাকায় অভিজাতপাড়ায় এ সিসার প্রচলন বেড়েছে। বিশেষ রেস্টুরেন্ট আছে এর জন্য। বিশ্বের অনেক দেশেই এখন সিসা সেবন তরুণদের নতুন আকর্ষণ। বিশেষ করে মেয়েদের মধ্যে। পাকিস্তানে প্রায় ৩৩ শতাংশ, সৌদি আরবে ৫২ শতাংশ মেয়ে সিসা সেবন করছে। বাংলাদেশের পরিসংখ্যান এখনও কেউ নেয়নি, তবে সরকার এ ব্যাপারে বিশেষ উদ্যোগ নিতে পারে।
এটলাসের আর একটি তথ্য খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে। বিশ্বে কয়েকটি তামাক কোম্পানি ব্যবসা করছে, যার মধ্যে ফিলিপ মরিস ইন্টারন্যাশনাল, ব্রিটিশ-আমেরিকান টোব্যাকো (বিএটি), ইম্পেরিয়াল টোব্যাকো গ্রুপ, জাপান টোব্যাকো ইন্টারন্যাশনাল এবং চীনা ন্যাশনাল টোব্যাকো গ্রুপ অন্যতম। ম্যাপে দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশ, মিয়ানমার, পাকিস্তান, অস্ট্রেলিয়াসহ অনেক দেশে ব্রিটিশ-আমেরিকান টোব্যাকো কোম্পানি একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েম করে রেখেছে। তারা একদিকে তামাক সেবন করিয়ে মানুষ মারছে, অন্যদিকে তথাকথিত ‘ভালো কাজ’ পুরস্কার নিচ্ছে। বাংলাদেশে তামাক চাষে পাতা পোড়ানোর জন্য ব্যাপকভাবে গাছ কেটে আবার নতুন করে দ্রুত বাড়ে এমন গাছ যেমন ইপিল ইপিল লাগিয়ে তারা বিশ্ব পরিবেশ দিবসে (জুন ৫) পুরস্কার নিয়েছে পরপর কয়েক বছর। আমাদের দেশের পরিবেশমন্ত্রী দিয়ে তারা গাছ লাগানোর কর্মসূচি উদ্বোধন করান। এর বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রতিবাদ করার কারণে এ পুরস্কার দেয়া বন্ধ হয়েছে; কিন্তু তিরস্কার দেয়ার কাজ শুরু হয়নি। বান্দরবানসহ পার্বত্য চট্টগ্রামের বন উজাড় হয়ে গেছে। পাহাড়গুলো ন্যাড়া হয়ে গেছে। জানি না সরকার কবে দেখবে যে, আর গাছ নেই। তারা চোখ বুজে আছেন।
এবার আরেক অবাক কান্ড ঘটাল ব্রিটিশ-আমেরিকান টোব্যাকো কোম্পানি! তারা বাংলাদেশ ব্র্যান্ড ফোরামের কাছ থেকে বিশ্ব নারী দিবসের প্রাক্কালে ‘Most female friendly Organisation ‘ হিসেবে পুরস্কার পেয়েছে। এ খবর আমরা যারা বিশ্ব নারী দিবস নারীদের অধিকার রক্ষার দিন হিসেবে পালন করি তারা জানতেও পারিনি। জানলে নারীর জন্য ক্ষতিকর সংগঠনের এভাবে প্রতারণা করে পুরস্কার দেয়ার বিরোধিতা আমরা অবশ্যই করতাম। খবরটি প্রকাশিত হয়েছে অনেক দেরিতে। ডেইলি স্টার পত্রিকায় ১৭ মার্চ, ২০১৫ তারিখে ৫ নম্ব্বর পাতায় ‘News in Brief’ হিসেবে ‘BATB wins Most female friendly organisation award ‘ শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছে। বাংলাদেশে তামাকবিরোধী নারী জোটের (তাবিনাজ) পক্ষ থেকে এ পুরস্কারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানো হচ্ছে। আন্তর্জাতিক নারী দিবসকে এভাবে কলুষিত করতে না দেয়ার জন্য আমরা সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। কারণ এর মাধ্যমে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনেরও লঙ্ঘন করা হচ্ছে। এটা কোম্পানির পরোক্ষ প্রচার এবং মিথ্যা দাবি। এ পুরস্কার আইনের প্রচ্ছন্ন লঙ্ঘন।
তবুও একটি ভালো খবর দিয়ে শেষ করছি। ২০১৩ সালে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০০৫ সংশোধিত হওয়ার পর থেকে এর বিধিমালা করার কাজ চলেছে; কিন্তু কোথায় গিয়ে যেন থেমে ছিল। এখন তা অনুমোদিত হয়েছে, অর্থাৎ আইন বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বাধা দূর হয়েছে। ধন্যবাদ যারা এর জন্য দিন-রাত কাজ করেছেন।
আমাদের দেশের মানুষের বিশেষ করে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সুস্থ রাখতে হলে প্রতি ঘর, কর্মস্থল এবং জনসমাগমস্থল তামাকমুক্ত করতে হবে। তামাক কোম্পানির পরোক্ষ বিজ্ঞাপন প্রচারণা বন্ধ না করলে কোম্পানির ফাঁদে পড়বে তরুণ সমাজ। মানুষের অভ্যাস পরিবর্তন করেই যদি সুস্থ থাকা যায়, তাহলে কেন তা করব না?