ফরিদা আখতার || Tuesday 05 November 2013
সকল ধরণের উদ্বেগ উৎকন্ঠার তোয়াক্কা না করেই শেষ পর্যন্ত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় বিটি বেগুনের “শর্তসাপেক্ষে অনুমোদন” প্রদানের প্রজ্ঞাপন জারী করেছে। বোঝাই যাচ্ছে যারা এই অনুমোদন দিয়েছেন তাঁরা নিজেরাই নিশিচত নন যে এই বেগুন আসলেই নিরাপদ কিনা। অথচ এই কথা পরিবেশবাদী ও কৃষকদের নিয়ে কাজ করেন এমন সংগঠন গুলো এতোদিন ধরে বলে আসছেন। তাঁরা দাবী জানিয়েছিলেন মানুষের স্বাস্থ্য, পরিবেশ ও স্থানীয় জাতের বেগুনের ওপর এর ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে কিনা নিশ্চিত না হয়ে যেন অনুমোদন না দেয়া হয়। এই একই কারণে ভারত ও ফিলিপাইনে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু সে কথার কোন গুরুত্ব সরকার দেন নি। এমনকি বিশ্বের নামকরা বিজ্ঞানীরা মাননীয় প্রধান মন্ত্রীর কাছে চিঠি দিয়ে তাদের উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন। কিন্তু এই সব কিছুই উপেক্ষে করে শর্ত সাপেক্ষে অনুমোদন দেয়া হয়েছে।
আমরা ভেবে পাচ্ছিলাম না বাংলাদেশের গবেষণায় কী এমন করা হোল যে তাঁরা স্বাস্থ্য ও পরিবেশ ঝুঁকি নিয়ে প্রতিবেদন হাজির করে অনুমোদন নিতে পারছেন। হাইকোর্ট পর্যন্ত গিয়েও তাঁরা বিষয়টি এড়িয়ে গেলেন। এবং বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বারি) কৃষি মন্ত্রণালয়ের বায়োটেকনোজি সংক্রান্ত জাতীয় টেকনিকাল কমিটির সকল ধাপ পার হয়ে পরিবেশ মন্ত্রণায়ের ন্যাশনাল কমিটি অন বায়োসেফটি (এনসিবি) এবং বায়োসেফটি কোর কমিটি (বিসিসি) এর কাছে উত্থাপন করার মতো কী এমন তথ্য হাজির করতে পারছেন, যা দিয়ে বাংলাদেশের মতো ফসলের বৈচিত্রপুর্ণ দেশে একটি দেশে জেনেটিকালী মডিফাইড ফসল প্রবর্তনের ক্ষেত্র তৈরী হোল? তাছাড়া এই গবেষণা বাংলাদেশের কোন সমস্যা সমাধানের লক্ষে করা হয় নি। বেগুনে অনেক ধরণের পোকার আক্রমণ ঘটে, তার মধ্যে শুধু ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকা দমনের জন্য বেসিলাস থুরিজেনিসিস নামক ব্যাক্টেরিয়ার জিন চারটি স্থানীয় জাতের বেগুনের মধ্যে প্রবেশ করানো হয়েছে, যা গাছেই বিষ উৎপাদন করে পোকা মেরে ফেলবে।
পুরো ব্যাপারটির মধ্যে একটা তড়িঘড়ির ভাব লক্ষ করা গেছে। জুলাই মাসে অনুমোদনের আবেদন করার মামলা হয়েছে দুটি, সে মামলা খারিজ হলেও সেখানে কিছু সতর্কতার কথা ছিল। সরকার স্বাস্থ্য ঝুঁকির কোন প্রতিবেদন দিয়েছেন কিনা জানা যায় নি, তবে বায়োসেফটি কোর কমিটি (বিসিসি) কে অক্টোবরের ২১ তারিখ চিঠি দিয়ে ২৩ অক্টোবরের ম ধ্যে তাদেয় মতামত/ প্রতিবেদন পরিবেশ ম ন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করার জন্যে বলা হয়। খুবই আশ্চর্যের বিষ্য যে এতো বড় সিদ্ধান্তের বিষয়টি এতো অল্প সময়ে কিভাবে করা হতে পারে?
আমরা জানি বিটি বেগুনের গবেষণার উদ্যোগ বাংলাদেশ থেকে আসে নি। বিটি বেগুন প্রকল্পের অংশীদার বেশীর ভাগ বিদেশী সংস্থা যেমন ইন্টারন্যাশনাল সার্ভিস ফর দি একুইজিশান অব এগ্রবায়োটেক এপ্লিকেশান (ISAAA), ইউনিভার্সিটি অব ফিলিপাইন্স, লসবেনোস (UPLB), সাউথ ইস্ট এশিয়ান রিজিওনাল সেন্টার ফর গ্রাজুয়েট স্টাডি এন্ড রিসার্চ ইন এগ্রকালচার (SEARCA) এবং বীজ কোম্পানী যেমন ভারতের MAHYCO, যার সাথে বহুজাতিক কোম্পানী মনসান্তোর অংশীদারিত্ব রয়েছে। কাজেই এই গবেষণা কেবল বাংলাদেশের বিজ্ঞানীদের,এমন দাবী করা যাবে না।[ওয়েবসাইট দেখুন www.absp2.net]। বাংলাদেশে গাজীপুরে অবস্থিত কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান (BARI) এই গবেষণা করছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য সংস্থা ইউএসএইডের বিশেষ কর্মসুচী ABSP II এর অধীনে। ভারতে এই বেগুন নিয়ে প্রচুর বিরোধিতা ও হৈ চৈ হয়েছে এবং ফেব্রুয়ারি ২০১০ সালে ভারতের পরিবেশ মন্ত্রী জয়রাম রমেশ ছাড়পত্র দিতে অস্বীকার করেছে্ন।শুধু তাই নয় ভারতে বিটি বেগুন গবেষণার ওপর মোরাটরিয়াম জাড়ি হয়েছে। কিন্তু ভারতের উদ্যোক্তা কোম্পানি মাহায়কো ভারতের নিষেধাজ্ঞায় বসে থাকতে রাজী নন। তাই তাঁরা যেমন করেই হোক একটি অনুমোদন পত্র নিয়ে নিতে চাচ্ছেন, তার মধ্যে যুক্তি থাকুক বা না থাকুক। এবং এই অনুমোদনের মধ্যে সেটাই ফুটে উঠেছে।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটে দেয়া প্রজ্ঞাপনে http://bari.gov.bd/home/latest_news শর্তসাপেক্ষে অনুমোদনের মধ্যে চারটি শর্ত খুব গুরুত্বপুর্ণ, অর্থাৎ এই বিষয়গুলো মীমাংসাহ না করেই সরকার অনুমোদন দিয়েছে। এই শর্তগুলো হচ্ছেঃ
২ মাঠ পর্যায়ে অবমুক্তির পূর্বে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এবং প্রতিষ্ঠানকে Field production nlanning Field biosafety management planning Emergency Response Planning, Safety measures ‡hgbt lsolation distance management planning, border row management planning Techniques for Protection of local and indigenous variety and wild plants প্রণয়নপূর্বক তা এনসিবি বিসিসিকে অবহিত করতে হবে;
৪ সীমিত চাষাবাদের জন্য নির্ধারিত এলাকার কৃষকগণকে বিটি বেগুনের পরিবেশসম্মত চাষাবাদ এবং বায়োসেফটি সংক্রান্ত বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান করতে হবে। বায়োসেফটি এবং বিটি বেগুনের চাষাবাদ বিষয়ক নিয়মকানুন সম্বলিত একটি নির্দেশিকা সংশ্লিষ্ট কৃষকগণকে সরবরাহ করতে হবে;
৫ বিটি বেগুন চাষাবাদের কারণে পরিবেশ এবং জনস্থাস্থ্যের উপর কোন ঝুঁকি তৈরী হলে আবেনকারী প্রতিষ্ঠান এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণসহ জরুরী পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হবে, যাতে করে এ ধরনের হুমকির বিস্তার প্রতিরোধ করাসহ এর বিরূপ প্রভাব উপশম করা যায়। মাঠ পর্যায়ে অবমুক্তির কারণে উদ্ভূত পরিবেশগত যে কোনো বিরূপ প্রভাব বা পরিস্থিতির ক্ষেত্রে আবেদনকারী সংস্থা/প্রতিষ্ঠানকে বায়োসেফটি রুলস এর আওয়াতায় দায়-দায়িত্ব বহন করতে হবে;
৬ বায়োসেফটি রুলস এর আওতায় বিটি বেগুন যাতে লেবেলিং বজায় রেখে বাজারজাত করা হয়, সে লক্ষ্য আবেদকারী প্রতিষ্ঠানকে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে;
শর্ত নম্বর দুই সম্পর্কে আমাদের দাবী হচ্ছে, মাঠ পর্যায়ে অবমুক্তির আগে এই পরিকল্পনা কোন কোন এলাকায় করা হবে তা ঠিক করে এটা ঠিকভাবে করা হয়েছে কিনা তা দেখার জন্যে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত স্বাধীন বিজ্ঞানীদের দ্বারা পরীক্ষা করে দেখা হোক। নইলে দায়সারাভাবে পরিকল্পনা করে দুই নম্বর শর্ত পুরণ করার চেষ্টা থাকতে পারে। আমরা এ ব্যাপারে উদ্বিগ্ন।
শর্ত নম্বর চার কৃষকদের বায়োসেফটি সংক্রান্ত প্রশিক্ষণের বিষয়টি দায়িত্বহীনভাবে বলা হচ্ছে। বাংলাদেশে ব্যাপক চাষ হলে কতজন কৃষককে তাঁরা এই প্রশিক্ষণ দিতে পারবেন? এই প্রশিক্ষণ শেষ পর্যন্ত কিভাবে দেয়া হবে তাও পরিস্কার নয়। ইতিমধ্যে হাইব্রিড ও অন্যান্য ফসলের প্রশিক্ষনের ক্ষেত্রে দেখা গেছে মুষ্টিমেয় কয়েকজন কৃষকদের এনে কিছু সামান্য কিছু তথ্য দিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়। তারা মুল বিষয়টি্র ভাল মন্দ সম্পর্কে জানতে পারেন না। তাছাড়া পরিবেশ সম্মত চাষাবাদ বলতে তাঁরা কি বুঝিয়েছে সেটা পরিস্কার নয়। পরিবেশসম্মত কৃষির প্রধান উপাদান হচ্ছে দেশীয় বীজ রক্ষা করা, এবং প্রাণ বৈচিত্র্যের কোন ক্ষতি সাধন না করা কিন্তু বিটি বেগুন চাষাবাদ অবশ্যই এককাট্টা চাষ হবে, যা পরিবেশ সম্মত কৃষির সাথে সংগতিপুর্ণ নয়। বেগুনে বিষ স্প্রে করা হবে না ঠিকই কিন্তু বেগুন গাছটিকে বিষাক্ত করে দেয়া হবে। এর ফলাফল মাটি ও পরিবেশের জন্যে ভাল নয় বলেই বিশ্বব্যাপী বিটি বেগুনের বিরোধিতা করা হচ্ছে। কীটনাশক ব্যবহারের কমাবার জন্যে বিশ্বের বিখ্যাত কীটতত্ত্ববিদরা আইপিএম (সমন্বিত বালাইনাশক পদ্ধতি ব্যবহারের প্রস্তাব দিয়েছেন যা ইতিমধ্যে সফল হয়েছে বলে প্রমানিত। অথচ তা না করে কোম্পানি নিয়ন্ত্রিত জেনেটিকালী মডিফাইড বেগুনের প্রবর্তন করা হচ্ছে।
শর্ত নম্বর পাঁচ দেখেই বোঝা যাচ্ছে তাঁরা স্বাস্থ্য ও পরিবেশ ঝুঁকি নিয়েকোন কাজ করেন নি। অথচ একবার যদি এই ঝুঁকি ঘটে যায় তা অপরিবর্তনীয়, তা ফেরানোর কোন উপায় থাকবে না। কাজেই এটা বলা যথেষ্ট নয় যে আবেদনকারী সংস্থা এর দায়-দায়িত্ব বহন করবে। এর দায়-দায়িত্ব অনুমোদন প্রদানকারী সংস্থার ওপরও পড়বে। সারা বিশ্বে এই সব বিষয় নিয়ে উদ্বিগ্নতা আছে বলেই জিএম ফসল সব দেশে প্রবর্তন করা সম্ভব হচ্ছে না। যেখানে হয়েছে সে সব দেশ নানা ধরণের ক্ষতির মুখে পড়েছে যা তারা আর ফেরাতে পারছে না। অথচ বাংলাদেশের মতো কৃষি প্রধান দেশে, যেখানে জীবন জীবিকা ও অর্থনীতিতে অবদান রাখার ক্ষেত্রে, কৃষকরাই সংখ্যা গরিষ্ট জনসংখ্যার অংশ তাদেরকে হুমকির মুখে ফেলে, ঝুঁকি আছে জেনেও অনুমোদন দেয়া হচ্ছে কার স্বার্থে? একবার অনুমোদন পেয়ে গেলে কোম্পানি দ্রুত তার মতো করে ব্যবহার করবে, সেখানে সরকারের কিছু করার থাকবে বলে মনে হয় না।
শর্ত নম্বর ছয় খুবই হাস্যকর। বাজারে যখন বিটি বেগুন বিক্রি হবে তার গায়ে কিভাবে লেবেন এটেঁ দেয়া হবে? বেগুনের গায়ে লাগানো লেবেল মানুষ কিভাবে দেখবে, বা দেখার বিষয় তাদের কি জানানো হবে? যদি না হয় তাহলে এই লেবেল লাগাবার শর্ত আরোপ করে অনুমোদনদাতারা নিজেদের দায় থেকে রক্ষার চেষ্টা করতে পারেন কিন্তু এর বাস্তবায়ন করে মানুষ কে বাঁচানো যাবে না।
আমরা মানুষের স্বাস্থ্য, পরিবেশ রক্ষা এবং স্থানীয় জাতের বেগুন রক্ষার জন্যে এখনো সরকারকে আহবান জানাচ্ছি বিটী বেগুনের এই অনুমোদন স্থগিত করুন, এবং দেশের মানুষকে সম্ভাব্য ক্ষতি থেকে বাঁচান।