বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস, ২০১২

ফরিদা আখতার || Friday 27 July 2012

প্রজনন স্বাস্থ্যের প্রতি অবহেলা ও বিজিএমইএ সমাচার!

বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস ছিল ১১ জুলাই। সরকার এবং সংশ্লিষ্ট সংগঠন পালন করেছেন নিয়মানুযায়ী।কিন্তু একটু অবাক হলাম দেখে যে জাতি সংঘের দেয়া প্রতিপাদ্য Universal Access to Reproductive Health Services বা সার্বজনীন প্রজনন স্বাস্থ্য সেবার প্রাপ্যতা নিয়ে যেন কারো কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। এগারো তারিখের পত্রিকা খুললে মনে হবে সেদিন বাংলাদেশে জন সংখ্যা কত, কোন জেলায় জন্মহার বেশী বা কম,আদম শুমারীর ফলাফল কি ইত্যাদী তথ্য দিয়ে ভরা। আরও লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে এই দিনে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের প ক্ষ থেকে কোন ক্রোড়পত্রও ছিল না।

এতোদিন বিশ্ব জন সংখ্যা দিবসে কথা বলার জন্যে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বা জন সংখ্যা বিশেষজ্ঞরাই সোচ্চার ছিলেন। কিন্তু এখন হঠাৎ দেখছি কথা বলছেন বাংলাদেশ তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ।শ্রমিকের অধিকার হরণের আর একটি নতুন মাত্রা তাঁরা যোগ করেছেন! সে প্রসংগে কথা বলাই আমার মুল উদ্দেশ্য। তবে তার আগে দেখা যাক ১১ জুলাই কিভাবে পালিত হোল।

জাতি সংঘ জনসংখ্যা তহবিল (UNFPA) এই দিনে প্রজনন স্বাস্থ্য সেবার প্রতি গুরুত্ব দিতে গিয়ে প্রতিটি জন্ম যেন নিরাপদ হয় এবং প্রতিটি গর্ভধারণ যেন কাংখিত হয় তার প্রতি জোর দিয়েছেন। তাদের মতে এখন বিশ্ব ব্যাপী ২২ কোটি ২০ লক্ষ নারী প্রয়োজনীয় পরিবার পরিকল্পনা সামগ্রী পাচ্ছেন না বলে জন্মদান বিলম্ব করতে চাইলেও করতে পারছেন না। আবার প্রায় ৮০ কোটি নারী সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মৃত্যু বরণ করছেন। কাজেই প্রজনন স্বাস্থ্য সেবা মানে শুধু জন্মহার রোধ করাই নয় বরং জন্মদানকেও নিরাপদ করতে হবে। কিন্তু কেন জানি জনসংখ্যা দিবস এলে মারো মারো কাটো কাটো ভাব জেগে ওঠে। এবং তা দেখা যায় পুরুষ নীতি-নির্ধারকদের মাঝেই।তাদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য প্রশ্ন তুলছি, প্রতিদিন এতো যে দুর্ঘটনা জনিত মৃত্যু ঘটে তা রোধ করার কোন উদ্যোগ নেই কি এই জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের চিন্তা থেকেই? এমন নিষ্ঠুরভাবে ভাবতে বাধ্য হলাম মানুষের সংখ্যার প্রতি এমন আচরণ দেখে।

দিবসটি পালন করতে গিয়েও প্রজনন স্বাস্থ্যের প্রতি চরম অবহেলা লক্ষ করা গেছে। ‘সার্বজনীন প্রজনন স্বাস্থ্য সেবা’ টি-শার্ট সবাই পড়ে র্যাষলী ক রেছেন কিন্তু মুখে বলছেন অন্য কথা। মাতৃ স্বাস্থ্য নিরাপদ করার জন্য কোন উদ্যোগ নিয়ে আলোচনা সেখানে ছিল না। ‘দুটি সন্তানের বেশী নয়, একটি হলে ভাল হয়’ শীর্ষক শ্লোগান দেয়া হচ্ছে জোরে শোরে, কিন্তু এতে কি মানুষ বিভ্রান্ত হবে না? দুটি সন্তান কি সব সময় ছেলে হবে, কিংবা সবারই কি একটি ছেলে এবং একটি মেয়ে হবে? একটি মাত্র সন্তান মানে যদি একটি কন্যা হয় তাহলে তার অধিকার দেবে কে? উত্তরাধিকার আইনে নারীর অধিকার দিতে গিয়ে সংশ্লিষ্ট গোষ্টির প্রতিবাদের ভয়ে আজ পর্যন্ত সরকার জাতীয় নারী নীতি পাশ হতে পারছে না। শুধু মেয়ে হলে বাবার সম্পত্তি পাবে না, তাহলে কোন বিচারে দুটি মেয়ের বাবা-মায়েরা খুশি হবে? তাছাড়া মেয়েদের অবস্থা উন্নতির দিকে কোন ব্যবস্থা এখনো সরকার বা সমাজ করতে পারে নি। প্রতিদিনের পত্রিকায় নারী নির্যাতন, যৌতুক ইত্যাদীর খবর এখন যেন সবার গা-সওয়া ব্যাপার হয়ে গেছে। বারই জুলাইয়ের দৈনিক পত্রিকায় রয়েছে অনেক নারীর নির্যাতন ও যৌতুক যন্ত্রণার কাহিনী। কে দিচ্ছে তাদের নিশ্চয়তা!চীনে এক সন্তান কর্মসুচী নিয়ে ব্যাপকভাবে নারী ভ্রুণ হত্যার পর এখন তারা নীতি বদলেছে। অথচ নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও তাদের প্রজনন স্বাস্থ্য সেবার নিশ্চয়তা দেশে একটি পরিকল্পিত জনসংখ্যা নীতি তৈরী করতে সহায়তা করতে পারে।

আর এটাও বুঝতে হবে প্রজনন স্বাস্থ্য সেবা মানে শুধু কিছু জন্ম নিয়েন্ত্রণ পদ্ধতি ধরিয়ে দেয়া নয়। এগার তারিখের সভায় উল্লেখ করা হয়েছে দেশের ৬০% শতাংশ দম্পতিকে পরিবার পরিকল্পনা্র আওতায় আনা হয়েছে। বাজেট বক্তৃতায় অর্থ মন্ত্রী ২০২১ সালের মধ্যে ৮০% উন্নীত করতে চাইছেন। তিনি জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী মজুদের কথা বলেছেন কিন্তু কোথাও প্রজনন স্বাস্থ্য সেবার উন্নতি করার জন্য কোন পদক্ষেপ নেয়ার কোন পরিকল্পনা নাই। জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী মজুদ রেখে কারো ব্যবসা হতে পারে নারী স্বাস্থ্যের উন্নতি হবে এমন কথা নেই।

শুধু দুটি বা একটি সন্তানও যদি হয় তাহলে যে সন্তানটি জন্মাবে সেটা যেন মা ও শিশু উভয়ের জন্য নিরাপদ হয় তার ব্যবস্থা করার দায়িত্ব সরকারের। যদি তারা নিয়ম বেঁধে দেন যে দুটির বেশী হতে পারবে না তাহলে তা নিরাপদ ক্রার দায়িত্ব সরকারে। মাতৃকালীন ছুটির বিষয়টিও প্রজনন স্বাস্থ্য সেবার অধিকার হিসেবেই এতোদিন নারী আন্দোলন দাবী করে এসেছে। কিন্তু বিশ্ব জন সংখ্যা দিবসের ঠিক একদিন আগে (১০ জুলাই, ২০১২) প্রথম আলোর একটি খবরে চোখ আটকে গেল।খবরটির শিরোনাম ‘মার্তৃত্বকালীন ছুটি বাড়লে জন্মহারও বাড়বে! মনে করে বিজিএমইএ’।এমন একটি শিরোনাম দেখে অনেকটা আঁতকে উঠেই পড়ে ফেল্লাম।এবং বিস্মিত হলাম।বিজিএমইএ একটি রপ্তানীমুখী ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান, তারা কবে থেকে জনসংখ্যা তত্ত্ব নিয়ে বিশেষজ্ঞ হয়েছেন তা আমাদের জানা ছিল না। তবে হ্যাঁ, স্বার্থ বুঝে সবাই একটি অবস্থান নিতেই পারে এবং বিজিএমইএ আর একবার প্রমাণ করলেন তাঁরা শুধু শ্রমিক বিরোধী নন তাঁরা ঘোরতর নারী বিরোধী।

প্রথম আলোর প্রতিবেদক মানসুরা হোসাইনের এই প্রতিবেদন যারা পড়েন নি তাঁদের একটু ধরিয়ে দেয়ার জন্য বলছি, বাংলাদেশ তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ) মার্তৃত্বকালীন ছুটি সংক্রান্ত বিষয়ে মতামত দিয়েছে।তারা বলেছে,মার্তৃত্বকালীন ছুটি ছয় মাস করা হলে জন্মহার বাড়াতে উৎসাহিত করবে।সুবিধা পাওয়ার পর কর্মীদের চাকুরীতে ফিরে না আসার প্রবণতাও বাড়বে। দীর্ঘ অনুপস্থিতিতে শ্রমিকের দক্ষতা হ্রাস পাবে।

এখন যখন বিশ্বব্যাপী মাতৃত্বকালীন ছুটির ১৬ সপ্তাহ থেকে বাড়িয়ে ২৪ সপ্তাহ বা ছয় মাস করা হচ্ছে, এবং বাংলাদেশে এই আইন স্বয়ং প্রধান মন্ত্রী ঘোষণা করেছেন তখন বিজিএমইএ-র এই বক্তব্য হাস্যকর শুধু নয়,চরম অজ্ঞতারও শামিল।তারা নিজেদের স্বার্থ রক্ষার জন্য এতোখানি অমানবিক ও অশালীন আচরণ করবেন তা শ্রমিকদের ন্যায্য দাবী অমান্য করার মধ্য দিয়েই পরিস্কার ভাবে ফুটে ওঠে। তাই আমি খুব আবাক হই নি, অবাক হয়েছি তাদের ভাষার ব্যবহার দেখে। বিজইএমইএ-র হাস্যকর ও বুদ্ধ্বিবিবেচনাহীন বক্তব্য প্রথম আলোর প্রতিবেদন থেকে পাঠকদের কাছে আবারও তুলে ধরছি। তারা বলছে ‘পোশাক শিল্পে ৮০% নারী শ্রমিক কর্মরত, যেখানে কোনো পোশাক এককভাবে তৈরি করেন না।শার্ট নির্মাতা প্রতিষ্ঠানে একটি লাইনের মধ্যে একজন বডি সেলাই, একজন কলার, একজন কাফ, একজন পকেট তৈরিসহ একেকটি কাজ করেন। একটি লাইনের মধ্যে একজন দক্ষ শ্রমিক অনুপস্থিত থাকলে উৎপাদনের মাত্রা অনেক কমে যাবে ইত্যাদী, ইত্যাদী…। একজন শ্রমিকের মাতৃত্বকালীন ছুটি নেয়ার কারণে কোথায় কোন উৎপাদন ঠেকে গেছে তার কোন উদাহরণ খুঁজে পাওয়া যাবে বলে আমার জানা নাই।জানতে চাই, মাতৃকালীন ছুটি কি একসাথে ৮০% নারী শ্রমিক নিয়ে থাকেন? কয়জন নারী শ্রমিক মাতৃত্বকালীন ছুটি নেয়ার কারণে কত সংখ্যক শার্টের কাফ বা কলার লাগানো যায় নি? এই হিশাব বিজিএমইএ কি কখনো করেছে নাকি যা মনে আসলো তাই বলে বসছে!

এই শার্টের কলার-কাফের জন্য মাতৃত্বকালীন ছুটি বন্ধ!!


গার্মেন্ট শ্রমিকরা আছে বলেই আজ এই শিল্প টিকে আছে।হাজার কোটি ডলারের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন হচ্ছে। এখন দেখছি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের পাশাপাশি তাদের ওপর বাড়তি দায়িত্ব দেয়া হচ্ছে জন সংখ্যা নিয়ন্ত্রণের!তাই তাদের মার্তৃকালীন ছুটির অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে!

মাতৃত্বকালীন ছুটি পাওয়া কোন মালিকের ইচ্ছা-অনিচ্ছা বা তার বিশেষ অনুগ্রহের বিষয় নয়, এটা প্রতিটি কর্মজীবী নারী্র অধিকার। এই অধিকার লংঘন করার দায়ে ব্যবস্থা নেয়ার প্রয়োজন আছে। আমি নারী সংগঠন এবং শ্রমিক সংগঠনদের ধন্যবাদ জানাই যে তাঁরা সাথে সাথে এর প্রতিবাদ জানিয়েছেন। আমিও তাঁদের সাথে এক্ মত হয়ে দাবী জানাচ্ছি এই বক্তব্য অবিলম্বে প্রত্যাহার করতে হবে। এবং স র কারের প্রতি আহবান জানাই সকল নারী শ্রমিকের ছয় সপ্তাহ মাতৃত্বকালীন ছুটি পাওয়ার অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *