সাইদা আখতার || Wednesday 05 November 2014
বাংলাদেশে নারীর সংগ্রাম, সংগ্রামের ধরণ এবং বর্তমান নারী আন্দোলনের বিষয় এবং সামগ্রিক ভাবে দেশের মানুষের মুক্তির সংগ্রামে কোন না কোন ভাবে সম্পৃক্ত রয়েছে বাংলাদেশের নারী।১৯৯৫ সালে জাতি সংঘ আয়োজিত বিশ্ব নারী সম্মেলন হয়ে গেল। আগামি ২০১৫ সালে এসে তার কুড়ি বছর পুর্ণ হবে। অনেক কাজের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছিল। এখন দেখতে হবে কত দুর এগিয়েছি।
বেইজিং এর কুড়ি বছর উপলক্ষ্যে দেশের বিভিন্ন নারী সংগঠন নানাভাবে কাজ করছেন। নারীগ্রন্থ এই পর্যালোচনার কাজটি ঢাকার বাইরে যারা আছেন তাদের নিয়ে করেছে। তারই একটি অংশ হিশেব রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের ১৬টি জেলার নারীপ্রধান সংগঠনের প্রতিনিধিদের নিয়ে বেইজিং এর কুড়ি বছর উপলক্ষ্যে কর্মপরিকল্পনা গ্রহণের জন্য গত ২৯ অক্টোবঢ়, ২০১৪ তারিখে দিনব্যাপী একটি পর্যালোচনা সভার আয়োজন করে রাজশাহী জেলায় এসোসিয়েশন ফর কমিউনিটি ডেভেলাপমেন্ট এর কার্যালয়ে। এই সভা থেকেই বেইজিং এর কুড়ি বছর কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন পর্যলোচনার কয়েকটি গুরুত্বর্পূণ দিক চিহ্ন ফুটে উঠে-
১. নারী নির্যাতন ও নারী অধিকার
বাংলাদেশের পত্র-পত্রিকার তথ্য অনুসারে নারী নির্যাতনের হার দিন দিন বাড়ছে এবং এর ধরণও পাল্টাচ্ছে। নারী পাচার, ধর্ষণ, ধর্ষণের পর হত্যা, গণধর্ষণ, এসিড নিক্ষেপ, যৌতুক ও বাল্য বিবাহ এ সব ঘটনা রোধের কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। বাংলাদেশে নির্যাতন প্রতিরোধের জন্য বেশ কয়টি আইন বিদ্যমান। আইন বাস্তবায়নের জটিলতা এবং আইনের ফাঁক-ফোকর থাকার কারণে নারী নির্যাতন প্রতিরোধের কোন পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে না। নারী নির্যাতন প্রতিরোধের জন্য সরকার সহ নারী সংগঠন এবং মানবাধিকার সংগঠন নানান কর্মসূচী গ্রহণ ও কাজ করে যাচ্ছে। নারী অধিকার আদায়ের জন্য বিভিন্ন সচেতনতামূলক কাজ সরকারী ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠনের দ্বারা হয়ে থাকলেও কার্যকর স্থানে নারী তার অধিকার আদায়ে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না।
অবস্থান ভেদে নারী নির্যাতন এর ধরণ বিভিন্ন হচ্ছে। শহর কেন্দ্রিক নির্যাতনের ধরণ ভিন্ন। একজন শহরের গৃহিনী এবং একজন গৃহস্থ পরিবারের পরিবারিক অবস্থান ভিন্ন, তাদের নির্যাতনের ধরণ অ মাত্রাও ভিন্ন। গার্মেন্টস শ্রমিক (মহিলা ) কৃষক, জেলে, কামার-কুমার প্রত্যেকে বিভিন্ন আঙ্গিকে নির্যাতনের শিকার হয়। এই নির্যাতন শুধু যে পরিবার কেন্দ্রিক তা নয় সামাজিক, রাজনৈতিক ও পরিবশগঢ় অবস্থান কেন্দ্রিকও হতে পারে। নারীর উপর নির্যাতন শুধু শারীরিক নয়। এর সাথে মানসিক, অর্থনৈতিক সামাজিক ও রাজনৈতিক সব ধরণের বৈষম্য জড়িত।
বেঁচে থাকার সংগ্রাম নারীর জন্য আজকের নয়। এই সংগ্রাম সব সময় ছিল। এখন সে সংগ্রামের রূপ বদলাচ্ছে। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে অর্থনৈতিক কর্মকান্ড, মানুষের জীবিকা এবং মানুষের মধ্যে মানষিকতা সবকিছু খোয়া যাচ্ছে। নারী হয়ে পড়েছে সস্তা শ্রমিক। আর তার সাথেই হচ্ছে নির্যাতিত শ্রমিক। অন্যদিকে নারী ঘরে স্বামী দ্বারা নির্যাতিত হয়। পুরুষ শাসিত সমাজ দ্বারা নির্যাতিত হয়। নারী সস্তা শ্রমিক হয়েই দেশের ভিতর এবং বাইরে কাজের জন্য যাচ্ছে। মেয়েরা কাজ করতে চায় এই প্রয়োজন এবং চাওয়ার সুযোগ নিচ্ছে পাচারকারী চক্র।
২. কৃষি ও পরিবেশ
কৃষি উৎপাদনের মূলে রয়েছে নারী। কিন্তু নারীর কাজের কোন স্বীকৃতি নেই, অন্যদিকে কৃষি চলে যাচ্ছে বহুজাতিক কোম্পানির হাতে। বহুজাতিক কোম্পানি প্রযুক্তি নির্ভর কৃষি বা অল্প কয়েকটি ফসলের ব্যাপক উৎপাদনের নির্ভরশীল। বাংলাদেশের মানুষের রয়েছে বৈচিত্র্যময় ফসল। কোম্পানী এককাট্টা ফসল উৎপাদন করতে গিয়ে নষ্ট করে দিচ্ছে বৈচিত্র্যময় ফসল ও পরিবেশ। আবাদী খাদ্যের পাশাপাশি অনাবাদি খাদ্য গরিব মানুষের বিশেষ করে গরিব নারীর খাদ্যের উপায় ছিল সেটা আর থাকছে না। বাংলাদেশের গরিব মেয়েরা কুড়িয়ে পাওয়া খাদ্য সংগ্রহ করে। গ্রামের কৃষক পরিবারের সদস্য হিসেবে নারীর গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। বীজ সংগ্রহ সংরক্ষণের জন্য নারীর গুরুত ছিল পরিবারের কাছে অনেক বেশী।
বিগত শতাব্দীর ষাটের দশক থেকে বাংলাদেশে কৃষি ক্ষেত্রে ব্যবহারের জন্য প্যাকেজের নামে আসে উফসী বীজ, বিষ বা কীটনাশক, রাসায়নিক সার এবং ডিপ-টিউবওয়েল। এই প্যাকেজ ব্যবহারের পূর্বে কৃষিতে বৈচিত্র্য ছিল। ধানের মৌসুমে ধান, বোরো মৌসুমে রবিশস্য প্রচুর উৎপাদিত হত। সত্তুর দশকের পর বাংলাদেশের কৃষির ক্ষেত্রে উফসী বীজ, রাসায়নিক সার ও ডিপ-টিউবওয়েলের ব্যবহার ক্রমশ বাড়তে থাকে এবং আশি নব্বুই দশকে হাইব্রীড বীজের প্রসার ঘটে। এর ফলে কৃষক স্থানীয় জাতের বীজ হারিয়ে বাজারের বীজের ওপর নির্ভরশীল হতে থাকে। এই সুযোগে বহুজাতিক কোম্পানী বীজের ব্যবসা শুরু করে এবং কৃষককে নিঃস্ব করে তোলে। রাসায়নিক সার ব্যবহারে মাটির উর্বরা শক্তি কমে। ফলে কৃষিপণ্য উৎপাদনের মাত্রা হ্রাস পাচ্ছে। মাটির অভ্যন্তরে জীব, অনুজীব, পোকা মাকড় মারা যাচ্ছে। পুকুর, বিল ও জলাশয়ের পানি দুষিত হওয়াতে মাছের বৈচিত্র্য কমছে। পশু-পাখির খাদ্য সমস্যা প্রকট হয়েছে। উচ্চ ফলনশীল চাষাবাদে মানুষের খাদ্যের অংশ বাড়ছে বলা হলেও প্রকৃত পক্ষে পুষ্টিকর খাদ্য কুড়িয়ে পাওয়া খাদ্যের পরিমাণ কমে যাচ্ছে। রাসায়নিক সার ও উফশী ব্যবহারে স্থানীয় জাতের আবাদের আবাস নষ্ট করছে। গর্ভবর্তী নারী ও শিশুর ওপর পুষ্টিহীনতার প্রভাব পড়ছে। প্রতিবন্ধী শিশুর জন্ম সংখ্যা বাড়ছে। মায়েদের গর্ভপাত হচ্ছে। নারীর সন্তান ধারণের ক্ষমতা কমছে। আধুনিক কৃষি আসার কারণে নারী কৃষি কাজ থেকে যেমন তার গুরুত্ব হারিয়ে ফেলছে অপর দিকে পরিবেশ হুমকির দিকে যাচ্ছে।
৩. জীবন-জীবিকা
নারীর জীবন-জীবিকা রক্ষায় নারীর সংগ্রাম অনেক আগে থেকে। কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরী করার জন্য তারা পারিবারিক ও সামাজিকভাবে লড়াই করছেন। কখনও নীরবে, কখনো প্রকাশ্যে নারী তার পরিবারের মধ্যে থেকে নিজেদের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরী করে নেয়। গ্রামের মেয়েরা কাঁথা তৈরী, নকশি কাজ সহ যাবতীয় কারুশিল্প কাজ, সংসারের প্রয়োজনে পাটি তৈরী, মাটির সরঞ্জাম তৈরী, শাড়ি, গামছা তৈরীসহ তাঁতের কাজ, মাঠে নেমে ধানের জ্বালা, হাঁস-মুরগী, ছাগল, গাভী লালন-পালন করে। বাড়ীর আঙ্গিনায় শাক-সবজির চাষ করে। হাঁস-মুরগীর ডিম, গাভীর দুধ, শাক-সবজি বিক্রি করে আর্থিক সংকটের মোকাবিলা করে। এই সব ধরণের জীবিকার প্রধান উৎস আশে প্রকৃতি ও পরিবেশ থেকে।
আদিবাসীদের জীবিকার প্রধান অবলম্বন হচ্ছে কৃষি কাজ। তারা সব সময়ই কৃষি কাজের সাথে জড়িত। পুরুষের পাশাপাশি বীজ তোলা থেকে শুরু করে ফসল কাটা, সংগ্রহ এবং সংরক্ষণে বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে। তারা তাদের নিজেদের পরিধেয় বস্ত্র নিজেরাই তৈরী করে। আদিবাসী নারীরা সকলেই এক সময় তাঁতের কাজ করতো। নদী, খাল, বিল, ডোবা থেকে দলবেঁধে মাছ ধরত। সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে তাদের জীবন জীবিকার ধারায় পরিবর্তন এসেছে। এখন তারা বহুবিধ সমস্যায় জর্জরিত। আদিবাসীদের মধ্যে ভূমিহীনের সংখ্যা বাড়ছে। বন জঙ্গল কেটে ফেলায় অনেক ঔষধী গাছ হারিয়ে যাচ্ছে। খাল-বিল, নদী, নালা ভরাট হয়ে যাওয়ায় অনেকে বাধ্য হয়ে পেশা পরিবর্তন করে শহরমুখী হচ্ছে। জেলেরা শহরে এসে রিক্সা ভ্যান চালাচ্ছে।
৪. শ্রমিক ও শ্রমজীবী নারী
নারী বিভিন্ন ক্ষেত্রে শ্রমিক হিসেবে নিয়োজিত তবে গার্মেন্টস শ্রমিকদের মধ্যে শতকরা ৯০ ভাগ হচ্ছে নারী। দেশের অভ্যন্তরে কাজ করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের জন্য তারা দিনভর কাজ করে। দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের রেকর্ড গড়তে এবং অর্থনীতিকে বিপদমুক্ত রাখতে তারা সবচেয়ে বড় সহায়ক শক্তি। এই নারী শ্রমিকরা এখন পর্যন্ত মজুরী বৈষম্যের শিকার। অসুস্থতার মাতৃত্বকালীন ছুটি নেই তাদের। পোশাক কারখানায় তারা তালাবদ্ধ অবস্থায় কাজ করে। আর সে কারণে আগুনে পুড়ে অনেক শ্রমিক শ্বাসরুদ্ধ অবস্থায় মারা যায়। মালিক পক্ষ সব সময় শ্রমিকদের সঙ্গে চরম, অমানবিক আচরণ করে থাকে। শ্রমিক নির্যাতনের মধ্যে সঠিক সময়ে বেতন পরিশোধ না করা, শ্রমিক ছাঁটাই বেশী রয়েছে। বেতন ভাতা এবং ওভারটাইম বৃদ্ধির জন্য শ্রমিকরা আন্দোলন করলে পুলিশের নির্যাতনের শিকার হয়।
বাংলাদেশের চা বাগানে নারী শ্রমিকেরা কাজ করে। এ শ্রমিক নারীরা নানান বৈশম্যের শিকার হয় তাদের দৈনিক মজুরী অত্যান্ত কম। কোম্পানী থেকে বরাদ্দকৃত ছোট ছোট খুপড়ীতে তাদের বাস করতে হয়। চা বাগানের শ্রমিক কলোনীতে স্যানিটারী পায়খানা, নিরাপদ পানির সু-ব্যবস্থা নেই। বর্জ্য মিশ্রিত নোংরা পানি তারা প্রাত্যহিক সকল কাজে ব্যবহার করে। শিক্ষার সুযোগ শ্রমিক সন্তানদের জন্য খুবই নগণ্য। স্কুলগামী ছাত্রদের মধ্যে ঝরে পড়ার হার অনেক বেশি। চা-বাগান মালিকরা শ্রমিকদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, নিরাপদ পানিসহ তাদের মৌলিক চাহিদার প্রতি একেবারে উদাসীন। অভিবাসী হিসেবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কর্মরত নারী শ্রমিকরা বহুমুখী অবহেলা আর প্রতারণার শিকার হচ্ছেন প্রায়শ। গৃহশ্রমে নিয়োজিত নারী শ্রমিকরা বিদেশে বেশি নির্যাতনের শিকার হয়।
৫. নারী ও স্বাস্থ্য
বিশ্বে মানব উন্নয়নের একটি গুরুত্বর্পূণ সূচক হিসাবে স্বাস্থ্য স্বীকৃতি। ন্যূনতম স্বাস্থ্যসেবা পাওয়া একটি মৌলিক মানবাধিকার হিসাবে গণ্য হয় এবং স্বাস্থ্যসহ মৌলিক চাহিদা নিশ্চিত করার জন্য সরকার অঙ্গীকারবদ্ধ। কিন্তু আজ পযর্ন্ত স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করা সরকারের পক্ষে সম্ভব হয়নি। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি প্রকাশ করেছে। কিন্তু এতে জনগণের স্বাস্থ্য অধিকার প্রতিষ্ঠার কোন সুযোগ নাই। সার্বিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থার প্রজনন স্বাস্থ্য ছাড়া নারীর সাধারণ স্বাস্থ্যের দিকে সরকারী নজর কম।মাতৃ স্বাস্থ্য কিছুটা স্বীকৃতি পেলেও নারীর সার্বিক স্বাস্থ্যের কোন স্বীকৃতি নাই।
অর্জন কম হয়েছে কি বেশী তার চেয়ে বড় কথা নারীর সংগ্রাম চলবেই। বেইজিংয়ের অর্জন কুড়ি থেকে বুড়ি হলেও নারী সংগ্রাম এগিয়ে যাবে পুর্ণ উদ্যমে। একদিন নিশ্চয়ই নারী মাথা তুলে দাঁড়াবে।