ফরিদা আখতার || Thursday 20 February 2014
বহুবার লিখেছি, নারী সংগঠনের পক্ষ থেকে আমরা আন্দোলন করেছি একটি দাবি নিয়ে। সেটা হচ্ছে জাতীয় সংসদে নারীদের জন্য যে আসন সংরক্ষিত আছে, তা সরাসরি নির্বাচিত হোক। নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের প্রশ্ন যখনই ওঠে ততবার এই কথার মীমাংসা জরুরি হয়ে পড়ে জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত নারী আসনের কী হবে? পৃথিবীর অনেক দেশেই নারীদের জন্য আসন সংরক্ষণের ব্যবস্থা আছে; কিন্তু এভাবে এত দীর্ঘকাল ধরে শুধু মনোনয়নের ব্যবস্থা কোথাও আছে বলে আমার জানা নেই।
বাংলাদেশে এই দাবি উঠেছে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে নারী সংগঠনের সরাসরি অংশগ্রহণের সময় থেকে, ১৯৮৭ সালে। সেটাই ছিল নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের লড়াইয়ের একটি উল্লেখযোগ্য সময়কাল। রাজপথের আন্দোলনে থেকে নারীরা বুঝেছিলেন শুধু স্বৈরাচার হঠালেই হবে না, সংবিধানে নারী যেখানে দুর্বল অবস্থানে আছে, সেটা দূর করতে হবে। তাই সংরক্ষিত আসনে সরাসরি নির্বাচনের দাবি উঠেছিল। এর জন্য দরকার ছিল সংবিধান সংশোধনের।
হ্যাঁ, সংবিধান সংশোধন অনেকবার হয়েছে, শেষতক পঞ্চদশ পর্যন্ত হয়েছে, সংরক্ষিত আসনের ভাগ্যে জুটেছে আসন বৃদ্ধি; কিন্তু সরাসরি নির্বাচন করার বিধান আনা যায়নি। নারীরা দলবেঁধে মনোনীত হওয়ার জন্য প্রতিযোগিতায় নেমে ফরম কিনে এই আসনে মনোনীত হচ্ছেন একের পর এক সংসদে। কিন্তু তাদের স্থান পেছনের সারিতে। সামনে আসতে হলে সরাসরি নির্বাচিত হতে হয়। তবুও দলের সিদ্ধান্ত মেনে তারা পেছনের সারিতেই বসছেন। এটাই নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের ভাগ্য!
এখন ২০১৪ সাল, দশম সংসদের জন্য ৫০টি আসনে নারীদের পেছনে বসার জন্য প্রতিযোগিতায় নেমেছিলেন ঢাকা এবং জেলা পর্যায়ের রাজনৈতিক দলের নেত্রীরা। আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ বলে তাদের ভাগে বেশি আসন পড়েছে, মহাজোটের অন্যান্য শরিক দল এবং দশম সংসদের বিরোধী দল কাম-সরকারের অংশ জাতীয় পার্টির ভাগে আনুপাতিক হারে কিছু আসন যাচ্ছে। কে কত পেল সেটা জানতে পারব শিগগিরই মনোনয়নের পর্ব শেষ হলে। আনুপাতিক হারে নারী আসন ভাগ করার এ বিধান করা হয়েছে জোট সরকারের আমলে, তাতে ভাগবাটোয়ারার কিছু অংশ শুধু সংখ্যাগরিষ্ঠ দল এককভাবে পায় না, বিরোধী দল এবং সংসদে নির্বাচিত অন্য দলও পায়। এবার দশম সংসদে সেটার একটা কৌতুকপ্রদ আনুপাতিক হিসাব দেখলাম যে ১৫ জন বিদ্রোহী স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য, হাজী সেলিমের নেতৃত্বে একটি জোট গঠন করে সংরক্ষিত নারী আসনে ২.৬ জন দাবি করলেন। কিন্তু মানুষকে তো আর ০.৬ ভাগে ভাগ করা যাবে না, তাই দুজনই তারা মেনে নিতে রাজি বলে ঘোষণা দিয়েছেন। দেখার বিষয় তারা সেটা পাচ্ছেন কিনা।
আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চূড়ান্ত করার দিনে প্রধানমন্ত্রী সবাইকে পিঠার দাওয়াত দিয়ে বললেন, মনোনয়ন দিতে না পারলেও পিঠা অবশ্যই দিতে পারবেন। সবার সঙ্গে হাস্যরস করে সময় কাটিয়ে দিলেন। জেলা পর্যায় থেকেও উঠে আসা অনেক যোগ্য নারী নেত্রী বঞ্চিত হবেন সন্দেহ নেই, কারণ যাদের মনোনীত করা হয়েছে, তাদের জন্য হিসাব-নিকাশ একেবারে আলাদা। তার সঙ্গে জনগণের চাহিদার হিসাব মিলবে না। তবে দুঃখের বিষয় হচ্ছে, যারা মনোনয়ন চেয়েছিলেন তারা নিজেদের জনপ্রিয়তা যাচাইয়ের কোনো সুযোগ পেলেন না। প্রধানমন্ত্রী যাদের ঠিক করে রেখেছেন তারাই হবেন সংরক্ষিত আসনের ‘সুযোগ্য’ সংসদ সদস্য। অথচ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ তাদের নির্বাচনী ওয়াদা অনুযায়ী এই কাজটি ২০০৯ সালে সরকার গঠন করে সংসদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে করতে পারত, কিন্তু তারা করেননি। তারা নির্বাচনী ইশতেহারে দেয়া ওয়াদা ভঙ্গ করেছেন। প্রথম দুই বছর আন্তর্জাতিক নারী দিবসে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ঘোষণা দিয়েছেন সরাসরি নির্বাচন দেবেন, আসন সংখ্যা ১০০ করবেন। এসব কথার কথাই থেকে গেছে। নারী উন্নয়ন নীতিতেও সরাসরি নির্বাচনের বিধান রেখে সরকার নিজেই নিজের কথা ভঙ্গ করে চলেছেন। স্পিকার যখন মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ছিলেন তিনি নিজেই নারী উন্নয়ন নীতি ঘোষণা দিয়েছিলেন। এখন আবার তার হাতেই এই সংসদে সংরক্ষিত আসন আগের সেই অবস্থানে রয়ে গেল? অভিমানে কি নারী আন্দোলনও চুপ হয়ে গেল?
ভেবেছিলাম আজ অহেতুক সেসব পুরনো কথা ঘেঁটে পাঠকের বিরক্তি বাড়াব না। কিন্তু তবুও না লিখে পারছি না। মনে হচ্ছে, জাতীয় সংসদে ৫০ জন নারীর পেছনের সারিতে বসে থাকার দৃশ্য চোখে সয়ে গেছে। সবাই জানেন, ওরা তো সংরক্ষিত আসনের এবং নির্বাচিত নন। কাজেই পেছনে বসবেন না তো কোথায় বসবেন? নারীদের মধ্যে যারা সামনে বসেছেন তারা সাধারণ আসনে জনগণের ভোটে নির্বাচিত। তাই তারা আসনসংখ্যা ও গুরুত্ব অনুযায়ী বসেন। আমাদের দেখতে ভালোই লাগে। সংরক্ষিত আসনকে অলঙ্কার, পুরস্কার, বোনাস নানা নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে, মানের দিক থেকে তারা দ্বিতীয় শ্রেণীর সংসদ সদস্য। তাদের এলাকার সীমা নেই, তাদের দায়িত্বের ঠিক-ঠিকানা নেই।
প্রসঙ্গক্রমে একটু মন্তব্য করি। দশম সংসদে সম্ভবত বসার ব্যবস্থা তিন রকম হতে পারে। কারণ এখানেও জনগণের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হয়নি ১৫৩টি আসন, আর ১৪৭টি আসন অনেকটা ভোটারবিহীন বা নামেমাত্র ভোটারের ভোটে নির্বাচিত হয়েছে। সেভাবে সংসদে বসার ব্যবস্থা কি হতে পারে না? তাতে জনগণের বুঝতে সুবিধা হোক, নয় কি? আর সংরক্ষিত আসনের নারীদের যেহেতু পেছনে ঠেলে দেয়া হয় পরোক্ষভাবে নির্বাচিত বলে তাহলে ১৫৩টি আসনের সংসদ সদস্যরাও কি একই ক্যাটাগরিতে পড়েন না? বিষয়টি বিবেচনা করা যেতে পারে। কারণ আমার ভয় হচ্ছে, গণতন্ত্রের গতি যেদিকে যাচ্ছে তাতে আগামী নির্বাচনগুলো অন্যরকম হয়ে যেতে পারে। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচন এখন অস্বস্তির কারণ হলেও এটাই মেনে নিতে বাধ্য করা হচ্ছে জনগণ এবং প্রার্থীদের। নারীদের আসনের মতোই সবাইকে মনোনীত করে ঘোষণা দিয়ে দিলে নির্বাচন করার জন্য এত কোটি টাকা আর খরচ করতে হবে না। ল্যাঠা চুকে যায়।
নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের কথা রাজনৈতিক দলের নারীরা বলছেন ঠিকই কিন্তু মুশকিল হচ্ছে সংরক্ষিত আসনের ব্যাপারে তারা এখনও সচেতন নন, কিংবা বুঝতে চান না। বিশেষ করে বড় দুটি দল বিএনপি ও আওয়ামী লীগের নেত্রীদের মধ্যে এ ব্যাপারে বেশ একাত্মতা রয়েছে। তারা অন্যান্য সব বিষয়ে একে অপরকে তুলোধুনো করলেও সংরক্ষিত আসনে মনোনয়নের ব্যাপারে নারী আন্দোলনের দাবির বিরুদ্ধে তাদের অবস্থান পরিষ্কারভাবে ব্যক্ত করেন। সেদিন একটি টেলিভিশন টকশোতে আওয়ামী লীগের অপু উকিল, বিএনপির হেলেন জেরিন খান যেভাবে দিলারা চৌধুরীর সঙ্গে এই প্রশ্নে দ্বিমত পোষণ করলেন, তাতে আমি মোটেও অবাক হইনি। তারা অন্যান্য বিষয়ে পরস্পরের সঙ্গে তর্ক করেছেন। প্রসঙ্গ উঠেছিল নারী আন্দোলনের পক্ষ থেকে সরাসরি নির্বাচনের দাবি তোলার কারণে ২০০১ সালে বিএনপি জোট সরকার সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েও ২০০৪ সাল পর্যন্ত সংরক্ষিত আসনে নারীদের মনোনয়ন দিতে পারেনি। আওয়ামী লীগ সে সময় নারী আন্দোলনকে এক ধরনের সমর্থন দিয়েছিল কিন্তু নিজেরা ক্ষমতায় এসে তা বেমালুম ভুলে গিয়ে সেই পরোক্ষ নির্বাচনের পথই বেছে নিয়েছিলেন। হেলেন জেরিন খান অষ্টম জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত আসনের সদস্য হয়েছিলেন, তবে তা হয়েছিলেন মাত্র এক বছরের জন্য। তাই তিনি নারী আন্দোলনকে দুষলেন। দিলারা চৌধুরী একজন রাজনৈতিক বিশ্লেষক হিসেবে সরাসরি নির্বাচনের প্রয়োজনীয়তা নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের জন্য জরুরি_ এ কথা বোঝাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু দুই রাজনৈতিক দলের নেত্রীরা তা মানতে রাজি ছিলেন না। এতে বোঝা যাচ্ছে, সংরক্ষিত আসনে সরাসরি নির্বাচনের ক্ষেত্রে দলের পুরুষ সদস্যরাই শুধু নন, শর্টকাট ক্ষমতা যারা চান রাজনৈতিক দলের এমন নারী কর্মীরাও একটা বড় বাধা। তারা সংসদের বাইরে তাদের সুযোগ-সুবিধাকে বড় করে দেখছেন কিন্তু সংসদে তাদের পেছনের সারিতে বসার এই প্রতীকী ক্ষমতাহীনতাকে মোটেও গুরুত্ব দিচ্ছেন না। এর মাধ্যমে তারা নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের ভবিষ্যতে কুড়াল মারছেন।
অথচ এখন উপজেলা নির্বাচন যখন হচ্ছে তখন দেখছি নারীরা ভোটের যুদ্ধে ঠিকই অংশগ্রহণ করছেন। সেখানে আসন সংরক্ষিত আছে, অর্থাৎ নারীদের আসনে নারীরা লড়ছেন একে অপরের সঙ্গে। কিন্তু জনগণ তাদের ভোট দিয়ে নির্বাচিত করছেন। এটাই হওয়া উচিত ছিল সর্বোচ্চ পর্যায়ে জনপ্রতিনিধিদের বেলায়। কারণ তারা দেশের জন্য আইন প্রণয়ন করেন।
আমরা যারা নারী আন্দোলন করি তারা রাজনৈতিক দলের নারী কর্মীদের সম্মান করি এবং তাদের পেছনের সারিতে দেখতে আমাদের ভালো লাগে না। তাই এত কথা বললাম। এখনও সুযোগ আছে। দশম সংসদে সরাসরি নির্বাচনের বিধান রেখে সংবিধান সংশোধন করুন।