কনের বয়সে ‘মাইনাস টু’: বাল্য বিয়ে নিরোধ নয়, জায়েজ হবে

ফরিদা আখতার || Saturday 11 October 2014

বাল্য বিবাহ নিয়ে সরকার একটি সমাধান দিতে গিয়ে প্রচলিত আইনে ১৮ বছর থেকে কমিয়ে ষোল বছর করার সিদ্ধান্ত প্রায় হয়ে গেছে। সম্প্রতি জাতি সংঘের ইউনিসেফের একটি প্রতিবেদনে দেখা গেছে যে বাংলাদেশে ৬৬% মেয়ের বিয়ে ১৮ বছরে আগে হয়ে যায়, আর ২০ থেকে ২৪ বছরের মেয়েদের মধ্যে তিন ভাগের এক ভাগ ১৫ বছরের আগে বিয়ে হয়ে যায়।http://www.unicef.org/bangladesh/children_4866.htm এ বছর ২২ জুলাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রায় ৬০ জন প্রতিনিধি নিয়ে লন্ডনে Girl Summit, 2014 – এ অংশগ্রহণ করে এসেছেন, যেখানে বাল্য বিবাহ বন্ধ করা অন্যতম প্রধান আলোচ্য বিষয় ছিল। সেখান থেকে ফিরে বাল্য বিবাহ রোধের কথা বলে বিয়ের বয়সে মাইনাস টু? তাহলে নিরোধ করা হোল নাকি জায়েজ হোল?

সরকারের যুক্তি কি জানি না, তবে মনে হচ্ছে বিভিন্ন গবেষণায় যেহেতু দেখা যাচ্ছে প্রায় ৬৬% মেয়ের বিয়ে ১৮ বছর বয়সের নীচে হয়েই যাচ্ছে, তাহলে এতো সংখ্যক বিয়ে বেআইনী না রেখে বিয়ের বয়স কমিয়ে দিলেই এই বিচ্ছিরি পরিসংখ্যানকে ভদ্র বানানো যায়। তাই ষোল বছর নির্ধারণ করা হচ্ছে। এতে পরিসংখ্যানের চেহারা কতখানি উন্নত হবে বলা মুশকিল। আসলে বিয়ে তো তার চেয়েও কম বয়েসে হয়ে যাচ্ছে। ষোল বছর করলেই খুব বেশি এগুনো যাবে না। যে বয়সেই বিয়ে হোক না কেন এখন কাজীর খাতায় আঠারো হয়ে যাচ্ছে, তখন ষোল হবে, এই যা। না হলে বিয়ে রেজিস্ট্রি হবে না। কাজীর খাতায় কনের বয়স আইনী বয়স উঠবেই। কাজেই আইন করে বিয়ের বয়স কমালে এবার থেকে ষোল বছর লিখতে তাদের সুবিধা হবে। মিথ্যার সংখ্যায় মাইনাস টু হবে। এই চিন্তা করে যারা সরকারকে এই বুদ্ধি দিয়েছেন, তাঁরা নিঃসন্দেহে বোকার স্বর্গে বাস করছেন। তারা সমাজে মেয়েদের অবস্থা পরিবর্তন করতে আগ্রহী নন তাঁরা পরিসংখ্যানের অবস্থা বদলাতেই উদ্গ্রীব। তাদের জন্যে আমাদের সহানুভুতি দেখাবার সুযোগ নেই, দুঃখিত।



বাল্য বিয়ে নিয়ে ভাবনা নতুন কিছু নয়। বাল্য বিয়ে নিরোধের জন্যে ‘Child Marriage Restraint Act in 1929’ প্রণীত হয়েছিল।এই আইনটি তৎকালীন পাকিস্তান সরকার গ্রহণ করেছিল, সেখানে ১৬ বছরের কম হলে তাকে শিশু সংজ্ঞায়িত করা হয়েছিল। এবং ১৮ বছরে বেশী বয়সের পুরুষ যদি শিশু বয়সের মেয়েকে বিয়ে করে তারও শাস্তির বিধান ছিল। ব্রিটিশ আমলে রাজা রাম মোহন রায়ের মত সমাজ সংস্কারকরা এ ব্যাপারে বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছিলেন। এ ছাড়াও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে জাতি সংঘের মানবাধিকার ঘোষণা, ১৯৪৭ (The 1948 Universal Declaration of Human Rights) অনুযায়ী স্বাধীনভাবে সম্মতির মাধ্যমে বিয়ে হওয়া, ১৯৭৯ সালে নারীর বিরুদ্ধে সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপের সনদে Convention on the Elimination of All Forms of Discrimination against Women বা সিডো সনদে বিয়ের বয়স ১৮ বছর নির্ধারণ করা হয়েছে। বাংলাদেশ সিডো সনদে ১৯৮৪ সালে স্বাক্ষর করেছে, একই সাথে ১৯৯৮ সালে UN Convention on Consent to Marriage, Minimum Age for Marriage and Registration of Marriages স্বাক্ষর করেছে।

বিয়ের বয়স মেয়েদের জন্য ১৮ আর ছেলের জন্য ২১ বছর করার পেছনে প্রজনন স্বাস্থ্য এবং বিশেষ করে সরকার পরিচালিত পরিবার পরিকল্পনা কর্মসুচির সম্পর্ক ছিল, এখনো আছে। অল্প বয়সে বিয়ে মানে অল্প বয়েসে সন্তানের জন্ম দেয়া। তার ফলে জনসংখ্যা বৃদ্ধির যোগ আছে তাই সামাজিকভাবে জনসংখ্যা কমাবার এটা একটা সফল পদক্ষেপ ছিল, বলতেই হবে। এর ফলে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ হয়েছে নিশ্চয়ই, পাশাপাশি সামাজিকভাবে মেয়েদের অধিকারের প্রশ্নটি তোলা গেছে। জন্মের পরেই যে মেয়েকে বিবাহযোগ্যা মনে করা হোত তার ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি হয়েছে। বিয়ে না দিলে তাকে অন্তত স্কুলে পাঠাতে হবে, কিংবা কোন কাজের সাথে যুক্ত হতে হবে। বিয়ের বয়স বাড়ানোর কারণে সেই সব কথা মা-বাবাকে ভাবতে হয়েছে।এখন দেশে লক্ষ লক্ষ মেয়েরা গার্মেন্ট শ্রমিক হিশেবে এভাবে হয়তো কাজে যোগ দিত না যদি তাদের বিয়েটাই নিয়তির একমাত্র লিখন হয়ে দাঁড়াতো। এটা ভাল পরিবর্তনের লক্ষণ। যে বয়সে লেখা-পড়া করা, খেলা বা কাজের কথা ভাববে আর সমাজ তার দিকে আঙ্গুল তুলবে না ‘বিয়ে হয়নি কেন’ বলে, সে বয়সটা মেয়েদের ভালভাবে, নিজের মতো করে কাটুক এটা অবশ্যই সবার কাম্য। নারীদের সমাজে পিছিয়ে থাকতে দেখে মেনে নেয়ার প্রবণতা থাকে। নারীদের সমাজের উঁচু পর্যায়ে দেখা যায় না, কারণ তাদের জীবন গড়ে তোলার সময়েই তার জীবনের সিদ্ধ্বান্ত অন্যের কব্জায় চলে যায়। তার ভাগ্য নির্ধারিত হয় সেই ‘পরের বাড়ির” ভালত্ব বা তার প্রতি সহানুভুতির ওপর। আর যদি অল্প বয়সেই সন্তানের মা হতে হয় তাহলে সে নিজেই বাধা পড়ে যায় সন্তান লালন পালনের কর্তব্যে। বাল্য মা। কতটুকুই বা বোঝে। পুতুলের যত্ন যেমন করে নেয় তেমনি বাচ্চার সাথে তার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। আর সেই সময় সে তার জীবনের অন্য কাজ থেকে দূরে সরে যায়। সমাজে সে পিছিয়ে পড়ে। নারীর প্রতি বৈষম্যের জন্যে বাস্তব পরিস্থিতি তৈরি হয়। তবে এ কথা স্বীকার না করলে অন্যায় হবে যে, যেসব নারী অল্প বয়সে বিয়ে এবং সন্তান লালন পালনের পরও নিজের এবং স্বামী ও শ্বশুর বাড়ীর সহযোগিতায় সমাজে প্রতিষ্ঠাও পেয়েছেন। তবে তাঁদের সংগ্রামের ইতিহাস অনেক দীর্ঘ।



এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে বাল্য বিয়ের পেছনে বহু কারণ আছে, কাজেই বাল্য বিয়ে বন্ধ করো বললেই বন্ধ হয় না। আইন আছে ১৮ বছরের কম বয়সে বিয়ে দেয়া যাবে না, তাই কাজীর খাতায় সব ১৮বছর। অর্থাৎ আইনকে ফাঁকি দেয়া হচ্ছে আইন যারা রক্ষা করেন তাঁদের মাধ্যমে। কোন কাজী তো বলছেন না যে আমি বিয়ে পড়াতে পারবো না যদি বয়স সঠিক না হয়। বাল্য বিয়ের পেছনে সামাজিক সমস্যা বেশী বড় নাকি পারিবারিক তা নির্ধারণ করা এখন কঠিন কাজ। কোন কারণটি আগে দুর করলে এই সমস্যা থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে, সেটাও ভাল করতে বোঝার চেষ্টা করা হয়নি। বাল্য বিয়ে তো শুধু মাত্র একটি মেয়েকে একটি ছেলের সাথে কলমা পড়ানো বা কপালে সিঁদুর দিয়ে দেওয়া, তা তো নয়। এর সাথে জড়িয়ে আছে নারী ও পুরুষের ব্যাক্তিগত আচার আচরণ, একে অন্যের পরিবারের সাথে খাপ খাওয়ানোর প্রশ্ন এবং সর্বোপরি প্রজনন স্বাস্থ্যের মতো গুরুত্ব পুর্ণ বিষয়। যে বয়সে মেয়েরা মা-বাবার কাছে অনেক কিছু শেখার কথা সে বয়েসেই সে চলে যায় অন্যের বাড়ী। সেখানেই তার শিক্ষা হ্য় বা হয় না। তবে এখানে মেয়েটি ‘পরের ঘরের মেয়ে’ তার ভুল করার জন্যে সময় বা সুযোগ বরাদ্দ খুব কম। তাকে শিখতে হয় অন্যের জন্যে, নিজের জন্যে নয়। এইভাবে এক পর্যায়ে মেয়েটি হয়ে যায় কোন বাড়ীর বউ, কোন ব্যাক্তির বউ, কারো মা, ইত্যাদি। আমি অবাক হয়ে যাই যখন দেখি বাংলাদেশের শতকরা ৬৬ ভাগ মেয়েই (তিন ভাগের দুই ভাগ) এভাবে জীবন গড়ে তুলেছে। তাদের সালাম জানাই। তবে এটা ঠিক বাংলাদেশে মেয়ের যতটুকু পিছিয়ে আছে তার একটি কারণ হিশেবে বাল্য বিবাহ, – এই কথা ভুল বলা হবে না।

বিয়ে হলেই সন্তান হওয়ার ব্যাপার আছে। প্রজনন স্বাস্থ্যের দিক থেকে দেখলে অল্প বয়সে গর্ভধারণ মেয়েদের জন্যে এবং তার সন্তানের জন্যে বিপজ্জনক হতে পারে। এই কথা প্রজনন স্বাস্থ্যবিদরা নানাভাবে বলেছেন, এমন কি গ্রামের দাইমায়েরাও বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্নতা প্রকাশ করেছেন নানাভাবে। অল্প বয়সে বিয়ে দিয়ে কেউ অল্প বয়সে গর্ভধারণ ঠেকাতে পারবে কিনা তা বলা খুব মুশকিল। অল্প বয়সে বিয়ে দেয়ার অর্থ হচ্ছে জেনে শুনে একটি মেয়েকে বিপদের মুখে ঠেলে দেয়া। এটাও মনে রাখা দরকার বাল্য বিয়ে মানেই স্বামীও আর একজন অপ্রাপ্ত বয়স্ক, বা তরুণ এমন নয়। যেসব কারণে মা-বাবা বাধ্য হয়ে বিয়ে দেন সেখানে মেয়ের চেয়ে স্বামীর বয়স দ্বিগুন হতে পারে, দোজবরে হতে পারে, বিপত্নিক হতে পারে। একেবারে বুড়োর কাছে ১৫-১৬ বছরের মেয়ে বিয়ে দেয়ার ঘটনাও বিরল নয়। তাহলে প্রজনন স্বাস্থ্য আরও বেশি হুমকির মুখে পড়তে পারে। যেসব স্বামী তার প্রথম স্ত্রী কন্যা সন্তান জন্ম দিচ্ছে বলে বারে বারে বিয়ে করে তারাও তো এই অল্প বয়সী মেয়েদের বিয়ে করছে। আইনে শুধু মেয়ের বিয়ের বয়সের কথা উল্লেখ করলেই হবে না, যার সাথে বিয়ে হচ্ছে তার বয়স এমন কি বৈবাহিক অবস্থার বর্ণনাও উল্লেখ থাকতে হবে। সেটা কি আদৌ হবে?

ইউনিসেফের প্রতিবেদনে বাল্য বিয়ের গোড়ার কারণ হিশেবে দুটি কারণকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। একটি হচ্ছে যৌতুক, অন্যটি হচ্ছে মেয়েদের যৌন হয়রানী বা উত্যক্ত করা। আমাদের নিজেদের গবেষণায় দেখেছি যৌতুক এমন একটি বিচ্ছিড়ি হিশাব নিকাশের পর্যায়ে গেছে যে বয়স কম হলে যৌতুক কম দিলে চলবে, আর বয়স বেশী হলে যৌতুকের পরিমান বাড়বে। অথচ অল্প বয়সী মেয়ের তুলনায় প্রাপ্ত বয়স্ক হলে তার কাছে সংসারের অনেক দায়িত্ব আশা করা যায়। এভাবেই পরিবার গঠিত হতে পারে। কিন্তু এখনো সমাজে মেয়েদের সম্পর্কে ‘কুড়িতে বুড়ি’ চিন্তা যায়নি বলে বাবা মায়েরা ভয় পায়, কুড়ি পার হলে মেয়ের বিয়ের প্রস্তাব আর আসবে না। আসলেও অনেক বেশী যৌতুক দাবী করবে যা তাদের পক্ষে দেয়া সম্ভব হবে না। অর্থাৎ সামাজিকভাবেও মেয়েদের বয়স নিয়ে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয় বলেও বাল্য বিবাহের মতো ক্ষতিকর কাজ ঘটে যায়। অথচ নারী্র ক্ষমতায়ন, নারীর অধিকার নিয়ে বিশ্বব্যাপী এতো তোলপাড় হলেও নারীর বিয়ের বয়স নিয়ে খুব বেশী চিন্তা বদলাতে পারেনি। সরকারও অবচেতনে সেই ধারণাকেই প্রশ্রয় দিচ্ছেন কিংবা নিজেই বিশ্বাস করছেন। সরকার এই ধারণা পরিবর্তনের জন্য প্রচার প্রচারণা চালাতে পারেন, সচেতনতা সৃষ্টির জন্য কাজ করতে পারেন, তা না করেই যদি শুধু বয়স কমিয়ে দেয়া হয় তাহলে কুড়িতে নয় এখন ১৮তেই বুড়ি হয়ে যেতে হবে। এখানেও ‘মাইনাস টু’ হয়ে যাবে।



বাল্য বিয়ে প্রতিরোধের জন্য সমাজে্র অনেক গভীরে কাজ করতে হবে। মেয়েরা শিক্ষার সুযোগ পেলে, কাজের সুযোগ পেলে, সমাজে প্রতিষ্ঠিত হতে পারলে বিয়ে নিয়ে উৎকন্ঠা কমবে। বিয়ে হতে হবে পরিবার গঠনের সিদ্ধান্তের সাথে যুক্ত হয়ে, একটি মেয়েকে বোঝা মনে করে অন্যের বাড়ী পাঠিয়ে দেয়া হিশেবে নয়। পরিবারে পুত্র ও কন্যার মর্যাদা ও অধিকার সমান করে দেয়া হোক, সম্পত্তির অধিকারের বিষয়টি নিয়ে আরো বিস্তারিত আলোচনা হোক। এভাবেই পরিবর্তন আসবে।

বিয়ের বয়সে মাইনাস টু করে বাল্য বিয়ে নিরোধ হবে না, জায়েজ হবে মাত্র।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *