ফরিদা আখতার || Tuesday 13 January 2015
গত বছর অনুষ্ঠিত নির্বাচন এবং সরকার গঠন সবার জন্য অস্বস্তিকর, খোদ সরকারের মধ্যেও এ বোধ আছে বলে আমার বিশ্বাস। এর আইনি বৈধতা নিয়ে কিছু বলার না থাকলেও গ্রহণযোগ্যতার প্রশ্ন বরাবরই ছিল, এবার আবার মাঠ গরম হয়ে উঠেছে। সারা দেশে অবরোধ চলছে, সঙ্গে চলছে কিছু কিছু জেলায় হরতাল। এবার ৫ জানুয়ারি, ২০১৫ তারিখ ছিল সেই প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের এক বছর পূর্তি। স্বাভাবিকভাবেই যারা নির্বাচনের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দল বা জোট তাদের জন্য এ দিনটি ছিল ক্ষোভ প্রকাশের। তারা এক বছর চুপ করে থেকে দেখেছে সরকার কী করে। সরকারের পক্ষ থেকে মন্ত্রী ও নেতারা পুরো পাঁচ বছর পূরণ না করে ‘কোনো কথাও বলবে না’ এমন কড়া কড়া কথা ক্রমাগতভাবে বলে যাচ্ছে দেখে বোঝা গেল, তারা অগণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ক্ষমতায় জেঁকে বসেছে; আর উঠতে চাইছে না। ৫ জানুয়ারিতে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ঘোষণা দিল গণতন্ত্র রক্ষা দিবস পালনের, তারা আনন্দ-ফূর্তি করতে চায়। একইসঙ্গে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট একে গণতন্ত্র হত্যা দিবস হিসেবে পালন করার জন্য সমাবেশ করার পরিকল্পনা করে।
একই সময়ে একই স্থানে সমাবেশ হবে। কিন্তু তা হতে পারল না। আগের দিন, অর্থাৎ ৪ জানুয়ারিতেই সরকার সব ধরনের পরিবহন বন্ধ করে দিয়ে অবরোধ সৃষ্টি করল, সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করে দিল। শুধু তাই নয়, বিএনপির নয়া পল্টনের কার্যালয় বন্ধ করে দিল, যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীকে পুলিশ আদর-যত্ন করে অ্যাপোলো হাসপাতালে ভর্তি করে দিল। আর খালেদা জিয়ার গুলশানের কার্যালয়ে শত শত পুলিশ দিয়ে বেষ্টনী তৈরি করে ‘অবরুদ্ধ’ করা হলো। এ সময় খালেদা জিয়া কার্যালয় থেকে বের হয়ে পুরানা পল্টনে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। গত বছর নির্বাচনের আগে খালেদাকে মার্চ ফর ডেমোক্রেসিতে যাওয়ার ক্ষেত্রে যে বাধা সৃষ্টি করা হয়েছিল, এবারও একই ফরমুলায় পুলিশ দিয়ে ঘেরাও করা এবং হাস্যকর পদ্ধতিতে বালুর ট্রাক দিয়ে অবরুদ্ধ করা হয়। এবার সেই পুরনো পদ্ধতির মধ্যে একটু পরিবর্তন এনে বালুর ট্রাকের সঙ্গে ইট ও সুরকির ট্রাক আনা হলো। সবচেয়ে বেশি আশ্চর্যের বিষয় হলো, এক পর্যায়ে গুলশান কার্যালয়ের গেটে তালা লাগানো হলো। ছোট তালা হলেও চাবি ছাড়া খুলবে না। এ চাবি পুলিশের হাতে। সমাবেশ হওয়ার কোনো উপায় নেই জেনেও খালেদা জিয়া যখন বের হওয়ার জন্য গাড়িতে উঠলেন তখন জাতীয়তাবাদী মহিলা দলের কর্মীরা গেট খোলার জন্য ধাক্কা দিচ্ছিলেন। এ সময় পুলিশ তাদের ওপর পিপার স্প্রে করল, বেশ কয়েকজনের চোখে সরাসরি লাগল, এমনকি গাড়িতে বসে থাকা খালেদা জিয়াও সেই পিপার স্প্রের কারণে কাশতে লাগলেন। পিপার স্প্রে ব্যবহারসংক্রান্ত উচ্চআদালতের নির্দেশনা উপেক্ষা করে এ কাজ যে পুলিশ করেছে, তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। খালেদা জিয়ার কথা বলতে কষ্ট হচ্ছিল। এ সময় সাংবাদিকদেরই কথার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি ঘোষণা দিলেন, অবরোধ চলবে। সেই অবরোধ এখনও চলছে।
এর মধ্যে ট্রাকগুলো সরে গিয়েছিল, ১১ জানুয়ারি থেকে আবার রাখা হয়েছে, কারণ ১২ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ নিজেই বঙ্গবন্ধুর দেশে প্রত্যাবর্তন দিবস পালন করবে। তাদের হাতেই প্রশাসন, পুলিশ। প্রধানমন্ত্রী নিজেই দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। কাজেই অনায়াসেই অনুমতি মিলেছে। বিরোধী পক্ষ হরতালের ঘোষণা দিয়েছে।
দেশে কি নির্বাচিত সংসদ আছে? উত্তর নিশ্চয়ই হবে, না। সংসদ সদস্যদের অধিকাংশই নির্বাচিত নয়। এর মধ্যে বিরোধী দলও রয়েছে, তারাও একইভাবে অনির্বাচিত। এমন একটি ‘সংবিধান রক্ষা’ বা ‘নিয়মরক্ষার নির্বাচন’ হয়েছিল ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি। এতে আমরা ভোটার হিসেবে অধিকারবঞ্চিত হয়েছি। আমি একজন ভোটার হিসেবে বলতে পারছি না, এই যে ৩০০ জন সংসদে আছেন, যারা আইন প্রণয়ন করবেন, আমাদের প্রতিনিধি হয়ে কথা বলবেন তাদের অন্তত একজন আমাদের এলাকা থেকে আমাদের কারও না কারও ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন। ১৫৪টি আসনের ক্ষেত্রে ভোটাররা সে সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। যে ১৪৬টি আসনে নির্বাচন হয়েছে তাতে ভোটারের উপস্থিতি এত কম ছিল যে, নির্বাচন কমিশনের তিন দিন লেগেছে অঙ্ক মিলিয়ে ৪০ শতাংশ বানাতে। আর ৫ জানুয়ারি সারা দিন মিডিয়ায় দেখে এবং যারা পর্যবেক্ষণ করেছেন তাদের হিসাবে ১০ শতাংশ কী ১২ শতাংশ। আর যারা সাহস করে বলতে চান যে নির্বাচন শুধু রাজনৈতিক দলগুলোই বর্জন করেনি, ভোটাররাও করেছে, তাদের হিসাবে ৫ শতাংশ ভোট পড়েছে। বাংলাদেশের মতো দেশে এমন ঘটনা আর কখনও ঘটেনি। নির্বাচনে কারচুপি হয়, মারধর হয়, ভোট চুরি হয় এমনকি গণনার সময়ও এলোমেলো হয়ে যায়। এসব জেনেও মানুষ ভোট দেয়। সেখানে নির্বাচন হবে আর ভোটাররা ঘরে বসে থাকবে- এমন ঘটনা ঘটতে আমরা এর আগে দেখিনি। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের নেতিবাচক দিক ছিল, নির্বাচনের গণনা হতে হতে মানুষ তার ভোট দেয়া প্রার্থী জিতল কিনা, তার পছন্দের দল সরকার গঠন করার মতো আসন পেল কিনা- এসব জানার উত্তেজনা ছিল না। ৫ তারিখের আগেই জানা হয়েছিল সরকার কে গঠন করছে, কারণ সরকার গঠনের জন্য নূ্যনতম যত আসন দরকার, তা আওয়ামী লীগ পেয়ে গেছে! কাজেই অন্য আসনগুলোতে শতকরা ১০০ ভাগ ভোট পেলেও বিরোধী দল হওয়া ছাড়া উপায় নেই। কাজেই সেদিক থেকেও ভোটারদের আগ্রহ কম ছিল।
এবারের ৫ জানুয়ারিতে শেষপর্যন্ত প্রমাণ করে দিল, সরকার গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে না। নির্বাচন বৈধ কী অবৈধ, তা দিয়ে আর বিচার করার কিছু নেই। এবার নতুন করে প্রমাণ হচ্ছে, দেশে গণতন্ত্র নেই, অন্তত নির্বাচিত সরকার হলে যে আচরণ আশা করা যায়, সেটা পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি যখন উত্তপ্ত থাকে তখন টেলিভিশনে টকশোগুলোর জনপ্রিয়তা বাড়ে। জনগণ এখন রাস্তায় নামতে চায় না; কিন্তু টকশোতে কেউ কড়াভাবে সরকারের সমালোচনা করলে খুশি হয়, ‘একদম ঠিক বলেছে! এটাই আমার কথা।’ মাঝরাত পর্যন্ত ঘরের বেড রুম বা ড্রয়িং রুমে টেলিভিশন দেখে নিজের মতো করে খুশি বা অ-খুশি হয়ে ঘুমাতে যায়। আমিও গত কিছু দিন টকশোগুলো মনোযোগ দিয়ে দেখছিলাম বোঝার জন্য যে, এ আলোচনায় ‘গণতন্ত্র’ কীভাবে ফুটে ওঠে। প্রথমেই একটু বলে রাখি, টকশোতে কালো আর সাদা তালিকা (অর্থাৎ কাদের আনা যাবে আর কাদের আনা যাবে না) ছোট হতে হতে এখন মাত্র কয়েকজনের মধ্যে গিয়ে ঠেকেছে। এদের খুব কষ্ট করতে হয়। এক চ্যানেল থেকে অন্য চ্যানেলে দৌড়াতে হয়, একটাতে শার্ট ও অন্যটায় কোট পরে কিছু পার্থক্য বোঝানোর চেষ্টা করা হয়- এ এক মহাকারবার। এদের মধ্যে বেশিরভাগই সাংবাদিক। কেন জানি না, টকশোগুলোর সিদ্ধান্ত হয়েছে, বাংলাদেশের রাজনীতি একমাত্র সাংবাদিকরাই বোঝেন। আমরা জানি, সাংবাদিকদের কাজ হচ্ছে সংবাদ সংগ্রহ করা এবং তা বস্তুনিষ্ঠভাবে পরিবেশন করা। কিন্তু এখন তারা বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ধারক-বাহক হয়ে গেছেন। ধরে নেয়া হচ্ছে তারা অবজেক্টিভ ব্যাখ্যা দিচ্ছেন। কিন্তু যে কেউ এখন টকশোতে কে আছেন দেখেই বুঝতে পারেন আজ আলোচনা কোন দিকে যাবে। এদের সঙ্গে দুই-একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এনে একটা ব্যালেন্স করা হচ্ছে বটে; কিন্তু সেখানেও চিহ্নত কয়েকজনের ঠাঁই হয় এবং তাদের সম্পর্কেও এরই মধ্যে সবাই জানে। প্রথম বাক্য শুনেই বোঝা যায় পরের বাক্য কী হবে। আরও অদ্ভুত ব্যাপার, তাদের মধ্যে দুই-একজন এক চ্যানেলে যাচ্ছেন অতিথি হয়ে, অন্য চ্যানেলে গিয়ে নিজেই সঞ্চালক হচ্ছেন। সঞ্চালকের নিরপেক্ষতা বোঝার আর কোনো উপায় নেই, কারণ অতিথি হয়ে তিনি একটি পক্ষ নিয়ে এরই মধ্যে অন্য চ্যানেলে যা বলার বলে এসেছেন।
চ্যানেল-বিশেষে বোঝা যায় বিষয় নির্ধারণ, অতিথি আমন্ত্রণ এবং অতিথিদের কথা বলার সময় বণ্টনের ক্ষেত্রে তাদের আচরণ চরম অগণতান্ত্রিক। কয়েকজনকে আনা হয় দর্শকদের বোঝানোর জন্য যে, বিরোধী মতের অতিথিকেও আনা হয়েছে। এক্ষেত্রে সঞ্চালকরা কৌশলে তাদের কথা বলার সময় বাধা দিয়ে, থামিয়ে দিয়ে আর না পারলে বিরতিতে যাওয়ার ঘোষণা দিয়ে বেশ পারদর্শিতার পরিচয় দেন।
টকশোতে ভালো কিছু হয় না, তা বলছি না। অন্তত টকশোর আলোচনা থেকে ১৫৪+১৪৬ আসনের বিস্তারিত আলোচনা অনেকের বুঝতে কাজে দিয়েছে। বর্তমানে একটি আলোচনা আমি খুব উপভোগ করি এবং একইসঙ্গে শঙ্কিত হই। সেটা হচ্ছে, গণতন্ত্র রক্ষা হয়েছে বা নিহত হয়েছে, এ দুই অবস্থানের মাঝখানে একজন আলোচক নিয়মিতভাবে প্রায় প্রতিদিন প্রতিটি টকশোতে বলছেন, গণতন্ত্র রক্ষাও হয়নি, নিহতও হয়নি, আহত হয়েছে। এটা একটা মহাঅদ্ভুত কথা। আহত অবস্থায় ২০১৪ সালের জানুয়ারির ৫ তারিখ থেকে ২০১৫ সালের ৫ তারিখ পর্যন্ত থাকার কথা নয়। হয় তাকে সুস্থ হতে হবে, না হলে মরে যেতে হবে। যিনি এ গণতন্ত্র আহত হয়েছে বলছেন তার দিক থেকে হয়তো বিবেচনার বিষয় হচ্ছে, এতে অস্থির হওয়ার কিছু নেই। এক সময় নির্বাচন ঠিকমতো হলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। তার কথা যদি ধরেও নেই তাহলেও জানার বিষয় আহত হয়েছেন কী হাত-পা ভেঙে নাকি একেবারে মাথায় আঘাত (হেড ইনজুরি) পেয়েছেন? সে অনুযায়ী তার চিকিৎসা হওয়ার কথা। এসব কোনো বিশ্লেষণ ছাড়া হঠাৎ এ গণতন্ত্র আহত হওয়ার তত্ত্ব কেন হাজির করা হচ্ছে, তা বুঝতে কষ্ট হয় না এ কারণে, ৫ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে খোদ সরকারই অস্বস্তিতে আছে, সারা বিশ্বে এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কাজেই আহত হওয়ার কথা স্বীকার করলে কিছুটা আত্মরক্ষা হয়। এখন একে স্বল্পমেয়াদি দ্রুত রোগ সারানোর জন্য অ্যান্টিবায়োটিক চিকিৎসা দেয়া হবে নাকি দীর্ঘমেয়াদি কবিরাজি চিকিৎসা দেয়া হবে- তা সরকার ঠিক করতে পারবে।
অন্যদিকে টকশোগুলোতে বলতে শোনা যায় মানুষ তো শান্তিতে আছে, তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো হয়েছে, ব্যবসা-বাণিজ্য হচ্ছে (!)… ইত্যাদি। তাহলে গণতন্ত্র যে অবস্থাতেই থাকুক মানুষের কিছু যায়-আসে না। এমনও কথা কোনো কোনো টকশোতে বলা হয়েছে (খুব জ্ঞানী-গুণী মানুষ বলেছেন) গণতান্ত্রিক আন্দোলন মানে যদি হয় বাসে আগুন দেয়া, মানুষ মারা, জ্বালাও-পোড়াও তাহলে সে গণতন্ত্রের দরকার নেই! কোনো ভালো যুক্তি ছাড়াই মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরের উদাহরণ টেনে বলা হচ্ছে উন্নয়ন হলে গণতন্ত্রের দরকার হয় না। বাহ। অবশ্য এ যুক্তির বিপক্ষে অনেকেই কথা বলেছেন; তবুও জনগণের মাথায় এ কথা ঢোকানো হচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ তো ‘সোনার খাঁচায় বন্দি পাখি’ কখনোই হতে চায় না। আর এ কথা মোটেও সত্যি নয়, দেশে উন্নয়ন হচ্ছে। রাস্তাঘাট ও সেতু বানালেই উন্নয়ন হয় না, শ্রমজীবী মানুষের অবস্থা কি ভালো আছে? বিদেশে শ্রমবাজার সঙ্কুচিত হয়ে যাচ্ছে, গার্মেন্টের কারখানা একের পর এক বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। তাহলে ভালো থাকার নমুনা কী? শুধু তাই নয়, আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদ, কৃষি- সবকিছুই এখন বিদেশি কোম্পানি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। সুন্দরবনের যে ক্ষতি হয়ে গেল তা ধামাচাপা দিয়ে ঠিকই শেলা নদী খুলে দেয়া হয়েছে নৌ পরিবহনের জন্য।
এরপরও টকশোতে বলা হয়, আমরা ভালো আছি। টকশোতে দুই-একজন কড়া ভাষায় সমালোচনার সুযোগ পাচ্ছেন- এটাই কি গণতন্ত্র?
অবশ্যই, তবে তা টেলিভিশনের পর্দায়, টকশো গণতন্ত্র। ভবিষ্যতে পলিটিক্যাল সায়েন্সের জন্য এ টকশো আলোচনা পাঠ্য হলে অবাক হব না।