জিএমও বিরোধী গণ মোর্চা, বাংলাদেশ || Wednesday 18 September 2013
বাংলাদেশে বেগুনের মতো সব্জি একেবারে সাধারণ মানুষের খাদ্য এবং পুষ্টির উৎস। বেগুন কৃষকের বাড়তি আয়ের সুযোগ করে দেয়। বাংলাদেশ বেগুনের শত শত জাতের আদি উৎপত্তিস্থল। সেইদেশে হঠাৎ বিনা কারণে পরিবেশ ও স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ জেনেটিকালী মডিফাইড বেগুন বা বিকৃত বেগুন কৃষক পর্যায়ে চাষের অনুমতি চাওয়ার যে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে তার কোন যুক্তি নাই। বাংলাদেশে এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানো হচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে। জিএমও বিরোধী গণমোর্চা ইতিমধ্যে এ বিষয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছে এবং পরিষ্কার বলেছে বাংলাদেশে এই ধরণের বিকৃত বেগুনের কোন প্রয়োজনীয়তাই নাই।
বাংলাদেশে ২০০৯-১০ সালের পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিশাব অনুযায়ী রবি এবং খরিফ মৌসুমে মোট ১১৫৪২৪ একর জমিতে ৩৪১২৬২ মেট্রিক টন বেগুন উৎপাদন করা হয়। এই সব্জি অত্যন্ত জনপ্রিয় এবং দেশে এবং বিদেশে এর চাহিদা রয়েছে। শুধু তাই নয় এই সব্জির মধ্যে রয়েছে প্রোটিন, শর্করা, খনিজ লবন, ভিটামিনসহ অনেক পুষ্টিগুণ ।
বিটি বেগুন একটি জিএমও। অর্থাৎ প্রাণের গঠন সংকেতে (Gene) বিকৃতি ঘটিয়ে এই বেগুন বানানো হয়েছে। বিকৃতি ঘটাতে সক্ষম প্রযুক্তি (Genetic Engineering) ব্যবহার করে আমাদের পরিচিত সব্জি বেগুনের গঠনে বিকার ঘটিয়ে এই ক্ষতিকর উদ্ভিদ তৈরী। ব্যাসিলাস থুরিনজেনসিস (বিটি) ব্যাকটেরিয়া থেকে ক্রিসটাল জিন বেগুনে সংযোজন করা হয়েছে। কিন্তু বেগুন তো অণুজীব নয় যে তার মধ্যে ব্যাক্টেরিয়ার জিন ঢুকাতে হবে। উদ্দেশ্য হিশেবে বলা হয়েছে বেগুনের ফল ও কাণ্ড ছিদ্রকারী পোকা প্রতিরোধ ক্ষমতা এতে বৃদ্ধি করা যাবে।
বাংলাদেশে দেশীয় বেগুন থাকতে বিটি বেগুনের দরকার আছে কি?
স্বাস্থ্য ও পরিবেশের বিপজ্জনক ঝুঁকি নিয়েই কি জেনেটিকালি মডিফাইড বিটি বেগুন ছাড় দেয়া হবে?
কৃষকের বেগুন বাজারজাতের ব্যবস্থা নাই কেন?
বিকৃতি ঘটানোর কাজে দুটো বীজ কোম্পানি জড়িত। ভারতের মহারাষ্ট্র হাইব্রিড বীজ কোম্পানি (মাহিকো) ও বহুজাতিক বীজ কোম্পানি মনসান্টো। মূলত এটি মনসান্টোর টেকনলজি। তাদের সহায়তায় মাহিকো বেগুনের জিন বিকৃতির এ কাজটি সম্পন্ন করে ২০০৫ সালে। একই সময় বাংলাদেশ ও ফিলিপাইনে বিটি বেগুন নিয়ে গবেষণা শুরু হয়। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটকে (বারি) এ কাজের সাথে যুক্ত করে নেওয়া হয়।
যদিও বিটি বেগুন গবেষণা একই সাথে তিনটি দেশে করা হয়েছে, কিন্তু দুটি দেশ ভারত ও ফিলিপাইনে এই বিকৃত বেগুন পরিবেশ ও স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণে কোন ছাড়পত্র দেয় নি। ভারতের পরিবেশ মন্ত্রণালয় বহুজাতিক কোম্পানি মনসান্তোর সহায়ক মাহিকোর বানানো বিটি বেগুন ছাড়ের উপর অনির্দিষ্ট কালের জন্য মরেটোরিয়াম বা নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। য়াসলে কোম্পানিগুলি কী করতে চাইছে আর তাদের দাবি ঠিক কিনা সেটা পরীক্ষার জন্য ভারতের সুপ্রিম কোর্ট একটি উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন প্যানেল নিযুক্ত করে। যার সঙ্গে বড় বড় বিজ্ঞানী ও পরিবেশবাদীরা যুক্ত ছিলেন। সেই প্যানেল সব দিক বিবেচনা করে অনির্দিষ্ট কালের জন্য জিএম ফসলের সব রকম মাঠ-পরীক্ষা বন্ধের সুপারিশ করেছে। অন্যদিকে গ্রীনপিস (দক্ষিণ পুর্ব এশিয়া) ফিলিপাইনের আদালতে একটি রিট আবেদন করে। আবেদনের প্রেক্ষিতে ফিলিপাইনের আদালত পরিবেশ ও প্রাকৃতিক সম্পদ বিভাগ এবং সংশ্লিষ্ট বিভাগকে বিটি বেগুনের মাঠ-পর্যায়ের গবেষণা বন্ধের জন্য আদেশ দিয়েছে। বহুজাতিক কোম্পানিগুলো ভারত ও ফিলিপাইনে ছাড়পত্র পেতে ব্যর্থ হয়ে এখন তাদের শেষ চেষ্টা চালাচ্ছে বাংলাদেশে।
জিএমও বিরোধী গণমোর্চার প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশে কী এমন গবেষণা ফলাফল বের হোল যে ভারত ও ফিলিপাইনে পরিবেশ ও স্বাস্থ্য ঝুঁকির যে মীমাংসা হয় নি এবং আদালত যেখানে এই ধরণের বিকৃত বেগুনের ছাড়পত্র দেয় নি সেখানে বাংলাদেশে তা দেওয়া যাবে? কিভাবে শুধু বাংলাদেশেই স্বাস্থ্য ও পরিবেশ ঝুঁকির বিপজ্জনক প্রশ্নের মীমাংসা গুটিকয়েক বারির বিজ্ঞানী করে ফেললেন? তারা কিভাবে সেটা করেছেন, তার পদ্ধতি, প্রকরণ ও সিদ্ধান্ত নেবার ধরণ তারা আগে প্রকাশ না করেই মাঠ পর্যায়ে বিকৃত বেগুন ছাড়বার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠেছেন কেন? তাছাড়া তারা কি জানেন না যে কৃষকের উৎপাদিত প্রচুর দেশীয় জাতের পুষ্টিকর ও সুস্বাদু বেগুন রয়েছে এবং তাদের উৎপাদনও হয় প্রচুর। অথচ সরবরাহ নিশ্চিত না থাকায় এলাকায় কৃষকরা দাম পান না। দাম না পাওয়ার এই মূল সমস্যা সহ রয়েছে আরও নানান আর্থ-সামাজিক প্রশ্ন। বেগুনের উৎপাদন সমস্যা নয়, সমস্যা তার বাজারজাত করনের। তাছাড়া বারির বিজ্ঞানীরাই বলেন, পোকা লাগে হাইব্রিড বেগুনে, দেশীয় জাতের বেগুনে না। অথচ বাংলাদেশের অস্থির রাজনৈতিক পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে এবং জনণের সাথে মতামত নেয়ার বিষয়টি গুরুত্ব না দিয়ে তড়িঘড়ি ছাড়পত্র দেবার এই অতিরিক্ত আগ্রহ কেন? এতে শুধু বহুজাতিক কোম্পানির স্বার্থ রক্ষা করা হচ্ছে। আর বাংলাদেশকে নিক্ষেপ করা হচ্ছে ভয়ানক পরিবেশ ও স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে। বহুজাতিক কোম্পানির স্বার্থে বাংলাদেশের কৃষকদের দিয়ে চাষ করিয়ে আর ভোক্তাদের বিকৃত বেগুন খাইয়ে গিনিপিগ হিশেবে ব্যবহার করবার এই চেষ্টা শুধু ভীতিকর নয়, অপরাধের পর্যায়েই পড়ে। এর দায় কি এইসব বিজ্ঞানীদের নিতে হবে না?
জাতীয় দৈনিক দ্যা ডেইলি ষ্টার (১৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৩) তারিখে প্রকাশিত “Modified Brinjal Found Okay” প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে দেশের প্রথম জিএম ফসল বিটি বেগুনের সকল বৈজ্ঞানিক গবেষণা ফলাফল ঠিক আছে এবং তাঁরা কৃষি মন্ত্রণালয়ে তাদের পর্যালোচনা প্রতিবেদন পাঠাবার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। কৃষি সচিবের নেতৃত্বে গঠিত National Technical Committee for Crop Biotechnology (NTCCB) বিশেষজ্ঞ কমিটির প্রতিবেদন দেখবেন এবং চুড়ান্ত অনুমোদনের জন্য পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের অধীনে National Committee on Biosafety (NCB) এর কাছে পাঠাবেন। এ ব্যপারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেও অবহিত করা হয়েছে। জাতীয় কমিটির কাছে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বারি) গত ১৫ জুলাই অনুমোদনের আবেদন করেন। উল্লেখ্য, নয়টি স্থানীয় বেগুনের জাত বিটি বেগুন উদ্ভাবন কাজে ব্যবহার করা হয়েছে। এর মধ্যে চারটি বেগুনের জাত উত্তরা বেগুন, কাজলা বেগুন, খটখটি বেগুন এবং চট্টগ্রামের দোহাজারী বেগুনে বিটি সংযোজন করা হয়েছে এবং এই বিটি বেগুনের বীজ ছাড় করানোর লক্ষ্যে অনুমোদনের জন্য কৃষি মন্ত্রণালয়ের কাছে আবেদন করা হয়েছে। এই বিটি প্রযুক্তির মালিক মনসান্তো-মাহিকো কোম্পানি। তাদের প্রযুক্তি ব্যবহার করে নতুন যে বিটি জাত তৈরি হবে তার মালিকানা কোম্পানিরই থাকবে। ইতিমধ্যে মাহিকো এই বীজের ওপর পেটেন্টের আবেদন করেছে। অর্থাৎ পেটেন্ট পাওয়া বীজ কোম্পানির কাছ থেকেই কৃষককে চড়া দামে কিনতে হবে, যে দাম কোম্পানি নিজেই নির্ধারণ করবে। অথচ এই বেগুনগুলো এখন কৃষকদের নিয়ন্ত্রণেই আছে। তাদের কারও মুখাপেক্ষি হতে হয় না। এখানে প্রশ্ন তোলা যেতে পারে যে বহুজাতিক কোম্পানির অর্থে পরিচালিত এই দেশীয় জাতের বীজে কোম্পানির পেটেন্ট করা টেকনলজি ব্যবহার করার অধিকার বাংলাদেশের কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বারি)কে কে দিয়েছে? এই বীজ কৃষকের সম্পদ যা জাতীয় বীজ সম্পদ রক্ষণাগার হিসেবে বারিতে সংরক্ষিত আছে। অর্থাৎ বারি এই বীজের মালিক নয়। অথচ কৃষকের বীজ বিকৃত করে আবার কৃষকের কাছেই বিক্রির ব্যবস্থা করা হচ্ছে! এই ঘটনা কৃষকের সার্বভৌম অধিকার হরণের শামিল। সকল রাজনৈতিক দল এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলীর প্রতি মনোযোগ দেয়া প্রয়োজন। এখানে শুধু টেকনলজির প্রশ্নই জড়িত নয়, প্রাণ সম্পদের ওপর দেশের জনগণের সার্বভৌম অধিকারের প্রশ্ন জড়িত। দেশের কৃষক সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠির অংশ। তারাই নির্বাচনে ভোট দিয়ে সরকার গঠনে ভুমিকা রাখেন। কৃষকের অধিকার হরণ করার কোন উদ্যোগ তারা মেনে নেবে না। যে দল এখন ক্ষমতায় আছে এবং যারা আগামিতে ক্ষমতায় আসবেন, এবং জাতীয় সংসদে জন প্রতিনিধি হয়ে যাবেন, সকলকেই কৃষকের স্বার্থ বিরোধী কাজ যেন না হয় সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে ।
ডেইলি ষ্টারের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিটি বেগুনের পুষ্টিমান নিয়ে পরিক্ষা করা হয়েছে, এবং এর বিষাক্ততার পরীক্ষা toxicological test করা হয়েছে ভারতের ল্যবরটরীতে। তার অর্থ এই যে বেগুন খাওয়ার কারণে মানবদেহে স্বাস্থ্য ঝুঁকি আছে কিনা এমন কোন পরীক্ষা বাংলাদেশে করা হয় নি। প্রশ্ন হচ্ছে ভারতে কি স্বাধীন কোন ল্যবরটরীতে পরীক্ষা করা হয়েছে নাকি মাহিকো কোম্পানির ল্যবরটরীতে করা হয়েছে? অথচ ভারতের গবেষণায় এই মাহিকো কোম্পানির দেয়া স্বাস্থ্য গবেষণা প্রতিবেদন নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, এবং ভারতের সরকার স্বীকার করেছেন যে বিটি বেগুনের নিরাপত্তা স্বাস্থ্য নিয়ে প্রশ্ন আছে এবং তাঁরা কোম্পানির বাইরে স্বাধীনভাবে গবেষণার জন্যে নির্দেশ দিয়েছেন। ভারতে এখনো সেই প্রশ্নের মীমাংসা হয় নি। তাহলে ভারতের ল্যাবরেটরীতে পরীক্ষা করে বাংলাদেশের জন্যে বিকৃত বেগুন নিরাপদ — এই কথা কেমন করে মেনে নেয়া যায়? বাংলাদেশ সরকার কি এই তথ্যের ওপর ভিত্তি করে ছাড় পত্র দিতে পারেন?
বিকৃত বেগুনের সুদুর প্রসারী পরিবেশ ও স্বাস্থ্য ঝুঁকি সম্পর্কে আন্তর্জাতিকভাবে উৎকন্ঠা প্রকাশ করা হয়েছে।এগারো জন আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন বিজ্ঞানী আমাদের প্রধানমন্ত্রীর কাছে চিঠি লিখে অনুরোধ জানিয়েছেন ব্যাপক চাষাবাদের অনুমোদন না দেয়ার জন্যে, কারণ এর পরিবেশ ও স্বাস্থ্য ঝুঁকি এমন যে একবার ঘটা শুরু করলে তা প্রতিরোধ বা বন্ধ করবার কোন উপায় বিজ্ঞানীদের এখনো জানা নাই। এই কারণেই বিকৃত বেগুন ভারত ও ফিলিপাইনে অনুমোদন পায় নি। অথচ বাংলাদেশে ছাড় দিলে এই বেগুন রপ্তানি হয়ে অন্য দেশে যাবে এবং ভোক্তাদের স্বাস্থ্যের ক্ষতি করতে পারে। বেগুন দেশে বিদেশে সাধারণ মানুষের সব্জি। বাংলাদেশের মতো ঘন বসতি পুর্ণ দেশে বিটি বেগুন বাজারে ছাড়লে তার ক্ষতি ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা আছে। অথচ এসব বিষয় সম্পর্কে নিশ্চিত না হয়েই দেশের বিশাল জনগোষ্টির মধ্যে ছেড়ে দেয়া হচ্ছে, যা বড় বিপদ ডেকে আনতে পারে। বিটি বেগুন খাওয়ার ফলে এলার্জী, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নষ্ট হওয়া, লিভারের ক্ষতিসহ সুদুর প্রসারী স্বাস্থ্য ঝুঁকির সম্ভাবনা আছে বলে আন্তর্জাতিকভাবে বিজ্ঞানীরা প্রাণি গবেষণায় জেনেছেন।
বাংলাদেশে এই গবেষণা পরিচালিত হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক সহায়তায় দেয়া প্রকল্প ABSP-II এবং মনসান্তোর সাথে সরাসরি সম্পর্কিত Cornell University এর তত্ত্বাবধানে। এখানে বিজ্ঞানীরা স্বাধীন ভাবে গবেষণা করছেন না। তাহলে এখানে বিজ্ঞানীরা কিভাবে এতো সহজভাবে কোন ক্ষতি নেই বলে দিচ্ছেন? যেখানে অন্য দেশের সরকার এই সব কোম্পানি স্বার্থ প্রোণোদিত দাবিকে কোন মূল্য দেন নি। তাছা পরে যদি ক্ষতি ধরা পড়ে তার দায় দায়িত্ব কে নেবে? যে কারণে ভারত এবং ফিলিপাইন সরকার এই কাজ থেকে বিরত থেকেছেন, বাংলাদেশ সরকার কেন জনগণের স্বাস্থ্যের কথা বিবেচনায় আনবেন না?
বিটি বেগুনের পক্ষে যুক্তি হিশেবে দেখানো হচ্ছে যে ডগা ও ফল ছিদ্রকারি পোকার কারণে ৫০ থেকে ৭০% বেগুনের ফসল নষ্ট হয়ে যায়। এবং তাই কৃষকরা এক মৌসুমে ৮০ বার কীটনাশক প্রয়োগ করে যার কারণে বেগুন বিষাক্ত হয়ে যায় বলে ডেইলি ষ্টারের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এই তথ্যের পক্ষে কোন প্রমান দেয়া হয় নি। যেসব স্থানীয় জাতের বেগুন নিয়ে বিটি করা হয়েছে সেগুলোর মধ্যে এই পোকার আক্রমণ তেমন তীব্র নয়। বারির নিজস্ব গবেষণায় দেখা গেছে স্থানীয় জাতের বেগুনে পোকার আক্রমণ খুব কম হয়। যেমন ঝুমকি বেগুনে পোকা খুবই কম লাগে, মাত্র ১-১০% (Highly Resistant) খটখটিয়াও মোটামুটি কম লাগে, ২০% (Fairly Resistant)।কিছু বেগুন যেমন ইসলামপুরি ২১- ৩০% পোকার সম্ভাবনা আছে (Tolerant) এবং ইরি বেগুন একটু বেশী লাগে ৪১% এর বেশী।
বেগুনে শুধু একধরনের পোকার আক্রমণ হয় না, যদিও ডগা ও ফল ছিদ্রকারি পোকার আক্রমনকেই সবচেয়ে বেশী ক্ষতিকর হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। বিটি করার কারণে শুধু ডগা ও ফল ছিদ্রকারি পোকার আক্রমণ বন্ধ করা যাবে, অন্য পোকার আক্রমণ ঠিকই থাকবে। অথচ এই সব পোকার ব্যবস্থাপনা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত এবং জাতি সংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা কর্তৃক অনুমোদিত সম্বন্বিত কীট ব্যবস্থাপনা (Integrated Pest Management) বা আইপিএম পদ্ধতিতে রোধ করা সম্ভব এবং এতে কোন প্রকার স্বাস্থ্য ও পরিবেশ ঝুঁকি নেই। ইতিমধ্যে আন্তর্জাতিক খ্যাতিমান কীটতত্ত্ববিদ যুক্তরাষ্ট্রের মিনেসোটা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডেভিড এন্ডো মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে চিঠিতে জানিয়েছেন যে আইপিএম পদ্ধতি ব্যবহার করে ক্ষুদ্র কৃষকদের উৎপাদনশীলতা বাড়ানো সম্ভব। আইপিএম ইতিমধ্যে কৃষক পর্যায়ে ব্যবহার করে ভাল ফল পাওয়া গেছে। তাহলে কৃষকের প্রতি সরকারের দরদ থাকলে তাদের উচিত সমন্বিত কীট ব্যবস্থাপনার ওপর জোর দেওয়া, বিকৃত বেগুন প্রবর্তন করা নয়। তাছাড়া বিটি প্রযুক্তি ব্যবহারে কীট প্রতিরোধক হয়ে উঠতে পারে, যা বিপজ্জনক। লাভ দূরে থাকুক কৃষকের পথে বসার সম্ভাবনা।
ডেইলি ষ্টারের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে বারির মহা পরিচালক ও কৃষি মন্ত্রী জানিয়েছেন যে কৃষক বীজ রাখতে পারবে, কারণ এই প্রযুক্তি হাইব্রিড বেগুনের ওপর করা হয় নি,স্থানীয় জাতের ওপর করা হয়েছে। অতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহারের যে পরিসংখ্যান দেয়া হয় তা উচ্চ ফলন শীল এবং হাইব্রীড বেগুনের ক্ষেত্রেই করা হয়, স্থানীয় জাতে রোগ বালাই কম হয়, কীটনাশকও দিতে হয় না। সেদিক থেকে দেখতে গেলে বিটি বেগুনের আদৌ কোন প্রয়োজন ছিল না, হাইব্রিড বেগুনের চাষ বন্ধ করে দিলেই হোত। প্রায় তিন লক্ষ মেট্রিক টন বেগুন শুধু হাইব্রীড বেগুন থেকে হয় না, সারা দেশে বিভিন্ন ভৌগলিক অবস্থায় স্থানীয় জাতের বেগুন দিয়েই হয়। স্থানীয় জাতের বেগুনের চাহিদাই বেশী।
স্থানীয় জাতের বেগুনকে বিকৃত করে বিটি বেগুন করার কারনে বীজ রক্ষা করতে পারলেও ফলন ঠিক মতো পেতে হলে প্রতি বছর কোম্পানির কাছ থেকেই বীজ কিনতে হবে । এর মাধ্যমে কোম্পানি দেশের একটি গুরুত্বপুর্ণ সব্জির ওপর তার কর্তৃত্ব স্থাপন করতে পারবে, যা ক্রমে আমাদের খাদ্য ব্যবস্থার ওপর আগ্রাসী হয়ে উঠবে।
আমরা আশা করবো যে পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের অধীনে বায়োসেফটি কমিটি পরিবেশের ক্ষতির দিক বিবেচনায় রাখবেন।
জিএমও বিরোধী গণমোর্চার দাবী:
১. ফিলিপাইন ও ভারতের আদালতের সিদ্ধান্ত অনুসরণ করে অবিলম্বে বিটি বেগুন ছাড়ের প্রক্রিয়া বন্ধ করতে হবে।
২. বারির বিটি বেগুনের গবেষণা প্রতিবেদন অবিলম্বে জনসমক্ষে হাজির করা হোক যাতে গবেষণার মান ও ফলাফল সম্পর্কে নিরপেক্ষ পর্যালোচনা করা সম্ভব হয়।
৩. বিটি বেগুনের স্বাস্থ্য ও পরিবেশ ঝুঁকির বিষয়ে অন্য দুটি দেশের স্বাধীন বিজ্ঞানী, স্বাস্থ্য ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে মতবিনিময় করা হোক।
৪. বেগুনের পোকার সমস্যা সমাধানের জন্য সমন্বিত কীট ব্যবস্থাপনা (IPM) জোরদার করা হোক।
৫. বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা যেন স্বাধীন ভাবে গবেষণা করতে পারেন তার জন্য প্রয়োজনীয় জাতীয় তহবিল গঠন করা হোক।
৬. কৃষক এবং ভোক্তাদের ক্ষতি হয় এমন কোন উদ্যোগ যেন নেয়া না হয় তা নিশ্চিত করা হোক।
… … … … …
সম্প্রতি গঠিত জিএমও বিরোধী গণমোর্চা জাতীয় প্রেস ক্লাবে বিটিবেগুন অনুমোদন প্রক্রিয়া বন্ধ করবার দাবি জানিয়ে যে সংবাদ সম্মেলন করে তার ভিত্তিতে এই প্রতিবেদনটি তৈরী হয়েছে।
অন্যন্য প্রাসঙ্গিক লেখাঃ