ফরিদা আখতার || Sunday 04 January 2015
হঠাৎ করে কেউ নাই হয়ে যেতে পারে, এই কথা বিশ্বাস করা আমার জন্যে খুব কঠিন। মনে হয় চোখের সামনে থেকে হঠাৎ হারিয়ে গেল। আর কোন্দিন দেখবো না, এটা কি হতে পারে? ডেইজীর মৃত্যু তেমনই এক অনুভুতির সৃষ্টি করেছে আমাদের অনেকের মধ্যে। গত ২৭ ডিসেম্বর ২০১৪ দিবাগত রাতে নিজের বাসায় ডেইজি ইন্তেকাল করেছে (ইন্না লিল্লাহে ওয়া ইন্না লিল্লাএ রাজেউন …)। বছর শেষ হতে আর মাত্র তিন দিন বাকী ছিল। নতুন বছরে (২০১৫) এসে আমরা তার বাসায় গিয়ে তার আত্মার মাগফেরাতের জন্যে দোয়া করলাম।
হাসিনা আফরোজ সিদ্দিক (ডেইজী), যাকে ডেইজী বললেই বোধ হয় বেশী চেনা যাবে। সত্যি যেন একটি ফুলের মতো মানুষ, যার হাসি দেখে, কথা শুনে এবং তার স্পর্শ বুঝিয়ে দেয় – তার মধ্যে কোন খাদ নেই। ডেইজী নারীগ্রন্থ প্রবর্তনার সোমবারে মেয়েদের আড্ডার একেবারে প্রথম থেকেই (১৯৯০ সাল) আসছে। আজ আমি একজন বন্ধু হিশেবে তার কথা মনে করছি তেমনি তার আরও অনেক অনেক বন্ধু গড়ে উঠেছিল নারীগ্রন্থ প্রবর্তনার আড্ডার মাধ্যমে। তাঁরাও আজ ডেইজীকে হারাবার বেদনায় কাতর। মর্মাহত।
ডেইজি একটি ফুলের নাম, মুলতঃ দেখতে সাদা, মাঝখানে হলুদ ছোট ছোট অসংখ্য পাপড়ি দিয়ে একটি চোখের মতো আকৃতি তৈরি করে। ডেইজি ফুল আরও অনেক রংয়ের হয় তবে আমার বন্ধু ডেইজির নাম নিশ্চয় এই সাদা ডেইজির সাথেই বেশী মিলে যায়। ডেইজী ফুল সম্পর্কে বলা হয় এটা উদ্ভিদ বিজ্ঞানে বৃহৎ “vascular plants” পরিবারভুক্ত, যা সংবহন-নালিকা-সংবলিত; যার প্রধান কাজ হোল আশে পাশের গাছ-পালাকে রক্ষার জন্য সহায়তা করা। পৃথিবীর প্রায় ১০% ফুলের আধার হয়ে আছে এই পরিবারের উদ্ভিদ। কাজেই ডেইজী একা ভাল থাকতে চায় না, সে অন্যকে নিয়ে ভাল থাকে। ডেইজি ফুলটি ভোর থেকেই ফোটে, একে বলা হয় “দিনের চোখ”। জার্মান উদ্ভিদ বিজ্ঞানী পল ডিয়েট্রিখ (Paul Dietrich) এবং তাঁর ঘনিষ্ট সুইডিস বন্ধু কার্ল লিনিয়াস Carl Linnaeus ১৭৯২ সালে ডেইজি পরিবার সনাক্ত করেন। বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে ডেইজি ফুল বিশুদ্ধতা ও সরলতার প্রতীক। এর অনেক গুনাগুন রয়েছে, যেমন খাদ্য হিশেবে ডেইজি ফুলের পাতা সালাদের সাথে খাওয়া যায়, এর পাতার মধ্যে প্রচুর ভিটামিন সি রয়েছে। ওষুধি গুনের দিক থেকে রক্তক্ষরণ কমানো, বদহজম এবং কফ কমিয়ে দিতে সাহায্য করে। মৌমাছি ডেইজি ফুল খুব ভালবাসে এবং মধু তৈরিতে ভাল ভুমিকা রাখে।
ডেইজি ফুল এবং মানুষ ডেইজির মধ্যে কী অদ্ভুত মিল! সত্যিই অকৃত্রিম।
আমার সাথে ডেইজির পরিচয় অনেক আগে, আমার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকে – সত্তুরের দশকের মাঝামাঝি থেকে। আমি অর্থনীতির ছাত্রী ছিলাম, ডেইজি ছিল ইতিহাসের। তবুও একই সময়ে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে কেমন যেন খুব কাছাকাছি এসে গিয়েছিলাম। এমনিতেই সে সময় বিশ্ববিদ্যালয়ে মেয়েদের সংখ্যা কম ছিল, তাই হয়তো একে অপরের ঘনিষ্ট হয়ে যেতাম। সাথে ইংরেজী বিভাগের সোফিয়া, সমাজবিজ্ঞানের রওশন, আর রসায়নের মহসিনা ছিল। আমাদের সবার আর একজন ঘনিষ্ট বন্ধু ছিল দিলরুবা। চট্টগ্রাম কলেজ থেকে যার সাথে ঘনিষ্ঠতা। সেই পুরনো কথাগুলো আজ তুলবো না, বলতে গেলে শেষ করা যাবে না। তবে ডেইজী আমার সাথে নারীগ্রন্থ প্রবর্তনায় দেখা হলেই পুরণো বন্ধুদের কথা মনে করিয়ে দিতো। আমি স্বীকার করছি, বন্ধুদের সাথে সামাজিক সম্পর্ক আমার ঠিকভাবে রাখা হয় নি। আমার কাজের ধরণটাই হয়তো তার জন্যে দায়ী। কিন্তু নারীগ্রন্থ প্রবর্তনায় ডেইজীর নিয়মিত আসা-যাওয়ার কারণে তার সাথে আমার সম্পর্ক বজায় ছিল। এর জন্যে ডেইজীই বেশী ধন্যবাদ পাবার যোগ্য।
চট্টগ্রামে সে বড় হলেও বাবার বাড়ি পশ্চিমবঙ্গের হুগলী জেলার সবলসিংহপুর গ্রামে। নানীর সাথে চট্টগ্রামে চলে আসে এবং সেখানেই তার বড় হওয়া। শ্বশুর বাড়ি ব্রাম্মণবাড়িয়া।
ডেইজীর কখনো বসে থাকে নি। সাংসারিক জীবনও চালিয়েছে। বিয়ে হয়েছে, ছেলে-মেয়ে হয়েছে। স্বামী মোঃ আমানউল্লাহ বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজ। ছেলে মোঃ আসাদুর রহমান নায়েল। কম্পিউটার সায়েন্সে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে, পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমবিএ করে বর্তমানে নাইজেরিয়ান সরকারের সাথে নাইজেরিয়াতে প্রজেক্টের কাজ করছে। মেয়ে সুমাইয়া আফরীন। বাংলা ইউনিভাসির্টি অব প্রফেশনাল থেকে বিবিএ শেষ করেছে ২০১৪ সালে। বর্তমানে ভারত সরকারের স্কলারশীপে এমবিএ করছে ইউনিভার্সিটি অব নাইসোর্স-এ। মৃত্যুর মাত্র এক দেড় ঘন্টা আগেও মেয়ের সাথে স্কাইপে কথা বলেছে। মেয়ে পরীক্ষা শেষ হলে দেশে আসবে এই অপেক্ষায় ছিল। মেয়ে আসলো মায়ের মৃত্যু সংবাদ পেয়ে। কী দুঃর্ভাগ্য!!
ডেইজীর কর্মজীবনের শুরু ১৯৭৮/৭৯ সালে একটি স্কুলে এবং পরে একটি নাইট কলেজে কয়েক বছর শিক্ষকতাও করে। এলএলবি-তে প্রথম অংশ সমাপ্ত করে নারায়ণগঞ্জে। তারপরেই ১৯৮২ সালে আরব বাংলাদেশ ব্যাংক (এবি ব্যাংক)কারওয়ানবাজার শাখায় ‘প্রভিশনাল অফিসার’ পদে নিযুক্ত হয়। ঢাকা এবং চট্টগ্রামে দীর্ঘ ২৩ বছর চাকুরী জীবন পার করার পর ২০০৩ সালে অবসর গ্রহন করে। কর্মজীবনে নারীদের প্রতিকুল অবস্থা সম্পর্কে ডেইজী খুব সচেতন ছিল। সে যখন কোন বিষয়ে সে নারী হিশেবে বৈষম্যের লক্ষণ সেই বিষয়ে সে কথা বলতো।
অবসর নিলেও ডেইজীর কাজ থেমে থাকে নি। নারীগ্রন্থ প্রবর্তনার আড্ডার সদস্যদের নিয়ে নানা ধরণের পরিকল্পনা তার লেগেই থাকতো। কখনো বেড়াতে যাওয়া, কখনো বাড়ীতে দাওয়াত দিয়ে খাওয়ানো। আড্ডার মহিলাদের সাথে ভারত ঘুরে এসেছিল। আমাদের সাথে মুম্বাইতে অনুষ্ঠিত ওয়ার্ল্ড শোশাল ফোরামে যোগ দিয়েছিল। এতে সে খুব খুশি ছিল। নারীগ্রন্থের কাজে নেত্রকোনায় গিয়ে আদীবাসীদের সাথে সভা করেছিল। বিভিন্ন সময়ে সভা সেমিনারে দাওয়াত দিলে ঠিকই আসতো। যতোদিন সে পল্টনের দিকে থাকতো, তখন অধ্যাপক লতিফা আকন্দের সাথে আসা যাওয়া, তাঁকে পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব নিয়ে বসতো নিজের মতো করে। এই ডিসেম্বর মাসের শুরুতেই (৩ ডিসেম্বর) লতিফা আপা মৃত্যু বরণ করেন। আমরা সোমবারের আড্ডায় তাঁর স্মরণ সভা করেছিলাম। সেদিন ডেইজীও এসেছিল। এবং লতিফা আপাকে নিয়ে অনেক কথা বললো। অনেক কথা আমরাও জানতাম না। রমনা পার্কে ‘একটু বসি’ নামে নারীদের জন্যে যে স্থানটি লতিফা আপা করেছিলেন, তার কথাও বললো। বলেছিল লতিফা আপা তার সাথে ভারতে বেড়াতে যেতে চান। ডেইজীর মেয়ে আফরীনকে দেখতে গেলে যেন অবশ্যই তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় এমন আবদার করেন। ডেইজী এই কথা বলতে গিয়ে খুব হেসেছিল। কিন্তু একি হোল? লতিফা আপা ভারত নয় পৃথিবীর ওপারে চলে গেলেন ডিসেম্বর মাসের শুরুতে, আর ডেইজী গেল মাসের শেষে! এটা তো কথা ছিল না। আমরা যারা সেদিন ডেইজীর কথা শুনছিলাম, এখন মনে হচ্ছে দুজনেই আমাদের ফাঁকি দিয়ে চলে গেছে।
ডেইজীর নিজ বাসা পিংক সিটিতে, শুনেছিলাম অনেক দুর। কিন্তু কত দুর তা বুঝতে পারিনি। সকালে মৃত্যুর খবর শুনে আমরা কয়েকজন যখন তার বাসায় যাচ্ছিলাম, বসুন্ধরা পার হয়েও আরও অনেক দূরে… বিশ্বাস হয় নি, এতো পথ পাড়ি দিয়ে প্রতি সোমবার মোহাম্মদপুরে আড্ডায় এসেছে। মাঝে কিছুদিন হয়তো একটু বাদ পড়তো গাড়ী না পেলে। কিন্তু তার গাড়ীর ব্যবস্থা থাকলে সোমবারে আড্ডায় টের পাওয়া যেতো না সে অতদুর থেকে আসে। এ ব্যাপারে তার স্বামী আমান উল্লাহ ভাইয়ের সহযোগিতা ছিল পুরোদমে।
রাস্তা যতোই দূরে হোক পিংক সিটির ভেতরে ঢুকে মনটা ভরে গেল। ডেইজীর বাসা ৭ নম্বর রোডে, প্রায় শেষের দিকে। প্রতিটি বাড়ীর সামনে বাগানের জায়গা আছে, গাছ পালা আছে। একটা সবুজের ভাব। ডেইজী ঢাকা শহরের অশ্লীল ফ্লাট কালচার থেকে বের হয়ে এমন একটি জায়গায় নিজের বাড়ী করেছে। শুধু প্রাকৃতিক সোন্দর্য নয়, পাড়া-প্রতিবেশী নিয়ে থাকা, একটা সমাজ গড়ে তোলার সেই পুরণো রীতি ডেইজী আবার ফিরিয়ে এনেছে পিংক সিটিতে তার বাড়ীতে। সেখানে বাড়িতে বাড়ীতে ডেইজীর মৃত্যুতে শোক করছে। অথচ ঢাকা শহরের বিশাল উঁচু বিল্ডিংয়ের পাশের ফ্লাটের কেউ মারা গেলেও হয়তো জানতে পারেন না। জানলেও সামান্য সৌজন্যমুলক সহানুভুতি ছাড়া বিশেষ কিছু পাওয়া যায় না। কিন্তু এখানে দেখলাম অন্য রকম ব্যাপার। ডেইজীর জন্যে পয়লা জানুয়ারিতে মহিলাদের দোয়ার আয়োজন করেছিলেন পাড়া প্রতিবেশীরা। গেটেই দেখা গেল কালো ব্যানারে লেখা “আমাদের প্রাণপ্রিয় ডেইজী ভাবী”। এলাকার সবাই উদ্যোগ নিয়ে খাওয়া-দাওয়ার আয়োজনও করেছিলেন, একেবারে আত্মীয়ের মতো করে। ডেইজী তাদের সাথে তেমন সম্পর্ক তৈরী করতে পেরেছিল। এটা এক আসাধারণ গুণ, অসাধারণ ক্ষমতা। সেদিন দোয়ার পর মহিলারা সকলের অনুমতি নিলেন ডেইজীর ইচ্ছে ছিল রমনা পার্কের মতো এখানেও মহিলাদের জন্য একটি জায়গা “একটু বসি” করার জন্যে। উপস্থিত সবাই সম্মতি দিলেন।
ডেইজীর কথা এভাবে লিখতে হবে ভাবিনি, এখন যে লিখছি তাও আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। শুধু তাঁর সেই হাসিমাখা চেহারাটি ভাসছে। চোখে ভাসছে সে আমাদের কোন একটি কাজ ভাল লাগলে তার প্রশংসা কেমনভাবে করতো। এক পর্যায়ে লজ্জা লাগতো। আসলেই কি আমরা তার যোগ্য?
ডেইজী, তুমি যেখানেই আছো ভাল থেকো, আমরা শুধু সে দোয়াই করি।