জাহাংগীর আলম জনি || Wednesday 18 March 2015
বীজ ও প্রাণসম্পদের সমৃদ্বির মাধ্যমে জীবন জীবিকার উন্নতির লক্ষ্যে পরিগঠিত একটি অর্থ ব্যবস্থাপনা প্রাণবৈচিত্র্যের সামাজিক ব্যবস্থাপনা তহবিল” (CBM Fund)। এই তহবিল ব্যবস্থাপনার মূল লক্ষ্য হলো গ্রামীণ বিশেষত গরীব ও প্রান্তিক জণগোষ্ঠির অর্থ প্রাপ্তির ক্ষেত্র সৃষ্টি ও অর্থ ব্যবস্থাপনার ক্ষমতায়ন বিকাশের মধ্য দিয়ে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও প্রাণসম্পদের সমৃদ্বি। পাবনা, না্টোর, সিরাজগন্জ, টাংগাইল ও কক্সবাজার এলাকায় নয়াকৃষি কৃষকরা এরই মধ্যে প্রাণবৈচিত্র্যের সামাজিক ব্যবস্থাপনা তহবিল গঠন ও তা ব্যবহারেরর মাধ্যমে প্রাণসম্পদের সমৃদ্বি ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে তাদের সৃজন ও সৃষ্টিশীল তৎপরতার উল্লেখযোগ্য নজির হাজির করেছেন।
নাটোর জেলার বড়াইগ্রাম উপজেলার কৃষ্ণপুর গ্রাম। নয়াকৃষি চাষাবাদ ব্যবস্থা অনুশীলনের মাধ্যমে বিগত ছয় বছর ধরে এই গ্রামের কৃষকরা প্রাণবৈচিত্র্যের সামাজিক ব্যবস্থাপনা কর্মসূচীর মাধ্যমে প্রাণসম্পদ বৃদ্বি ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্বির লক্ষ্যে কাজ করে আসছেন। এই গ্রামের বীজ ব্যবস্থাপনা কমিটি প্রাণবৈচিত্র্যের সামাজিক ব্যবস্থাপনা তহবিল থেকে ২০১৪ সালে ৮০ হাজার টাকা গ্রহণ করে এবং নিজস্ব ৭ হাজার টাকা সঞ্চয় তহবিলসহ ৮৭ হাজার টাকা দিয়ে ৩৩ শতাংশ জমি বন্বক নেয়। জমিতে মিশ্য ফসল হিসেবে পাটের মধ্যে আউশ (কালাবকরী) ও আমন (দীঘা) ধান এবং পরবর্তী মৌসুমে রসুন ও পেঁয়াজের চাষ করে ১০ হাজার টাকা বাড়তি আয় করা হয়। বর্তমানে জমিতে গম আছে এবং কয়েকদিনের মধ্যেই ফসল কাটবে। গম থেকে আরো ৮ হাজার টাকা বাড়তি আয় হবে কৃষকরা হিসাব করেছেন। জমিতে বিনিযোগকৃত আয় কৃষকদের দলীয় ব্যাংক হিসেবে নিয়মিতভাবে জমা হচ্ছে। উৎপাদিত ফসলের মধ্য থেকে ৩০ কেজি ধানের বীজ দলটি নয়াকৃষি বীজ আখড়ায় জমা করেছেন। বিলুপ্তপ্রায় ধানের এই জাতগুলো পরবর্তী মৌসুমে অন্য কৃষকদের সহায়তা হিসেবে প্রদান করা হবে। প্রাণবৈচিত্র্যের সামাজিক ব্যবস্থাপনা তহবিল ব্যবহারের স্বল্প সময়ের মধ্যে নয়াকৃষি বীজ কমিটির এই দলটি দলীয় আয় বাড়ানোর পাশাপাশি হারিয়ে যাওয়া ফসলের জাত উদ্বার করে তা কৃষক পর্যায়ে বিস্তারে সামাজিক ব্যবস্থাপনায় ভ’মিকা রাখছেন।
কৃষ্ণপুর গ্রামের খলিসা ডাঙ্গা দল প্রাণবৈচিত্র্যের সামাজিক ব্যবস্থাপনা তহবিল থেকে ৫৫ হাজার টকা গ্রহণ করে নয়াকৃষি কৃষকদের উৎপাদিত কার্তিকশাইল ও হিজলদীঘা জাতের আমন ধান মজুদ করেছেন। নয়াকৃষি কৃষকদের নিকট থেকে সংগৃহীত এই ধানগুলো নয়াকৃষি বিক্রয়কেন্দ্র শস্যুন্দরের মাধ্যমে বাজারজাত করে বাড়তি আয় দলীয় তহবিলে এবং আয়ের একটি অংশ নয়াকৃষি বীজ আখড়া পরিচালনার কাজে ব্যয় করার পবিকল্পনা করেছেন।
নাটোর জেলার বড়াইগ্রাম উপজেলার আরেকটি গ্রাম রাজেন্দ্রপুর। এই গ্রামের নয়াকৃষি বীজ অভিঙ্গ কমিটি দল প্রাণবৈচিত্র্যের সামাজিক ব্যবস্থাপনা তহবিল থেকে ৫৫ হাজার টাকা ব্যবহার করে তা দিয়ে জমি বন্বক নিয়েছেন। জমিতে চাষ করেছেন দেশী পাট, মশুর ডাল ও রসুন। আয় হয়েছে ৯ হাজার টাকা। ফসলের একটি অংশ জমা করা হয়েছে বীজ আখড়ায়।
পাবনা জেলার পাড়াসিধাই সিবিএম গ্রামে নয়াকৃষি দল প্রাণবৈচিত্র্যের সামাজিক ব্যবস্থাপনা তহবিল থেকে ৬০ হাজার টাকা গ্রহণ করে ১৩ কাঠার আবাদী জমি কটে রাখা হয়। জমিতে পাট, করলা, মশুরের ডাল ও মিষ্টি আলুর চাষ করে ৮০০০ টাকা আয় করেন। আয় ও নিজস্ব সঞ্চয় তহবিল টাকা দিয়ে পরবর্তী মৌসুমে প্রায় হারিয়ে যাওয়া আউশ ধানের বীজ উৎপাদন করার পরিকল্পনা করেছেন।
টাঙ্গাইল জেলার, দেলদুয়ার থানার স্বল্পনাড়– গ্রাম। এই গ্রােেমর শতকরা ৮০ভাগ পরিবার কৃষি কাজের সাথে জড়িত। এছাড়া অন্যান্য পেশার মধ্যে রয়েছে ব্যবসায়ী, শ্রমিক,চাকুরীজীবী। সিবিএম ফান্ড গঠনের জন্য সিবিএম গ্রামের নয়াকৃষি পরিবারের ৪০জন সদস্য নির্বাচন করা হয়। নির্বাচিত সদস্যদের নিয়ে সিবিএম ফান্ড দল গঠন করা হয়েছে। যারা প্রত্যেকে বর্তমানে সিবিএম ফান্ডের সদস্য। এর ভিত্তিতে সিবিএম ফান্ডের ৪টি দল গঠন করা হয়েছে। প্রতিটি দলের আলাদা আলাদা নাম রয়েছে। প্রতিটি দলে সদস্য সংখ্যা ১০জন করে । মোট সদস্য সংখ্যা ৪০জন। এর মধ্যে নারী সদস্য ৩৮জন এবং পুরুষ সদস্য ০২জন। প্রতিটি দলে এক জন করে সভাপতি, কোষাধ্যক্ষ এবং সেক্রেটারী রয়েছে। প্রতি সপ্তাহে সদস্যরা ১০টাকা করে সঞ্চয় জমা করেন। এই সঞ্চয় দিয়ে তারা একটি ফান্ড গঠন করেছেন। মে -২০১৪ ইং মাসে সোনালী ব্যাংক লাউহাটি শাখায় যৌথভাবে একটি সঞ্চয়ী হিসাব খোলা হয়। সিবিএম ফান্ড এর সভাপতি গোলাপী বেগম এবং কোষাধ্যক্ষ শেফালী বেগম যৌথভাবে ব্যাংক হিসাব পরিচালনা করছেন। দলের পক্ষ থেকে স্বল্পনাড়– গ্রামে ১ লক্ষ টাকা দিয়ে ৭০শতাংশ জমি কট নেওয়া হয়েছে। জমিতে মৌসুম অনুযায়ী ধান, গম, খেসারী চাষ করে ৪১ হাজার টাকা আয় হয়েছে। দলীয় ৭ জন সদস্য ছাগল পালন করে আয় করেছে ৫ হাজার টাকা। বর্তমানে দলীয় ব্যাংক হিসাবে ৫৩ হাজার টাকা সঞ্চয় আছে। ব›ধক নেওয়া জমির ফসল থেকে ধান ও খেসারীর বীজ বীজ আখড়ায় জমা দেওয়া হয়েছে।
প্রাণবৈচিত্র্যের সামাজিক ব্যবস্থাপনা তহবিল গঠন ও ব্যবস্থাপনার এই সফলতা গ্রামপর্যায়ে ক্রমশ বিস্তার লাভ করছে। এরই মাঝে চারটি কৃষক সংগঠন সমবায় অধিদপ্তর থেকে নিবন্ধন গ্রহণ করেছেন। নাটোর ও টাংগ্ইাল এলাকায় দুইটি কৃষক সংগঠন নয়াকৃষি বিক্রয় কেন্দ্র শস্যুন্দরের মাধ্যমে কৃষকদের উৎপাদিত পণ্য বাজারজাত করছেন। প্রাণবৈচিত্র্যের সামাজিক ব্যবস্থাপনা তহবিল এর মাধ্যমে প্রাণসম্পদের সমৃদ্বি ও জীবন জীবিকার উন্নয়নে গ্রামগঠনের এই নতুন ধারণা গ্রামীণ আর্থ সামাজিক অবস্থার উন্নতি ও কৃষকদের অধিকার রক্ষায় ইতিবাচক ভ’মিকা পালন করছে।