রাজনৈতিক আগুনের নিষ্ঠুরতা : আমাদের তো চুপ করে থাকার কথা নয়

ফরিদা আখতার || Wednesday 04 December 2013

গত ক’দিন বিরোধী দলের ডাকা অবরোধ কর্মসূচি চলছে, একইসঙ্গে চলছে নানা ধরনের রাজনৈতিক ‘সহিংসতা’। সহিংসতার সঙ্গে উদ্ধৃতি চিহ্ন দিলাম এই কারণে যে, সমাজে একটা ধারা আছে, যারা অবরোধ কর্মসূচি নাকি হরতাল সে ব্যাপারে বিভ্রান্ত হয়ে ঠিক করতে পারছেন না, ঠিক কীভাবে নিজেদের কাজকারবার করবেন। যারা সরাসরি অবরোধের বিরোধিতা করছেন এবং তাদের দাবি সঠিক নয়, এটা প্রমাণ করতে চাচ্ছেন, তাদের জন্য এই সময়ে ঘটে যাওয়া সহিংসতার মাত্রা কতখানি তা দিয়ে আন্দোলনের যৌক্তিকতা বিচার করছেন। ট্রেনের লাইন বা ফিশপ্লেট তুলে ফেলা, রাস্তায় গাছ কেটে ফেলে রেখে রাস্তায় চলাচল বন্ধ করে দেয়া, সিএনজি, লেগুনা ও বাসে আগুন লাগানো,ককটেল ফোটানো-কোনোটাকেই ভালো কাজ বলার অবস্থা নেই।

মানুষের মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। এদের মধ্যে রাজনৈতিক কর্মী আছেন, আছেন সাধারণ মানুষ ও পথচারী। অতএব, তাদের সার কথা হচ্ছে, যারা অবরোধ ডেকেছে তারা খুবই খারাপ করছে, তাদের সমর্থন করা যায় না। কিন্তু একটু যদি টেলিভিশনের খবর লক্ষ্য করে দেখা যায়, তাহলে চোখে পড়বে নিরস্ত্র কিছু ছেলেপেলে, যাদের রাজনৈতিকভাবে পিকেটার বলা হচ্ছে আর সরকারি দল বলছে ভাড়া করা শিশু, তাদের দিকে বন্দুক তাক করে গুলি ছুড়ছে পুলিশ। কিছু পরিস্থিতি দেখে মনে হয় দেশে যুদ্ধ চলছে; কিন্তু কে কার সঙ্গে যুদ্ধ করছে? আমরা নিজেরাই নিজেদের শত্রু হয়ে গেছি? বন্দুকের গুলির আঘাতে আহতদের হাসপাতালে নেয়া হয় কিনা জানা যায় না, বরং তাদের পুলিশের ভ্যানে করে গ্রেফতার করে নিয়ে যেতে দেখা যায় বেশি। অথচ একবার কেউ বলে না যে, সরকার যেভাবে একগুঁয়েমিপনা করে একতরফা নির্বাচনের খেলায় নেমেছে তার কারণে এতসব সহিংসতা ঘটছে, যার কিছু অংশ সরকার নিজেও ঘটাচ্ছে বলে জনমনে বিশ্বাস জন্মাচ্ছে। তাই সহিংসতার দায় একপক্ষের নয়, দু’পক্ষেরই।

প্রতিদিনের সহিংসতা দেখে দেখে গা সওয়া হয়ে যাচ্ছে গণমাধ্যমের কল্যাণে। আগুন জ্বললে খবর পাঠকদের চাঙ্গা মনে হয়। তবুও সবকিছুর মধ্যে যা আমাদের সহ্য সীমার বাইরে চলে গেছে তা হচ্ছে শাহবাগে বাসে আগুনে ঝলসে যাওয়া মানুষের কষ্ট। এই ঘটনার যারা শিকার হয়েছেন তারাই একমাত্র জানেন এই কষ্ট কেমন, যারা নিজ আপনজন হারিয়েছেন তাদের আর্তনাদ শুনে নিজেদেরই অসহায় লাগে। কারণ যতই আমরা সহানুভূতি জানাই না কেন তাদের কষ্ট লাঘব করবে না। জানি না, সবাই প্রাণে বাঁচবে কিনা। ডাক্তারের কথা শুনে মনে হচ্ছে, বেঁচে গেলেও কমপক্ষে ছয় সপ্তাহ ভুগতে হবে। অনেকেই তাদের দেখতে যাচ্ছেন। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী সেদিনই গেছেন। গত দু’দিন ধরে টেলিভিশনে স্ক্রল দেখছি বিরোধী দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবসহ প্রায় সব শীর্ষ নেতার বিরুদ্ধে মামলা দেয়া হয়েছে, এই বাসে আগুন দেয়ার জন্য। এখন তারা যদি দেখতে যেতেও চান তাদের আসামি হিসেবে আত্মসমর্পণের জন্যই যেতে হবে। শুনেছি, (গণমাধ্যমে) তাদের অনেকেই এখন ঘরে থাকতেও পারছেন না। দলের নয়াপল্টন কার্যালয় থেকে রুহুল কবির রিজভীকে এ অভিযোগে রাতের আঁধারে সিনেমা স্টাইলে গ্রেফতার করা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীরা আইন ভাঙতে পারেন কিনা আমার জানা নেই, কিন্তু তারা তাই করেছেন।

