ফরিদা আখতার || Sunday 12 August 2012 ||
তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন
কিছু তথ্য ভয়াবহ। যেমন, তামাক ব্যবহারের প্রত্যক্ষ্ ফল হিসেবে প্রতি বছর ৩০ বছরের বেশী বয়স্ক জনগোষ্ঠির মধ্যে প্রতি বছর ৫৭,০০০ জন মৃত্যু বরণ করেন এবং ৩,৮২,০০০ জন পঙ্গুত্ব বরণ করেন। এই তথ্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার। এই সংখ্যা প্রতি বছরের। গত দশ বছরের হিশাব নিলে মাথা ঘুরে যাবে। আবার নিজে ধূমপান না করেও অন্যের ধূমপানের ফলে কর্মক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন ১ কোটি ১৫ লক্ষ মানুষ। বাড়ী ঘর, রাস্তা ঘাটের হিশাব নিলে এই সংখ্যা দুই তিনগুণ বেড়ে যাবে। বলা বাহুল্য, এর শিকার প্রধানতঃ নারী।
বাংলাদেশে ১৫ বছরের বেশী জনগোষ্ঠির মধ্যে ৪৩.৩% মানুষ কোন না কোনভাবে তামাক ব্যবহার করেন, এই তথ্য ভয়াবহ। যে বয়সে সুস্থ্ সবল এবং কর্মক্ষম থাকবে সেই বয়স থেকে তামাক সেবন শুরু করে অতি অল্প বয়সে মানুষ নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু কিংবা পঙ্গুত্ব বরণ করছেন। একটি পরিবারে এক জনের মৃত্যু হলে সেই পরিবারের সকল সদস্যই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই বছরে সাতান্ন হাজারকে পাঁচ দিয়ে গুণ দিলে দেখতে পাই দুই লক্ষ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, একইভাবে পঙ্গুত্ব বরণকারীদের পরিবারের ভোগান্তি কোন অংশে কম নয়।
প্রায় সময়ই শুধু সিগারেট ও বিড়ি খাওয়াকেই আমরা তামাক সেবন বলে ধরে নেই। ধনী ও মধ্যবিত্তরা নানা ব্রান্ডের সিগারেটে টান দেয়, আর গরিব মানুষ ফুঁকে বিড়ি। উভয়কেই আমরা ধূমপায়ী বলে চিনি। পরিসংখ্যান দেখে অবাক হই — যারা ১৫ বছর বয়স পার করেছেন, এমন পুরুষদের ৪৪.৭% ধূমপান করে আর মেয়েরা করে ১.৫% । মেয়েদের মধ্যে ধূমপানের সংখ্যা বাড়ছে কারণ যারা এই পণ্যের ব্যবসা করে তাদের চোখ এখন আধুনিক ও শিক্ষিত মেয়েদের দিকে।এই ব্যপারে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০১০ সালে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছে। তবে আশার কথা যে ধূমপানের বিরুদ্ধে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এমন সচেতনতা বেড়েছে যে কেউ আর প্রকাশ্যে বলে না যে তিনি ধুমপান করেন, বরং যারা ধূমপান ছেড়েছেন এবং কোন দিন একটি সিগারেট হাতে নেন নি, তাদের নৈতিক শক্তি অনেক বেশী। ড্রয়িং রুমে এস্ট্রে এখন থাকে না, উপহার হিশেবে লাইটার দেয়াও হয় না। ধূমপান করলে বাইরে গিয়ে করতে হয়। ধূমপান যে ভাল নয়, এমন কি ভদ্রতাও নয়, সেই কারণেই এই লুকোচুরি। বলতে বাধু হচ্ছি, এক্সকিউজ মী!
অন্যদিকে, ধোঁয়াবিহীন তামাকজাত দ্রব্য যেমন জর্দা, গুল, সাদা পাতা/আলাপাতা,নস্যি খৈনীসহ ধোঁয়াবিহীন তামাকের ব্যবহারকারী পুরুষ ও নারী উভয়ের মধ্যে রয়েছে, তবে পুরুষদের তুলনায় নারীদের সংখ্যা বেশী। ধোঁয়াবিহীন তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবহার পুরুষদের মধ্যে ২৬.৬% আর নারীদের মধ্যে ২৭.৯%। বলাবাহুল্য, গরিব নারীদের সংখ্যাই বেশী। তাঁরা জানতেও পারেন না যে পানের সাথে জর্দা খেয়ে কি সর্বনাশ হয়ে যাচ্ছে। কয়েকদিন আগে তামাক বিরোধী চিকিৎসক সংগঠন ‘উফাত’ আয়োজিত একটি সভায় দু’জন জর্দা,গুল সেবনকারীকে আনা হয়েছিল। তারা ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশানে চিকিৎসা নিচ্ছেন। তাঁদের মুখের ক্যান্সারের অবস্থা এবং তাঁদের কষ্টের কথা শুনে অংশগ্রহণকারীদের চোখের পানি ধরে রাখা কষ্টকর হয়ে গিয়েছিল। সভায় প্রধান অতিথি মাননীয় আইন মন্ত্রী ব্যরিস্টার শফিক আহমেদও আবেগ-আপ্লুত হয়ে গিয়েছিলেন। মনে হচ্ছিল নীতি নির্ধারকদের তামাক সেবনের এই ভয়াবহ পরিণতি দেখাতে পারলে হয়তো বিষয়টির প্রতি তাঁরাও মনোযোগি হতেন।
তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার করে নানা রকম রোগ আক্রমণ করে। যেমন, হৃদরোগ, মস্তিষ্কে ষ্ট্রোক, পক্ষাঘাত, ফুসফুসের ক্যান্সার, ফুসফুসের যক্ষা, মুখে-স্বরযন্ত্র-শ্বাস নালীর ক্যান্সার, ক্ষতিগ্রস্ত মাঢ়ি, ইত্যাদি। তাছাড়া নারীদের নানা ধরণের প্রজনন স্বাস্থ্য সমস্যা হচ্ছে। গর্ভবতী নারী সুস্থ শিশু জন্ম দিতে পারছে না, সময়ের আগে জন্ম নেয়া, কম ওজন সম্পন্ন শিশুর জন্ম দেয়া, এমন কি গর্ভস্থ শিশুর মৃত্যুও ঘটছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই স্বাস্থ্য সমস্যার কথা তুলে ধরেছেন। বাংলাপিডিয়ার তথ্য থেকে জানা যায় ফুসফুসের ক্যান্সারের ৮৫% কারণ ধূমপান এবং পুরুষদের মধ্যে ক্যান্সার সংক্রান্ত মৃত্যুর ২১% ঘটে এই কারণে। অন্যদিকে নানা ধরণের ক্যান্সারের মধ্যে মুখের ক্যান্সারের পরিমান ১৩%, যা জর্দা, গুল সহ ধোয়াঁবিহীন তামাক দ্রব্য সেবনের কারণে ঘটে। অন্যান্য ধরণের ক্যান্সারের সাথেও তামাক দ্রব্যের ব্যবহার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত, তাই ঢাকা মেডিকেল কলেজের প্রাপ্ত তথ্য থেকে বলা হচ্ছে বাংলাদেশে ৫০% ক্যান্সার কমানো যাবে শুধু তামাক দ্রব্য সেবন বন্ধ করে দিতে পারলে।
বিড়ি কারখানায় যারা কাজ করে সেই ৬৫,০০০ নারী, পুরুষ ও শিশু শ্রমিকরা যেন মৃত্যু কুপের মধ্যে নিজেদের সঁপে দিয়েছে। ‘বাংলাদেশে বিড়িঃ মিথ ও বাস্তবতা’ শীর্ষক একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন থেকে জানা যায় এই শ্রমিকরা বড় ধরণের স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে রেয়েছে। কারখানার ভিতরের পরিবেশ তামাকের ধুলায় আচ্ছাদিত, আর নারী ও শিশু সহ বিড়ি শ্রমিকরা প্রতিনিয়ত তা নিঃশ্বাসের সাথে টেনে নিতে বাধ্য হচ্ছে। তাদের শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে। বুকে ব্যথা, কাশি, যক্ষা ইত্যাডি রোগে তারা আক্রান্ত হতে থাকে। রংপুরের হারাগাছের হাসপাতালে গেলে এই রোগীদের দেখা মিলবে, তেমনি যেখানে বিড়ি কারখানা আছে সেখানেই এই সমস্যা চোখে পড়বে।
আরও আছে তামাক চাষের কথা। কৃষি জমিতে তামাক পাতার চাষ কুষ্টিয়া ও এর আশে পাশের জেলায় এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে খাদ্য সংকট সৃষ্টি করেছে, বন ধ্বংস করেছে, মাটি ও পানি নষ্ট হচ্ছে এবং সামগ্রিকভাবে কৃষকরা ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন। কিন্তু নিয়ন্ত্রণহীনভাবে কৃষকদের নানা প্রলোভন দেখিয়ে দেশেরএবং মানুষের জন্যে ক্ষতিকর এই কাজটি করে যাচ্ছে তামাক কোম্পানীগুলো।
তামাক দ্রব্য সেবন, বিড়ি উৎপাদন এবং তামাক চাষ সবই যখন মানুষের স্বাস্থ্যের জন্যে এতো ক্ষতির কারণ তখন এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া সরকারের দায়িত্ব। আশার কথা যে ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্যের উৎপাদন, ব্যবহার, ক্রয়-বিক্রয় ও বিজ্ঞাপন নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে বাংলাদেশে একটি আইন আছে তার নাম,‘ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০০৫’। আইনটি হয়েছে কারণ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ৫৬তম সম্মেলনে ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার নিরুৎসাহিত করার জন্য প্রণীত Framework Convention on Tobacco Control (FCTC) বাংলাদেশ সরকার ১৬ জুন ২০০৩ ইং তারিখে স্বাক্ষর এবং ১০ মে, ২০০৪ ইং তারিখে অনুস্বাক্ষর করেছে। কিন্তু আইন প্রণয়নের পর বাস্তবায়ন ও প্রয়োগের ক্ষেত্রে এর দুর্বল দিকগুলো ধরা পড়ে তাই সংশ্লিষ্ট সংগঠন ও সংস্থায় দীর্ঘদিন ধরে পর্যাপ্ত আলোচনা করে সংশোধনের প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। বিশেষ করে দেখা গেছে এই আইনে এফসিটিসির অনেকগুলো শর্ত পুরোপুরি পালিত হয় নি, তাই এফসিটিসির আলোকে সংশোধন করে আইনটি আরও কার্যকর করা সম্ভব।বর্তমান আইনটির দুর্বলতা এমন পর্যায়ে আছে যে একে নারীর প্রতি বৈষম্যমুলক আইন বলা যায়। নারীরা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ উভয় ভাবেই ক্ষতির শিকার। তাই তামাক বিরোধী নারী জোট (তাবিনাজ) জাতীয় সংসদের নারী সংসদ সদস্যদের কাছেও আবেদন জানিয়েছে। মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কাছেও আমাদের প্রত্যাশা নারী ও শিশুদের রক্ষার জন্য তাঁরা উদ্যোগ নেবেন। সংশোধনের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা এই অল্প পরিসরে সম্ভব নয়, কিন্তু এটুকু বলতে চাই তামাক নিয়ন্ত্রণ নিয়ে যারা কাজ করেন তাঁরা মনে করেন সংশোধিত আইন বাস্তবায়ন করতে পারলে মানুষের জীবন রক্ষার জন্য সহায়ক হবে।কিন্তু একই সাথে যারা এই পণ্য উৎপাদন ও ব্যবসার সাথে জড়িত তাঁরাও তৎপর রয়েছে আইনটিকে দুর্বল রেখে দেয়ার জন্য। তাদের পক্ষ থেকে যুক্তির একটি মাত্র হাতিয়ার হচ্ছে কোম্পানীগুলো বছরে একটি বড় অংকের ভ্যাট রাজস্ব খাতে দেয়, এতো রোগ সৃষ্টির বিনিময়ে! বাহ।এই যুক্তি দেখিয়ে তাঁরা অর্থ মন্ত্রণালয়কে দিয়ে আইনের সংশোধনে বাধা সৃষ্টি করে।তাই দীর্ঘদিন ধরে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে সংশোধনসহ প্রস্তাবটি মন্ত্রী পরিষদ সভার অনুমোদন লাভ করতে পারছে না।আমরা আশা করবো আগামী যে কোন সভায় প্রস্তাবিত সংশোধনী, যা দিয়ে মানুষের জীবন বাঁচানো যাবে, পরিবেশ রক্ষা হবে এবং ভবিষ্যত প্রজন্মকে রক্ষা করা যাবে তেমন সংশোধনের জন্য মন্ত্রী পরিষদের অনুমোদন পাওয়া যাবে যেন আগামি সংসদ আধিবেশনে সংশোধিত আইনটি পাশ হতে পারবে। দেশের মানুষের জীবন বাঁচাবার চেয়ে বড় আর কী হতে পারে? ঈদের আগে মানুষের জীবন রক্ষার জন্য একটি সংশোধিত আইনের অনুমোদন আমাদের দারুন অনুপ্রাণিত করবে।এটাই আমাদের ঈদের উপহার ধরে নেবো।