উবিনীগ || Tuesday 18 September 2012
কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরি ২০০৯ সালে উগান্ডা থেকে নেরিকা নামে একটি ধানের জাত নিয়ে আসেন। এই ধানের জাতটি আন্তর্জাতিক উদ্যোগে আফ্রিকার জন্যই উদ্ভাবন করা হয়েছিল। এর গবেষণার জন্য যেমন বিপুল পরিমান অর্থ খরচ করা হয়, তেমন তার সাফল্য প্রচারের পেছনেও অর্থ খরচ করা হয় প্রচুর। বেশ কয়েকটি ধনি দেশ, আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থা, গবেষণা প্রতিষ্ঠান এবং বহুজাতিক বীজ কোম্পানি মিলে আফ্রিকায় নেরিকার সাফল্য প্রমাণ করতে ব্যস্ত। এই সাফল্যের দাবি নিয়ে সন্দেহ ছিল শুরু থেকেই। কিন্তু আফ্রিকার খাদ্য সমস্যার সমাধানের কথা বলে সে সকল সন্দেহকে উড়িয়ে দেওয়া হয়। এর সঙ্গে যুক্ত হয় নতুন অজুহাত। যেমন, জলবায়ুর পরিবর্তন। নেরিকা ধানের জাতে বিভিন্ন সমস্যার দিক তো রয়েছেই তবে আফ্রিকায় নেরিকা ধান প্রবর্তনের যারা বিরোধিতা করছেন তারা বিশেষভাবে বলছেন যে বিপুল অর্থ খরচ করে আসলে কোম্পানির আধিপত্য প্রতিষ্ঠাই এই ধানের জাত প্রবর্তনের প্রধান উদ্দেশ্য। এতে আফ্রিকার কৃষি ব্যবস্থা ধ্বংস হবে এবং বীজের জন্য আফ্রিকার কৃষককে নির্ভর করতে হবে বীজ কোম্পানির ওপর।
ধানের মহাদেশ হচ্ছে এশিয়া। পৃথিবীর ৯০% ধান এশিয়া মহাদেশেই উৎপন্ন হয়। এই মহাদেশের মানুষের প্রধান খাদ্য ভাত। তাই এখানে ধানের বৈচিত্র থাকাটা আশ্চর্যের ব্যাপার নয়। ধানের বৈচিত্রের দিক থেকে বাংলাদেশ এশিয়ার অন্যতম বিখ্যাত দেশ। সেই দিক থেকে দেখলে আফ্রিকার ধান বাংলাদেশে প্রবর্তনের চিন্তাটাই কেমন যেন গোলমেলে। আফ্রিকার জন্য উদ্ভাবিত ধান বাংলাদেশে প্রবর্তনের বিশেষ কোন যুক্তি সরকার বা বিজ্ঞানিরা দিয়েছেন বলে জানা যায় নি। এ নিয়ে বাংলাদেশে কোন বৈজ্ঞানিক গবেষণার কথাও শোনা যায় নি। নতুন কোন জাত প্রবর্তন করতে হলে পরিবেশ ও প্রাণবৈচিত্রের ওপর তার প্রতিক্রিয়া বা প্রভাব মূল্যায়নের জন্য আন্তর্জাতিক প্রাণবৈচিত্র চুক্তি অনুযায়ী যে মূল্যায়নের বাধ্যবাধকতা আছে সেটাও মানা হয় নি। বা হলেও তার ফলাফল প্রকাশ করা হয় নি যা নিয়ে আলোচনা হতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশ এগ্রিকালচারাল ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশান (বিএডিসি) এই বছর (২০১২) আউশ মৌসুমে ৩০টি জেলার ৮৩টি উপজেলায় ৩৭, ০০০ কৃষকের কাছে বাংলাদেশে প্রথম বারের মত এই ধানের ৩০০ টন বীজ বিতরণ করবার পরিকল্পনা গ্রহন করে। বলা হয়েছে এটা ‘পরীক্ষামূলক’। কিন্তু কোন অর্থে ‘পরীক্ষা’ সেটা তারা খুলে না বললেও, এটা বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা নয়, বরং কৃষক এই ধান আদৌ গ্রহণ করে কিনা এটা ছিল তারই পরীক্ষা। অর্থাৎ এই ‘পরীক্ষা’ আসলে বাজারজাতকরণের প্রাথমিক উদ্যোগ ছাড়া আর কিছু নয়। কৃষি কর্মকর্তারা দাবি করেছিলেন ৮৩টি উপজেলায় এই জাত বপন করলে ১৮,০০০ থেকে ২০,০০০ হাজার টন বেশি ধান উৎপাদিত হবে। তাঁরা দাবি করেছেন আউশ ধানে যেখানে তিন থেকে চার মাস লাগে সেখানে নেরিকা ধান ৯০ দিনেই (তিন মাসেই) ঘরে উঠবে। অর্থাৎ এক মাস সময় কম লাগবে। এবং কৃষকরা চাইলে আমন ও বোরো মৌসুমেও এই ধান ব্যাপক ভাবে বিতরণের ব্যবস্থা করা হবে।
কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরি বলেছিলেন, “কৃষকরা এই ধান গ্রহণ করে কিনা আমরা সেই পরীক্ষা (adaptive trial) করব এবং ৫ টন ধান থেকে ১০০ টন বীজ উৎপাদন করে উৎপাদকদের মধ্যে এই জাত জনপ্রিয় করে তুলব যাতে আউশের উৎপাদন বাড়ানো যায়। নেরিকা ধান লাগিয়ে আমরা যদি আউশ মৌসুমে চল্লিশ লক্ষ টন ধান পাই তাতে আমি অবাক হব না” (‘Plans to nearly triple Aus production with newly imported seed; agriculture minister upbeat amid rice-import spree’, Daily Star, 19 February 2011)।
আমদানি করা আফ্রিকার ধান চাষ করে কৃষকরা ভয়ানক বিপাকে পড়ে যায়। কৃষকদের এই বলে প্রলোভিত করা হয় যে এই ধানের জাতের মেয়াদকাল ৯০ থেকে ১০০ দিন, আর তার শিষ ৬০ দিনেই নাকি চলে আসে। সেটা হয় নি। হওয়া তো দূরের কথা, ধান ক্ষেত উলটা আগাছায় ভরে গিয়েছে। এই জাতে যে প্রচুর আগাছা হয় এটা বিজ্ঞানিদের জানা ছিল, কিন্তু কৃষকদের সেটা বলা হয় নি। বলা হয়েছিল এই জাত খরা, রোগ বালাই ও পোকামাকড় সহিষ্ণু। অথচ মাঠের পর মাঠ আক্রান্ত হয়েছে পোকা মাকড়ে।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব আনওয়ার ফারুক, যিনি একই সঙ্গে কৃষি মন্ত্রণালয়ে বীজ বিভাগের ডিরেক্টর জেনারেল, বলেছিলেন যে দুর্যোগ আক্রান্ত এলাকার জন্য এই জাত উপযোগী। বিশেষত হাওর এলাকা ও বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের জন্য। বলাবাহুল্য, এই দুটি অঞ্চলই প্রাণবৈচিত্রের দিক থেকে খুবই সমৃদ্ধ। বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার কাছে তারা দাবি করেছিলেন খাদ্য নিরাপত্তা ও দারিদ্র বিমোচনের ক্ষেত্রে এই ধান ভূমিকা রাখবে।
জলবায়ুর পরিবর্তনের দোহাই দিয়ে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশানের চেয়ারমেন ড.এস এম নাজমুল ইসলাম দাবি করেছেন এই ধানের জাত প্রাকৃতিক দুর্যোগে্র কারনে ফসল হানি থেকে কৃষকদের রক্ষা করবে। এই কারনেই নাকি সরকার নেরিকা ধান বাংলাদেশে প্রবর্তনের সিদ্ধান্ত গ্রহন করেছে। কিন্তু বাংলাদেশে কোন্ গবেষণার ভিত্তিতে তারা এই দাবি করেছেন এই ধান সম্পর্কে বলবার সময় সাংবাদিকদের কাছে তার কোন সূত্র উল্লেখ করেন নি। ( তথ্যসূত্রঃ ‘The Government Pins Hope on Super Rice, The Daily Star 19 February 2012; BADC to distribute Nerica rice seed among 37,000 farmers, News Today, 31 March 2012; Drought-tolerant rice to go for a try-out, The Daily Star, 24 April 2012)
‘নেরিকা’ নামটি ইংরাজি থেকে তৈরি: নিউ রাইস ফর আফ্রিকা অর্থাৎ আফ্রিকার জন্য নতুন ধান। আফ্রিকা ধানের দেশ হিসেবে খুব পরিচিত নয় বলেই সম্ভবত ‘নিউ রাইস’ কথাটি বানানো হয়েছে। তবে আফ্রিকায় ধান হয় না তা নয়। প্রায় তিন হাজার বছরের আগে থেকেই আফ্রিকার মানুষ ধানকে তাদের কৃষিব্যবস্থার অন্তর্গত করেছে। ধানের যে দুটো প্রধান জাত রয়েছে সম্ভবত দুটোই শুরু থেকেই আবাদের অন্তর্গত হয়েছিল, তবে আফ্রিকায় যে জাতটি প্রধান স্থান দখল করে সেটির বৈজ্ঞানিক নাম ওরাইজা গ্লাবেরিমা (Oryza glaberrima) । যদিও ঔপনিবেশিক ইতিহাসের দোহাই দিয়ে বলা হয় আফ্রিকায় প্রায় পাঁচ শত বছর আগে পর্তুগিজরা এশিয়ার ধান ওরাইজা সেটিভা (Oryza sativa) আফ্রিকা মহাদেশে প্রবর্তন করে (Linares, O.F. African Rice (Oryza glaberrima), History and Future Potential, Smithsonian Tropical Research Institute, Panama 2002.)। তখন থেকে ধানের বিশ্বে ওরাইজা গ্লাবেরিমা এবং ওরাইজা সেটিভা নামক প্রজাতি দুটির আবাদ উত্তরে ভূমধ্যসাগর থেকে দক্ষিণে উত্তমাশা অন্তরীপ, পূর্বে আরব সাগর ও ভারত মহাসাগর এবং পশ্চিমে আটলান্টিক মহাসাগর পর্যন্ত বিস্তীর্ণ অঞ্চলে প্রজাতি দুটির আবাদ চলে আসছে।
নেরিকার বৈশিষ্ট হচ্ছে এটি আফ্রিকার ধানের (Oryza glaberrima) সঙ্গে এশিয়ার ধানের (Oryza sativa) সংকর। অর্থাৎ এই ক্ষেত্রে একই গণের (genus) অন্তর্গত দুটো প্রজাতির (species) সংকরায়ন ঘটানো হয়। বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তির দিক থেকে দেখলে সাধারণত এই ধরনের সংকরায়নে যা জাত তৈরি হয় তার পুনরুৎপাদনের শক্তি বা বীজের ভূমিকা পালনের ক্ষমতা থাকে না। এই সমস্যা সমাধানের প্রথম বারের সংকরায়ন থেকে পাওয়া জাতটিকে পেছনে এসে ওরাইজা সাটিভার সঙ্গে আবার সংকরায়ন করা হয়। প্রজননের এই বিশেষ পদ্ধতির জন্য নেরিকাকে প্রজাতির মধ্যে সংকরায়ন থেকে জাত হাইব্রিড (Interspecific hybrid) বলা হয়। হাইব্রিড বলতে আমরা সাধারণত যা বুঝি এই হাইব্রিড ঠিক সেই রকম নয়। এই পদ্ধতিতে বায়োটেকনলজি বা জৈবপ্রযুক্তির ব্যবহার আছে, কিন্তু নেরিকা জিএমও নয়।
