ফরিদা আখতার || Monday 24 March 2014
বাইশে মার্চ পালিত হোল বিশ্ব পানি দিবস। জাতি সংঘের সংস্থা ইউনিসেফ-এর বরাতে বলা হোল ‘সারা বিশ্বে নিরাপদ পানি সংক্রান্ত সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি) অর্জনের প্রায় চার বছর পর এবং জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ‘পানি পাওয়ার সুযোগ একটি মানবাধিকার’ বলে ঘোষণার পরও ৭৫ কোটিরও বেশী মানুষ পানির চাহিদা মেটানো থেকে বঞ্চিত রয়ে গেছে। বাংলাদেশে এই বঞ্চিতদের সংখ্যা ২ কোটি ৬০ লাখ মানুষ। ১৯৯৩ সালে বিশ্ব পানি দিবস ঘোষণার পর থেকে এই দিবসের একটি প্রতিপাদ্য থাকে; এবারেরটা ছিল পানি ও জ্বালানী সংকট, যা একে অপরের সাথে জড়িত, কিন্তু বাংলাদেশে সুপেয় পানি, নদী-দুষণ ইত্যাদি গুরুত্ব পেয়েছে বেশী।
আমি পানি দিবস নিয়ে লিখছি না, তবে পানি নিয়ে বলার অনেক কিছু আছে। বিশেষত পানি নিয়ে অন্যায় অবিচার যা চলছে তা বলতে হবে। আসলে আমরা দায়িত্বহীনভাবে পানি দুষণ করতে দেখেও চুপ থেকেছি, সমাজের একটি বিশাল জনগোষ্ঠি প্রতিনিয়ত পানির জন্যে যে কষ্ট পাচ্ছে তার কোন ব্যবস্থাই কোন সরকার নেয় নাই। সমাজে আমরা রাজনৈতিক আলোচনায় যে উজিরনাজির মারি সেখানে পানির মতো অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের কোন স্থান নাই। রাজনৈতিক আলোচনায় এই দিকগুলো উল্লেখ না করেও ক্ষমতায় থাকা ও ক্ষমতায় থাকা সম্ভব।
আজ (২৩ মার্চ) নিউ এজ পত্রিকার একটি খবর: বাংলাদেশ পানি সরবরাহের জন্য ৮১% বাজেট খরচ করে শুধু ঢাকায় (তাও একান্তই ধনীদের এলাকায়)। প্রায় ১৫ কোটি ডলারের প্রকল্প নেয়া হয়েছে শুধু গুলশান, বনানী, বারিধারা, ধানমন্ডি, মিরপুর এবং বাড্ডায় নিয়মিত পানি সরবরাহের জন্য, যদিও পানির বিল সারা শহরের মানুষের জন্য একই রাখা হয়েছে। পুরান ঢাকার চিত্র হচ্ছে কলস ও বালতির দীর্ঘ সারিতে দাঁড়িয়ে থাকা। চৈত্র-বৈশাখ মাসে এই ছবি দেখার জন্যে তৈরি থাকুন। পত্রিকার প্রথম পাতায় ছাপা হবে। আফসোস করবেন, কিন্তু কাজ হবে না। চট্টগ্রামে এক এক এলাকায় এক এক সময় পানি সরবরাহ কম-বেশী করে চালিয়ে দেয়া হচ্ছে।
পানির চেয়ে বড় রাজনীতি এখন আর কিছু নেই। ভারতের সাথে সম্পর্কের টানাপড়েনের প্রধানদিক হচ্ছে ফারাক্কা, তিস্তার পানি থেকে বাংলাদেশের মানুষকে বঞ্চিত করা, ইত্যাদি। তারা উজানে আছে বলে যখন ইচ্ছা পানি ছেড়ে আমাদের ভাসিয়ে দেয় কিংবা যখন আমাদের দরকার হয় নদি থেকে পানি সরিয়ে নেয়, আমামদের তখন শুকিয়ে মারে। মমতা ব্যানার্জী পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের ভোট চান, অথচ প্রতিবেশী রাষ্ট্রে তিস্তার পানি তাঁর ইচ্ছা বা মর্জির ওপর নির্ভরশীল, এটা এক বড় ধরণের স্ব-বিরোধিতা। তাঁর ইচ্ছা নেই বলে স্বয়ং মনমোহন সিংও পানি দিতে পারছেন না। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে পানি কেন্দ্র করে সংঘর্ষ বাড়তে পারে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ এবং তারই সাথে চীন মিলে তিনটি বড় নদী আমরা ভোগ করি, গঙ্গা, সিন্ধু ও ব্রহ্মপুত্র। উজানে থেকে যেমন বাংলাদেশ ও পাকিস্তানকে পানিতে কষ্ট দিচ্ছে ভারত, তেমনি চীনও উজানের সুযোগ নিচ্ছে ভারতের বিরুদ্ধে। নদীতে উজান-ভাটির সম্পর্কের সৌন্দর্য নষ্ট করছে ক্ষমতার রাজনীতি। টিপাইমুখ বাঁধ দেয়ার সময় বাংলাদেশে অনেক প্রতিবাদ হয়েছে, কিন্তু আমাদের সরকারের নমনীয় নীতির কারণে আমাদের ভবিষ্যত পানি শূন্য হবার দশা হয়েছে। সকলকে কষ্টে থাকতে হবে। মরতে হবে গরিব মানুষকে। তবে শুধু দক্ষিণ এশিয়া নয়, বিশ্বের প্রায় সব দেশেই পানি কেন্দ্রিক ক্ষমতাবান ও ক্ষমতাহীন রাষ্ট্রের যুদ্ধ চলবে, এই ভবিষ্যতবাণী সবাই করছে। কারণ যতো আধুনিক শহর হবে, কৃষি হবে সেচ নির্ভর এবং জ্বালানির জন্যে হাইড্রো-ইলেকট্রিসিটির ওপর বিভিন্ন দেশ নির্ভরশীল হবে ততই এই সংঘাত তীব্র হবে।
কৃষি উৎপাদন বাড়ছে বলে দাবী করছি কিন্তু আধুনিক সেচ নির্ভর কৃষি পানি কেড়ে নিচ্ছে অন্য সকলের জীবন ও জীবিকা। মিষ্টিপানির ৭০% ব্যবহার হয় কৃষিতে সেচের জন্যে, ১০% গৃহস্থালী কাজ ও বাকী ২০% অন্য সকল ধরণের জীবিকার জন্যে। এটা কি অন্যায় নয়?
শহরের ধনী মানুষ পানির শাওয়ার ছেড়ে ইচ্ছে মতো গোসল করে, কিংবা বাথ-টাবে শুয়ে থাকে। এ সবই পানির নানা রকম ব্যবহার। একই বাথরুমে কত রকম ব্যবস্থা, বড় লোকের মতিগতি বলে কথা! অথচ আফ্রিকা এবং এশিয়ার মেয়েরা (যাদের বয়স ১৫ বছরে কম) গড়ে ৩.৭ মেইল হেঁটে যায় এক বা দুই বালতি পানি আনার জন্যে। সব ধনী দেশ মিলে ১ কোটি মানুষ সুপেয় পানির অভাবে আছে, অথচ শুধু আফ্রিকাতেই ৩৪.৫ কোটি মানুষের জন্যে সুপেয় পানির কোন ব্যবস্থাই নেই।
এখন আবার নতুন যন্ত্রণা শুরু হয়েছে বোতলের পানি নিয়ে। একসময় বলা হয়েছিল গ্রামে গেলে টিউবওয়েলের পানি খেতে হবে, নইলে ডাইরিয়া হয়ে মরে যাবে। এখন বলা হচ্ছে, টিউব ওয়েলে আর্সেনিক আছে, কাজেই বোতলের পানি খেতে হবে। ওয়াসার পানিও নিরাপদ নয়। বোতলের পানি আসলে বাণিজ্যকভাবেই উৎপাদিত ও বাজারজাত করা হয়। সবাই এতোটাই বিশ্বাস করা শুরু করলেন যে কোথাও যেতে হলে আগে বোতলের পানি কিনতে হবে, সেমিনার মিটিং করলে সবার সামনে একটি করে পানির বোতল থাকতে হবে। নইলে মিটিং থেকে বের হয়েই তার ডাইরিয়া হয়ে যাবে! কিন্তু এখন গবেষণায় দেখা যাচ্ছে বোতলের পানি কিনতে গিয়ে পরিবারের খরচের ওপর বাড়তি চাপ পড়ছে। যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্ণিয়ায় ২০১১ সালে দেখা গেছে ট্যাপের পানি দুষিত বলে বোতলের পানি কেনা বাবদ খরচের ওপর তিন গুন বেশী চাপ পড়েছে। অনেক গরিব পরিবার বাধ্য হয়ে ট্যাপের পানিই খেয়েছে। অসুস্থ হলেও তার উপায় নেই। অন্য একটি গবেষণায় বলা হয়েছে ট্যাপের পানি দুষিত না হলেও অনেকেই বিশ্বাস করেন বোতলের পানি বেশী ‘নিরাপদ’, কাজেই প্রায় দুই গুণ টাকা খরচ করেছেন আফ্রিকান-আমেরিকান এবং ল্যাটিনোরা। এরা সবাই ধনী নয়, তবুও বোতলের পানিই খাবে। এর ফলে তাদের অন্যান্য প্রয়োজনীয় খরচ বাদ দিতে হয়েছে। এমনকি অসুখ হলে চিকিৎসার খরচও করতে পারেনি।
সবচেয়ে চমকপ্রদ তথ্য হচ্ছে ধনী এবং উন্নয়নশীল দেশে এখন ক্রমে বোতলের পানির ব্যবহার কমে আসছে। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও ইওরোপে, কিন্তু বোতলের পানির বাজার বেড়ে যাচ্ছে দরিদ্র দেশগুলোতে। অতি দ্রুত। তার কারণ এখানে নদীর পানি দুষিত হচ্ছে, ট্যাপের পানিও নিরাপদ নয় বলে অনেকের ধারণা এবং বোতলের পানির কোম্পানি মজায় ব্যবসা জমিয়ে তুলেছে। গরিব দেশে প্রথমে বোতলের পানি খেতে শুরু করে এখানকার ধনীরা, পরে তাদের ফেলে দেয়া বোতলে গরিব মানুষ পানি নিয়ে খায়, এবং একসময় তারাও বোতলের পানিতে অভ্যস্ত হয়ে যায়। বোতলের পানির জন্যে যে প্লাস্টিকের বোতল ব্যবহার তা ভয়ানক পরিবেশ দুষণের কারণ হয়ে উঠছে।
এটা কেউ বলছে না, নিরাপদ পানি পেতে হলে পানি সরবরাহের উৎস নিরাপদ করতে হবে, শহরে ট্যাপের পানি, গ্রামে পুকুর খাল, নদী, টিউবচওয়েলকেই নিরাপদ করতে হবে। এর কোন বিকল্প নেই। পানি দিয়ে ধনী গরিব বৈষম্য তৈরি করা ঘোরতর মানবাধিকার লংঘন। পানি পাওয়া মানবাধিকার। সকলের। পানি যদি জীবন হ্য় তাহলে সেটা সবার জন্যে সমান হতে হবে।