বিএনপি নেতারা সব হুকুমের বা উসকানিদাতা হিসেবে আসামি; কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে, যারা বোমাটা মেরেছে পুলিশ এখনও তাদের ধরতে পারেনি। কোনো প্রত্যক্ষদর্শীকেও হাজির করছে না। আমি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালকে ধন্যবাদ জানাই যে, তারা এত রোগীকে একত্রে চিকিৎসা দিচ্ছেন এবং বাঁচানোর চেষ্টা করছেন। যদিও ভিআইপিরা এত বেশি দেখতে যাচ্ছেন এবং তাদের যাওয়াকে কেন্দ্র করে আয়োজন করতে গিয়ে রোগীদের চিকিৎসা দিতে পারছেন না।

এই লেখা যখন লিখছি তখন প্রধানমন্ত্রীও গেছেন বার্ন ইউনিটে বাসের আগুনে পোড়া রোগীদের দেখতে। কিন্তু সেখানে গিয়ে তিনি যে প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছেন তার উত্তর কি তিনি দিতে পেরেছেন? গীতা সরকারের শরীর, মুখ সব পুড়ে গেছে। তিনি পরিষ্কার বলে দিয়েছেন, ‘আমরা অসুস্থ সরকার চাই না, খালেদারেও চিনি না, হাসিনার কাছেও যাই না।’ ধন্যবাদ গীতা সরকার আপনাকে। আপনি একাই অনেক রোগীর মনের যাতনা মিটিয়ে দিয়েছেন। এর আগে দেখেছি, আগুনে পুড়ে গিয়ে মৃতদের স্বজনরা গণতন্ত্রকে ধিক্কার দিয়েছেন! একটা দেশের জন্য এটা লজ্জার বিষয় যে, মানুষ এখন গণতন্ত্রের বিপক্ষে কথা বলছে। কারণ তারা ভুগছে, পুড়ে মরছে। গণতন্ত্র যদি হয় দুটি দলের ক্ষমতায় যাওয়ার বা থাকার লড়াই, তাহলে এমন মনোভাব মানুষের মনে জাগলে তার বিরুদ্ধে কিছু বলার আছে কি? অন্যদিকে মানুষ যদি স্বস্তি পায় একটি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে, তাহলে সেটা কি গণতন্ত্র নয়? প্রধানমন্ত্রী কি পারেন না সেই স্বস্তিটুকু দিতে?

কেন জানি না, আজকাল ভূরি ভূরি টিভি চ্যানেল থাকা সত্ত্বেও ঢাকার বাইরের ঘটনাকে প্রাধান্য দেয়া হয় না। ট্রেনের ইঞ্জিনে ও বগিতে আগুনের ঘটনা দেখানো হয়; কিন্তু যারা আহত হন তাদের কোথায় নেয়া হচ্ছে, কেমন আছেন, কীভাবে শেষ পর্যন্ত মাঝপথ থেকে গন্তব্যে যাচ্ছেন তার কোনো খোঁজ গণমাধ্যম দেয় না। শুধু তাই নয়, ঢাকার বাইরে জনগণের সম্পৃক্ততায় যে প্রতিরোধ গড়ে উঠছে, তা বেমালুম চেপে যাওয়া হচ্ছে। ঢাকার বাইরে কি শুধু ট্রেনলাইন উপড়ে ফেলা হচ্ছে? মোটেও না। একেবারে গ্রাম পর্যায়েও মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে অবরোধ পালন করছে, তা দেখানো হচ্ছে না। এটা কী কোনো সিদ্ধান্ত নাকি নিজেরাই ভয় পেয়ে দেখাচ্ছেন না? নাকি ঢাকা শহরের মানুষকে দেখাতে চাচ্ছেন না, কারণ তারা ‘শান্তি চায়’! ঢাকা শহরের যারা মধ্যবিত্ত মানুষ তারা নিজেদের ‘সাধারণ’ মানুষ বলে দাবি করেন; কিন্তু এই মধ্যবিত্ত নারীরা সারা দিন হয়তো ‘জীবন মানেই জি-বাংলা’ দেখে সময় কাটান। মাঝখানে একটু-আধটু খবরে সহিংসতা দেখে বিরক্ত হয়ে ওঠেন-দেশে এসব কী হচ্ছে?

