ফরিদা আখতার || Saturday 08 March 2014
সমাজে নারীর প্রতি বৈষম্য, শোষণ, নির্যাতন সব কিছুই যেন নারীকে যুগ যুগ ধরে বেঁধে রেখেছে, নারী সেসব শৃংখল ভেঙে এগিয়ে যাওয়ার জন্য সংগ্রাম করে যাচ্ছে। এখনও, এই ২০১৪ সালেও। এবার আন্তর্জাতিক নারী দিবসের বক্তব্য Inspiring Changes- পরিবর্তনের অনুপ্রেরণা। তাহলে পরিবর্তন কিছু নিশ্চয়ই আসছে এবং এর পেছনে রয়েছে অনেকের অবদান। নারীদেরই অবদান। আন্তর্জাতিক নারী দিবসকে স্বাগত জানিয়ে আজকের লেখাটি লিখছি আমাদের তরুণ প্রজন্মের প্রতি অনুপ্রেরণা জোগানোর জন্য। তবে আজকের লেখায় আমি কিছু আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট বেশি ব্যবহার করব আমাদের নিজেদের অবস্থা বোঝার জন্য।
পরিবর্তনের ক্ষেত্রে একটি বড় ধরনের আন্দোলন ছিল নারী ও পুরুষের মধ্যে সমতা অর্জন। এটা একদিকে প্রয়োজন ছিল এ কারণে যে, পুরুষতন্ত্র যখন প্রমাণ করতে ব্যস্ত থাকে, শারীরিকভাবে ভিন্ন হলে ভিন্ন শ্রম বিভাজন হয়, এমনকি মস্তিষ্কের ক্ষমতাও ভিন্ন হয়ে যায় এবং তাই তাকে কম মজুরি দিলে চলে, দিতে হয় কম মর্যাদা; তখন প্রমাণের প্রয়োজন হয়ে যায়- যেসব কাজ পুরুষ করে, একই কাজ নারীও করতে পারে। সে কাজ ভালো হতে পারে, খারাপও হতে পারে। ইরাক যুদ্ধে মার্কিন সৈন্যদের মধ্যে নারীদের দেখে আমি নারীর সমধিকার অর্জিত হয়েছে মনে করতে পারিনি, ভেবেছি তাদের নির্মমতার কথা। তারাও পুরুষ সৈন্যদের পাশাপাশি নির্যাতন চালিয়েছে, নিরীহ নারী-পুরুষ-শিশুকে হত্যা করেছে। সেদিক বিচার করে সমধিকার অর্জনের কাজ কি থেমে থাকবে? আমরা কি নির্ধারণ করে দেব নারী হিসেবে কোন কাজে পুরুষের সমপর্যায়ে যাব আর কোনটাতে যাব না? সেটা করা যাবে না। তাহলে পথ রুদ্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু এটাও সত্য, পুরুষতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যে থেকে যদি সমতা অর্জন করা হয়, তাহলে সেটা ‘অন্যায্য’ অবস্থায় সমতায় যাওয়া নারীকে নির্যাতিত হতে হয় নীরবে। ইরাক যুদ্ধে যাওয়া মার্কিন নারী সৈন্যরা তাদেরই সহকর্মী পুরুষ সৈন্য দ্বারা ধর্ষিত হয়েছে ব্যাপকভাবে। সেসব তথ্য চাপিয়ে রাখলেও বের হয়ে যাচ্ছে। এমন কঠিন উদাহরণ থাকা সত্ত্বেও এটা মানতে হবে, অনেক কঠিন কাজ করে নারীরা দেখিয়েছেন তারা পুরুষের চেয়ে কম নন।
সমধিকারের জন্য উচ্চ শিখরে ওঠা নারীদের জন্য খুব কঠিন কিছু নয়। আসলে পুরুষদের দিন শেষ। পুরুষতান্ত্রিক চেতনা নিয়ে বেশিদিন রাজত্ব করা যায় না। মানুষ হিসেবে নারী ও পুরুষ উভয়কেই আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন। সুযোগ পেলে যে কেউ এগিয়ে যেতে পারবে। এর জন্য বর্তমান সময়ে দেশ পরিচালনার দায়িত্বে হাসিনা-খালেদাকে দেখিয়ে বিচার করার কিছু