উবিনীগ || Tuesday 18 February 2014
বিটি বেগুন চাষের অনুমোদন প্রত্যাহার এবং কৃষক পর্যায়ে চাষ বন্ধের দাবীতে, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৪, সকাল ১১টায় গাজীপুর জেলা প্রসাশক ভবনের সামনে প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। বিটি বেগুন বিরোধী মোর্চা এই প্রতিবাদ সমাবেশের আয়োজন করে। বিটি বেগুন বিরোধী মোর্চা- পরিবেশ সংগঠন, উন্নয়ন সংগঠন, কৃষক সংগঠন, স্বাস্থ্য আন্দোলন নেটওয়ার্ক, শ্রমবিকাশ কেন্দ্র সহ বিভিন্ন সংগঠনের একটি মোর্চা। এই সমাবেশে বক্তব্য রাখেন মহিদুল হক খান, ফরিদা আখতার, জাহাঙ্গীর আলম জনি, টাংগাই থেকে আগত কৃষক আক্কাস আলী, কৃষক মাঈনুদ্দীন, কৃষক সুলতানা বেগম ও বাসিরন বেগম, কৃষক জিন্নাত আলী বক্তব্য রাখেন। আরও বক্তব্য রাখেন, পলাশ বড়াল, সাঈদ আহমেদ কবির, রোকেয়া বেগম, সীমা দাস সীমু, আতাউর রহমান মিটন। সংহতি প্রকাশ করে বক্তব্য রাখেন, গাজীপুর মুক্তি যোদ্ধা সংসদের প্রাক্তন ডিপুটি কমান্ডার রমিজ উদ্দিন মাষ্টার, বীর মুক্তি যোদ্ধা হাতেম আলী, ফজলে নিজামী ও সাংবাদিক আনিসুর রহমান।
বক্তারা বলেন, বাংলাদেশে জিএম ফসলের প্রবর্তন করে এ দেশের কৃষি ও ভোক্তা হিশেবে জনগণকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেয়া হচ্ছে। বহুজাতিক কোম্পানির সহযোগিতায় জেনেটিক কারিগরির মাধ্যমে ফসলের প্রাণ গঠনের পরিবর্তন করে বিটি বেগুন করা হচ্ছে। বাংলাদেশ কৃষি প্রধান দেশ এবং আমাদের সংখ্যাগরিষ্ট জনগোষ্টি কৃষির উপর নির্ভরশীল। একই সাথে এদেশ ফসলের দিক থেকে বৈচিত্র্যপূর্ণ। এখানে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠানে যে বীজ সম্পদ আছে তা দিয়েই বোঝা যায়। এখানে সবজি, ডাল, তেলসহ জনগণের জন্যে প্রয়োজনীয় নানা ফসলের বীজ সংগ্রহ করা আছে।
টাংগাইলের নয়াকৃষির কৃষক আক্কাস আলী, জিন্নাত আলী, বাছিরন বেগম ইউপি সদস্য ও অন্যান্যরা
লক্ষ্য করা যাচ্ছে, ২০০৫ সাল থেকে শুরু হওয়া জেনিটিক ইঞ্জিনিয়ারিং প্রযুক্তি ব্যবহারে বিটি বেগুনের গবেষণা শুরু করে ২০১৩ সালে হঠাৎ তড়িঘড়ি করে কৃষক পর্যায়ে চাষের অনুমোদন প্রক্রিয়া শুরু হয় এবং ৩০ অক্টোবর, ২০১৩ তারিখে বিটি বেগুনের ৪টি জাত (বিটি বেগুন-১ (উত্তরা), বিটি বেগুন-২ (কাজলা), বিটি বেগুন-৩ (নয়নতারা) এবং বিটি বেগুন ৪ (ওঝউ০০৬) নামে অবমুক্ত করার অনুমোদন দেয়া হয়, গত ২২ জানুয়ারি, ২০১৪। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বারি) পক্ষ থেকে বিটি বেগুনের ৪টি জাত গাজীপুর, রংপুর, পাবনা ও জামালপুর এলাকায় মাঠ পর্যায়ে চাষ করার জন্য ২০ জন কৃষকের মাঝে চারা বিতরণ করা হয়েছে। ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকা দমনের নামে এই বিতর্কিত জেনেটিকালি মডিফাইড খাদ্য ফসল ভারত ও ফিলিপাইনের মতো দেশে প্রবর্তন করা যায় নি, অথচ বাংলাদেশের মতো কৃষি নির্ভর দেশে প্রবর্তন করে কৃষক, ভোক্তা এবং বাংলাদেশের কৃষির জন্যে হুমকি তৈরি করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ বেগুনের আদি উৎপত্তি স্থল এবং বেগুনের বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ দেশ। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বারি) দেশীয় বীজ রক্ষা করার কাজে নিয়োজিত একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানে সংরক্ষণ করা আছে কৃষকের হাজার বছরের লালিত বেগুনের বিভিন্ন জাত। জেনেটিক ইঞ্জিনীয়ারিং প্রযুক্তি যে পদ্ধতিতে আমাদের দেশে আসছে তাতে কৃষকের পছন্দ ও চাহিদার কথা উপেক্ষা করেই বেগুনের স্থানীয় জাত কৃষকদের অনুমতি ছাড়াই বহুজাতিক কোম্পানীর নিয়ন্ত্রণে চলে যাচ্ছে, পাশাপাশি কৃষকরা অপ্রস্তুত অবস্থায় বিটি বেগুনের মতো জিএম ফসল চাষে বাধ্য হচ্ছে, যা কৃষকের জন্য সর্বনাশ বয়ে আনবে
বিটিবেগুন বিরোধী গান পরিবেশন করছেন কৃষক আক্কাস আলী
জিএম ফসল প্রবর্তনের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী বিটি বেগুনের গবেষণায় বিপজ্জনক টেকনোলজি প্রবর্তনের ক্ষেত্রে আগাম হুঁশিয়ার থাকার নীতিমালা (Pre-cautionaryPrinciples) মেনে চলা হয়েছে কিনা তার কোন প্রমাণ মেলে নি (বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বারি) বেগুনে ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকা দমনের নামে মাটির ব্যাক্টেরিয়ার জিন, ব্যাসিলাস থুরিনজেনসিস (bacillus thuringenesis সংক্ষেপে বিটি) ব্যাকটেরিয়া থেকে ক্রিসটাল জিন বেগুনে সংযোজন করা হয়েছে। উদ্দেশ্য হিশেবে বলা হয়েছে বেগুনের ফল ও কাণ্ড ছিদ্রকারী পোকা প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করা। এভাবে বেগুনকে জিএম খাদ্য বানানো হয়েছে)।
বিটি বেগুন মানুষের জন্যে এবং পরিবেশের জন্যে নিরাপদ কিনা না জেনেই কৃষক পর্যায়ে চাষের জন্যে দেয়া হয়েছে। এই ধরণের ফসলের চাষের জন্যে যে বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হয় কৃষকের তা জানা নেই। তাদের পক্ষে সব সতর্কতা মেনে চলা সম্ভব নয়। আশে পাশের কৃষকদের সাধারণ ফসলও ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এর সাথে খাদ্য নিরাপত্তারও কোন সম্পর্ক নেই। বাংলাদেশের জন্যে বেগুন জেনেটিক ইঞ্জিনীয়ারিংয়ের ফলে কোন অর্থনৈতিক লাভ নেই। এই সবজিকে জেনেটিক ইঞ্জীনীয়ারিং করার ফলে আন্তর্জাতিক বাজার বাড়বে না বরং সংকুচিত হয়ে যাবার সম্ভাবনাই বেশী, কারণ বাংলাদেশের মতো দেশ থেকে যারা সবজি আমদানী করে তারা জিএমও নয় এমন খাদ্যের জন্যেই কেনে।
প্রতিবাদ সমাবেশ শেষে বিটি বেগুন বিরোধী মোর্চা’র পক্ষ থেকে সাত সদস্য বিশিষ্ট্য একটি প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনিষ্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. রফিকুল ইসলাম মন্ডল এর সাথে সাক্ষাত করে জনস্বার্থের কথা বিবেচনা করে স্বাস্থ্য, পরিবেশ এবং কৃষকের জন্য ক্ষতিকর বিটিবেগুন চাষের অনুমোদন অবিলম্বে প্রত্যাহার করে এর চাষ বন্ধের উদ্যোগ নেবার আহ্বান জানিয়ে এক করা হয়। স্বারক লিপির অনুলিপি গাজীপুর জেলা প্রশাসক বরাবরও প্রদান করা হয়। প্রতিনিধিদের পক্ষ থেকে বিটি বেগুনে স্বাস্থ্য ক্ষতি সংক্রান্ত কোন গবেষণা বাংলাদেশে হয়েছে কি না এ বিষয়ে সীমা দাস সীমু জানতে চাইলে ড. রফিকুল ইসলাম মন্ডল মন্তব্য করেন, “সকল বিষয় মেনেই বিটি বেগুনের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। আমাদের লিখিত প্রতিবেদন আছে”। লিখিত প্রতিবেদনের কপি চাওয়া হলে পরবর্তীতে দেওয়া হবে বলে জানান।
স্বারক লিপি প্রদান করে, বিটি বেগুন, বিরোধী মোর্চার প্রতিনিধিরা।
এই মোর্চার পক্ষ থেকে আমরা সুনির্দিষ্টভাবে বলতে চাই,
১. বিটিবেগুনের স্বাস্থ্য ক্ষতি সংক্রান্ত কোন গবেষণা বাংলাদেশে হয় নি। ফলে মানুষ ও অন্যান্য প্রাণের ক্ষতি হবে না এই দাবী ভিত্তিহীন।
২. পরিবেশ ও প্রাণ বৈচিত্র্যের ক্ষতি সম্পর্কে কোন মূল্যায়ন বা হুঁশিয়ারিই নাই। অথচ প্রাণবৈচিত্র্য সংক্রান্ত নানান আন্তর্জাতিক চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ যা করতে বাধ্য। কারণ বাংলাদেশ এই চুক্তিগুলোতে স্বাক্ষর করেছে এবং তা বলবত করবার জন্য আন্তর্জাতিক ভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
৩. পরিবেশ, অর্থনীতি, কৃষি ও স্বাস্থ্য কোন বিবেচনাতেই বাংলাদেশে বিটি বেগুন চাষের কোন যৌক্তিকতা নাই। কাবণ বিটি বেগুনের চারা বিতরণ ও চাষ প্রাণ ও পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি, অবিলম্বে বিটিবেগুনের চাষ বন্ধ করা হোক।
৪. আমরা মানুষের সার্বজনীন কল্যাণে বিজ্ঞানের সঠিক ব্যবহারের বিরোধী নই। কিন্তু বাংলাদেশে বিটি বেগুনের গবেষণা ও ব্যবহার কোন কল্যাণ আনবে না বরং এটা ক্ষতিই করবে আর কেবলমাত্র বহুজাতিক কোম্পানীর লাভ হব
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন-এর গাজীপুর জেলার প্রতিনিধরা মানবন্ধনে অংশগ্রহণ করেন।