আফ্রিকা রাইস সেন্টার বা ওয়েষ্ট আফ্রিকান রাইস ডেভলপমেন্ট এসোসিয়েশন
আফ্রিকা রাইস সেন্টার বা ওয়েষ্ট আফ্রিকান রাইস ডেভলপমেন্ট এসোসিয়েশন এ নতুন প্রজাতিটি উদ্ভাবন করে। সাবেক WARDA (বর্তমান African Rice Center) পশ্চিম আফ্রিকার ১১টি দেশ মিলিতভাবে ১৯৭১ সালে সিয়েরা লিওনে এ প্রতিষ্ঠানটি স্থাপন করে। সিয়েরা লিওনে গৃহযুদ্ধ শুরু হলে ১৯৮৬ সালে প্রতিষ্ঠানটি আইভরি কোষ্টের বুয়াকে শহরে স্থানন্তরিত হয়। আইভরি কোষ্টের গৃহযুদ্ধের সময় ২০০২ সালে প্রতিষ্ঠানটি বেনিনের রাজধানী কটনু শহরে স্থানান্তরিত হয়। আফ্রিকান ডেভলপমেন্ট ব্যাংক,জাপান সরকার এবং ইউনাইটেড ন্যাশন ডেভলাপমেন্ট ফান্ড-এর আর্থিক সহায়তায় এ প্রতিষ্ঠানটি পরিচালিত হয়। প্রাথমিক অবস্থায় পশ্চিম আফ্রিকার ১১টি দেশ এ সংস্থার সদস্য ছিল। বর্তমানে আফ্রিকার ২৪টি দেশ এ সংস্থার সদস্য। আফ্রিকা রাইচ সেন্টার ইউএনও পরিচালিত কনসালটেটিভ গ্রুপ অব ইন্টারন্যাশনাল এগ্রিকালচার রিসার্চ (CGIAR) এর ১৬টি সংস্থার মধ্যে ১৫ তম সংস্থা। বোঝাই যাচ্ছে,এই ধান কোন কৃষকের নয়,এর সাথে জড়িত রয়েছে কৃষিতে নিয়োজিত বহুজাতিক কোম্পানির স্বার্থ।
আফ্রিকার রাইচ সেন্টার থেকে এ পযর্ন্ত প্রায় ৩০০০ নেরিকা জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে। যার মধ্যে ১১টি জাত আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে কৃষকদের মধ্যে অংশিদারিত্বমূলক জাত বাছাই (Participatory Plant Selection) প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ছাড় করা হয়েছে (তথ্য সূত্রঃ site resources.worldbank.org/AFRICAEXT/R…)। ড. মন্টি জোনস,শিয়েরা লিওনের উদ্ভিদ বিজ্ঞানীকে নেরিকা ধান উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে উল্লখযোগ্য অবদানের জন্য ২০০৪ সালে সম্মানজনক ওয়ার্লড ফুড প্রাইজ প্রদান করা হয়। প্রফেসর উয়ান লংপিং যিনি ১৯৭০ সালে সর্ব প্রথম চীনে হাইব্রিড ধান উদ্ভাবন করেন তার সাথে ড. জোনস ২,৫০,০০০ মার্কিন ডলার ভাগাভাগি করে নেন। উল্লেখ্য ১৯৮৭ সালে প্রফেসর এম.এস. স্বামিনাথনকে ভারতে উচ্চ ফলনশীল ধান ও গমের জাত উদ্ভাবনের জন্য এ সম্মানে ভূষিত করা হয়।
বাংলাদেশে নেরিকা
মাঠ পর্যায় উবিনীগের গবেষণায় চাঁপাই নবাবগঞ্জ,নাটোর ও কুষ্টিয়া জেলায় বিভিন্ন কৃষকের সাথে আলাপের মাধ্যমে এবং মাঠ পরিদর্শনে দেখা যায় যে, কোন একটি প্লটেও নেরিকা ধানের আশানুরূপ ফলন হয় নি। ফলে কৃষকরা হতাশ। শুধু তাই নয়,কৃষকদের মধ্যে সরকারীভাবে সরবরাহ করা এই ধান বীজের প্রতি প্রচণ্ড অবিশ্বাস সৃষ্টি হয়েছে। সরেজমিন মাঠ পরিদর্শনের কিছু নজির এখানে তুলে ধরা হলো-
নাটোর:
নাটোরের বড়াইগ্রাম থানার,চাঁন্দাই ইউনিয়নে রিলিফ স্বরূপ ইউনিয়ন পরিষদের সদস্যদের মাধ্যমে চাঁন্দাই ইউনিয়নের ৯টি ওর্য়াডে ৬০ জন গরিব কৃষকদের সরকারি পক্ষ থেকে এই নেরিকা ১০ জাতের বীজ দেওয়া হয়েছে। রাজেন্দ্রপুর গ্রামে ৬জন কৃষক এই নেরিকা জাতের বীজ নিয়েছে। এই গ্রামের কৃষকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে নেরিকা বীজ প্যাকেজ হিশেবে দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ শুধু বীজ নয়, তার সঙ্গে রাসায়নিক সার ব্যবহারের জন্য সারও সরবরাহ করা হয়েছে। এই প্যাকেজে ছিল:
নেরিকা ধানের বীজ; ৮ কেজি, ইউরিয়া সার: ১৬ কেজি, টি এস পি: ১০ কেজি, পটাশ: ১০ কেজি এবং ১ টি নির্দেশিকা বই।