এখন শীতের মৌসুম, মজার মজার তরকারি খাওয়ার কথা, তখন তারা বিরক্ত হচ্ছেন তরকারি বোঝাই ট্রাক কেন ঢাকায় আসতে পারছে না! তাদের ছেলেরা রাস্তা ফাঁকা পেয়ে ক্রিকেট খেলছে। রাজনীতি, গণতন্ত্র- এসব কিছুতেই তাদের কিছু যায়-আসে না। গুলশানের ঘরগুলোতে রাতে গান-বাজনা হচ্ছে। এদের মধ্যে দু-একজন টকশো শুনে বুঝছেন যে হাসিনা যা খালেদাও তা। এই দুই মহিলার ঝগড়া-ঝাটিতেই দেশে এমন অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। তারা এসবে নেই। তারা ‘সাধারণ’ মানুষ।

অন্যদিকে যারা আসলেই সাধারণ মানুষ তারা কিন্তু পুরো রাজনৈতিক ঘটনা পর্যবেক্ষণ করছেন এবং তাদের সৎ মতামত দিচ্ছেন। রিকশায় বসে রিকশাওয়ালার সঙ্গে কথা বললে কিংবা চায়ের দোকানে, শ্রমিক বা গ্রামের কৃষক তাদের মতামত ঠিকই দিচ্ছেন। তারা বল প্রয়োগের বিরোধিতা করছেন।

আরও অবাক হয়ে যাই যখন দেখি রাজধানীর আর্মি স্টেডিয়ামে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত উৎসব হচ্ছে তিন-চার দিন ধরে। আমি নিজে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের খুব ভক্ত, সুযোগ হলে এবং দেশের অবস্থা ভালো থাকলে হয়তো যাওয়ার কথা ভাবতাম। কিন্তু যেদিন জানতে পেরেছি যে, এটা শুধু বেঙ্গল ফাউন্ডেশন একার আয়োজন নয়, এর সঙ্গে সহযোগী আছেন কলকাতার সঙ্গীত রিসার্চ একাডেমি (এসআরএ), যা কিনা আইটিসি বা ইন্ডিয়ান টোব্যাকো কোম্পানির একটি প্রতিষ্ঠান। আইটিসি ব্রিটিশ-আমেরিকান টোব্যাকো কোম্পানির গ্লোবাল সাবিসিডিয়ারি হিসেবে কাজ করছে। তারা ধন্য যে, ভারতের শীর্ষ উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত শিল্পীরা তাদের আয়োজিত অনুষ্ঠানে গাইছেন, তাদের প্রতিষ্ঠানে সময় দিচ্ছেন। কিন্তু তামাকবিরোধী আন্দোলনে যুক্ত হতে গিয়ে যখন দেখছি বছরে বাংলাদেশে কমপক্ষে ৫৭ হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে শুধু ধূমপানের কারণে (ধোঁয়াবিহীন তামাকের কারণে মৃত্যুর সংখ্যা এখনও কেউ গুনছেন না)। অন্যদিকে প্রায় তিন লাখের অধিক মানুষ তামাকের কারণে পঙ্গুত্ব বরণ করছেন।

অ-সংক্রামক রোগ (ইংরেজিতে ঘঈউ) যেমন হার্টের রোগ, স্ট্রোক, ফুসফুসের রোগ, ক্যানসার ইত্যাদি যেভাবে বাড়ছে তার সঙ্গে তামাক সেবন সরাসরি যুক্ত। এসব কথা মনে হলে হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়ার বাঁশিতে, কিংবা প-িত শিবকুমার শর্মার জাদুর হাতে সন্তুর বেজে উঠলে তখন তাতে মন ছুঁয়ে যায় না, বরং মনে হয়, এই শিল্পীরা কি এতই দামি যে, তাদের একমাত্র তামাক কোম্পানিই আমন্ত্রণ জানাতে পারে আর কেউ পারে না?

শুধু তাই নয়, উদ্যোক্তাদের দিক থেকে দেখতে গেলে দেশের এই দুঃসময়ে এই অনুষ্ঠান কী না করলে হতো না? তারা কি সবাইকে প্রতিভাবান নিরো বানিয়ে ছাড়বেন? রাতে উচ্চ ও মধ্যবিত্তরা যেমন দেখছেন তেমনি সরকারের লোকজনও সেখানে মগ্ন হয়ে শুনছেন। প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিষয়ক উপদেষ্টা গওহর রিজভী সেখানে গিয়ে সরকারি সহযোগিতার প্রতিশ্রুতিও দিয়ে এসেছেন! (কালের কণ্ঠ, ১ ডিসেম্বর, ২০১৩)। এই কাজ কি আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিষয়ক উপদেষ্টার কাজ, নাকি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের কাজ? কোন ধরনের সরকারে আমরা বাস করছি?

সবকিছু মিলিয়ে এক নিষ্ঠুর সময়ের মধ্যে আমরা যাচ্ছি। কিছু কথা নয়, আসলে আমাদের তো অনেক কথা বলার আছে। আমাদের তো চুপ করে থাকার কথা নয়।

ফরিদা আখতার

নারীনেত্রী ও উন্নয়নকর্মী।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *