ফরিদা আখতার || Sunday 13 July 2014
ঈদ আসছে। সবাই কেনাকাটা করছে। নানা রংয়ের ও ঢংয়ের পোশাক। ঈদুল ফিতরেই সাবাই মূলত পোশাক কেনে, আপনজনের কাছ থেকে উপহার পায়, নিজেও কেনে। রাজধানী ঢাকায় কোন অজুহাত ছাড়াই যানজট হয়, পনের মিনিটের পথ দুই ঘন্টায় পাড়ি দিতে হয়। এখন তো শপিং মল আছে কিংবা কাপড়ের দোকান আছে এমন জায়গায় গাড়ী ও রিক্সার ভীড় লেগেই আছে। কাপড়ের পাশাপাশি ঈদের আনুসাঙ্গিক জিনিসের কেনাকাটাও হচ্ছে। ব্যাবসায়ীদের জন্য বছরের এই সময়টাতেই তাদের সারা বছরের বিনিয়োগের মূল অংশ উদ্ধার হতে পারে। এর সাথে জড়িত থাকে কর্মসংস্থানের প্রশ্ন। অর্থাৎ ঈদ একদিকে পবিত্র মাহে রমজানের রোজার শেষে ধর্মীয়ভাবে পালনের একটি দিন অন্যদিকে এর সাথে জড়িত রয়েছে দেশের অর্থনীতির একটি বিশাল অংশ। পরিবহন ব্যবসার কথা আর নাই বা বললাম।
দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি হিশেবে বর্তমানে যে খাতটি সবচেয়ে বেশী অবদান রাখছে তা হচ্ছে গার্মেন্ট শিল্প। দেশের রপ্তানির বেশির ভাগই আসে তৈরি পোশাক খাত থেকে। বিজিএমইএ-র মতে ‘জাতীয় রপ্তানির আয়ের ৭৭ শতাংশই আসে তৈরি পোশাক থেকে। এর সাথে যুক্ত আছে ৪৪ লাখ শ্রমিক ও কর্মচারী। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) প্রকাশিত রপ্তানির হালনাগাদ পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে সদ্যসমাপ্ত ২০১৩-১৪ অর্থবছরে রপ্তানি আয় হয়েছে ৩০.১৮ বিলিয়ন ডলার, যা আগের অর্থবছরের চেয়ে ১১.৬৫% বেশি।ত্রিশ বিলিয়ন ডলারের এই রপ্তানি আয়ের মধ্যে পাঁচ ভাগের চার ভাগ অবদান তৈরি পোশাক শিল্পের। অর্থাৎ এই সময়ে শুধু তৈরি পোশাক পণ্য রপ্তানি থেকেই আয় হয়েছে ২৪.৪৯ বিলিয়ন ডলার, যা মোট রপ্তানি আয়ের ৮১ শতাংশ। তৈরী পোশাকের মধ্যে নীট পণ্য রপ্তানি থেকে আয় হয়েছে ১২.০৪ বিলিয়ন ডলার। আর ওভেন পণ্য রপ্তানি থেকে আয় হয়েছে ১২.৪৪ বিলিয়ন ডলার [১০ জুলাই, ২০১৪, ৩০ বিলিয়ন ডলার ছাড়ালো রপ্তানি আয় – bdnews24.com.htm]
দেশের অর্থনীতির অন্য সব খাতে মন্দা চলছে তা ইপিবির পরিসংখ্যান থেকেই বোঝা যাচ্ছে। যেমন গত অর্থবছরে ২০১২-১৩ অর্থবছরের তুলনায় পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি থেকে আয় কমেছে ২০ শতাংশ। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে এই খাতের পণ্য রপ্তানি করে আয় হয়েছে ৮২৪ কোটি ডলার, যা আগের অর্থবছরে ছিল ১০৩০ কোটি ডলার। এছাড়া হিমায়িত মাছ রপ্তানি থেকে আয় কমেছে ৯.৫৪ শতাংশ ও প্লাস্টিক বর্জ্য রপ্তানি থেকে আয় কমেছে ২২.৯৭ শতাংশ। পাশাপাশি তামাক, ফুল, ফল, সিমেন্ট, লবন, পাথর, কসমেটিকস, মদ্রিত মালামাল, সুতা ও সুতা দিয়ে তৈরি পণ্য, বিশেষায়িত টেক্সাটাইল পণ্য টেরিটাওয়েল, জাহাজ ও ভবন নির্মানের পণ্য রপ্তানি থেকে আয় কমেছে। তাহলে বোঝা যাচ্ছে, একমাত্র পোশাক শিল্প দেশের রপ্তানী আয়কে ধরে রেখেছে। এর জন্যে শুধু গার্মেন্ট শিল্পের মালিক নয়, পোশাক শ্রমিকদের কৃতিত্ব অনেক বেশী। তাদের এই অবদানের স্বীকৃতি কি দেয়া হচ্ছে? উত্তর হচ্ছে, না। একদিকে যখন আমরা দেখছি অর্থনীতির চাকা এগিয়ে নিচ্ছে পোশাক শিল্পের শ্রমিকরা ঠিক তখন দেখছি পত্রিকার শিরোনাম ’২০ রমজানের মধ্যে বকেয়া বেতন পরিশোধের দাবী” তারা এখনো তাদের বেতন পায়নি । দাবির মধ্যে বলা হচ্ছে, ২০ রমজানের মধ্যে পোশাক শ্রমিকদের বেতন ভাতা ও এক মাসের সমপরিমাণ টাকা বোনাস হিসেবে পরিশোধ করতে হবে। এই দাবিগুলো শ্রমিক সংগঠনগুলো তুলে আনছে। অনেক কারখানায় এখনো জুন মাসের বেতন বকেয়া রয়ে গেছে। কোন কারখানায় তারও আগের দুই মাসের বেতন বকেয়া আছে। চট্টগ্রামে বেশ কিছু কারখানা বন্ধ হয়ে আছে এবং প্রায় ৯ হাজার শ্রমিক বেকার হয়ে গেছে। এর কারণ মালিক পক্ষ অর্ডারের অভাব বলে জানিয়েছে।
এই লেখা যখন লিখছি, তখন ১২ রমজান (জুলাই মাসের ১২ তারিখ) চলছে। শ্রমিকদের দাবি হচ্ছে ২০ রমজানের মধ্যে তাদের বকেয়া পরিশোধ করা এবং ঈদ বোনাস দেয়ার। তাহলে তারা পরিবারের জন্যে কেনাকাটা করতে পারবেন। যে মা তার সন্তানকে গ্রামে নানী-দাদীর কাছে রেখে আসে এবং গার্মেন্টে কাজ করে তার জন্যে তো ঈদের সবচেয়ে বড় আনন্দ হচ্ছে সন্তানের হাতে জামা তুলে দিয়ে তার মূখে হাসি ফোটানো। সময়মতো বেতন-ভাতা পেলে সে কাজটি তাঁরা করতে পারবেন। কিন্তু আজ পর্যন্ত মালিক পক্ষ তো নয়ই, সরকারের পক্ষ থেকেও কোন উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। আর মাত্র এক সপ্তাহ বাকী। বাণিজ্য মন্ত্রী ইওরোপিয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূতের সাথে বৈঠক করে বলেন “ঈদের আগে গার্মেন্ট শ্রমিকদের বেতন-ভাতা পরিশোধ করতে হবে।” ব্যাস হয়ে গেলো (যুগান্তর, ১১ জুলাই, ২০১৪)। এই কথা কি গার্মেন্ট মালিকদের কানে গেছে নাকি শুধু মিডিয়ার মাধ্যমে জনগণ শুনেছে এবং বাণিজ্য মন্ত্রীকে বাহবা দিয়েছে। শ্রমিকরা সময়মতো বেতন-ভাতা ও বোনাস না পেলে দাবী তুলতে গিয়ে অবশ্যই আন্দোলন করবেন। প্রতি বছর তাদের অন্দোলন-সংগাম ছাড়া বেতন ভাতা পাওয়া যায় না। তবে এবার মালিক পক্ষ আগে ভাগেই আন্দোলন যেন না হতে পারে তার ব্যবস্থা করে রাখছেন। তারা গোয়েন্দা সংস্থার বরাতে বলতে শুরু করেছেন বেতন ভাতার দাবি নিয়ে কৃত্রিম অসন্তোষ সৃষ্টি করে আন্দোলনের নামে ভাংচুর আর জ্বালানো-পোড়ানোর চেষ্টা করা হবে (যুগান্তর, ৫ জুলাই, ২০১৪)। ইতিমধ্যে আন্দোলনকারী শ্রমিকদের প্রতি মালিক পক্ষ ও সরকারের বিরূপ মনোভাবের প্রকাশ করা হচ্ছে; পুলিশ ফাঁকা গুলি টিয়ার শেল নিক্ষেপ ও লাঠি চার্জ করছে। বিক্ষোভ মোকাবেলায় পুলিশ জলকামান, রায়ট কন্ট্রোল কারসহ আধুনিক সরঞ্জাম ব্যবহার করছে।এ যেন যুদ্ধ ক্ষেত্র! এতোসব না করে শ্রমিকদের ন্যায্য পাওনা বুঝিয়ে দিলেই তো হয়ে যায়। শ্রমিকেরা তাদের পাওনা বেতন চাইছেন এবং তা যেন ঈদের আগে হয় সেটাই তাদের উৎকন্ঠার বিষয়। আর তো কিছু নয়। এর মধ্যে ষড়যন্ত্র খুঁজতে যাওয়া অজুহাত ছাড়া আর কি হতে পারে? মালিক নিজে দামী কাপড় পরে ঈদ করবে আর শ্রমিক সাধারণ ভাবেও কাপড় কিনতে পারবে না, তাতো হয় না। তারা তো পোশাক শ্রমিক। সারা বিশ্বের মানুষের সৌখিন কাপড় তারাই প্রস্তুত করে দেয় “মেইড ইন বাংলাদেশ” নাম দিয়ে। আর সে শ্রমিক ঈদের আগে বেতন-ভাতা চেয়েছে একটি নতুন পোশাক কিনে নিজের সন্তানের মুখে হাসি ফোটাবার জন্যে। তাও হতে দেবেন না গার্মেন্ট মালিকরা?
এ বছর ১ লা মে, আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, শ্রমিক না খেয়ে মরবে আর মালিক বিলাসিতা করবে—এটি হতে দেয়া হবে না। যে শ্রমিকের ঘামে, উপার্জিত আয়ে মালিকদের বিলাসিতা এনে দেয় সেই শ্রমিকদের সুনজরে আনতে হবে। [বাংলাদেশ প্রতিদিন,অন-লাইন ডেস্ক, ১ মে, ২০১৪]তবে তিনি এও বলেছেন মালিক-শ্রমিকদের সুসম্পর্ক পারে ভালো কাজের পরিবেশ তৈরি করতে।এবং এটাও লক্ষণীয় যে তিনি শ্রমিকের দাবি দাওয়া আদায়ের ক্ষেত্রে যৌক্তিকতার প্রশ্ন তুলেছে্ন এবং যৌক্তিক উপায়ে উত্থাপন করতে শ্রমিকদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। কে ঠিক করবে শ্রমিকের দাবি যৌক্তিক কিনা? মালিক?
ঈদের আগে ২০ রমজানের মধ্যে শ্রমিকদের বেতন-ভাতা ও বোনাসের দাবী কি যৌক্তিক নয়? তাঁরা যখন নিজ নিজ কারখানায় দাবি তুলছে তখন মালিকপক্ষ তাদের কথা শুনছে না, বাধ্য হয়ে যখন তারা রাস্তায় নামছে তখন তাদের পুলিশ ও জলকামান দিয়ে ঠেকানো হচ্ছে।এক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী কেন হস্তক্ষেপ করছেন না? কেন নির্দেশ দিচ্ছেন না যে ২০ রমজানের মধ্যে সব বেতন বকেয়া শোধ করে দিতে হবে? আমরা এখনো আশা করছি তিনি সে কাজটি করবেন।
যে শিল্প এতো বেশী বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন করে আনে সে শিল্পে শান্তি রক্ষার দায়িত্ব কি শুধু শ্রমিকের? শ্রমিকরা বেতন না পেলেও চুপ মেরে বসে থাকবে? তার কি ঈদের আনন্দ বলে কিছু নেই?
পোশাক কারখানায় শ্রমিকের প্রতি অন্যায় অবিচার করা হচ্ছে এবং শ্রমিক অধিকার রক্ষা হচ্ছে না বলে যুক্তরাষ্ট্রে জিএসপি সুবিধা বাংলাদেশ এখনো ফিরে পাচ্ছে না। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের অগ্রাধিকারমূলক বাজার সুবিধা বা জিএসপি সংক্রান্ত কমিটি ইউএস ট্রেড রিপ্রেজেনটিভ (ইউএসটিআর)জানিয়েছে জিএসপি ফিরে পাওয়ার ক্ষেত্রে যে শর্তগুলো ছিল, তার অনেক গুরুত্বপূর্ণ শর্ত বাংলাদেশ পূরণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। বাংলাদেশের শ্রমিক অধিকার ও শ্রমিক নিরাপত্তা উন্নয়নে গৃহীত সার্বিক পদক্ষেপ, সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের গতি ও সরকারের আন্তরিকতা পর্যালোচনা শেষে জিএসপি পুনর্বহাল সংক্রান্ত এই কমিটির পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এ সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছে।(আরটিএনএন,৩ জুলাই, ২০১৪)। ইউএসটিআরের বিবৃতি অনুযায়ী জিএসপি ফিরে পেতে দেওয়া শর্তগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ উন্নতি করলেও শ্রমিকদের অধিকার রক্ষা ও কারখানার কর্মপরিবেশ উন্নয়নে আরও বাস্তব পদক্ষেপ নিলে জিএসপি স্থগিতাদেশ প্রত্যাহারের বিষয় বিবেচনা করবেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা।এবারের সভায় সেটা সন্তোষজনক হয়নি, কাজেই ২০১৪ সালের মধ্যে বাংলাদেশের যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে জিএসপি ফিরে পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।যদি ডিসেম্বরের সভায় সন্তোষজনক অগ্রগতি দেখানো যায় তাহলে ২০১৫ সালে পয়ায়া যেতে পারে।একইভাবে ইওরোপীয় ইউনিয়নও তাদের উৎকন্ঠা জানিয়েছে। এটা খুবই দুঃখজনক হবে যে শ্রমিকের আন্দোলন দমন করতে গিয়ে এবং শ্রমিকদের ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করে বিদেশী বায়ারদের কাছে এক পর্যায়ে কমপ্লায়েন্সের প্রশ্নে জবাব্দিহি করতে বাধ্য হবেন এবং একসময় মালিক পক্ষ শ্রমিকদের পাওনাও বুঝিয়ে দিতে বাধ্য হবেন। কিন্তু সেটা হলে তো আর ঈদের আগে হবে না। শ্রমিকের ঈদের আনন্দ মাটি হয়ে যাবে। গার্মেন্ট কারখানার পুরো বাজারটাই যেহেতু রপ্তানীমূখী সেখানে বিদেশীদের কথা শুনবো না বলার সুযোগ খুব কম। এই বিদেশীদের মধ্যে বায়াররা আছেন এবং আছেন রিটেইল দোকানের ক্রেতারা। বাংলাদেশে গার্মেন্ট শিল্পে ঘটে যাওয়া সকল দুর্ঘটনার কথা তারা জানে।তাজরীনের দাউ দাউ করা আগুন এবং রানা প্লাজা ভবনের নীচে পিষ্ট হওয়া গার্মেন্ট শ্রমিকদের সব কথাই তারা জানে।রানা প্লাজার আহত শ্রমিকরা এখনো মরছে, ধুকে ধুকেভাস্পাতালে পড়ে আছে দীর্ঘ দিন। তাদের ঈদে কে দেখবে? সরকার কি এ বিষয়ে কোন উদ্যোগ নেবে?
শেষে আবারও বলছি, পোশাক তৈরী করে দিচ্ছেন যে শ্রমিক সে কি তার এবং তার প্রিয়জনের পোশাক সময় মতো কিনে ঈদ করতে পারবে তো?