কৃষক আফাজ উদ্দিন জানান, এই বীজ বিতরন করা হয়েছিল চৈত্র মাসের মাঝামাঝিতে। বিতরনের সময় স্থানীয় ইউ পি সদস্য তাইজুল বলেছিলেন, এই জাতটি মূলত আউশে করে তবে ৩টি মৌসুমেই করা যাবে। এই জাতটি উচ্চ ফলনশীল জাত, এবং এই জাতের বীজও রাখা যায়। আউশ মৌসুমের ধানের স্থানীয় জাতের মতই নেরিকা ধানের জাতের আবাদ করা যায়। এই ধান বপন থেকে কর্তন পর্যন্ত সময় লাগবে ৯০ থেকে ১০০ দিন। বিতরন করা ৮ কেজি ধানের বীজ একক ভাবে ৩৩ শতক জমিতে অথবা আমনের সাথে মিশ্র ভাবেও করা যায়। এছাড়া নেরিকা ধানের জাতে রোগ-বালাই ও পোকা-মাকড়ের আক্রমণ কম এবং প্রতি ৩৩ শতকে একক হলে ৩৭৩ থেকে ৪৪৮.০০ কেজি হবে আর মিশ্র ভাবে করলে ১৪৯.৩০ থেকে ২২৪.০০ কেজি ফলন হবে। নেরিকার পক্ষে এতো ভাল গুন গান শুনে কৃষকরা নেরিকা ধানের আবাদ শুরু করেন। পক্ষান্তরে স্থানীয় জাতের ধানের বিঘা প্রতি (৩৩ শতক) গড় ফলন ১৯১ কেজি, উফশী জাতের ধানের বিঘা প্রতি গড় ফলন ৩৮০ কেজি। সূত্রঃ বিবিএস ২০১০ এবং হাইব্রিড ধানের বিঘা প্রতি ফলন ৭৩৫ কেজি
(সূত্রঃ www.unapcaem.org/Activities/A1112sanya/bd.pdf)
কৃষকদের কাছে কৌতুহলের বিষয় হচ্ছে কেন নেরিকা ধানের বীজ ৬০ জন কৃষককে চাঁন্দাই ইউনিয়নে রিলিফ হিশাবে দেওয়া হয়েছে? এর আগে তো রিলিফ হিশেবে ধানের বীজ দেয়া হয় নি।
রাজেন্দ্রপুর চন্দ্রগাছি বিলের কৃষক শুকুর আলীর কাছে জানা গেছে নতুন তথ্য। তিনি বলেন,বৈশাখের ১৫ তারিখে (বঙ্গাব্দ) নেরিকা জাতের বীজ বপন করার পর ৯২ দিন পরে ১৩ শ্রাবন তারিখে এখনও প্রতি গাছে কাইস থোড় (ধানের শিষ বের হবার পূর্বাবস্থা ) আসেনি। কিন্তু ব্লক সুপারভিজারের কথা অনুসারে এ ধান বপন থেকে কর্তন পযর্ন্ত সময় লাগবে ৯০ থেকে ১০০দিন। কিন্তু মাঠে দেখা যায় ধানে এখনও কাইস থোড় আসেনি। আর বিলে চাষ করার ফলে মাটি উর্বর বেশি হওয়ায় ধান গাছ বেশি বৃদ্ধি হয়েছিল যার ফলে গত ২০দিন আগে যাতে গাছ পড়ে না যায় তার জন্য ধান গাছের মাথা কেটে দিতে হয়েছিল। সেই সময় গাছের উচ্চতা ছিল প্রায় ৩০ ইঞ্চি লম্বা। জমির অবস্থা দেখে সময় মত ধানের থোড় না আসায় ধানের ফলন নিয়ে কৃষকরা চিন্তিত হয়ে পড়েন ।
সরজমিনে দেখা যায়, গজানোর হার কম ছিল, প্রতিটি ধানের গাছ সমান নয় ,প্রতিটি গাছের গোছায় পোয়ার সংখ্যা ৩-৫ টি, প্রতিটি (কান্ড)চিকন, লম্বা অনুপাতে গাছ মোটা কম, পাতা গুলোর রং সবুজ এবং হেলানো, গাছের গোড়ার রং কালচে,শিকড় গুলো বাদামি রংয়ের এবং গুচ্ছ। বর্তমানে ২৬ জুলাই২০১২ নাটোর, বড়াইগ্রাম উপজেলার রাজেন্দ্রপুর গ্রামে কৃষক শুকুর আলীর নেড়িকা ধানের ক্ষেত থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। ২৮ এপ্রিল ধান রোপন করা হলো আজ ২৬ জুলাই ২০১২ হলেো ধান গাছে কোন থোড় আসে নাই। কিন্তু এ সময়ে ধান পাকার কথা। জমির মাটি খুবই উর্বর হবার কারণে ধানের গাছ খুব বেশী বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে আজ ২৬ জুলাই থেকে ২০দিন পূর্বে ধান গাছের মাঝ বরাবর কাটা হয়। শিকড়ের দৈর্ঘ্য ২.৫ ইঞ্চি লম্বা।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ
চাঁপাইনবাবগঞ্জের কৃষকদের নিজ নিজ এলাকার উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তার মাধ্যমে “কৃষি পূনর্বাসন ভর্তুকি” নেরিকা-১০ ধানের ৮ কেজি বীজের একটি প্যাকেট এবং এর সাথে ১৬ কেজি ইউরিয়া, ১০ কেজি ডিএপি এবং ১০ কেজি করে এমওপি রাসায়নিক সার দেওয়া হয়েছে।
কৃষকদের বলা হয়েছিলঃ
১. নেরিকা-১০ জাতের ধান যে কোন সময়ে অর্থাৎ আউশ, আমন ও বোরো মৌশুমে চাষ করা যাবে;
২. খরা প্রবণ এলাকায় ভাল হবে;
৩. অল্প সময়ে অর্থাৎ তিন মাসে ধান আসবে;
৪. রাসায়নিক সার কম লাগবে, আগাছা কম হবে;
৫. রোগ পোকা মাকড় এর আক্রমন কম হবে;
৬. উৎপাদন ভাল হবে এবং ৮ কেজি বীজ দিয়ে ১ বিঘা (৩৩ শতাংশ) জমি আবাদ করা যাবে ।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার সদর উপজেলার ইসলামপুর ইউনিয়নে ৪০ জন কৃষককে নেরিকা – ১০ জাতের ধান দেয়া হয়েছে। কৃষক হাফিজুল ইসলাম বলেন,‘পরীক্ষামুলকভাবে ১০ কাঠাতে লাগানোর মনস্থির করে বীজ তলায় বীজ করেছি কিন্তু চারার অবস্থা এবং খরার ভাব দেখে পানির অভাবে এ ধান লাগাই নি। এক মাস পর ভেঙ্গে আমনের আবাদ করেছি।
কৃষক কামরুজ্জামান বলেন,‘যাদেরকে এই নেরিকা জাতের বীজ দিয়েছে, সবাই সারসহ বীজ সম পরিমানে পেয়েছে। আমি বীজ তলা তৈরী করে বীজ দিয়ে ৬/৭ দিন অপেক্ষা করেছি কিন্তু ধানে কোন ট্যাগ (অঙ্কুর) আসেনি। মনে কষ্ট নিয়ে বীজ ভেঙ্গে আবার পৌষ ধানের বীজ বুনেছি’।
কৃষক আলম হোসেন বলেন, নেরিকা-১০ জাতের ধান আমার জমিতে তিন বার করা হয়েছে। এক বার আমি নিজে করেছি পরের দুই বার বিএডিসি-এর কর্মকর্তা সেলিম সাহেব নিজেই নিজ খরচে তাদের তত্ত্বাবধানে করেছেন। এই বীজ দিয়েছিল হেমন্ত কালে (বোরো মৌসুমে )। প্রথম বার আমি নিজেই ৬ কাঠা (প্রায় ১০শতাংশ) জমিতে ২ কেজি নেরিকা-১০ বপন করেছি। কৃষি অফিসের নির্দেশ অনুসারে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক দিয়েছি। জমিতে এমন ভাবে আগাছা হয়েছে যা পরিস্কার করা যায় নি। গাছ লম্বা হয় মাত্র দুই থেকে আড়াই ফুট, ছড়া হয় ছোট ছোট। জমির অবস্থা দেখে মন খারাপ হয়ে যায়, ধান আর কাটা হয়নি। কৃষি অফিসার সেলিম ভাইয়ের সাথে আমার সম্পর্ক ভাল থাকায় দ্বিতীয় বার আমার সমপরিমান জমিতে কৃষি অফিসার নিজেই নিজ খরচে আবাদ করেন। এ বছর আমাকে অফিসার জোর করে ধরেছে, এক বিঘাতে নেরিকা – ১০ বপন করতেই হবে’। আগামীতে করবেন কিনা মতামত জানতে চাইলে বলেন, ‘নিয়মে পড়ে না, ডাটা মিষ্টি, পোকা বেশী লাগে। আসলে চাষ কিন্তু চলবেনা। এটা ফালতু ধান’। চেয়ারম্যান মাইনুল ইসলাম বলেন, আমি এ বৎসর নেরিকা-১০ জাতের ধান বুনেছি। একই জমির মধ্যে স্থানীয় জাতের ধাইরা জাতের ধানও বুনেছি। যারা নেরিকা -১০ আবাদ করছে,তাদের কারও ভালো হয়নি। যে নিয়মের কথা বলা হয়েছিল, তার চেয়েও ঘন করে ছিটাইছি তারপরও বাহার (অঙ্কুরোদগম) হয়নি, পাতলা পাতলা গজাইছে। আপনি আমার জমিতে যান, সরজমিনে সবই দেখতে পাবেন’।
ইয়াছিন হাজী বলেন, “আমার কামলা খরচ,নিজেদের খরচ, সার-বিষের খরচ তারপরও জমিতে ধান হবে এমন লক্ষণ নাই। আজ ৩১ মে ২০১২ বোনার পর ৭০/৭৫ দিন হয়ে গেল, ক্ষেতের অবস্থা দেখলে মনে হয় ধান গাছের বয়স ৯/১০ দিন হবে’।
ইয়াছিন হাজী, পুত্র মাহাবুল এবং ভাতিজা নুরুল হুদা ভাবছেন নেরিকা -১০ জাতের ধান নিয়ে তারা বিপাকে পড়েছেনন। ,এই ধানের জমি কি করবেন। এ ধান হওয়ার কোন সম্ভাবনা নাই ।
নেরিকা -১০ ধানের উৎপাদনশীলতার উপর তথ্য।
মো: রমজান আলী বয়স: ৪৫ বৎসর
গ্রাম: লক্ষ্মী নারায়নপুর (মেলকার পাড়া), ইসলামপুর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদরচাপাইনবাবগঞ্জ।
আবাদকৃত জমির পরিমান: ৩০ শতাংশ
আবাদের সময়কাল: ১১৩ দিন মাত্র। বীজ তলায় বীজ ছিটানোর তারিখ ১৮মে ২০১২, ০৩ রা জ্যৈষ্ঠ ১৪১৯।জমিতে চারা লাগানোর তারিখ ৩০মে ২০১২, ১৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪১৯ এবং ধান কাটার তারিখ ০৮ সেপ্টেম্বর ২৪শা ভাদ্র ১৪১৯ বঙ্গাব্দ।
চাষ পদ্ধতি: রাসায়নিক কৃষি।
মোট ব্যয়ের পরিমান: ১০১৩৪.০০ টাকা।
মোট আয়ের পরিমান: ৩৯৮৭.৫০ টাকা।
নীট ক্ষতির পরিমান: ৬১৪৬.৫০ টাকা।
এ ছাড়া মো: মাইনুল ইসলাম চেয়ারমান বারঘরিয়া ইউনিয়ন পরিষদ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর চাঁপাইনবাবগঞ্জ। তিনি উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তার উদ্যোগে ০২ বিঘা জমিতে নেরিকা – ১০ জাতের ধান আবাদ করেন। গত ২৮.০৭.২০১২ তারিখ তার কাছে তথ্য জানতে চাইলে বলেন, এ জাতের ধান যারা বুনেছেন তাদের কারও ভালো হয়নি। যে নিয়মের কথা বলেছিল তার চেয়ে ঘন বুনেছি তার পরও বাহার (অঙ্কুরোদগম) হয়নি। পাতলা পাতলা গজাইছে। ফলন কেমন হবে জানি না। পুনরায় অদ্য ১২.০৯.২০১২ তারিখ তথ্য জানতে চাইলে বলেন, ২/৩ দিন হলো জমিতে ধানের অবস্থা দেখার জন্য গিয়েছিলাম।
দেখা যাচ্ছে কিছু কিছু ছড়া বের হচ্ছে কিন্তু ছড়াতে সব ধানে চাউল নেই। অনুমান করে বুঝলাম যে, ০২ বিঘা জমির ধান কাটতে যে পরিমান জিন(ধান কাটার মজুরী) দিতে হবে সে পরিমান টাকা এ ধান থেকে আসবে না। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি কেটে গরুর খাদ্য হিসাবে ব্যবহার করবো।
এভাবেই ইসলামপুর ইউনিয়নের ঈদুলমাঝি গ্রামের ইয়াছিন হাজীর ছেলে মো: মাহাবুবুল হক তার জমির নেরিকা জাতের ধান কেটে গরুর খাদ্য হিসাবে ব্যবহার করছেন।
কৃষকদের উন্নতি ও উৎপাদন বাড়ানোর জন্য কৃষিতে সরকার ভূর্তকী দেয় কিন্তু সরকারী উদ্যোগে ত্রিশ শতাংশ জমিতে কৃণক রমজান আলী নেরিকা – ১০ জাতের ধান আবাদ করার ফলে নীট ক্ষতি হয়েছে ৬১৮৬.৫০ টাকা। এর মধ্যে সরকারের ক্ষতি ১১৭৪ টাকা (ভূর্তকী দেয়া বীজ এবং রাসায়নিক সারের মূল্য) এবং কৃষকের ক্ষতি ৪৯৭২.৫০টাকা এভাবে সরকার যতই কৃষিতে ভূর্তকী দিবে ততই সরকার এবং কৃষক সহ কৃষি উৎপাদন চরম ক্ষতি গ্রস্থ হবেন। এ দায়িত্ব কে নিবে ?
কুষ্টিয়া
কুষ্টিয়া জেলার ৬ টি উপজেলায় এপ্রিল, ২০১২ মাসে আউশ মৌসুমের শুরুতে সরকারী কৃষি ভর্তুকির আওতায় প্যাকেজ আকারে ১০ কেজি করে আউশ ধানের বীজ এবং ১০ কেজি ইউরিয়া, ১০ কেজি টিএসপি এবং ১০ কেজি এমওপি মোট ৩০ কেজি সার বিতরন করা হয়। আউশ ধানের বীজের মধ্যে সিংহভাগই ছিল উফশী বিআর-২৮, এবং পরীক্ষামুলক ভাবে কিছু কৃষককে নেরিকা-১০ জাতের ধান দেয়া হয়। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা এবং স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা এই প্যাকেজ বিতরনের জন্য কৃষক নির্বাচন করেন।
জিন্নাত আলী (গ্রাম: বড়ীয়া, ইউনিয়ন: বটতৈল, উপজেলা: কুষ্টিয়া সদর) বীজ নিয়ে তার এক বিঘা জমিতে ৫ কেজি বীজ ছিটিয়ে বোনেন। এরপর একহাত পরিমান গাছ বড় হওয়ার পর জমিতে প্রচুর আগাছা হয় এবং ধান গাছ মরা ছনের মত হতে থাকে। এই ভাবে ধান গাছের বয়স ২ মাস পর্যন্ত দেখার পর তার কোন সম্ভাবনা না দেখে ক্ষেতে চাষ দিয়ে ভুট্টার আবাদ করেন।
রেজাউল ইসলাম (গ্রাম: বড়ীয়া,ইউনিয়ন : বটতৈল,উপজেলা: কুষ্টিয়া সদর) ৫ শতক জমিতে আউশ মৌসুমে এক কেজি বীজ ছিটিয়েছিলেন। আর বাকী ধান চিড়া কুটে খেয়ে ফেললেন এবং আউশ ধানের মতো বোনা ও পরিচর্যা করলেন। একমাস পার হলেও ধানের গাছের চেহারা আশানুরূপ হয় নি। ক্রমেই আগাছা বেশী এবং ধান গাছ হাল্কা হলুদ রং ধারণ করলো। কোন উন্নতি না দেখে জমি নষ্ট করে কি হবে ভেবে কেটে গরুকে খাইয়ে দিয়েছেন ।
পত্রিকার খবর
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে,রাজশাহীর চারঘাট,বাঘা,গোদাগাড়ী ও পবা উপজেলার ৭৫০ জন কৃষক প্রত্যেককে আউশ প্রনোদনা হিসেবে নেরিকা-১০ জাতের আট কেজি করে ধান,১৬ কেজি করে ইউরিয়া,১০ কেজি ডিএপি ও ১০ কেজি করে এমও পি সার দেওয়া হয়। একই পরিমাণে ধান ও সার দেওয়া হয় যশোরের আট উপজেলার তিন হাজার কৃষককে। রাজশাহী ও যশোরে মোট পৌনে চার হাজার কৃষককে নেরিকা-১০ জাতের বীজ ও সার দেওয়া হয়। বপনের ৬০ দিনে শীষ আসার কথা,৭৭ দিনেও আসেনি। তাই নেরিকা জাতের ধান নিয়ে নিরাশ কৃষক (প্রথম আলো ২৬ জুলাই,২০১২)
‘চুয়াডাঙ্গায় নেরিকা জাতের ধান চাষে চাষীদের সর্বনাশ’ শিরোনামে সংবাদে বলা হয় এ জেলায় ৪টি উপজেলায় ১ হাজার ৫০০ বিঘা জমিতে নেরিকা ধানের চাষ করে এর উৎপাদন শূন্যের কোঠায় দাঁড়িয়েছে,চাষীরা বেশ উৎসাহ নিয়ে এ ধানের চাষ করে,কিন্তু চাষের পর ধান গাছ দিনে দিনে নষ্ট হতে থাকে। চুয়াডাঙ্গা জেলায় নেরিকা ধান চাষে বিপর্যয় দেখা দিচ্ছে (ইত্তেফাক,৩ আগষ্ট,২০১২)।
কমলগঞ্জ (মেৌলভীবাজার) ও চিতলমারীতে (বাগের হাট) নেরিকা ধান চাষ করে কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত (দৈনিক ইত্তেফাক, ৬ সেপ্টেম্বর ২০১২)
চিতলমারীতে অপরিপক্ব নেরিকা ধানে আগাম থোড় : সর্বস্বান্ত কৃষকরা
চিতলমারী (বাগেরহাট) প্রতিনিধি : চলতি আউশ মৌসুমে চিতলমারীতে অপরিপক্ব নেরিকা জাতের ধান গাছে আগাম থোড় দেখা দিয়েছে। উফশী আউশ উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে সহায়তা কর্মসূচির আওতায় ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের মাঝে স্থানীয় কৃষি অফিসের মাধ্যমে বিনামূল্যে এ জাতের ধান বীজ বিতরণ করা হয়।
উপজেলার ৩১০ জন কৃষকের ৩১০ বিঘা জমির ফসল চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত চাষীদের মাঝে চরম হতাশা বিরাজ করছে। জেলা ও উপজেলা কৃষি কর্মকর্তারা কৃষকের ধানক্ষেত পরিদর্শন করে কৃষকের ক্ষতির কথা স্বীকার করেন।
স্থানীয় কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, উপজেলার ৭টি ইউনিয়নে এসব ধানের ব্লকের সংখ্যা ১০টি। এরমধ্যে নেরিকা জাতের ধান বীজ বড়বাড়িয়ায় ব্লকে ৩৫ জন কৃষক, হাড়িয়ারঘোপ ৩০, কলাতলা ৪৫, হিজলা ৬৫, শিবপুর ৩৫, চিতলমারী ১০, চরবানিয়ারী ৪০, খড়মখালী ২৫ ও সন্তোষপুর ব্লকে ২৫ জনসহ ৩১০ চাষীর মধ্যে বিনামূল্য বিতরণ করা হয়।
জানা গেছে, আফ্রিকা থেকে আমদানিকৃত নেরিকা জাতের এই ধান চাষের মাত্র ৪৫ দিনের মধ্যে অপরিপক্ক ধানগাছে আগাম থোড় দেখা দিয়েছে। এ ছাড়া ধানের গোছা দিন দিন মরে যাচ্ছে। ঘটনায় উপজেলার সুরশাইল, কুরমুনি, হিজলা, শিবপুর, খড়মখালী, কুড়ালতলা ও বড়বাড়িয়াসহ বিভিন্ন এলাকার চাষীদের মাঝে চরম হতাশা ছড়িয়ে পড়েছে।
কুরমনি গ্রামের কৃষক রেজাউল দাড়িয়া, কুড়ালতলার হাফিজুর রহমান, আনছার আলী, চর শৈলদাহ গ্রামের হেদায়েত আলী, শান্তিপুরের অধির বিশ্বাসসহ অনেক কৃষক জানান, তারা স্থানীয় কৃষি অফিস থেকে এ বীজ পেয়ে ধানচাষ করেন। কিন্তু চারা লাগানোর ৪০-৪৫ দিনের মধ্যে ধান গাছে আগাম থোড় দেখা দিয়েছে। ফলে বিভিন্ন ব্যাংক, এনজিও, দাদন ব্যবসায়ী ও সুদখোর মহাজনদের ঋণের জালে আবদ্ধ চাষীরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। খবর পেয়ে কৃষি কর্মকর্তা মোঃ আবু তালহা ক্ষতিগ্রস্ত বিভিন্ন ক্ষেত পরিদর্শন করেন।
এ ব্যাপারে কৃষি সম্প্রসারণ বাগেরহাট খামার বাড়ির উপ-পরিচালক হীরেন্দ্র নাথ হাওলাদার ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে বলেন, আফ্রিকা থেকে নেরিকা জাতের ধানের বীজ আনা হয়েছে। ইতোমধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা ক্ষতিপূরণ দাবিও করেছে। এ কথা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। ভবিষ্যতে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের সরকারি যে কোনো প্রোগ্রামের মাধ্যমে উপকৃত করা হবে।
(দৈনিক ভোরের কাগজ : ১০/০৯/২০১২)
ভিন্ন খবর
নেরিকা ধান চাষে সারা দেশে ফলন বিপর্যয় দেখা দিলেও রহস্যজনক কারণে শেরপুর জেলা থেকে ভিন্ন রকম খবর পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। দৈনিক কালের কন্ঠে (১ সেপ্টম্বর, ২০১০) ছাপা হয়েছে “ নতুন ধান নেরিকা মিউট্যান্ট শেরপুরে ফলন দিয়েছে একরে ৫৭ মণ। দৈনিক ইত্তেফাক (২৭ আগষ্ট, ২০১২) পত্রিকায় ছাপা হয়েছে “ আউশ আবাদে প্রণোদনা। শেরপুরে নেরিকা ধানের ফলন একরে ৩৫ মণ ”। এ প্রতিবেদনে এমন কোন তত্ব প্রদান করা হয়নি যার দ্বারা প্রমাণ করা যায় যে নেরিকা ধান প্রতিবেদনে উল্লেখিত পরিমাণ ফলন দিতে সক্ষম। তাছাড়া এমন কোন কৃষকের নামও উল্লেখ করা হয়নি যার ক্ষেতে নেরিকা ধান আবাদ করে একরে ৫৭ মণ ফলন পাওয়া গিয়েছে। কৌশলে স্থানীয় জাত হিসাবে প্রচলনের জন্য স্থানীয় কৃষক মোকলেছুর রহমান লেবুর উদ্ভাবন হিসাবে এ জাতের নাম করণ করার প্রস্তাব করা হয়েছে “ নেরিকা লেবু ” হিসাবে।
শেষ কথা
কৃষকরা নেরিকা ধান নিজের ইচ্ছায় নিচ্ছেন না, তাঁরা এই ধান সম্পর্কে কিছু জানেনও না। তবে কেন তাঁদের এই ধান দেয়া হচ্ছে? সরকার কেন বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও পরিবেশগত প্রতিক্রিয়ার মূল্যায়ন ছাড়াই কৃষকের মাঠে এই বীজ ছড়িয়ে দিচ্ছেন? আসল গবেষণা শেষ না করে কৃষকরা গ্রহণ করে কিনা সেই ‘ট্রায়াল’ চালাতে চাইছেন? এটা বৈজ্ঞানিক গবেষণার দিক থেকে অনৈতিক, পরিবেশ ও প্রাণবৈচিত্রের জন্য বিপজ্জনক এবং কৃষকের সঙ্গে স্রেফ প্রতারণা ছাড়া কিছু নয়। তাছাড়া এই ধান দেওয়া হচ্ছে ভর্তুকি হিশাবে। অর্থাৎ যে বীজ বা উপকরণ কৃষকের প্রয়োজন তার পরিবর্তে তাকে অপরীক্ষিত বীজ দেওয়া হচ্ছে। কৃষকের জমি ব্যবহার করা হচ্ছে তাকে কোন ক্ষতিপূরণ ছাড়াই। খোদ কৃষককে ব্যবহার করা হছে গিনিপিগের মত, কৃষক জানে না তাকে কী বীজ দেওয়া হোল। তার পরিশ্রম আত্মসাৎ করা হয়েছে বিনা পারিশ্রমিকে। ‘এডাপ্টিভ ট্রায়াল’ বা কৃষক আদৌ এই বীজ গ্রহণ করে কিনা সেই পরীক্ষা চালাবার অজুহাতে আসলে নেরিকা-১০ নিয়ে বাংলাদেশের কৃষককে দিয়ে তাদেরই কৃষি জমিতে যে গবেষনা করা হোল তাতে বাংলাদেশের বা বাংলাদেশের কৃষকের স্বার্থ নাই। স্বার্থ রয়েছে বহুজাতিক বীজ কোম্পানি এবং তাদের সহায়ক বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা্র। মূলত কোম্পানির ধান বাজারজাত করবার আগে বাংলাদেশের কৃষকদের দিয়েই তাদের না জানিয়ে কোন অর্থ খরচ না করে কৃষকদের দিয়ে নীতিবহিরভূত ভাবে ‘গবেষণা’ করিয়ে নেয়া হচ্ছে। গিনিপিগ বানানো হচ্ছে বাংলাদেশের কৃষককে।
এই ক্ষেত্রে দেশের আইনও মানা হছে না। বাংলাদেশের কৃষি নীতি, বীজ আইন ও বীজ নীতি ইত্যাদি অবজ্ঞা করে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনষ্টিটিউট (ব্রি), বাংলাদেশ ইনষ্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার এগ্রিকালচার (বিনা), বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়,বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় সমূহ এবং কৃষি গবেষণায় নিয়োজিত বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা সমূহকে উপেক্ষা করে ধানের মত একটি নটিফাইড (জ্ঞাপনীয়) ফসলের জাত বিদেশ থেকে আমদানী করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়া বীজ বর্ধন করে কৃষকদের মাঝে ব্যাপক হারে কার স্বার্থে বিতরণ করা হল ? এটি একটি জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। এ ধান আবাদ করে কৃষকদের যে ক্ষতি হল সে ক্ষতিপূরণ কে দেবে ? তাছাড়া এ বীজ সরবরাহ করা হয়েছে সরকারী ভাবে। এর ফলে ব্যর্থতার দায় বহন করতে হবে সরকারকে, কোন আন্তর্জাতিক সংস্থা বা বীজ কোম্পানিকে নয়। বিশেষ ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশান এবং কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ। সরকারীভাবে সরবরাহকৃত বীজের প্রতি কৃষকদের যে অনাস্থা সৃষ্টি হল তার দায় এখনকে নেবে ?
আন্তর্জাতিক চুক্তি ও বিধান এবং বীজ সংক্রান্ত জাতীয় আইন সরকার লঙ্ঘন করতে পারে কিনা সেটাও গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় প্রশ্ন হয়ে উঠেছে।
(এই প্রতিবেদন প্রস্তুতের জন্য মাঠ পর্যায় থেকে তথ্য দিয়েছেন হারুণ-অর-রশিদ, মোজাহেদুল ইসলাম প্রিন্স ও আরফান আলী অলিফ। নেরিকা সংক্রান্ত অন্যান্য তথ্যের ভিত্তিতে প্রাথমিক প্রতিবেদন তৈরী করেছেন ড. এম এ সোবহান এবং সম্পাদনা করেছেন ফরহাদ মজহার ও ফরিদা আখতার)