নেই। সামাজিক-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক অবস্থা এমন জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে যে পুরুষ ক্ষমতায় আছেন নাকি নারী আছেন, আমরা আন্দোলন কর্মীরা বুঝতে পারছি না। আমরা বাংলাদেশে প্রথম নারী স্পিকার, প্রথম নারী ভিসি দেখে খুব আলোচনা করি, কিন্তু এ পদে আসার প্রক্রিয়াটা সমতার মাপকাঠি দিয়ে বিচার করা হয়েছিল কি-না জানি না। মনে হয় না। তবুও আমি তাদের অভিনন্দন জানাই, কারণ তারা এসব পদ আর নারীশূন্য রাখেননি।
এবার দেখা যাক আন্তর্জাতিকভাবে নারীদের অনুপ্রেরণা কোন দিক থেকে আসছে। পুঁজিতান্ত্রিক সমাজে নারীদের মধ্যে কে কত বেশি ধন সম্পদের মালিক হতে পেরেছেন, তা নারী-পুরুষের সমতা বিচারের একটি মানদণ্ড হিসেবে বিবেচিত হয়। এটাও একটা দেখার বিষয় হতে পারে। মার্কিন ফোর্বস ম্যাগাজিন সেই সফল নারীদের খোঁজ নিয়ে থাকে এবং প্রতিবছর সেই নারীদের একটি তালিকা করার মতো নাম পেয়েও যায়। এর মধ্যে একজনের নাম বাংলাদেশে অনেকের জানা, তিনি হচ্ছেন মেলিন্ডা গেটস (Melinda Gates)। তিনি ও তার স্বামী বিল গেটস (যিনি বারবার পৃথিবীর ধনীর শীর্ষ তালিকায় থাকছেন) বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন করে ৬৫০ মিলিয়ন ডলার দিয়ে শিক্ষা কর্মসূচি চালিয়েছেন। এটা অবশ্যই ভালো কাজ। এটা তার পাহাড় সমান ধনের একটি কণা মাত্র। তার সঙ্গে এটাও বলা দরকার যে, এ ফাউন্ডেশন আরও অনেক কাজ করছে, যার সবটাই উন্নয়নশীল দেশের জন্য ভালো কি-না তা পর্যালোচনা করে দেখতে হবে। বিশেষ করে তারা এখন প্রযুক্তিনির্ভর কৃষি উন্নয়নের দিকে নজর দিয়েছেন, যা খুব সতর্কভাবে মূল্যায়ন করতে হবে। মেলিন্ডা যদি সত্যিই বাংলাদেশ নারীদের পক্ষে দাঁড়াতে চান, তাহলে কৃষিতে নারীদের জ্ঞান ও দক্ষতার ওপর বাইরে থেকে চাপিয়ে দেয়া প্রযুক্তি দিয়ে হবে না। এটা তাকে বোঝাতে হবে। বাংলাদেশে মেলিন্ডা খুব জোরালোভাবেই আছেন। এতদিন কৃষিতে ফোর্ড ও রকেফেলারের কর্তৃত্ব ছিল, এখন তা বদলাচ্ছে। মেলিন্ডা চলে আসছেন প্রযুক্তি নিয়ে।
এরপর আরেকটি নাম সামনে এসেছে। তিনি ওপরা গেইল উইনফ্রে (Oprah Gail Winfrey) আমেরিকার মিডিয়া Harpo Productions-এর মালিক, টকশো সঞ্চালক, অভিনেত্রী, প্রযোজক এবং সর্বোপরি তিনি একজন জনহিতৈষী ব্যক্তি। তিনি ২০০৯ থেকে ২০১০-এর মধ্যে প্রায় ৩১৫ মিলিয়ন ডলার আয় করেছেন এবং আরও অনেক সেলিব্রিটিকে তুলে এনেছেন। কাজেই তার কাজের উন্নতি হলে অন্যেরও উন্নতি হবে এমন আশা করা যায়। উইনফ্রের উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে ছিল Leadership Academy for Girls (যদিও ২০০৭ সালে শুরু করার সময় তা যথেষ্ট বিতর্কিত ছিল)। তিনি দক্ষিণ আফ্রিকায় ৪০ মিলিয়ন ডলার খরচ করে এমন একটি কাঠামো বানিয়ে দিয়েছিলেন, যা গরিব-দুঃখী মেয়েদের শিক্ষার জন্য অবদান রেখেছিল।
মারিয়া শ্রিভার (Maria Shriver) একাধারে সাংবাদিক ও অ্যাক্টিভিস্ট, অরেকজন অগ্রযাত্রার অনুপ্রেরণার নাম। তিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন। সেটা হচ্ছে বার্ষিক শ্রিভার রিপোর্ট, যেখানে তিনি কর্মজীবী মা ও তাদের শিশুদের অবস্থা নিয়ে লিখেছেন। এ প্রতিবেদনের মাধ্যমে তিনি দেখাতে পেরেছেন আমাদের মা, নানি-দাদি তথা নারীরা তাদের জীবনে যা অর্জন করতে চান বা যা হতে চান, তা করতে পারবেন।
বিবিসি গত বছর (২০১৩) সারা বিশ্বের প্রায় ১০০ নারীকে হাজির করেছিল, যারা নানাভাবে জীবনে অবদান রেখেছেন। এর মধ্যে বাংলাদেশ থেকেও ব্যবসায়ী নারী অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। শুধু পার্থক্য এই যে, বাংলাদেশের গ্রামেগঞ্জের যেসব নারী নিজের সীমিত সামর্থ্যরে মধ্যে থেকে আরও নারীর জন্য কাজ করে যাচ্ছেন, তাদের খবর বিশ্বের কেউ রাখছেন না। আমাদের দেশের ধনী নারীর সংখ্যাও কম নয়। এদের মধ্যে কয়েকজন অবশ্যই জনহিতকর কাজও করছেন। আমি নিজে আমার দু’-একজন বন্ধুর মধ্যে সেই আকুতিও দেখি। কিন্তু আবার অনেককে দেখি এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ উদাসীন। যারা জনহিতকর কাজ করছেন, তাদের তালিকা হলে মন্দ হয় না। আমি আন্তর্জাতিক নারী দিবসে তাদের সেই প্রেরণার উৎস হওয়ার আহ্বান জানাব।
এত অনুপ্রেরণার পরও বিশ্বের নারীর অগ্রগতির পাশাপাশি নির্যাতনের যে ঘটনা ঘটছে, তা না লিখে উপায় নেই। প্রথমেই আন্তর্জাতিক চিত্র তুলে ধরছি। ইউরোপীয় ইউনিয়ন সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় দেখিয়েছে, প্রতি তিনজনের মধ্যে একজন নারী ১৫ বছর বয়সের পর থেকে কোনো না কোনো ধরনের যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। এ সমীক্ষাটি করেছে European Union Agency for Fundamental Rights (FRA)। তারা ২৮টি ইউ সদস্য রাষ্ট্রের প্রায় ৪২ হাজার নারীর তথ্য নিয়েছে। এ পর্যন্ত করা সমীক্ষার মধ্যে এটাই সবচেয়ে বড়। নারীরা জানিয়েছেন, ৮ শতাংশ নারী নানাভাবে নির্যাতিত হয়, প্রতি ২০ জন নারীর মধ্যে একজন ধর্ষণের শিকার হয়। নির্যাতনের মধ্যে রয়েছে শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতন, পারিবারিক (একেবারে ঘনিষ্ঠজনের দ্বারা নির্যাতন), উত্ত্যক্ত করা এবং বিশেষ করে নতুন প্রযুক্তির কারণে হয়রানি। শতকরা হিসাবে ১০ শতাংশ নারী উত্ত্যক্ততার শিকার, ১০ শতাংশ নারী ১৫ বছর বয়সের আগেই কোনো বয়স্ক পুরুষের দ্বারা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। সবচেয়ে উদ্বেগজনক, ২২ শতাংশ নারী তাদের বর্তমান কিংবা সাবেক পার্টনারের দ্বারা নির্যাতিত হয়েছেন। অর্থাৎ ঘরের ভেতরেই নির্যাতন।
বাংলাদেশেও নারী নির্যাতনের মাত্রা মোটেও কমেনি, বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে বেড়েছে। শতকরা ৮০ ভাগ নারীই নির্যাতনের শিকার। অথচ এদেশ চলে নারী প্রধানমন্ত্রী দ্বারা। অনেক উচ্চাসনে নারী রয়েছেন। জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত আসনে নারীদের পুতুল বানিয়ে রাখার কাজটিও হয়ে গেছে। সবাই সরাসরি নির্বাচনে আসতে পারছেন না। দেশে রাজনৈতিক পরিস্থিতি নারী নির্যাতন বাড়িয়ে দিচ্ছে। রাজনৈতিক বক্তব্যে নারীর প্রতি অবমাননাকর ভাষা ব্যবহার হচ্ছে অহরহ। গুম, হত্যা, গ্রেফতার পুরুষদের ক্ষেত্রে হলেও অশান্তি হচ্ছে নারীদেরই। পত্রিকায় ছবিতে তাদের কান্নার শব্দ পাওয়া যায় না, কিন্তু টেলিভিশনে খবর দেখলে আমি নিজেও কাঁদি, অসহায় বোধ করি। এ নারীরা কারও সাহায্য পায় না, তারা মানবাধিকার লংঘনের পরোক্ষ শিকার, তারা সাক্ষী, তারা নিজে কোনো সাহায্যের দাবিদার নন।
কৃষিতে নারীর অবদান যেন সবাই ভুলতে বসেছে। তাই কৃষিতে এমন প্রযুক্তি আনা হচ্ছে, বিশেষ করে বায়োটেকনোলজি, যার মাধ্যমে কৃষক নারী হারাবে তার হাজার বছরের সঞ্চিত বীজ রক্ষার জ্ঞান ও দক্ষতা। জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং করে বিটবেগুন আজ তাই নারী আন্দোলনের বিষয় হওয়ার দরকার। এরই মধ্যে সেই আন্দোলন বাংলাদেশে শুরু হয়েছে।
শেষ করার আগে গার্মেন্ট শ্রমিকদের কথা বলব। আন্তর্জাতিক নারী দিবস যাদের আন্দোলনের কারণে ক্লারা জেৎকিন ১৯১০ সালে ঘোষণা দিয়েছিলেন, সেই গার্মেন্ট শ্রমিকরা কি ভালো আছে? তারা কি ন্যায্য মজুরি পাচ্ছে? তাদের আন্দোলনকে দমানোর জন্য পুলিশ বেধড়ক লাঠিপেটা করছে। তারা আগুনে পুড়ে মরছে, ভবন চাপায় পিষ্ট হচ্ছে। যারা বেঁচে যাচ্ছে, সেই বাঁচাকে মানুষের মতো বাঁচা বলে না। দুর্বিষহ জীবন কাটছে তাদের। যারা নিজে সংসার চালাত, সবার অন্ন জোগাত- তারা এখন সংসারের বোঝা। তাই বলে গার্মেন্টের নারী শ্রমিকরা কাজ থামিয়ে বসে নেই। প্রতিদিন সকালে রঙিন ছিটের জামা পরা মিছিলের মতো করে মেয়েদের হন হন করে গার্মেন্ট কারখানার দিকে যেতে দেখলে একবারও কি মনে হয় এদের মনে আগুন কিংবা ভবন ধসের ভয় আছে? কী অদ্ভুত সাহসী এ মেয়েরা! সালাম জানাই তাদের। আর ধিক্কার দেই যারা আজও তাদের ন্যায্য পাওনা দিতে গড়িমসি করছে, তাদের শোষণ করে নিজের বিত্তের পাহাড় গড়ছে, তাদের।
তবে হ্যাঁ, গার্মেন্ট শ্রমিকদের ওপর শোষণ বিশ্বের কাছে আর গ্রহণযোগ্য নয়। বিশ্ববাজার পেতে হলে শ্রমিকের অধিকারের স্বীকৃতি লাগবে।
গার্মেন্ট শ্রমিকরাই হোক নারীর অগ্রযাত্রার অনুপ্রেরণার উৎস। আমাদের এ গরিব মেয়েরাই দেশের জন্য ধন এনে দিচ্ছে।
আমরা চাই নারীদের জন্য শান্তিপূর্ণ ও মর্যাদাপূর্ণ জীবন ও তার অগ্রযাত্রা।