ধোঁয়াবিহীন তামাকজাত দ্রব্যেরও কর বাড়ানো হোক

ফরিদা আখতার || Friday 30 May 2014 || 

জাতীয় বাজেটে জনগণের ব্যবহার্য নিত্যপ্রয়োজনীয় ও বিলাস দ্রব্যের ওপর কর আরোপ করা হলে সে পণ্যের দাম বাড়বে কী বাড়বে না তা নির্ধারিত হয়। আমরা জানি, কর আরোপের সাধারণ উদ্দেশ্য রাজস্ব আয় বৃদ্ধি করা; কিন্তু রাজস্ব বৃদ্ধি করতে গিয়ে জনগণের ওপর যেন চাপ সৃষ্টি না হয় তার দিকেও নজর দিতে হয়। সরকারের দিক থেকে এসব বিষয় লক্ষ্য রাখা অত্যন্ত জরুরি। কর আরোপের মাধ্যমে নিষিদ্ধ নয়; কিন্তু মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর পণ্যের ব্যবহার কমানো ওই বিশেষ কৌশলে একটি বিশেষ পদক্ষেপ হিসেবে নেয়া যেতে পারে।

এমন কিছু পণ্য আছে যা ক্ষতিকর; কিন্তু দামে সস্তা হওয়ার কারণে ব্যবহার কমানো সম্ভব হয় না। সেক্ষেত্রে উচ্চ হারে কর আরোপ করে দাম বাড়িয়ে দেয়া জরুরি পদক্ষেপ হিসেবে স্বীকৃত। অর্থনীতির একেবারে সাধারণ সূত্র ধরে দাম বাড়ালে ব্যবহার কমবে, ক্ষতিকর তামাক পণ্যের ব্যবহার কমানো যেতে পারে। ফলে শুধু রাজস্ব আয় নয়, জনস্বাস্থ্য রক্ষার ব্যবস্থা হিসেবেও উচ্চ হারে কর আরোপের প্রয়োজন হতে পারে। এটা প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ, যা সরকার জনগণের স্বার্থে গ্রহণ করতে পারে।

তামাকজাত দ্রব্য স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর বলে প্রমাণিত এবং এর ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের জন্য দেশে আইন রয়েছে। আইন বাস্তবায়নের বিধিমালাও করা হয়েছে। বিড়ি-সিগারেট অর্থাৎ ধূমপানের জন্য ব্যবহারযোগ্য পণ্যের ওপর কর আরোপ হচ্ছে ঠিকই; কিন্তু দুঃখজনক হচ্ছে এ কর আরোপ এমনভাবে করা হয়, যার কারণে স্বল্প আয়ের মানুষ এবং নতুন ভোক্তাদের ঠেকানো সম্ভব হয় না। অবশ্য সিগারেট কোম্পানিগুলো বাজেটের আগে রাজস্ব বিভাগে এত বেশি যাতায়াত করে যে, তাদের প্রভাব ঠেকানো মুশকিল হয়ে যায়। কিন্তু সরকারের দায়িত্ব জনগণের স্বাস্থ্য সুরক্ষা করা। কাজেই কোম্পানির হিসাব-নিকাশের সঙ্গে তা যুক্ত হওয়া উচিত নয়। সরকার তার দায়িত্ব পালন করবে এটাই কাম্য।

প্রতিবারের মতো এবারও তামাক পণ্যের ওপর কর বাড়াতে বাধা দিচ্ছে তামাক কোম্পানি। প্রজ্ঞার সঙ্কলিত পত্রিকা ও টেলিভিশন প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে, তামাক কোম্পানি খুব সক্রিয়ভাবে রাজস্ব বোর্ডে যাতায়াত করছে এবং কর বাড়ালেও যেন ব্যবহার না কমে তার জন্য হন্যে হয়ে নানা কৌশল অবলম্বন করছে। করছে দেনদরবার। তামাক নিয়ন্ত্রণকারী সংগঠনের দাবি হচ্ছে, দামের সস্ন্যাব তুলে দেয়া। অর্থাৎ বেশি দামের সিগারেট ও কম দামের সিগারেট-বিড়ির ওপর সমান হারে কর বাড়ালে কম দামি সিগারেটের মূল্য এমনভাবে বাড়বে, যাতে নতুন ধূমপায়ী এবং স্বল্প আয়ের ক্রেতাদের ক্রয়ক্ষমতার নাগালের বাইরে যায়। দীর্ঘদিন ধরে তামাকবিরোধী সংস্থাগুলো তামাকের ব্যবহার কমাতে উচ্চ-মধ্য-নিম্নমান বা সস্ন্যাব ব্যবস্থা তুলে গড়ে ৭০ শতাংশ কর বাড়ানোর জোর দাবি জানালেও বাস্তবে ২০০৪ সালে কর না বাড়িয়ে আরও একটি সস্ন্যাব যুক্ত করা হয়েছে। আমরা বারবার বলছি, কর আরোপ করা শুধু রাজস্ব বৃদ্ধির জন্য নয়, জনস্বাস্থ্য রক্ষায় তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবহার কমানোর জন্য করতে হবে। কারণ স্বাস্থ্য খাতে তামাকজনিত রোগের কারণে চিকিৎসা খরচ বাড়ছে। স্বাস্থ্যরক্ষা তামাক কোম্পানির এজেন্ডা নয়, সে চায় তার পণ্য বেশি বিক্রি হবে এবং মুনাফা হবে। তাই তারা কর না বাড়াতে কিংবা কার্যকরভাবে না বাড়াতে দেনদরবার করছে। দুঃখজনক হচ্ছে, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে তামাকজাত পণ্যে কার্যকর হারে কর আরোপে ২০১০ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সহায়তায় এনবিআরে টোব্যাকো ট্যাঙ্ সেল স্থাপন করা হলেও এখন তারা কোনো কথাই বলছে না। তাহলে বোঝা যাচ্ছে, কোম্পানির ধূর্ত কৌশলে এনবিআর ধরা দিচ্ছে। তারা কোম্পানির সঙ্গে গোপন বৈঠক করছে অর্থমন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীর উপস্থিতিতে, অন্যদের সঙ্গে করছে প্রকাশ্যে। ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশনের ১৯ মে প্রচারিত একটি সংবাদ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এবারও তামাক পণ্যে সস্ন্যাব তুলে দেয়া হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন অর্থ প্রতিমন্ত্রী। তারা বলছে, জনস্বাস্থ্যকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে জনগণকে তামাক থেকে দূরে রাখতে কর কিছুটা বাড়ানো হবে। কর আরোপের মাধ্যমে কার্যকরভাবে তামাক ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে জনস্বাস্থ্যকে গুরুত্ব দেয়া হলো কোথায়?

তামাকজাত পণ্যের মধ্যে ধোঁয়াবিহীন তামাক পণ্য যেমন জর্দা, সাদা পাতা, গুল ইত্যাদি কর আরোপের আওতায় এনে দাম বাড়িয়ে ব্যবহার কমানোর দাবি তুলেছে তামাকবিরোধী নারী জোট (তাবিনাজ)।

আমরা জানি, বাংলাদেশে ৪৩ শতাংশ (৪ কোটি ১৩ লাখ) প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ কোনো না কোনোভাবে তামাক সেবন করেন। আমরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ধূমপান নিয়ন্ত্রণের কথা বলি। ধূমপান পুরুষদের মধ্যেই বেশি, নারীদের মধ্যে কম; কিন্তু নারীরা ধূমপানের শিকার হন পরোক্ষভাবে। ঘরে স্বামী, বাবা, ভাই বা যে কোনো পুরুষ আত্মীয় ধূমপান করলে নারীরা এর ক্ষতি থেকে খুব রেহাই পান না। কর্মক্ষেত্রে সহকর্মী এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সহপাঠীদের ধূমপানের শিকার হয় নারী। কাজেই সিগারেট-বিড়িতে করারোপ করে ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ হলে নারীদের স্বাস্থ্যও রক্ষা হবে। তার সঙ্গে রক্ষা পাবে শিশুরাও। সরকার কি এ বিষয়টিকেও আমলে নেবে না? এটা কি তাদের দেখার বিষয় নয়?

পাশাপাশি ধোঁয়াবিহীন তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার পুরুষ ও নারী উভয়ের মধ্যে থাকলেও নারীদের মধ্যে বেশি; ২৮ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক নারী এবং ২৬ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ ধোঁয়াবিহীন তামাক সেবন করেন (গ্লোবাল এডাল্ট টোব্যাকো সার্ভে ২০০৯)। বাংলাদেশে ধোঁয়াবিহীন তামাকপণ্যগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে জর্দা, গুল, সাদাপাতা ইত্যাদি। যদিও এসব ক্ষতিকর তামাক পণ্য নিয়ন্ত্রণ করা অত্যন্ত জরুরি, ধোঁয়াবিহীন তামাক সম্পর্কিত তথ্যের ঘাটতি এক্ষেত্রে একটি বড় বাধা। কর আরোপের প্রশ্নে এ পণ্য সম্পর্কে তেমন আলাপ-আলোচনা হয় না।

তামাকবিরোধী নারী জোটের (তাবিনাজ) সদস্যরা দেশের ৩৫টি জেলায় একটি অনুসন্ধান চালিয়ে ১৩০টি বিভিন্ন নামের জর্দা এবং ১২টি গুলের সন্ধান পেয়েছে। সব জেলায় কারখানা নেই; কিন্তু ব্যবহার সবখানেই আছে। দেশের ৩৫টি জেলায় ১৪১টি কারখানায় জর্দা ও গুল উৎপাদিত হয়। আরও কিছু জেলায় কারখানা থাকতে পারে। সেটাও দেখা হচ্ছে। ৩৫ জেলায় ১২০টি জর্দা কারাখানা এবং ২১টি গুল কারখানা পাওয়া গেছে। যদিও ধোঁয়াবিহীন তামাকপণ্য ব্যবহার সামাজিকভাবে স্বীকৃত এবং প্রকাশ্যেই পানের সঙ্গে জর্দা খাওয়ার রেওয়াজ আছে; কিন্তু কোনো বিশেষ কারণে জর্দা ও গুল উৎপাদনকারী ফ্যাক্টরিগুলো অনেকটা গোপনেই তা উৎপাদন করে। জর্দা-গুল ফ্যাক্টরিতে গিয়ে সাইনবোর্ড বা কোনো ধরনের নামফলক না থাকায় বেশিরভাগ কারখানাকে চিহ্নিত করা কঠিন হয়ে পড়েছিল। এ সাইনবোর্ড না দেয়া কি বেআইনি নয়? এর সঙ্গে কর ফাঁকি দেয়ার কোনো সম্পর্ক আছে কিনা তা এনবিআরের খতিয়ে দেখা উচিত। এসব কারখানায় যেসব শ্রমিক কাজ করে তার মধ্যে নারী ও শিশুই বেশি এবং তারাও কোনো তথ্য দিতে ভয় পায়। তারা খুব গরিব, ফ্যাক্টরির কাজের পরিবেশ খুবই অস্বাস্থ্যকর। কাজ করতে গিয়ে তামাকের গুঁড়া নাকে ঢুকে স্বাস্থ্যের জন্য হুমকি সৃষ্টি করছে। এদের নিয়মিতভাবে দীর্ঘমেয়াদে কাজে রাখাও যায় না। কারণ ছয় মাস কাজ করেই তারা অসুস্থ হয়ে পড়ে। এসব বিষয় পর্যবেক্ষণের জন্য শ্রম বিভাগ বা সংশ্লিষ্ট সরকারের বিভাগ থেকে কোনো উদ্যোগ দেখিনি। বেশিরভাগ কারখানাই পরিচালিত হয় কর্তৃপক্ষের কোনো ধরনের তদারকি বা নজরদারির বাইরে।

বেশিরভাগ জর্দা ও গুল প্লাস্টিক বা টিনের কৌটায় পাওয়া যায়। আবার কিছু পলিথিন বা কাগজের প্যাকেটেও পাওয়া যায়। জর্দার কৌটা বা প্যাকেটের আকার ১০ থেকে ৫০ গ্রাম পর্যন্ত আর এর দাম সর্বনিম্ন ৫ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৪৫ টাকা। গুলের সর্বনিম্ন দাম মাত্র ২ টাকা। খুব গরিব হলেও হাতে টাকা থাকলেই এ খরচ তারা করে ফেলে। কারণ তামাক সেবন করতে গিয়ে তারা কিছুটা নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। পানের সঙ্গে জর্দা ব্যবহারকারী কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা দিনে প্রায় ২০ থেকে ৫০ টাকা দোকান থেকে পান-জর্দা কিনতে খরচ করে। তাহলে মাসে প্রায় ৬০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা শুধু এ ক্ষতিকর পণ্যের জন্য খরচ হয়ে যায়। এর বিনিময়ে পরিবারে ১৪ থেকে ৩৫ কেজি চাল কেনা যেত, যা পরিবারের সবার ক্ষুধা মেটানোর জন্য কাজে লাগত। তাছাড়া এ পণ্য সেবনের কারণে যেসব অসুখ হচ্ছে তার চিকিৎসা বা ওষুধ কিনতে খরচ হয়ে যাচ্ছে আয়ের আরও একটি বড় অংশ। অজান্তেই পুরো একটি পরিবার একটিমাত্র পণ্যের ব্যবহারে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

জর্দা-গুলের খুচরা মূল্য বাড়ে এমনভাবে কর বাড়াতে হবে। উৎপাদনের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করার জন্য প্রয়োজনীয় আর্থিক ও আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে।

বাজেটের আগে এটাই আমাদের শেষ সুযোগ, কর আরোপের মাধ্যমে তামাক নিয়ন্ত্রণের যে কৌশল তা কাজে লাগানো। সাধারণ স্বল্প আয়ের মানুষকে তামাক পণ্য ব্যবহার থেকে দূরে সরাতে হলে কর বৃদ্ধি করে তামাক পণ্য ক্রয়ক্ষমতার বাইরে আনার চেষ্টা করে যেতেই হবে। সস্তা ও সহজলভ্য করে দিয়ে হাজার সচেতনতা সৃষ্টি করেও লাভ হবে না, কারণ চাইলেই কেনা যায় এমন পণ্য থেকে দূরে সরানো কঠিন। রিকশাওয়ালা, গৃহকাজে নিয়োজিত শ্রমিক, কারখানা ও নির্মাণ কাজের শ্রমিক এবং গ্রামীণ বিশাল একটি জনগোষ্ঠী না জেনেই নিজেদের স্বাস্থ্যের ক্ষতি করছেন। দোকানে গিয়ে পাঁচ টাকা দিয়ে একটি পান-জর্দা খাওয়া যায়, এ খরচ খুব একটা চোখে পড়ে না। গায়েও লাগে না।

এতদিন দাবি করা হয়েছে বিড়ি-সিগারেটের ওপর কর বৃদ্ধির জন্য, এবার তার সঙ্গে যোগ হচ্ছে জর্দা-গুল। উল্লেখ করা দরকার, এগুলো নিয়ন্ত্রণ করার বিষয়টি এখন সংশোধিত আইনের মধ্যে আছে। কাজেই ধোঁয়াবিহীন তামাকজাত দ্রব্যে করারোপ তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন বাস্তবায়নেও সহায়ক হবে। সরকার নিশ্চয়ই সেদিকটিও বিবেচনা করবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *